সামাজিক পরিবর্তন বলতে কি বুঝ? সামাজিক পরিবর্তনে বাহনসমূহের ভূমিকা আলোচনা
সামাজিক পরিবর্তন ও সমাজজীবন সদা পরিবর্তনশীল। গতিশীলতার আবর্তে সমাজে যে নানা ধরনের পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে তা একদিনের নয়; বরং এই পরিবর্তন মহাকালের দীর্ঘ পথ পরিক্রমণের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। পরিবর্তনের এ ধারা শুধু সামাজিক ক্ষেত্রেই নয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। এই সামাজিক পরিবর্তনে বিভিন্ন বাহনসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
![]() |
সামাজিক পরিবর্তন বলতে কি বুঝ? সামাজিক পরিবর্তনে বাহনসমূহের ভূমিকা আলোচনা কর। |
সামাজিক পরিবর্তন
সাধারণ অর্থে সামাজিক পরিবর্তন বলতে সমাজবদ্ধ মানুষের আচার-আচরণগত প্রক্রিয়ার পরিবর্তনকে বুঝায়। মূলত বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার রূপ ও প্রকৃতির বিশেষ পরিবর্তনই হলো সামাজিক পরিবর্তন।
সামাজিক পরিবর্তনের অর্থ হলো, সমাজের বসবাসকারী জনসমষ্টির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পরিবর্তন। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সামাজিক সংগঠনের কাঠামোগত পরিবর্তন সাধিত হয়।
সামাজিক পরিবর্তনে বাহনসমূহের ভূমিকা
সামাজিক পরিবর্তনে এলিট, রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী, বুদ্ধিজীবী এবং গণমাধ্যমসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নিম্নে সামাজিক পরিবর্তনের বাহনসমূহ ও তাদের ভূমিকা আলোচনা করা হলো:
(ক) সামাজিক পরিবর্তনে এলিটদের ভূমিকা
সাধারণ অর্থে এলিট হলো সমাজের উৎকৃষ্ট শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ, যারা সমাজে একটি বিশেষ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত এবং প্রভাব ও প্রতিপত্তি নিয়ে বসবাস করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত সামাজিক পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটেছে। এ রূপান্তরের ফলে পুরনো ধ্যানধারণা, অভ্যাস ও মূল্যবোধের পরিবর্তন হচ্ছে। পুরনো নেতৃত্বের স্থলে আসছে নতুন নেতৃত্ব। এই পরিবর্তনের উদ্যোগ, উদ্দীপক ও পরিচালক হচ্ছে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী যাদেরকে আমরা এলিট বলে অভিহিত করে থাকি। রাজনৈতিক ব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থান করে রাজনৈতিক এলিটেরা যারা সনাতন সমাজ কাঠামোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রূপান্তর ও পরিবর্তনকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।
(খ) সামাজিক পরিবর্তনে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সামাজিক পরিবর্তনে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা বিকাশের সাথে সাথে রাষ্ট্রের কার্যাবলির পরিধি যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি আমলাতন্ত্রের উপর সরকারি নির্ভরশীলতাও তত বিস্তৃত হয়েছে। সামাজিক পরিবর্তনে আমলাতন্ত্র নিম্নোক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে:
১. সরকারি নীতি নির্ধারণ ও নীতি প্রণয়ন
নীতি নির্ধারণ ও আইন প্রণয়নে যে টেকনিক্যাল জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, তা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিত থাকায় আমলাগণ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
২. নীতির বাস্তবায়ন
আমলাগণ সরকারি নীতি ও. আইন যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, সেক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
৩. জাতি গঠনের ক্ষেত্রে ভূমিকা
জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় শিল্প, কৃষ্টি, যাতায়াত, যোগাযোগ, শিক্ষা প্রভৃতি প্রসারের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. সামাজিক পরিবর্তন কার্যকর করা
আমলাগণ রাজনীতি নিরপেক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার জোগান দেয়, যা সামাজিক পরিবর্তন কার্যকর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
গ. সামাজিক পরিবর্তনে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা
একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন হিসেবে সামরিক বাহিনী গতানুগতিক সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন সাধন করে, সামাজিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী নিম্নোক্ত ভূমিকা পালন করে থাকে:
- ১. সামরিক বাহিনী উন্নত নাগরিক চেতনা গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
- ২. সুশৃঙ্খল সংগঠন হিসেবে সামরিক বাহিনী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।
- ৩. প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও সামরিক বাহিনীর ভূমিকা উল্লেখ করার মতো।
- ৪. সামরিক বাহিনী দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম।
- ৫. সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকে।
- ৬. সামরিক বাহিনী দেশের মধ্যে একাত্মতার চেতনা সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ঘ. সামাজিক পরিবর্তনে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামাজিক পরিবর্তনে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. সমস্যা নির্বাচন ও নীতি নির্ধারণ:
সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলির প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আপন আপন দলীয় মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে সেই সব সমস্যার সমাধানকল্পে নীতি ও কর্মসূচি নির্ধারণ করে।২. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও পরিবেশ সৃষ্টি:
সকল নাগরিকের ধর্ম, শ্রেণী, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমানাধিকারের স্বীকৃতি, পরমতসহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক বিরোধিতার বৈধতা স্বীকার, ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ইত্যাদি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল সামাজিক পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও পরিবেশ সৃষ্টি করে।৩. সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা:
রাজনৈতিক দল অংশীদারিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নীতিগতভাবে পন্থা অবলম্বন করে থাকে। দেশের সকল অঞ্চল ও পর্যায় থেকে সদস্য নিয়োগ করে রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণের সংকট নিরসন করে।
৪. অর্থনৈতিক উন্নয়ন:
সামাজিক পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বড় উপাদান হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্ব-স্ব অর্থনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে এ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়।৫. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা:
আনয়নরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সামাজিক পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল মুখ্য ভূমিকা পালন করে।(ঙ) সামাজিক পরিবর্তনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা
বুদ্ধিজীবী বলতে সাধারণভাবে সমাজের সেই জনগোষ্ঠীকে বুঝায়, যারা তাদের উন্নত মনন, বুদ্ধি ও চেতনার মাধ্যমে সমাজের যুগোপযোগী চাহিদার সাথে শিক্ষা, প্রযুক্তি, দক্ষতা প্রভৃতির সম্মেলন ঘটিয়ে সমাজকে আরো বেশি গতিশীল ও উন্নত করে তোলে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল গতানুগতিক সমাজব্যবস্থা থেকে আধুনিক সমাজে রূপান্তরের পিছনে যারা চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছেন তারা হচ্ছেন মূলত বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবীরা সামাজিক পরিবর্তনের বাহন হিসেবে নিম্নোক্ত ভূমিকা পালন করে থাকে:
- ১. বুদ্ধিজীবীরা জনগণকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।
- ২. বুদ্ধিজীবীরা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দীক্ষা দান করে।
- ৩. জাতীয় সংহতি অর্জনের জন্য জাতীয় ঐক্যবোধ সুদৃঢ় করে।
- ৪. বৃদ্ধিজীবী শ্রেণী সমাজে প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক উন্নতির মধ্য দিয়ে সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়।
- ৫. সমাজে গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
(চ) সামাজিক পরিবর্তনে গণমাধ্যমসমূহের ভূমিকা
সামাজিক পরিবর্তনে গণমাধ্যমসমূহের ভূমিকাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক পরিবর্তনে গণমাধ্যমসমূহের ভূমিকাকে নিম্নোক্তভাবে আলোচনা করা হলো:
১. সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন
শিক্ষিত ও সভ্য সমাজের জন্য সংবাদপত্র একটি অন্যতম শক্তিশালী গণমাধ্যম। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে এই মাধ্যম বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম এবং সামাজিক জীবনের নানা ধরনের বিষয় সম্পর্কে জনগণের মতামত সংবাদপত্রের মাধ্যমে গড়ে উঠে। এভাবে জনমত গঠন ও সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
২. বেতার
জনমত গঠনের অপর একটি শক্তিশালী মাধ্যম হলো বেতার। বেতারের মাধ্যমে প্রচারিত গণশিক্ষামূলক, পরিবার পরিকল্পনা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠান সামাজিক পরিবর্তনে অবদান রাখে।
৩. টেলিভিশন
টেলিভিশন হচ্ছে আধুনিক সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। টেলিভিশনের মাধ্যমে পরিবেশিত নাটক, বক্তৃতা, সংবাদ ও বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠান সামাজিক পরিবর্তন আনয়নে সহায়তা করে।
৪. চলচ্চিত্র
চলচ্চিত্র টেলিভিশনের মতো আরেকটি শ্রবণ ও দর্শনেন্দ্রিয় ঘটিত গণমাধ্যম। প্রেক্ষাগৃহে এবং ভ্রাম্যমাণ চলচ্চিত্র ইউনিটে গল্প, নাটক বা জীবস্তিকার মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্কারমূলক অনুষ্ঠান, চলমান চিত্রের সাহায্যে বহুদর্শকের সামনে উপস্থাপন করা হয়। একটি সার্থক চলচ্চিত্র জনমনে গভীর রেখাপাত করে ও সামাজিক পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক পরিবর্তন আনয়নে এর বিভিন্ন বাহনসমূহের গুরুত্ব ও ভূমিকা অপরিসীম। বস্তুত সামাজিক পরিবর্তন একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে বহু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সত্য, কিন্তু এর বাহনসমূহ এ সমস্ত বাধা অপসারণ করে কাজ করতে পারে। তাই সামাজিক পরিবর্তনের বাহনসমূহের যথাযথ ভূমিকা পালনের উপর নির্ভর করবে সামাজিক পরিবর্তনের ফলপ্রসূতা।