রাজনৈতিক দল কি? বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ও বিকাশ আলোচনা
অথবা,
বাংলাদেশের দলব্যবস্থার ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ আলোচনা কর
রাজনৈতিক দল ছাড়া আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা কল্পনা করাই কঠিন। বস্তুত আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে দলীয় কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভরশীল। সকল প্রকার রাষ্ট্রব্যবস্থাতেই তা গণতন্ত্র, সর্বাত্মকবাদী, সমাজতন্ত্র, উপনিবেশ উত্তর বা সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত নবীন রাষ্ট্রই হোক না কেন সকল ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো দলব্যবস্থা অবশ্যম্ভাবীরূপে বিদ্যমান থাকে। রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।
![]() |
রাজনৈতিক দল কি? বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ও বিকাশ আলোচনা |
রাজনৈতিক দল কি?
রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত যে দল, সংঘ বা গোষ্ঠী তাই রাজনৈতিক দল। সাধারণ ভাষায় রাজনৈতিক দল বলতে এমন একদল নাগরিক সমষ্টিকে বুঝায় যারা কতকগুলো নির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে বৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ পরিচালনা করা রাজনৈতিক দলের অন্যতম উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ
নিম্নে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা করা হলো।
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যহিত পরেই ১৯৭২ সালের সংবিধানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এসব দল হলো মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি।
২. স্বাধীনতা লাভের পর আওয়ামী লীগ সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একাংশ মুজিববাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলেন। অপরদিকে ডাকসুর তৎকালীন সহ সভাপতি আ স ম আব্দুর রব এবং ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের অপর অংশ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে 'বিপ্লবী সরকার' গঠনের দাবি করে। জাতীয় শ্রমিক লীগের একাংশ ও বিপ্লবী সরকার গঠন ও বৈপ্লবিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ দাবি প্রত্যাখ্যান করলে আ স ম আব্দুর রব ও শাজাহান সিরাজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। অবশেষে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ এবং সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হয়। মেজর (অব.) এমএ জলিল সভাপতি, আ স ম আব্দুর রব সাধারণ সম্পাদক এবং শাজাহান সিরাজ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মূলত ছাত্রলীগের বামপন্থি নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গড়ে ওঠে।
৩. ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেবল ৭টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এ দলগুলো ছিল (ক) আওয়ামী লীগ (খ) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, (গ) ন্যাপ (ভাসানী), (ঘ) ন্যাপ (মোজাফফর), (ঙ) বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং), (চ) জাতীয় লীগ এবং (ছ) কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চরম আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তখন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একটিমাত্র জাতীয় দল গঠন করা হয় এবং অপর সব দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে একদল বিপথগামী সামরিক অফিসারের হাতে নিহত হলে তার সরকারের পতন ঘটে। তখন দেশে সামরিক আইন জারি করে বাকশাল বাতিল করা হয় এবং এক বছরের বেশি সময় দলীয় তৎপরতা নিষিদ্ধ থাকে। জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য বৈধকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেন। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তিনি রাজনৈতিক দল বিধি ১৯৭৬ (political praties Regulation, 1976) জারি করেন। এ দলবিধিতে বলা হয়, কোনো রাজনৈতিক দল গঠন বা পরিচালনা করতে হলে এর গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচি সরকারের নিকট পেশ করতে হবে এবং কেবল সরকার অনুমতি দিলে তা কাজ করতে পারবে। এই দলবিধির অধীনে প্রায় ৬০টি ছোট-বড় সংগঠন দল হিসেবে অনুমোদন পেতে সরকারের কাছে আবেদন জানায়।
১৯৭৬ সালের ৪ মে এক সামরিক আদেশ বলে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক দল গঠনের উপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দলগুলো দলবিধির অধীনে পুরাতন বা নতুন নামে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭৬ সালের শেষ নাগাদ ২১টি রাজনৈতিক দল সরকারি অনুমোদন লাভ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমাগত চাপের মুখে জিয়াউর রহমানের সরকার ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে রাজনৈতিক দলবিধি বাতিল ঘোষণা করেন। যার ফলে রাজনৈতিক দল গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সব বাধা অপসারিত হয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে অসংখ্য রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১০০টির বেশি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব রয়েছে।
সবশেষে
পরিশেষে বলা যায় যে, স্বাধীনতা লাভের পর এদেশের প্রধান প্রধান, রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল এবং ওয়ার্কার্স পার্টি। এ সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গ্রাম পর্যায়ে সংগঠন বিস্তৃত রয়েছে।