বাংলাদেশে এতো অধিক রাজনৈতিক দল থাকার কারণ কি? জানুন বিস্তারিত...

অথবা, 

বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক দল গড়ে উঠার কারণ কি? আলোচনা কর


এক রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর গণতন্ত্রকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে। বর্তমান বিশ্বের আদর্শস্থানীয় শাসনব্যবস্থা হলো গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মৌলিক মানবাধিকার ও উন্নয়নের রক্ষাকবচ। রাজনৈতিক দলই গণতন্ত্রের প্রাণ। গণতান্ত্রিক নীতি আদর্শসমূহ বাস্তব রূপ লাভ করে রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই। উদারনৈতিক সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বহুদলীয় রাজনীতি। বিভিন্ন নীতি আদর্শের ভিত্তিতে এ দলগুলো গড়ে উঠেছে। তবে তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের ন্যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর উদ্ভব। এর মাধ্যমে দেশটির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও জাতীয় অনৈক্যই প্রতিভাত হয়েছে।


বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল এতো বেশি হওয়ার কারণ কি?
বাংলাদেশে কেন এতো অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে জানুন বিস্তারিত

বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক দল থাকার কারণ

বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য অনুযায়ী এ দেশের রাজনীতিতে দলব্যবস্থা বিদ্যমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিপুল সংখ্যক দল থাকার উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ নিম্নরূপ:

১. আদর্শগত সংঘাত

স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে প্রত্যেক দলের একটা আদর্শ থাকে এবং সেই আদর্শ অনুযায়ী দল পরিচালিত হয়। দল যদি তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয় তাহলে দলের সকলে তা মেনে নাও নিতে পারে। ফলে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব এবং এতে দলে বিভক্তি ঘটতে পারে। বাংলাদেশেও এ আদর্শের দ্বন্দ্বে বহু ভাঙন ও নতুন দলের জন্ম হয়েছে।

২. সাংবিধানিক স্বীকৃতি 

বাংলাদেশ একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অনুযায়ী এখানে বহুদলীয় ব্যবস্থা স্বীকৃত। যেকোনো ব্যক্তিই এখানে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অনুমোদন পাওয়ার অধিকারী। রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার অধিকার বাংলাদেশের মৌলিক মানবাধিকারের পর্যায়ভুক্ত। দল গঠনে সাংবিধানিক কোনো বাধা-নিষেধ না থাকায় বাংলাদেশে অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটেছে।

৩. সংসদীয় পদ্ধতির সরকার 

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আইনের দ্বারা। এখানে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হলেও অল্প কিছুদিন পরই দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরায় সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংসদীয় পদ্ধতি মূলত দলীয় শাসনব্যবস্থা। জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোট সরকার গঠন করবে এবং অপরাপর দলসমূহ সরকারের ধ্বংসাত্মক ও গণবিরোধী বিষয়গুলোর প্রতিবাদ করবে। এখানে বহুদলীয় ব্যবস্থা অনস্বীকার্য। বিশ্বের অপরাপর দেশের ন্যায় বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিও অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দলব্যবস্থাকে উৎসাহিত করেছে।

৪. বুর্জোয়া মানসিকতা

বুর্জোয়া মানসিকতা থেকে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল নয়। বুর্জোয়া তথা পুঁজিপতিরা তাদের স্বার্থে অর্থবলে বলীয়ান হয়ে এখানে রাজনৈতিক দল গঠন করে।

৫. নেতৃত্বের সংকট

রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঙার পেছনে নেতৃত্বের দুর্বলতা বিরাট অবদান রাখে। নেতৃত্ব সঙ্কটে দলের মধ্যে ফাটল ধরে। আবার একজনের নেতৃত্বে অনেক সময় অন্যজন মেনে নিতেও চায় না। ফলে দলের অভ্যন্তরে কোন্দলের সৃষ্টি হয়। এ কোন্দলে দল থেকে বহিষ্কার কিংবা পদত্যাগ করার মতো ঘটনাও ঘটে। এমতাবস্থায় দলের একটা অংশ বেরিয়ে যায় এবং নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে।

৬. সমযোগ্যতা সম্পন্ন 

একাধিক ব্যক্তির একই দলে উপস্থিতি দলের মধ্যে সমযোগ্যতা, নেতৃত্ব সম্পন্ন একাধিক ব্যক্তির উপস্থিতিও দলের মধ্যে কোন্দলের সৃষ্টি করে। এ কোন্দলে যিনি টিকে থাকেন তিনিই নেতা হিসেবে বহাল থাকেন। এ কারণে বাংলাদেশে বহু রাজনৈতিক দল বিভক্ত হয় ও নতুন দলের জন্ম হয়।

৭. রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ 

তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপায়। সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করে দেয়, এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ভাঙন দেখা যায় এবং একাধিক রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে এভাবেও বহুদলের সৃষ্টি হয়েছে।

৮. বিদেশি শক্তির প্রভাব

তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতিতেও বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর হাত রয়েছে এবং এ শক্তিগুলো তাদের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। তাই তারা একাধিক রাজনৈতিক দল 'এ' টিম, 'বি' টিম, 'সি' টিম হিসেবে গড়ে তোলে যাতে করে একটি রাজনৈতিক দল তাদের ক্ষমতাকে ধরে রাখতে না পারলেও অপর একটি দল সে স্থানটি পূরণ করতে পারে। আবার এ সকল ব্যক্তিবর্গের চক্রান্ত অনেক দলের মধ্যে ভাঙন ঘটে এবং নতুন দলের সৃষ্টি হয়।

৯. প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশের অভাব

এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশের দ্বারা উন্নত হতে পারে নি। বারবার সামরিক শাসনের আগমনের ফলে দলগুলোর সুষ্ঠু কার্যক্রমের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এতে করে ছোটখাটো সমস্যা এবং কোন্দল বড় আকার ধারণ করে এবং দলের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি হয়। ক্ষেত্র বিশেষে নতুন দলের উদ্ভব হয়। বাংলাদেশে জাতীয় পার্টির একাধিকবার ভাঙন এবং নতুন দলের বিকাশ এর জ্বলন্ত প্রমাণ।

১০. জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব 

রাজনৈতিক সচেতনতা গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশের অন্যতম পূর্বশর্ত। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ অশিক্ষিত। ফলে স্বভাবতই তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব প্রকট। এ সুযোগে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী নতুন দল গঠন করে এবং অল্প-বিস্তর জনসমর্থনও পেয়ে যায়। ফলে দেশের উন্নয়ন কিছু না হলেও রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

১১. ধর্মের ব্যাখ্যা নিয়ে মতদ্বৈততা

বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ মুসলমান এবং ধর্মভীরু। কিন্তু ধর্মের ব্যাখ্যা নিয়ে আলেম-ওলামাদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য বিদ্যমান। বিশেষ করে ইসলাম কায়েমের পন্থা নিয়ে এদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য। এমতাবস্থায় বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী নিজ নিজ বিশ্বাস ও মতাদর্শানুযায়ী দল গঠন করে এবং জনসমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বিশ্ব জাকের পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক দলগুলোর উদ্ভবের পেছনে রয়েছে আলেম-ওলামাদের মধ্যকার অনৈক্য।

১২. নেতৃত্বের মোহ 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দল থাকার অন্যতম কারণ ব্যক্তিবিশেষের নেতৃত্বের মোহ। কিন্তু একই দলে সবার পক্ষে নেতৃত্ব গ্রহণ সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় বঞ্চিত কর্মীরা নিজেরাই দল গঠন করে এবং নেতৃত্বের আসন পেয়ে নিজেদেরকে ধন্য মনে করে। একাধিকবার আওয়ামী লীগের ভাঙন এবং গণফোরামের উদ্ভব মূলত একারণেই।

১৩. নেতা-কর্মীদের মধ্যে সহনশীলতার অভাব 

নেতাকর্মীদের মধ্যকার সহনশীলতা সুস্থ ধারার রাজনীতির জন্য অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশে দলীয় নেতা কর্মীদের মধ্যে এ গুণটি অনুপস্থিত। এদেশে প্রত্যেক দলীয় নেতা সর্বক্ষেত্রে নিজস্ব মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে দেখা দেয় দলত্যাগের পাঁয়তারা। দলের মধ্যে চক্রান্ত আরো ঘনীভূত হয়। ক্রমে গড়ে উঠে নতুন রাজনৈতিক দল।

১৪. বহুধাবিভক্ত জনসমাজ 

স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘদিন পরও বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নি। ভাষা, ধর্ম, জাতীয়তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্যান্য বিশ্বাসের ভিত্তিতে সমাজ এখনও ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। এসব বহুমুখী মতভিন্নতার কারণে এদেশে একাধিক রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে এবং দলগুলো বিশেষ বিশেষ আদর্শ লালনকারী জনগোষ্ঠীকে স্বীয় পতাকা তলে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে।


পরিশেষে

সুতরাং বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্রায়তনের দেশে এত বেশি সংখ্যক রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের পেছনে রয়েছে বহুবিধ আর্থ-সামাজিক কারণ। স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে অত্র অঞ্চলে ক্রিয়াশীল ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টির ন্যায় মুষ্টিমেয় উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতা লাভের পর বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে দুশতাধিক রাজনৈতিক দল। এ দলগুলোর অধিকাংশই জনসমর্থহীন ও নাম সর্বস্ব হলেও তারা বাংলাদেশের বহুত্ববাদী ও নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই ধারক-বাহক।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

Next Post Previous Post