সুশীল সমাজ কি? সুশীল সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ। সুশীল সমাজের বৈশিষ্ট্য

ইংরেজি Civil Society-এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে সুশীল সমাজ। সতেরো শতকে প্রখ্যাত দার্শনিক Hobbes-এর লেখা থেকে Civil Society ধারণাটির উদ্ভব হয়। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সুশীল সমাজ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সুশীল সমাজ, গ্রাম ও শহরের পেশাজীবী ও বৃদ্ধিজীবী শ্রেণীর সমষ্টি। সুশীল সমাজকে সভ্য সমাজের সমার্থক হিসেবে গণ্য করা হয়। পৃথিবীর সকল সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুশীল সমাজের ভূমিকা অপরিসীম।

Origin and development of civil society
সুশীল সমাজ কি? সুশীল সমাজের সংজ্ঞা। সুশীল সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ। সুশীল সমাজের বৈশিষ্ট্য। সুশীল সমাজের প্রকৃতি বা স্বরূপ বিস্তারিত আলোচনা। 


সুশীল সমাজের সংজ্ঞা

জনগণের যে অংশ রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি কোনো সুবিধা পায় না কিন্তু রাষ্ট্রের উন্নয়নে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সে অংশকে সুশীল সমাজ বলে।


প্রামাণ্য সংজ্ঞা

সুশীল সমাজ একটি বহুল আলোচিত প্রত্যয় হলেও এর একক ও সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা প্রদান আজো সম্ভব হয় নি। বিভিন্ন লেখক ও চিন্তাবিদ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে সেগুলে উল্লেখ করা হলো।


১. কার্ল মার্কস (Karl Marks)-এর মতে, “সুশীল সমাজ হলো বস্তুবাদের ভিত্তিভূমি, আধুনিক সম্পত্তি সম্পর্কে সমষ্টির বিরুদ্ধে ব্যক্তিদের সংগ্রাম এবং চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ক্ষেত্রবিশেষ। মধ্যযুগের বিলুপ্তির পরেই এই সমাজের উদ্ভব ঘটে।"

২. UNDP-এর মতানুযায়ী, "সুশীল সমাজ হলো সেই ক্ষেত্র যেখানে সামাজিক আন্দোলন জন্ম নেবে ও বিকশিত হবে।' 

৩. সমাজবিজ্ঞানী ল্যারি ডায়মন্ড (Larry Diamond) বলেন, "সুশীল সমাজ হচ্ছে একটি মধ্যবর্তী অস্তিত্ব যা ব্যক্তিগত ক্ষেত্র ও রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থান করে।"

৪. অধ্যাপক জ্যা এল, কোহেন ও অ্যান্ড্রু অ্যারাটো (Jean L. Cohen & Andrew Arato) তাদের 'Civil Society & Political Theory' গ্রন্থে বলেন, "সুশীল সমাজ হচ্ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র, যা সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেরে সমাজ সংশ্লিষ্টতা বিচ্ছিন্ন করে।"

৫. অধ্যাপক আর্নেস্ট প্লেনার (Earnest Glener) তার 'Conditions Liberty Civil Society & Its Rivals' গ্রন্থে বলেন, "সুশীল সমাজ হচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি যা রাষ্ট্রের ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়।"

৬. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের মতে, "সুশীল সমাজ হলো পরিবার এবং রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী অস্তিত্ব। সুশীল সমাজের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো হলো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, গণমাধ্যম, পেশাজীবী সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন।"

৭. সাবেক বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেন, "সুশীল সমাজের ধারণাটি এসেছে সামাজিক চুক্তি মতবাদ থেকে, যা আঠারো শতকে পশ্চিম ইউরোপের বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকেই অধিক পরিচিতি লাভ করেছে। প্রকৃতির রাজ্যের প্রাকৃতিক অবস্থার তত্ত্ব এ ধারণাকে আরো বিকশিত করতে সহায়তা করেছে। বিগত কয়েক দশকে রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলার প্রামাণ্য চিত্র থকে এ সুশীল সমাজের ধারণা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।"


সুশীল সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ 

সাম্প্রতিককালে তাত্ত্বিক, গবেষক, বিশ্লেষক ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিকট আলোচনার বিষয় বা সুশীল সমাজ প্রত্যয়টি বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেছে। গণতান্ত্রিকতা হচ্ছে সুশীল সমাজের মূল আদর্শ। অধ্যাপক য়দ আনোয়ার হোসেন তাই যথার্থই লিখেছেন যে, "সমগ্র বিশ্বে গণতান্ত্রিক ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য সুশীল মাজের মজবুত ভিত্তি অপরিহার্য।"নিম্নে সুশীল সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ আলোচনা করা হলোঃ


১. সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ

সুশীল সমাজ ধারণার উৎপত্তি সামাজিক চুক্তি মতবাদ থেকে, যা অষ্টাদশ শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিশেষ ব্যাপ্তি লাভ করেছিল। মূলত প্রাকৃতিক অবস্থার তত্ত্ব এ ধারণাকে বিকশিত করে।

২. রাষ্ট্রের অপারগতা

অনেক সময় রাষ্ট্র বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বাস্তবায়নের জন্য সুশীল সমাজের শরণাপন্ন হয়। গত কয়েক দশকে সমাজ পরিশাসনে রাষ্ট্রের প্রমাণিত অপারগতা থেকে সুশীল সমাজের ধারণা এর শজ্জীবিত হয়েছে।

৩. বেসরকারি সংস্থাসমূহের উদ্যোগ 

UNDP এবং বেসরকারি সংস্থাসমূহের (NGO) উদ্যোগেই সুশীল সমাজের ধারণা উন্নয়নশীল বিশ্বে জনপ্রিয় হয়েছে এবং হচ্ছে। পাশ্চাত্য সূচিত এই ধারণাকে বাংলাদেশের মতো প্রাচ্য দেশে অঙ্কুরিত করার উদ্যম রয়েছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক রাজনৈতিক অগ্রগতির মূলকথাই হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা এবং তা নিশ্চিত হয় সরকারের দায়িত্বশীলতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে স্বচ্ছতার মাধ্যমে। আর এ কাজটি ত্বরান্বিত করার জন্য সুশীল সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ


সুশীল সমাজের বৈশিষ্ট্য

সুশীল সমাজ বলতে আধুনিককালের সভ্য সমাজকে বুঝানো হয়। সুশীল সমাজ হচ্ছে সংগঠিত স্বার্থের সমষ্টি। সুশীল সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি বেসামরিক, শিক্ষিত ও গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা সম্পন্ন মানুষের সংগঠন। বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং তার অনুকূলে জনমত সৃষ্টি করা সুশীল সমাজের কাজ। নিম্নে সুশীল সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলোঃ


১. গণতন্ত্রে বিশ্বাসী

সুশীল সমাজ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। গণ কায়েমের জন্য সুশীল সমাজ কাজ করে থাকে। সুশীল সমাজে সামরিক শাসন বা একনায়কতান্ত্রিক শাসন স্থান পায় না। অর্থাৎ সুশীল সমাজ সবসময় জনগণের কল্যাণের জন্য গণতন্ত্রের প্রতি অনুরাগী এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে।

২. সরকারের পরামর্শদাতা

জনকল্যাণের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য - সুশীল সমাজ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং এর স্বপক্ষে সুশীল সমাজ জনমত সৃষ্টি করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার সুশীল সমাজের উপর নির্ভরশীল থাকে। কেননা সুশীল সমাজ দেশের সচেতন নাগরিকের সমন্বয়ে গঠিত হয়।

৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বাহক

সুশীল সমাজ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বাহক। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সবাই সহনশীলতার পরিচয় দেয়। সরকারও সুশীল সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে জনস্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ড পরিহার করে। সুশীল সমাজ সবসময় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সচেষ্ট থাকে।

৪. জনসচেতনতা সৃষ্টি

সুশীল সমাজ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পক্ষে এবং সরকারের বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে জনমত সৃষ্টি করে। তারা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রচার-প্রচারণা, বাণী প্রদান,সভা, সেমিনার, আলোচনার মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা আনয়নে ভূমিকা রাখে। 

৫. মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল 

সুশীল সমাজ মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কোথাও এর লঙ্ঘন হলে তারা সোচ্ছার হয়ে উঠে। সাম্প্রতিককালে খুন, ধর্ষণ, রাহাজানী,সন্ত্রাস, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সুশীল সমাজ সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। 


পরিশেষে বলা যায়, পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক ধারায় প্রতিটি দেশেই সুশীল সমাজ সরকারের - সহযোগী সংগঠন হিসেবে কাজ করছে। ফলে জনগণের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি সুসংহত হচ্ছে।



সুশীল সমাজের প্রকৃতি বা স্বরূপ

সুশীল সমাজ হচ্ছে রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সুশীল সমাজ চরম দারিদ্র্য, দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগণের পক্ষে এমন গতিশীল ভূমিকা পালন করে, যাতে সরকার জনগণের পক্ষে কাজ করতে বাধ্য হয় এবং চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সুশীল সমাজের স্বরূপ বা প্রকৃতি বিশ্লেষণ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নিম্নে সুশীল সমাজে স্বরূপ বা প্রকৃতি আলোচনা করা হলো।


১. কাঠামো

কাঠামোগত দিক বিবেচনায় সুশীল সমাজের সকল গ্রুপ বা গোষ্ঠী সরকারি গোষ্ঠী নয়, এরা রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে আগ্রহী না হলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সর্বদা চেষ্টা করে। এনজিও নাগরিক কমিটি, আইনজীবী সমিতি, শিক্ষক সমিতি, আইন-সালিশ কেন্দ্র, পরিবেশবাদী সংগঠন, আইন সহায়তাকারী কেন্দ্র প্রভৃতি রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হলেও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২. কার্যাবলি

সুশীল সমাজ রাষ্ট্রের গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি, সিদ্ধান্ত ও আইনকে বাস্তবায়িত করতে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এক সময় সরকার বাধ্য হয় কাজটি দ্রুত বাস্তবায়ন করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নারী নির্যাত সংক্রান্ত আইন সম্পর্কে গৃহীত যেকোনো দ্রুততার সাথে সম্পাদন করার জন্য সুশীল সমাজ সরকারকে প্রভাবিত করতে পারে।

৩. সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি

সুশীল সমাজ রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই অধিকার সচেতন নয়। সে কারণে সুশীল সমাজ জনগণের মধ্যে তাদের বৈধ অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায়। সুশীল সমাজ জনগণের অধিকার সংরক্ষণ করে এবং অধিকারের পরিধি বৃদ্ধির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে।


পরিশেষে 

পরিশেষে বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সুশীল সমাজ এক অপরিহার্য অংশ। মূলত সুশীল সমাজ রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে কার্যক্রম চালায় এবং প্রয়োজনে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে আন্দোলনের মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টি করে থাকে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

Next Post Previous Post