নিরাপত্তা বলতে কি বুঝ? নিরাপত্তা গবেষণার বিষয়বস্তু আলোচনা

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় 
মাস্টার্স শেষ পর্ব
রাষ্ট্রবিজ্ঞান
বিষয় কোড : ৩১১৯০৯ 

নিরাপত্তা অধ্যয়ন (Security Studies)
রচনামূলক প্রশ্নবলি

প্রশ্ন: নিরাপত্তা গবেষণার পরিধি ও ক্ষেত্র আলোচনা কর।
অথবা, 
নিরাপত্তা গবেষণার পরিধি ও ক্ষেত্র সম্পর্কে লিখ।


ভূমিকাঃ আসন্ন কোনো আক্রমণ থেকে সুরক্ষা বা নিরাপদ থাকাই নিরাপত্তা। আর নানা ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং ভবিষ্যতে নিরাপত্তা ঝুঁকি বিঘ্নিত হওয়ার হুমকিসমূহ নিয়ে যা কাজ করে তাকে বলা হয় নিরাপত্তা গবেষণা। সামাজিক তথা মানব ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়টা সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় বলে নিরাপত্তা গবেষণা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

নিরাপত্তা গবেষণা কি?

আধুনিক বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে নিরাপত্তা গবেষণা। নিরাপত্তা হচ্ছে কোনো বৈদেশিক বা হিংস্র, ভয়ানক আক্রমণ থেকে ব্যক্তি, জ্ঞাতি, গোষ্ঠী, দেশ বা সর্বোপরি মানবজাতিকে সুরক্ষাকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। কিন্তু পূর্বে এ নিরাপত্তা চিন্তা শুধু রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট সরকারের মাথাতেই ঘুরপাক খেত। কিভাবে সামরিক মজুদ বৃদ্ধি করে রাষ্ট্রকে বহিঃশত্রুর হুমকিমুক্ত করা যায়, তা নিশ্চিত করাই ছিল এ নিরাপত্তা ধারণার প্রধান কাজ। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তা ধারণার আলোচনায় গবেষণার প্রয়োজন হয়। পরিবেশের অবনমন, ওজোনস্তরের ধ্বংসাবশেষ, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কষাঘাত, নিত্যনতুন রোগবালাই-এর আক্রমণ এবং বহু হুমকি মানব জাতির অস্তিত্বকে সঙ্কটে ফেলেছে, যার কারণে নিরাপত্তা গবেষণা একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এক সময় নিরাপত্তা বলতে কেবল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে বুঝানো হতো। কিন্তু আধুনিক যুগে নিরাপত্তা কেবল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নিরাপত্তা গবেষণায় সর্বপ্রথম নিরাপত্তা ঝুঁকিসমূহ চিহ্নিত করা হয়। বর্তমান বিশ্ব নানা ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা করছে। যেমন- পরিবেশ নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, প্রযুক্তির নিরাপত্তা, ভৌগোলিক নিরাপত্তা প্রভৃতি। নিরাপত্তা গবেষণার কাজ হলো এ সকল নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ ও প্রতিকার অনুসন্ধান করা।

নিরাপত্তা গবেষণার পরিধি ও ক্ষেত্র সম্পর্কে লিখ
নিরাপত্তা বলতে কি বুঝ? নিরাপত্তা গবেষণার বিষয়বস্তু আলোচনা

নিরাপত্তা গবেষণার পরিধি ও ক্ষেত্রঃ

নিম্নে নিরাপত্তা গবেষণার পরিধি ও ক্ষেত্র আলোচনা করা হলো।

১. মানব নিরাপত্তাঃ

আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় মানব নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চে স্থান দেওয়া হয়েছে। পরিবেশের অবনমন, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, রোগব্যাধি, সন্ত্রাস, বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রভৃতি কারণে আজ মানব জাতি বিপন্ন হতে চলেছে। তাছাড়া পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থায় নিরাপত্তাকে বাণিজ্যিকীকরণ করে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রকে আরো ক্ষমতা চর্চার সুযোগ দেওয়ার ফলে মানব নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। সে কারণে নিরাপত্তা গবেষণায় মানব নিরাপত্তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়।

২. খাদ্য নিরাপত্তাঃ

বিশ্বের প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের কারণে বহুদিন যাবৎ ক্ষুধার্ত। ২০০৭ সালের শেষ দিকে জৈব জ্বালানির জন্য বিশেষ কৃষিকাজের প্রসার, বিশ্ববাজারে খনিজ তেলের উচ্চ মূল্য, বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তন, আবাসিক প্রয়োজনে ও শিল্প-কারখানার কারণে কৃষিজমি হ্রাস পাওয়ায় বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দেয়। আবার দরিদ্র পরিবারগুলো কেবল ক্ষুধার শিকারই নয়, খাদ্যস্বল্পতা ও দুর্ভিক্ষের সময় এরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিরাপত্তা গবেষণায় কিভাবে খাদ্যকে মানব জাতির জন্য নিরাপদ করে তোলা যায়, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়।

৩. স্বাস্থ্য নিরাপত্তাঃ

এইডস, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, মানসিক সমস্যা, অপুষ্টিজনিত সমস্যা, খাদ্যে ভেজাল সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা, নতুন নতুন অজানা রোগজীবাণু ও ভাইরাসের আবির্ভাব বিশ্বের মানুষকে অস্থির করে তুলেছে। তাছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্য ও উন্নতির পরও স্বাস্থ্যগত হুমকি পুরোপুরি মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মানব জাতি আজ নিরাপদ বলে দাবি করতে পারে না। নিরাপত্তা গবেষণার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হলো স্বাস্থ্য নিরাপত্তা।

৪. পরিবেশ নিরাপত্তাঃ

দিনের পর দিন পরিবেশকে অনিরাপদ করার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে সমুদ্রসীমা বৃদ্ধি পাচ্ছে, উপকূলীয় অঞ্চল নিমজ্জিত হচ্ছে, ঘন ঘন জলোচ্ছ্বাসে ফসলসহ আবাদি জমি বিনষ্ট হচ্ছে। সুতরাং পরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে একসময় গোটা বিশ্বই নিরাপত্তাহীনতায় নিমজ্জিত হবে। তাই নিরাপত্তা গবেষণায় পরিবেশ নিরাপত্তা বিশেষ স্থান পেয়েছে।

৫. জ্বালানি নিরাপত্তাঃ

জ্বালানি নিরাপত্তা বলতে শক্তি সম্পদের নিরাপত্তাকে বুঝানো হয়। শক্তি সম্পদ হলো। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সৌরশক্তি প্রভৃতি। শক্তি যেদিন ফুরিয়ে যাবে, সেদিন পৃথিবীও থমকে যাবে। আবার অনিয়ন্ত্রিত ও অবিবেচিত আকারে জ্বালানি সম্পদের ব্যবহার পৃথিবীর পরিবেশকে বিপন্ন করছে, যা আজ মানব জাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করছে। এজন্য নিরাপত্তা গবেষণায় টেকসই উপায়ে শক্তি সম্পদের ব্যবহার ও সংরক্ষণের চিন্তা করা হয়।

৬. অর্থনৈতিক নিরাপত্তাঃ

অর্থনীতি ছাড়া জগতের কোনো কিছুই সচল নয়। রাষ্ট্র, সংগঠন, ব্যক্তি সকল কিছুর প্রাণ হলো অর্থনীতি। অর্থনৈতিকভাবে যে জাতি যত বেশি স্বাবলম্বী, তারা তত বেশি নিরাপদ। কিন্তু পাকিস্তান বা উত্তর কোরিয়ার নিকট পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেও তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না থাকায় তারা বিশ্বে নিরাপদ জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়। নিরাপত্তা গবেষণা জুড়ে মানব জাতির জন্য একটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কিভাবে অর্জন করা যায়, তা ভেবে দেখা হয়।

৭. বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তাঃ 

বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা একুশ শতকের বিশ্বায়নে খুব পরিচিত প্রপঞ্চ। মানুষের সাথে মানুষের এতো মিথস্ক্রিয়া বেড়েছে যে, বিশ্বের এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের মানুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর এ অবস্থায় বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা অর্জনে নিরাপত্তা গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম।

৮. সমবায় নিরাপত্তাঃ 

বৈশ্বিক সমবায় ব্যবস্থাকে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মকাণ্ড সম্পাদন করার জন্য নিরাপত্তা অধ্যয়ন আবশ্যক। কারণ নিরাপত্তা প্রসারতার মাধ্যমে সমবায়গুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। সুতরাং নিরাপত্তা গবেষণার একটি বিশেষ ক্ষেত্র হলো সমবায় নিরাপত্তা।

৯. ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তাঃ 

নিরাপত্তার প্রশ্নে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো তার সামরিক শক্তি, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত উৎপাদনে পিছিয়ে রয়েছে। এমতাবস্থায় বহির্শক্তি থেকে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য নিরাপত্তার বিষয়ে গবেষণা করা হয়।

১০. মানবিক নিরাপত্তাঃ

আধুনিক বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানবিক নিরাপত্তা খুবই আলোচিত বিষয়। তাই এক্ষেত্রে নিরাপত্তা অধ্যয়নের মাধ্যমে বৈশ্বিক মানবিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির দিক উন্মোচিত হয়। সুতরাং নিরাপত্তা গবেষণার উল্লেখযোগ্য দিক হলো মানবিক নিরাপত্তা।

উপসংহারঃ
পরিশেষে বলা যায় যে, নিরাপত্তা গবেষণার প্রথমে নিরাপত্তার ঝুঁক্তিসমূহ চিহ্নিত করা হয়। সেসকল ঝুঁকির প্রেক্ষিতে কিভাবে নিরাপত্তা অর্জন করা যায়, তার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, প্রযুক্তির নিরাপত্তা, ভৌগোলিক নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। নিরাপত্তা গবেষণায় এ সকল নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ ও প্রতিকার, প্রতিরোধের উপায় অনুসন্ধান করে এ পৃথিবীকে কিভাবে মানব জাতির জন্য নিরাপদ করে টেকসই উপায়ে এগিয়ে যাওয়া যায় তা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা হয়।
Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url