আধুনিকীকরণ কি? আধুনিকীকরণের তত্ত্বসমূহ আলোচনা কর
শিল্প বিপ্লবের ন্যায় আধুনিকীকরণের বিপ্লবও অধুনা সমগ্র বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে এবং তা বেশ অগ্রগতিও লাভ করেছে। বিশেষ করে নব স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রসমূহে যেসব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনসমূহ পরিলক্ষিত হচ্ছে সেগুলোকে আধুনিকীকরণে বিপ্লবের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা চলে। বস্তুত সকল সমাজেই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী আর এই পরিবর্তন চলছে এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে, ফলে আধুনিকীকরণ পেয়েছে নতুন গতি।
![]() |
আধুনিকীকরণ কি? আধুনিকীকরণের তত্ত্বসমূহ আলোচনা কর |
আধুনিকীকরণ কি?
আধুনিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যা প্রাপ্ত সম্পদের যুক্তিভিত্তিক সদ্ব্যবহার ঘটায় এবং আধুনিক সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এককথায় আধুনিক হওয়ার প্রক্রিয়াকেই আধুনিকীকরণ বলে। আর আধুনিক হওয়ার অর্থ হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত হওয়া। বেঞ্জামিন সোয়ার্জের মতে, "বিভিন্ন মানবিক উদ্দেশ্যে মানুষের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশকে যুক্তিসংগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মানুষের কর্মশক্তিকে সুব্যবস্থিত, সুসংগঠিত ও উদ্দেশ্যপূর্ণ উপায়ে প্রয়োগ করার নামই হচ্ছে আধুনিকীকরণ।"
- C. E. Black লিখেছেন যে, "আধুনিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যার ফলে ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দ্রুত পরিবর্তনশীল কার্যকলাপ সম্পাদনের উপযোগী হয়ে উঠে এবং যা মানুষের জ্ঞানের সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।"
সহজকথায় আধুনিকীকরণ হলো একটি চিরন্তন ও জটিল প্রক্রিয়া, যা পরিবর্তনের অচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রাচীন সমাজকে খাটো করে দেখে।
আধুনিকীকরণের বিভিন্ন তত্ত্ব
আধুনিকীকরণ। মূলত কোনো আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হওয়ার পদ্ধতি বিশেষ। আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছার পদ্ধতি বা উপায়ের পথও অনেক। প্রকৃতপক্ষে এই উপায় ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।
Claud. E. Welch তাই লিখেছেন যে, "Methods differ, the time available differs: the priorities differ." ব্রিটেনে যেমনিভাবে আধুনিকীকরণ ঘটেছে, সোভিয়েত ইউনিয়নে কিংবা জাপানে তেমনিভাবে তা ঘটে নি। নিম্নে আধুনিকীকরণের বিভিন্ন তত্ত্বসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. ক্রমবিবর্তন
আধুনিকীকরণের তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে ক্রমবিবর্তন লক্ষণীয়। যেমন- ব্রিটেনে আধুনিকীকরণ ঘটেছিল একটি ক্রমবিবর্তনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সেখানে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও পরিবর্তন সহগামী হয় নি; অসংখ্য প্রথা বিবর্তনের মাধ্যমে বহু সময় ধরে গড়ে উঠেছে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেগুলো পরিবর্তিত হয়ে অবশেষে একটি চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে। বলা হয়ে থাকে যে, 'প্রথার পিঠা' (The Cake of Custom) যুগে যুগে পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেখানে আধুনিকীকরণ সূচিত হয়েছে।
২. বিপ্লব
আধুনিকীকরণের, অন্যতম তত্ত্ব বিপ্লব, উদাহরণস্বরূপ সোভিয়েত ইউনিয়নে আধুনিকীকরণ সাধিত হয়েছিল বিপ্লবের মাধ্যমে, সেখানে বুশ বিপ্লবের অব্যবহিত পর পরেই কমিউনিস্ট পার্টির কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অপেক্ষাকৃত একটি দুর্বল রাষ্ট্র থেকে একটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্বশক্তিতে পরিণত করেছে।
৩. আমলাতন্ত্র
আমলাতন্ত্র আধুনিকীকরণের তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমলাতন্ত্র আধুনিকীকরণের অন্যতম বাহন। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা যদি জাপানের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, সেখানে আধুনিকীকরণ সাধিত হয়েছে এক অভিজাততান্ত্রিক আমলাতন্ত্রের হিতকর উদ্যোগের মাধ্যমে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে আধুনিকীকরণের তত্ত্ব হিসেবে চারটি বিষয় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যথা- বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্ব ও ভূমিকা, পরিবর্তনের অসম প্রকৃতি, আদর্শবাদের গুরুত্ব এবং সরকারি উদ্যোগ ও নেতৃত্ব। নিম্নে তত্ত্বগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
- বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্ব ও ভূমিকা: উন্নয়নশীল দেশসমূহে আধুনিকীকরণের নেতৃত্বে থাকে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। সমগ্র জনগণের এক ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে গঠিত এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী উন্নয়নশীল বিশ্বের গতানুগতিক সমাজব্যবস্থা থেকে আধুনিক সমাজে রূপান্তরের পিছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ- ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা বলা যায়। এ আন্দোলনে এ অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীরা অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
- বুদ্ধিজীবীদের শ্রম: ব্রিটিশ স্বৈরাচারের হাত থেকে শৃঙ্খলমুক্তির জন্য সৃষ্ঠু রাজনৈতিক সক্রিয়তায় যাবতীয় কৃৎকৌশলই বুদ্ধিজীবীদে শ্রমের ফসল, তাদের শক্ত লেখনী, নেতৃত্ব আন্দোলনে জনসাধারণের অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর তাদের এ ভূমিকাই এ সমস্ত দেশে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণে ত্বরান্বিত করেছে এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে গতিশীলতা আনয়ন করেছে।
- অসম বা আংশিক প্রকৃতি: উন্নয়নশীল দেশসমূহে আধুনিকীকরণের অপর একটি তত্ত্ব হচ্ছে-এর অসম বা আংশিক প্রকৃতি। এসব দেশে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সামাজিক পরিবর্তনের আগেই সাধিত হতে পারে কিংবা এর বিপরীতটাও ঘটে যেতে পারে। অর্থাৎ আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি গতানুগতিক কৃষ্টিগত রীতিনীতি প্রবহমান থাকতে পারে; অর্থনৈতিক পরিবর্তন সামাজিক ও কৃষ্টিগত পরিবর্তনের চেয়ে দ্রুততর সাধিত হতে পারে। পাশ্চাত্যের উন্নত রাষ্ট্রসমূহে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ স্বাভাবিকভাবেই সাধিত হয়েছিল অর্থাৎ সমাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে রাজনৈতিক পরিবর্তনের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কিন্তু আধুনিককালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অসমতা, বিরতি, অনিশ্চয়তা ও বিচ্ছিন্নতা যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়।
- আদর্শবাদের গুরুত্ব: উন্নয়নশীল দেশসমূহে আধুনিকীকরণের গতি ত্বরান্বিত করার জন্য এবং পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় অগ্রাধিকার ও নির্দেশনা দানের জন্য কোনো একটি বিশেষ মতবাদ বা আদর্শকে কাজে লাগাতে হয়। রাষ্ট্রীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মূহূর্তে জনগণের মধ্যে একাত্মবোধ ও সংহতি আনয়নে আদর্শবাদ বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল হতে পারে আদর্শবাদ থেকে আরো যেসব ভাবধারার উদ্ভব ঘটে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে দ্রুত শিল্পায়নের আকাঙ্ক্ষা, গণতান্ত্রিক ধারণার প্রসার, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে আস্থা স্থাপন এবং জাতীয় ঐক্য সাধনে চিরস্থায়ী প্রতিশ্রুতি।
- সরকারি উদ্যোগ ও নেতৃত্ব: উন্নয়নশীল দেশসমূহে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সরকারি উদ্যোগ ও নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এখানে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক অধিকমাত্রায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই কেবল জনজীবনের বিভিন্ন দিক সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ ও রূপান্তর করা সম্ভব। কাজেই আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই।
- বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্ব ও ভূমিকা: তত্ত্বটি অধিক গ্রহণযোগ্য আজ থেকে এক শতাব্দী পূর্বেও সারা পৃথিবী ছিল কোনো না কোনো ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তখন দেশে রাজতন্ত্র ছিল বিধায় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল গৌণ। কিন্তু বর্তমানে এদের ভূমিকা অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে বুদ্ধিজীবীরা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি প্রতিটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা সাধারণত পাশ্চাত্য শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত এবং এদের জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি দেশের অপরাপর জনগণের চেয়ে উন্নত ও প্রসারিত। বুদ্ধিজীবীগণ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অধিকমাত্রায় উপলব্ধি করেন। তারা শাসনতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া পরিকল্পনা করার ব্যাপক ক্ষমতা লাভ করেন। এডওয়ার্ড শিল্স তাই যথার্থই লিখেছেন- In no state formation in all of human history have intellectuals played such a role as they in these events of the present century, অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীগণ বর্তমান শতাব্দীতে রাষ্ট্রগঠনে যেরূপ ভূমিকা পালন করেছেন সমগ্র মানব ইতিহাসে কোনো রাষ্ট্র গঠনেই অন্য কেউ সেরূপ ভূমিকা পালন করেন নি। বুদ্ধিজীবীগণই জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের গুরুদায়িত্ব হাতে নিয়েছেন যখন জনগণের মাঝে উক্ত চেতনাবোধ খুব কমই ছিল।
- বুদ্ধিজীবীগণের ভাবধারা: শিল্পায়ন, গতিশীলতা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অধিকতর উত্তম ও উন্নত জীবনযাত্রার জন্য আধুনিকীকরণের দাবি করেন। তারা জনগণের কাছে নতুন রাজনৈতিক ভাবধারা প্রচার ও প্রকাশ করেন; তারা ব্যাপক পরিবর্তনের পক্ষে তাদের সকল মেধা, শ্রম ও দক্ষতা কাজে লাগাতে সচেষ্ট থাকেন। S. M. Lipset তাই লিখেছেন, "বুদ্ধিজীবীরা বিশ শতকে সমাজ পরিবর্তনের এজেন্ট। তারা বিভিন্ন কার্যকলাপে যে সমস্ত ধারণার বিস্তার ঘটান সেগুলোর মধ্যেই জাতি তার আত্মপরিচয় খুঁজে পায়।"
পরিশেষে বলা যায়, আধুনিকীকরণের আলোচিত তত্ত্বসমূহ চূড়ান্ত ও সম্পূর্ণ নয়। কারণ আধুনিকীকরণ একটি ব্যাপক দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন স্তরে উল্লিখিত তত্ত্বসমূহ ছাড়াও আরো অনেক তত্ত্ব থাকতে পারে। তাছাড়া আধুনিকীকরণের আলোচিত তত্ত্বগুলোর যেকোনো একটি, কয়েকটি অথবা সব কয়টিই আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বস্তুত আধুনিকীকরণের ধারণাটি আপেক্ষিক, চূড়ান্ত নয়।