প্রবন্ধ রচনা: দেশ গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা
জাতি গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা
অথবা
দেশ গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা
অথবা
নারীসমাজের অধিকার ও কর্তব্য
জাতি গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা |
ভূমিকা
নারী সমাজ জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জাতীয় জীবনে তাদের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তেমনি তাদের অধিকার রয়েছে। রাসুল সাঃ বলেছেন তোমাদের যেমন অধিকার আছে নারীদের উপর, তেমনি নারীদেরও অধিকার আছে তোমাদের উপর। আল্লাহ তাআলা বেহেশতে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেন হযরত আদম (আঃ)কে, অতঃপর হযরত আদম (আঃ) এর বাম পাজরের হাড় দ্বারা সৃষ্টি করেন হযরত হাওয়া (আঃ) কে। তারপর তাদেরকে পাঠানো হয় পৃথিবীতে। পৃথিবীতে এসে করেন তারা সুখের নীড়। আবাদ করেন পৃথিবী। ক্রমে গড়ে ওঠে সমাজ। তখন থেকে অদ্যাবধি নারী-পুরুষের সম্মিলিত শ্রম ও চেষ্টায় আমাদের সমাজ জীবনের বৃদ্ধি, সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি, নির্ভরশীল। তাইতো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-
"কোন কালে একা হয়নি ক জয় পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয় লক্ষী নারী।"
পরস্পর নির্ভরশীলতা
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করাই তার স্বভাব। সমাজে মানুষ একাকী বাস করতে পারে না। তাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপরের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। আদিম সমাজে গুহার পাশেও মানুষ সমাজবদ্ধ ছিল। সেখানে নর-নারী উভয়েই সমান ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং সংসার তথা দেশ গঠনে নারী সমাজের গুরুত্ব অনেক দিক থেকে উপেক্ষনীয় হতে পারে না। তাইতো কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কুন্ঠচিত্তে ঘোষণা করেছেন-
"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।"
কিন্তু সভ্যতার কোন এক পর্যায়ে এসে নারী, পুরুষের কারাগারে বন্দী হতে থাকে। তখন নারী শুধু ভোগের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এই বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে নারী আজ পুরুষের মতোই কর্মশীল জীবনের অধিকারী। একটি সমাজের উন্নতি বর্তমান বিশ্বে নারী সমাজের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল।
নারীত্বের গৌরব
নারীর সার্থকতা মাতৃত্বে। তাই ইসলাম মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেস্ত বলে নারীর মাতৃত্বকে সর্বোচ্চ গৌরবে ভূষিত করেছে। জাতির জন্য দেশের জন্য নারীর সবচেয়ে বড় অবদান সবচেয়ে বড় উপহার তার সন্তান। পৃথিবীর সকল সমাজ সংস্কারক, চিন্তাবিদ বিজ্ঞানী কবি লেখক রাষ্ট্রনায়ক তারাই প্রতিপালন করেছেন। কেবল প্রতিপালন নয় সন্তানের জীবন গঠনে এবং জীবনের দিক নির্দেশনায়ও তারা অমূল্য অবদান রেখেছেন। নারী গর্ভে ধারণ করেছেন হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর মত মহান ব্যক্তিত্বকে। যাকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ তা'আলা জগতের কিছুই সৃষ্টি করতেন না। নিউটনের মত বৈজ্ঞানিক, প্লেটো, সক্রেটিস, এরিস্টটলের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বিশ্বজয়ী নেপোলিয়ান সবাইকে গর্ভে ধারণ করে মাতৃত্বের গৌরব অর্জন করেছেন নারীই। এ দায়িত্ব মহান এ কাজ মহাগুরুত্বপূর্ণ। মাতার ঋণ যেমন সন্তান কোনদিনও শোধ করতে পারে না, তেমনি দেশ ও জাতির পক্ষেও নারীর ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়।
নারীর কর্তব্য
সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে তাই পরিবার, সমাজ এবং জাতীয় জীবনের উন্নয়ন ও দেশ গঠনে পুরুষের পাশাপাশি নারী সমাজের ভূমিকাও বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে বিশ্বে সাড়ে ৮০০ কোটি লোকের অর্ধেক নারী। সুতরাং সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নের জন্য নারীর ভূমিকা একান্ত প্রয়োজন। সন্তান প্রতিপালন সন্তানের জীবন গঠনে নারীর প্রথম এবং প্রদান কর্তব্য হলেও জীবনের আরও অনেক ক্ষেত্রে নারীর করণীয় অনেক কিছুই রয়েছে। অতীতের মতো নারীসমাজ আর পিছিয়ে নেই। যুগের বিবর্তনে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে। সে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে মানুষের জীবনের গতি, বেড়েছে কাজ। আর এ পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে নারীর কাজও বেড়েছে।
শিশুর চরিত্র গঠনে নারী
আজকের শিশু আগামী দিনের জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। আর এই শিশুকে নেতৃত্বের আসনে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব অনেকখানি মায়ের উপর নির্ভর করে। কারণ জন্মের পর থেকে শিশু মায়ের কাছেই মানুষ হয়। মায়ের স্নেহ মমতা ও শাসনের মধ্যেই তার আত্মবিকাশ ঘটে। মা যদি সন্তানকে সুপথে পরিচালিত করেন তবে সে সন্তান মনুষত্ববোধে দীপ্ত হবে। শিক্ষার আলোকে নিজেকে ও জাতিকে উজ্জ্বল করবে। তাই বিশ্বখ্যাত বীর নেপোলিয়ন বলেছিলেন আমাকে শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদের ভাল জাতি উপহার দেবো। সুতরাং শিশুর চরিত্র গঠনের জন্য তার মনন ও বিকাশের জন্য মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি।
জাতি/দেশ গঠনে নারী
জাতি/দেশ গঠনে নারীসমাজের দায়িত্ব পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। জাতীয় জীবনে সচ্ছলতা, জ্ঞান, ধর্ম-কর্ম ও প্রাণচঞ্চল্য সৃষ্টি না হলে জাতি অচল হয়ে যায়। নারীরা যেহেতু পুরুষের মতোই সমাজের একটি অংশ তাই পুরুষের মতো নারী সমাজকেও জাতি/সমাজ গঠনে ভূমিকা পালন করতে হবে।
সুতরাং দেশ গঠনে নারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অবশ্য নারীরা যে, দেশ ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখছেনা তা কিন্তু নয়। স্বাধীনতার পূর্বে এ দেশের নারীরা গৃহকোণে আবদ্ধ থাকলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক এগিয়ে গেছে। নারীরা এখন ব্যারিস্টার, হাইকোর্টের বিচারপতি, মন্ত্রণালয়ের সচিব, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ডিসি, সেনা অফিসার, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করেছেন।
নারীর অধিকার
নারীর সমাজের কর্তব্যের পাশাপাশি অধিকারের বিষয়টিও আমাদের ভেবে দেখা দরকার। কারণ কর্তব্যের সাথে অধিকারের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অধিকার ছাড়া কর্তব্য পালনে মানুষ উৎসাহ বোধ করে না। আমাদের সমাজে নারীরা এখনো চরমভাবে অবহেলিত। শিক্ষা সংস্কৃতি সকল ক্ষেত্রে নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে। অশিক্ষা ও কুসংস্কারের বেড়াজালে তাদের জীবন আবদ্ধ। বিশেষ করে গ্রামের অশিক্ষিত নারীর সমাজ সারাদিন স্বামীর সংসারে খেটে মরে বিনিময়ে সামান্যতম অধিকার ভোগ করতে পারে না। অবশ্য সহায়দের আধুনিক শিক্ষিত মহলের মধ্যে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে। মেয়ে নারীর অধিকারের কথা বলা হলেও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এখনো তার যথার্থ চর্চা হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীন ইচ্ছা পূরণের অধিকারও নেই তাদের। অবশ্য এক্ষেত্রে উন্নত দেশে নারীরা অনেকাংশে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারছে। তবে অধিকার ভোগ করতে গিয়ে কেউ যদি কর্তব্যের প্রতি অবহেলা করে তাহলে হিতে বিপরীত হবে।
উপসংহার
শুধুমাত্র পুরুষের সেবা ও কর্মে একটি জাতি আত্ম বলে বলিয়ান কিংবা নৈতিক শক্তিতে তেজিয়ান হতে পারে না। নারীর ত্যাগ সেবা ও শিক্ষা জাতিকে গৌরব দীপ্ত মহিমা দিতে পারে। উন্নত দেশগুলোতে নারীসমাজ জাতি গঠনে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। আমাদের দেশেও সুস্থ ও সুখী জাতি গঠনে নারী সমাজের অবদান একান্ত প্রয়োজন। জাতিকে সুস্থ উন্নত ও কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার কাজে নারী সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। জাতি গঠনে নারীদের ভূমিকা কে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। প্লেটো তার রিপাবলিক গ্রন্থে বলেন-
"women is an indispensable a part of the mankind who must complete their role to vibrate common interest."