আধুনিকীকরণ কি? একটি আধুনিক সমাজব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর
অথবা
আধুনিকীকরণ কি? একটি আধুনিক সমাজব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। উন্নয়নশীল সমাজে আধুনিকীকরণের প্রভাব কি?
পরিবর্তন বা গতিশীলতাই হচ্ছে সভ্যতার বাহক। প্রতিটি সমাজের লক্ষ্য হচ্ছে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো তথা গোটা সমাজব্যবস্থার উন্নয়ন। আর এই উন্নয়নকে সামনে রেখেই সমাজ এগিয়ে চলছে প্রগতির দিকে, আধুনিকতার দিকে। পরিবর্তনের এই ধারার প্রতি লক্ষ রেখেই যুগ যুগ ধরে রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানিগণ তাদের উত্তরসূরিদের পাথেয় হিসেবে জ্ঞানগর্ভ অবদান রেখে গেছেন। প্রকৃতপক্ষে তাদের বিরল অবদান থেকেই আমরা আধুনিক সমাজ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি।
![]() |
আধুনিকীকরণ কি? একটি আধুনিক সমাজব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। উন্নয়নশীল সমাজে আধুনিকীকরণের প্রভাব কি? |
আধুনিকীকরণ কাকে বলে
আধুনিকীকরণ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যা দ্বারা একটি আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রাপ্ত সমুদয় সম্পদের যুক্তিযুক্ত সদ্ব্যবহার করা হয়। এককথায় আধুনিক হওয়ার প্রক্রিয়াকেই আধুনিকীকরণ বলে। আর আধুনিক হওয়ার অর্থ হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত হওয়া।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
বিভিন্ন লেখক ও চিন্তাবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিকীকরণের সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন। নিম্নে তাদের দেওয়া কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হলো:
১. E. C. Black বলেন, "আধুনিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যার ফলে ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দ্রুত পরিবর্তনশীল কার্যকলাপ সম্পাদনে উপযোগী হয়ে উঠে এবং যা মানুষের জ্ঞানের সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।"
২. Benjamin Schwartz-এর মতে, "বিভিন্ন মানবিক উদ্দেশ্যে মানুষের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশকে যুক্তিসংগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মানুষের কর্মশক্তিকে সুবিন্যস্ত, সুগঠিত ও উদ্দেশ্যপূর্ণ উপায়ে প্রয়োগ করার নামই হলো আধুনিকীকরণ।"
৩. Robert Word বলেন, "আধুনিকীকরণ হলো মানুষের জীবনযাত্রার উপর প্রযুক্তিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের প্রভাব।"
৪. Rustow বলেন, "আধুনিকীকরণ হচ্ছে বিদ্যা, বুদ্ধি ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক অভিনব পদক্ষেপ, যা সামাজিক ক্ষেত্রে এক বিপ্লবস্বরূপ।"
৫. অধ্যাপক এম. ডব্লিউ, পাই-এর মতে, "আধুনিকীকরণ হলো ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তনের সেই প্রক্রিয়া যাতে প্রাচীনপন্থি গ্রাম বা কুলভিত্তিক সমাজসমূহ আধুনিক শিল্পায়িত এবং শহরকেন্দ্রিক জগতের চাপ ও আবেদনে সাড়া দিতে বাধ্য হয়।"
আধুনিক সমাজ
কোনো সমাজে নব নব আবিষ্কার, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলগত বিদ্যার প্রয়োগ, যুক্তিবাদী বিবেক প্রভৃতি যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশের ফলে যে সামাজিক পরিবর্তন সূচিত হয় এবং গতানুগতিক মূল্যবোধ, রীতিনীতি ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যে আমূল পরিবর্তন সংগঠিত হয়ে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা, কৃষ্টি ও সভ্যতার স্পর্শে সমাজব্যবস্থায় যে নব দিগন্তের সূচনা হয় তাকেই আধুনিক সমাজ বলে।
আধুনিক সমাজব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
সকল সমাজই আধুনিক নয়। আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার সংস্পর্শে আসলেও কোনো সমাজকে পুরোপুরি আধুনিক বলা যায় না। আধুনিক সমাজের কতগুলো সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো কোনো সমাজব্যবস্থায় পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান থাকলে সেই সমাজকে নির্দ্বিধায় আধুনিক সমাজ বলে অভিহিত করা যাবে। নিম্নে আধুনিক সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. নগরায়ণ
আধুনিকীকরণের প্রধান উপাদানগুলোর মধ্যে নগরায়ণ অন্যতম। আধুনিক বিশ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, সেখানে রাষ্ট্রগুলোর দ্রুত আধুনিকীকরণের স্থলে রয়েছে নগরায়ণ। শহরাঞ্চলের প্রসার ঘটলে সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং শিল্পের বিকাশ ঘটে। ফলে গ্রামের লোক শহরের দিকে ধাবিত হয় এবং জনগণ রাজনৈতিক তথা তাদের জীবনযাপন প্রণালি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে; সেই সাথে সভ্যতার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পায়।
২. শিল্পায়ন
আধুনিকীকরণের মূল শক্তি নিহিত আছে শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে। জাপান এর উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলেই জাপান আজ উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পেরেছে। শিল্পায়নের ফলে মানুষ সনাতন জীবনযাপন প্রণালির পরিবর্তে উন্নত উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ পায়। জনগণ তাদের গ্রাম্য সনাতন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি পরিত্যাগ করে শিল্পমুখী অর্থনীতির দিকে ধাবিত হয়। শিল্পের অগ্রগতির ফলে জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
৩. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি
আধুনিকীকরণের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা কত উন্নত। কারণ আধুনিকীকরণের সুফল ভোগ করতে হলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও রাস্তাঘাট উন্নত করতে হবে।
৪. রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণ বেশিমাত্রায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায় সে রাজনৈতিক ব্যবস্থা তত বেশি উন্নত। আধুনিককালে জনগণ রাজনৈতিক দল, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে থাকে। সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলে একদিকে যেমন তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে তেমনি রাজনৈতিক কৃষ্টির প্রসার ঘটে। তাই আধুনিকীকরণের পথকে প্রসারিত করতে রাজনীতিতে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
৫. সামাজিক গতিশীলতা
কোনো সমাজ যখন আধুনিকীকরণের পথে ধাবিত হয় তখন সে সমাজে সামাজিক গতিশীলতা লক্ষ করা যায়। মানুষ উন্নত জীবনযাপনের জন্য চাকরি নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে আসে আবার এক শহর থেকে আরেক শহরে যায়।
৬. ধর্মনিরপেক্ষতা
আধুনিক সমাজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। প্রত্যেক রাষ্ট্রে ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে রাখা উচিত। যদি কোনো রাষ্ট্রের শাসনকার্য ধর্মের প্রভাবে পরিচালিত হয় তবে স্বাভাবিক কারণে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মনে অসন্তোষ দেখা দেয়, যা দেশের জাতীয় সংহতির প্রতি হুমকিস্বরূপ। সুতরাং আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়।
৭. গতিশীলতা
আধুনিক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গতিশীলতা। এখানে যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে অজানা রহস্যের বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে।
৮. কর্মের উপর মর্যাদা
আধুনিক সমাজে ব্যক্তি তার কর্মের উপর মর্যাদা অর্জন করে। বংশগত বা কৌলীন্য এখানে বিবেচ্য নয়।
৯. পরিবর্তনধর্মী
আধুনিক সমাজ হচ্ছে পরিবর্তনধর্মী। প্রযুক্তিভিত্তিক সংস্কার ও সৃজনশীলতা আধুনিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। আধুনিক সমাজে যান্ত্রিক সভ্যতা ও প্রযুক্তিবাদী ধ্যানধারণার প্রভাব যুক্তিবাদী বুনিয়াদ রচনা করেছে।
১০. একক পরিবারের অস্তিত্ব
আধুনিক শিল্পায়িত ও নগরায়িত সমাজে যৌথ পরিবার ভেঙে একক ও সহজ পরিবারে পরিণত হয়েছে। গোত্রীয় বন্ধন অনেকটা শিথিল হয়েছে।
১১. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতি আধুনিক সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই যে সমাজ যত বেশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পারদর্শিতা, দক্ষতা ও সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে সে সমাজ তত বেশি আধুনিকতার পথে ধাবিত হবে।
১২. কৃষিক্ষেত্রে আধুনিকতা
আধুনিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো উন্নত কৃষিব্যবস্থা। কৃষির উন্নতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানেই আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাওয়া।
উন্নয়নশীল সমাজে আধুনিকীকরণের প্রভাব
১৯৩৯ সালের পর থেকে আধুনিকীকরণের উদ্ভব হলেও এর বিকাশ বা প্রয়োগ শুরু হয় মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। নিম্নে উন্নয়নশীল সমাজে আধুনিকীকরণের প্রভাব আলোচনা করা হলো:
১. মূল্যবোধ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে পরিবর্তন
উন্নয়নশীল সমাজে আধুনিকীকরণের প্রভাবে সনাতন সমাজের মূল্যবোধ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার ধ্বংস সাধিত হয়ে নতুন নতুন চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়েছে।
২. রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন
আধুনিকীকরণের প্রভাব উন্নয়নশীল সনাতন সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেছে।
৩. সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন
উন্নয়নশীল সমাজে আধুনিকীকরণের প্রভাবে সংস্কৃতিতে নতুন নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টি হয় এবং সমাজে প্রতিনিয়ত পাশ্চাত্য আধুনিক সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে গল্প, নাটক, কবিতা, সংগীত, নৃত্য, ইত্যাদি পরিবেশিত হয়ে থাকে।
৪. কৃষিক্ষেত্রে পরিবর্তন
উন্নয়নশীল সমাজে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি আধুনিকীকরণের প্রভাবে এ অঞ্চলে শিল্প ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে।
৫. নতুন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি
আধুনিকীকরণের প্রভাবে উন্নত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছে এবং নতুন নতুন সংঘ ও সমিতির উদ্ভব ঘটেছে।
আধুনিকীকরণের প্রভাব উন্নয়নশীল সমাজে অনেকটা একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করে আছে। এলিট শ্রেণী সমাজে আধুনিকীকরণের বাহকরূপে আধুনিকীকরণকেই মডেলরূপে বেছে নিয়েছে। উন্নয়নশীল সমাজে জনগণ নতুন নতুন ভাবনার সাথে নিজেদেরকে খাপখাইয়ে নিতে শিখেছে। কিন্তু আধুনিকীকরণের প্রভাব উন্নয়নশীল সমাজের অনুন্নতির কারণরূপে ধনতান্ত্রিক আধুনকীকরণ প্রক্রিয়াকে অভিযুক্ত করেছে। উন্নয়নশীল সমাজে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে নতুন তত্ত্ব বা প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
সবশেষেঃ
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, আধুনিকীকরণ একটি অতি জটিল প্রক্রিয়া। একটি আধুনিক সমাজ উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ হলেই চলবে না উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ স্থায়ী ও গতিশীল হতে হবে। উন্নত বিশ্বে যেখানে আধুনিকীকরণ ঘটেছে সেখানকার সামাজিক কাঠামো অধিকতর সুসংহত এবং সুগঠিত। তাই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সমাজ আধুনিকরূপে আত্মপ্রকাশ করবে।