সনাতন সমাজ ও আধুনিক সমাজের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ কর। একটি সনাতন সমাজে কিভাবে পরিবর্তন সাধিত হয়?
সবকিছুই নিয়ত পরিবর্তনশীল। জন্ম, বিকাশ ও পরিপূর্ণতা স্বাভাবিক নিয়মের অধীন এবং চিরন্তন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, সমাজও পরিবর্তনশীল এবং পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সমাজ অগ্রগতি লাভ করেছে। বস্তুত সকল সমাজের ইতিহাস হচ্ছে পরিবর্তনের ইতিহাস। মূলত সনাতন সমাজের সকল বাধাবিঘ্ন ক্রমান্বয়ে উপেক্ষা করে পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ আজকের আধুনিক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে।
![]() |
সনাতন সমাজ ও আধুনিক সমাজের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ কর। একটি সনাতন সমাজে কিভাবে পরিবর্তন সাধিত হয়? |
সনাতন সমাজ
সনাতন সমাজ বলতে আমরা সে সমাজকে বুঝি যেখানে আধুনিকতার কোনো প্রভাব পড়ে নি এবং স্থবিরতা বিরাজ করছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনুন্নত, রাজনৈতিক স্থিতিহীনতা এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক - মূল্যবোধের দিক থেকে সর্বজনীন সংস্কৃতির পরিবর্তে সংকীর্ণ সংস্কৃতিকেই সনাতন সমাজ বলে।
আধুনিক সমাজ
যে সমাজ নিজস্ব প্রচেষ্টায় জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি ও শক্তির উৎকর্ষ বিধানের মাধ্যমে নিজস্ব সম্পদের সদ্ব্যবহার দ্বারা সার্বিক উন্নতি সাধন, কৃষিজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার পরিবর্তে যান্ত্রিক উৎপাদন প্রচলন এবং গতানুগতিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধন করে শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রসারতা লাভ করেছে তাই আধুনিক সমাজ। মূলত আধুনিক সমাজ আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির সাথে সংহতি বজায় রেখে নিজেকে পরিবর্তন ও প্রগতির উপযোগিতা করে তুলেছে।
সনাতন সমাজ ও আধুনিক সমাজের পার্থক্য
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীগণ সনাতন ও আধুনিক সমাজের মধ্যে যে সকল পার্থক্য দেখিয়েছেন নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হলো:
১. প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশগত পার্থক্য
সনাতন সমাজে সীমিত প্রযুক্তিবিদ্যা বিকাশ লাভ করে। কোনো কোনো দিক দিয়ে এসব সমাজে উচ্চ মাত্রার নৈপুণ্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু সেখানে নিয়মিতভাবে নব নব আবিষ্কার এবং উন্নয়ন সম্ভব হয় নি। অন্যদিকে আধুনিক সমাজে ব্যাপক ভিত্তিতে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে এবং সেখানে উন্নয়নের জোয়ার প্রবাহিত হচ্ছে। সেই সাথে নব নব আবিষ্কারও সাধিত হচ্ছে।
২. কৃষিনির্ভর সমাজ কাঠামো
সনাতন সমাজের লোকেরা কৃষির উপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল, তাদের কৃষি পদ্ধতি ছিল মান্ধাতার আমলের, কিন্তু আধুনিক সমাজব্যবস্থা কৃষিনির্ভর হলেও সেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কৃষিব্যবস্থায় অনেক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে।
৩. বুদ্ধিজীবী শ্রেণী
সনাতন সমাজ নূতন ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারে না, কেননা সে সমাজে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী অনুপস্থিত। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে করণীয় ভূমিকা সম্বন্ধীয় প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশ ঘটে নি। কিন্তু আধুনিক সমাজে পর্যাপ্ত পরিমাণে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উপস্থিতি লক্ষণীয় এবং এ সমাজে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর - ভূমিকা ব্যাপক এবং গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, আধুনিক সমাজ এক অর্থে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
৪. আরোপিত ও অর্জিত মর্যাদাবোধ
সনাতন সমাজ কাঠামোতে বংশানুক্রমিকভাবে মর্যাদা নিরূপিত হয়ে থাকে। এখানে যোগ্যতার কোনো মাপকাঠি নেই। কিন্তু আধুনিক সমাজে মর্যাদা অর্জিত হয় যোগ্যতার মাপকাঠিতে। কারণ আধুনিক সমাজে শিক্ষিতের হার বেশি। সেই অর্জিত মর্যাদাবোধ বেশ জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে।
৫. পারস্পরিক সম্পর্ক
সনাতন সমাজে পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক সম্পর্কের বন্ধন খুবই সুদৃঢ়। কারণ এই সমাজে মানুষ নিঃস্বার্থভাবে একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে, সুখ-দুঃখ সব সমানভাবে ভাগ করে নেয়। কিন্তু আধুনিক সমাজে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি একেবারেই দুর্বল। এখানে কেউ কারো খবর রাখে না। আন্তরিকতার বড় অভাব পরিলক্ষিত হয়।
৬. শ্রেণী ব্যবস্থা
সনাতন সমাজ শ্রেণীভিত্তিক এবং এই শ্রেণীব্যবস্থা খুবই জটিল প্রকৃতির। অপরদিকে আধুনিক সমাজব্যবস্থা শ্রেণীভিত্তিক হলেও তেমন জটিল প্রকৃতির নয়।
৭. দৃষ্টিভঙ্গি
সনাতন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি হলো Collective তথা সমষ্টিগত। পক্ষান্তরে আধুনিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি হলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক। Max Weber সনাতন ও আধুনিক সমাজের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে বলেন, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ঐতিহ্য ও প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের উপর সনাতন সমাজ নির্ভরশীল, আর আধুনিক সমাজ পরিচালিত হয় যুক্তি ও আইনভিত্তিক কর্তৃত্বের কাঠামো দ্বারা।
সনাতন সমাজের পরিবর্তন প্রক্রিয়া
সনাতন সমাজের দুর্বল বৈশিষ্ট্যসমূহ উন্নত সমাজের সংস্পর্শে এসে আরো দুর্বল হয়ে উঠে এবং তাতে ভাঙন ধরে। মূলত উন্নত সমাজের প্রভাবে সনাতন সমাজে ভাঙন ধরছে এবং আধুনিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। সনাতন সমাজের পরিবর্তনের পিছনে দুটি বিষয় অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। যথা- ১. যুদ্ধবিগ্রহ ও বিজয় এবং ২. উপনিবেশ স্থাপন।
বস্তুত, নিম্নোক্তভাবে সনাতন সমাজে পরিবর্তন সাধিত হয়।
- ঔপনিবেশিক শক্তির প্রত্যক্ষ অনুপ্রবেশ,
- অর্থনৈতিক দৃষ্টান্ত এবং
- দক্ষতা ও ভাবধারার অনুপ্রবেশ।
১. উপনিবেশিক শক্তির প্রত্যক্ষ অনুপ্রবেশ
উন্নত সমাজের অনুপ্রবেশ সাধারণত ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঘটে এবং সনাতন সমাজকে দুভাবে প্রভাবিত করে।
- প্রথমত: নিজস্ব স্বার্থের প্রয়োজনে ঔপনিবেশিক শক্তি এমন কতগুলো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বাস্তবায়ন করে, যার ফলে সনাতন সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে। বন্দর, রাস্তাঘাট ও রেলপথের উন্নতি সাধন করা হয়। এ সমস্ত কার্যক্রম শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা সৃষ্টির জন্যই গ্রহণ করা হয় এবং পরবর্তীকালে এ সমস্ত কার্যক্রম গ্রহণের ফলে জাতীয় বাজারের সৃষ্টি হয়। কৃষিজাত পণ্যের জন্য ব্যবসাভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায়। গড়ে উঠে বিভিন্ন শহর। পাশ্চাত্যমুখী এলাকাগুলো আধুনিক জীবনের বিভিন্ন উপকরণের সঙ্গে পরিচিতি লাভকরে। কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও করব্যবস্থার ভিত্তিতে আধুনিক সরকারের কাঠামো গড়ে উঠে। মূলত এসব কিছুর ফলশ্রুতিতে সনাতন সমাজজীবনের প্রতিটি স্তরে কিছু পরিমাণে হলেও আধুনিকতার আওতায় চলে আসে।
- দ্বিতীয়ত: ঔপনিবেশিকতাবাদের বিশ্বজাগতিক তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব নেই। এটি কেবল গতানুগতিক সমাজের গতির সঞ্চার করে, সনাতন সমাজের অচলাবস্থা দূর করে। ঔপনিবেশিক শক্তির প্রত্যক্ষ প্রভাবের চেয়ে পরোক্ষ প্রভাব অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এতে করে সনাতন সমাজের জনগণ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠে এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার দাবি তুলে। ঔপনিবেশিক শক্তির প্রত্যক্ষ অনুপ্রবেশই কেবল সনাতন সমাজকে আধুনিকীকরণের গতি সঞ্চার করে না। এক্ষেত্রে সনাতন সমাজ উন্নত সমাজের নিকট যুদ্ধে পরাজিত হলেও আধুনিকীকরণের ঢেউ এতে সঞ্চারিত হয়।
২. অর্থনৈতিক দৃষ্টান্ত
সনাতন সমাজ উন্নত সমাজব্যবস্থার সংস্পর্শে এসে উন্নত হতে থাকে। এতে তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় জনস্বাস্থ্যের উন্নতি, খাদ্য সরবরাহ ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং শ্রমজীবী ও কৃষকদের জন্য স্বল্প মূল্যে পণ্য সরবরাহ প্রভৃতির প্রতি তাদের আগ্রহ জন্মায়। কেননা মানুষ সবসময় ভালো জিনিসই কামনা করে। গতানুগতিক সমাজব্যবস্থায় তারা বঞ্চিত ছিল এ বোধ তাদের মধ্যে অনুভূত হয়। ফলে তারা আধুনিকীকরণের দিকে ধাবিত হয়।
৩. দক্ষতা ও ভাবধারার অনুপ্রবেশ
ঔপনিবেশিক শাসনের ফলশ্রুতিতে যে আধুনিক প্রক্রিয়া শুরু হয় তার জন্য নতুন দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে উঠে। সনাতন সমাজব্যবস্থায় এর অভাবজনিত কারণে বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ শ্রমিকের অনুপ্রবেশ সনাতন সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তনের গতিকে ত্বরান্বিত করে।
৪. অন্যান্য কারণ
(ক) নতুন বাণিজ্যিক শ্রেণীর উদ্ভব; (খ) কারিগরি শ্রেণীর উদ্ভব; (গ) ধর্মীয় প্রভাব; (ঘ) মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব; (ঙ) শহরায়ন ও নগরায়ণ।
বস্তুত, উন্নত সমাজের সংস্পর্শে আসার ফলেই সনাতন সমাজের কাঠামো ও মূল্যবোধ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। মৌলিক অনুপ্রবেশ, অর্থনৈতিক দৃষ্টান্ত ও দক্ষতার ভাবধারা সঞ্চালন প্রভৃতি উপায় সনাতন সমাজকে যেভাবে স্পর্শ করে, তা সনাতন সমাজগুলোতে পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটায়।
পরিশেষেঃ
পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক সমাজের সংস্পর্শে আসার ফলেই গতানুগতিক সমাজের কাঠামো ও মূল্যবোধ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বর্তমান বিশ্বের সকল সনাতন সমাজে পরিবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশ্বের কোনো সমাজই বর্তমানে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সকল সমাজে পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সূচনা করেছে। উপরিউক্ত উপায়ে সনাতন সমাজগুলোর কাঠামো ও মূল্যবোধে যেভাবে ভাঙনের সৃষ্টি হয়, তাতে করে পরিবর্তনের মাধ্যমে সনাতন সমাজ আধুনিকতার দিকে ধাবিত হয়।