বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের কি কি সংস্কার দরকার?
সংস্কার হলো পরিবর্তনের একটি মডেল বা প্রক্রিয়া যা প্রতিষ্ঠানের কাঠামোর পরিবর্তন ও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়। আর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দল মূল প্রতিষ্ঠান যা জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। সুতরাং রাজনৈতিক দলের সংস্কার অর্থবহ করা দরকার। গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে রাজনৈতিক দলের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেকোনো দেশের উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য হলেও বাংলাদেশে তার কোনো বিকাশ ঘটেনি। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার একান্ত আবশ্যক।
![]() |
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের কি কি সংস্কার দরকার? বিস্তারিত আলোচনা- |
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের সংস্কার
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। দলের সংস্কারের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. গণতান্ত্রিক সংস্কার
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধন করতে হবে। বিগত দশকগুলোতে এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতর দলীয় সভাপতির ক্ষমতা, গণতান্ত্রিক আচরণ পরিলক্ষিত হয় নি। দলীয় প্রধানের ব্যাপক ক্ষমতা আবদ্ধ থাকে। দলের ভিতর কোনো বোর্ড নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয় নি। যোগ্যতার কোনো বিচার-বিবেচনা না করে বিভিন্ন দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠিত হয়। তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের ইচ্ছা দলীয় সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয় না। যার কারণে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকশিত হয় নি। তাছাড়া বাংলাদেশের আইন কাঠামোগুলোতে নেতাদের জবাবদিহিতা স্বচ্ছতা বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে যার কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পুনঃসংস্কার প্রয়োজন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন।
২. জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি প্রণয়ন
যেকোনো দেশের উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি অপরিহার্য। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেমস ও টুল তার "Leading Change" গ্রন্থে পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় জনগণের সম্পৃক্ততাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টিতে রাজনৈতিক দল ভূমিকা পালন করে, আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সরকারি দলের নেতৃবৃন্দকে জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করতে দেশ ও জনগণের কল্যাণে।
৩. দলীয় নেতৃত্বের পরিবর্তন
রাজনৈতিক দলের প্রাণস্বরূপ হচ্ছে দলীয় নেতৃত্ব। বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মহান ব্যক্তিদের নেতৃত্ব একুশ শতককে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলের বিকাশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ভালো নেতৃত্বের বিকল্প নেই। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে অনেক বড় অর্জন হলেও রাজনৈতিক দলের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিদের মানসিকতা ও সংকুচিত নেতৃত্ব সাধারণ জনগণের চাহিদা পূরণ করতে পারে নি। যার কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে তার কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন করতে পারে নি। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃত্বের পরিবর্তন আনতে হবে।
৪. নেতিবাচক রাজনৈতিক চর্চা পরিহার
বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে নেতিবাচক রাজনৈতিক চর্চা ব্যাপকভাবে দেশের সুনাম বিনষ্ট করেছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চায় হরতাল দীর্ঘদিন যাবৎ সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশে হরতালের সাথে যোগ হয়েছে অবরোধ নামক এক ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি। হরতাল, অবরোধ বিগত বছরগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বাণিজ্য, শিক্ষা সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক ধ্বংস সাধন করেছে। এ ধরনের কর্মসূচি গণতন্ত্র বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে। সুতরাং সুষ্ঠু গণতন্ত্রের বিকাশ এবং জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধানে আইনের মাধ্যমে হরতাল-অবরোধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সাথে সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক ধারার প্রবর্তন ঘটাতে হবে।
৫. সহনশীলতা আনয়ন
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদগণ গঠনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসতে চাইলেও বিরোধী দলের বৈরী আচরণের ফলে তা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে বিরোধী দল শুধুমাত্র বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজেরও সমালোচনা করে থাকে। তাই বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহনশীলতার দারুণ অভাব পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে বাংলাদেশের সমগ্র রাজনীতি হুমকির মুখে পড়েছে। জনগণের প্রাপ্তি ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সহনশীল মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে।।
৬. দারিদ্র্য বিমোচন
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই গরিব। এ সকল গরিব মানুষ রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন নয়। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল এ দারিদ্র্যকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল গঠন করে তাদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত। অধিকাংশ জনগণই অশিক্ষিত বিধায় এ সুযোগে স্বার্থান্বেষী মহল নতুন দল গঠন করে সহজেই তাদের পক্ষে জনসমর্থন আদায় করে নেয়। সুতরাং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের জন্য দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
সবশেষে
পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বৈচিত্র্যময়। স্বাধীনতা লাভের পর এখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে তা আবার মুখ থুবড়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখনো পুরোপুরি গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসতে পারে নি। সহনশীলতা, নেতৃত্ব এবং যোগ্যতা এখানে ব্যাপকভাবে বিকশিত হতে পারে নি। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের জন্য বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।