চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সংজ্ঞা দাও। আধুনিক রাষ্ট্রে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা ও কার্যাবলি আলোচনা কর

আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয়। বিশেষত উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বর্তমানে এটি একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। তবে উন্নত উন্নয়নশীল, অনুন্নত সকল সমাজের অনিবার্য বাস্তবতা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব। আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৃহৎ এবং জটিল। এগুলো বহু জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলনও বটে। ফলে প্রচলিত রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের মাধ্যমে সকলের স্বার্থ সংরক্ষণ করা প্রায় অসম্ভব। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোই এক্ষেত্রে নিজ নিজ গোষ্ঠীর স্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী। সরকারি যেকোনো সিদ্ধান্তকে নিজেদের স্বার্থে নিয়ে আসাই তাদের চরম ও পরমতম লক্ষ্য।


চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হলো এমন এক সুসংগঠিত জনসমষ্টি যারা সমজাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করে। ক্ষমতা দখল চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য নয় বরং নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করাই এর উদ্দেশ্য।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চাপসৃষ্টিকারি গোষ্ঠীর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের দেওয়া কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হলো।

১. ডেভিড ট্রুম্যান (David Trueman)-এর মতে, "চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হলো বহু ব্যক্তির সমষ্টি যা এক বা একাধিক অংশীদারি মনোভাব নিয়ে গঠিত হয়।"

২. জানসি পিয়ার্স-এর মতে, "স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী হলো এক একটি ব্যক্তিসমষ্টি যা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর দাবি উপস্থিত করে তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।"

৩. অ্যালমন্ড ও পাওয়েল (Almond & Powel)-এর মতে, "নির্দিষ্ট স্বার্থের বন্ধনে সংযুক্ত এবং এই সংযৌগ সম্পর্কে সজাগ ব্যক্তি সমষ্টিকে স্বার্থগোষ্ঠী বলে।"


চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী কি? চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কার্যাবলী
 চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী কি? চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সংজ্ঞা। আধুনিক রাষ্ট্রে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা ও কার্যাবলি বিস্তারিত আলোচনা।


চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কার্যাবলি

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো স্বার্থের প্রতিভূ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সিদ্ধান্তকে নিজেদের অনুকূলে প্রভাবিত করাই হলো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সর্বপ্রধান কাজ। গোষ্ঠীস্বার্থ সংরক্ষণে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো সাধারণত নিম্নলিখিত কার্যাবলি সম্পাদান করে থাকে।


১. জনমত গঠন

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো নির্দিষ্ট ইস্যুতে জনমত গঠনে সচেষ্ট থাকে। গণসংযোগের সকল হাট মাধ্যম, যেমন- বেতার, দূরদর্শন, সংবাদপত্র, জনসভা ইত্যাদি ব্যবহার করে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো নিজেদের দাবী-দাওয়ার সমর্থনে জনমত গঠন করে। প্রয়োজনে আন্দোলন, সংগ্রামেও তারা অংশগ্রহণ করে। আর এ কার্যে সাফল্য লাভকরলে তারা সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যবস্থাকে অতি সহজেই প্রভাবিত করে।

২. রাজনৈতিক দলকে সহায়তা দান

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিক দল নয়। তবে রাজনৈতিক দলের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। নির্বাচনের সময় তারা রাজনৈতিক দলের স্বপক্ষে প্রচার কার্য চালিয়ে কিংবা দলকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করতে সচেষ্ট হয়। এভাবে যে রাজনৈতিক দলের স্বপক্ষে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো কাজ করে সে দল সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে উক্ত দলের সমর্থক গোষ্ঠীগুলো সহজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

৩. সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন

সরকার ও জনগণের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র স্থাপিত হয় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মাধ্যমেই। এ গোষ্ঠীসমূহ জনগণের দাবির কথাই বলে। তারা জনগণের অভাব-অভিযোগ সরকারে নিকট পেশ করে। সরকার চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মাধ্যমে জনগণের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে অবগত হয়। সরকার কর্তৃত্ব গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কেও জানতে পারে জনগণ এ গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমেই। ফলে উভয়ের মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়।

৪. তথ্য সরবরাহ

চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী তথ্য সংগ্রহ এবং প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এই ধরনের গোষ্ঠী বক্তৃতা, সভা, মিছিল, বিবৃতি ইত্যাদি আয়োজন করে। এর মাধ্যমে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য বেরিয়ে আসে। তারা প্রশাসন সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। ফলস্বরূপ, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। তারা যে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংগ্রহ করে তা সরকারি নীতি নির্ধারণে সহায়তা করে।

৫. সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীকরণ

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালায়। গোষ্ঠীর চাপের ফলে আমলাতন্ত্রে ঔদাসীন্য এবং নিস্পৃহতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। রাজনৈতিক সমস্যাসমূহ সম্পর্কে সরকারের বক্তব্য রাজনৈতিক দলের ন্যায় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীও জনসাধারণের নিকট পেশ করে। এভাবে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিরোধে সহায়তা করে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো।

৬. সরকারের উপদেষ্টাস্বরূপ কার্যপালন

চাপ গোষ্ঠীগুলি সরকারের জন্য উপদেষ্টার ভূমিকাও পালন করে। বর্তমানে, সরকার আইন প্রণয়ন এবং বিশেষ স্বার্থকে প্রভাবিত করে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলির প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ করে।

৭. রাজনৈতিক প্রচারণা 

রাজনৈতিক সংগঠন না হওয়া সত্ত্বেও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিক প্রচারকার্য পরিচালনার একটি সুসংগঠিত মাধ্যম। নির্বাচনী রাজনীতিতে কোনো গোষ্ঠী স্বতন্ত্রভাবে সরকারি ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে না। সরকার গঠন তাদের লক্ষ্যও নয়। তাদের মূল লক্ষ্য সরকারের নীতিকে প্রভাবিত করা।

৮. আইন ও নীতির উৎস

উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ আইন এবং সরকারি নীতি ও সিদ্ধান্তের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। বহু ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন ও নীতি পরিবর্তনের জন্য গোষ্ঠীসমূহ সরকারের উপর চাশ সৃষ্টি করে।

৯. রাজনৈতিক সমাবেশের আয়োজন

বর্তমান সময়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সাথেই শ্রমিক, মালিক, কৃষক, শিক্ষক, চিকিৎসক প্রভৃতি গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র থাকে। গণ-সংগঠনরূপে সমাজের বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিগণ রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। রাজনৈতিক দিক থেকে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের সমবেত ও সংগঠিত করে। পেশাগত স্বার্থ এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য এভাবে একাত্ম হয়ে পড়ে।

১০. নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার

সরকারি নীতি-নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর একটি মৌলিক দায়িত্ব। মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাছে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী তাদের অভিযোগ ও অনুযোগ উপস্থাপন করে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তারা সরকারের নীতি প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করে। নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করাই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য। মূলত এভাবেই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো তাদের লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়।

১১. আমলাদের ওপর প্রভাব বিস্তার

আমলাদের প্রভাবিত করা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহের একটি অন্যতম কাজ। আমলারা হলো সরকারের স্থায়ী, দক্ষ ও বেতনভুক্ত কর্মচারী। যেকোনো সরকার কাঠামোয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা তথা শীর্ষস্থানীয় আমলাদের হাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল চাবিকাঠি থাকে। তাই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ প্রশাসনিক আমলাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

১২. আইনসভার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার

 আইনসভার সদস্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে প্রতিটি চাপ সষ্টকারী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থের প্রয়োজনে কাম্য আইন প্রণয়নে যেমন ব্যবস্থা করে তেমনি অকাম্য আইনের বিরোধিতা করার জন্য সচেষ্ট হয়। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর আইনসভার সদস্যরা তাদের নির্বাচনের সময় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোর উপর যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভরশীল থাকেন বলে নির্বাচিত হওয়ার পর ঐসব গোষ্ঠীর অনুকূলে কাজ করাকে তারা নিজেদের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করে।

১৩. বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিধি প্রেরণ 

সভা, সমাবেশ, সম্মেলন, আলোচনা গোষ্ঠী ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রতিনিধি পাঠানো চাপ গোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। চাপ গোষ্ঠী প্রতিনিধি পাঠিয়ে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। এই গোষ্ঠীগুলি নির্বাচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে সরকারের কাছে তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থ উপস্থাপন করে এবং সরকারি সিদ্ধান্তগুলিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।


পরিশেষে 

সুতরাং উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী ও তা আদায়ে সচেষ্টদলবদ্ধ প্রচেষ্টাই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী। তাদের অধিভুক্ত জনগণের স্বার্থে সরকারি নীতি-প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে যেমন তারা ব্যস্ত তেমনি গণবিরোধী যেকোনো পদক্ষেপকেও তারা প্রতিহত করে জোরালো তৎপরতার সহিত। সরকারকে জনকল্যাণকামী রাখাই মূলত তাদের মুখ্য লক্ষ্য এবং এজন্য সম্ভাব্য যেকোনো পন্থাই তারা গ্রহণ করে।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

Next Post Previous Post