খালেদা জিয়ার শাসনামলে (২০০১-২০০৬) বিরোধী রাজনীতির উপর আলোকপাত
২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তার নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার গঠন করে। চার দলীয় জোটে বিএনপিই ছিল প্রধান শক্তি। তাদের দেওয়া কর্মসূচিই মূলত জোটের নামে পরিচালিত হয়। জোটের অন্তর্ভুক্ত অপরাপর দলসমূহ সেইসব কর্মসূচিতে সাড়া কিংবা সমর্থন দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু জোট সরকারে মন্ত্রিত্ব না পাওয়ায় খুব স্বাভাবিকভাবেই বঞ্চিত শরিকদের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এ সময় বিরোধী দলীয় রাজনীতিতেও বিভিন্ন মাত্রা যোগ হয়।
![]() |
বেগম খালেদা জিয়ার শাসন আমল কেমন ছিলো। |
খালেদা জিয়ার শাসনামলে (২০০১-২০০৬) বিরোধী রাজনীতি
খালেদা জিয়ার শাসনামলে (২০০১-২০০৬) বিরোধী দলের রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল তীব্র প্রতিরোধমূলক। এ সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। নিচে খালেদা জিয়ার শাসনামলে (২০০১-২০০৬) বিরোধী রাজনীতির উপর আলোচনা করা হলো:
১. ড. এ. কিউ. এম. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণ
২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন এবং ড. এ. কিউ, এম, বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দান করেন। কিন্তু ক্ষমতার মাত্র ৭ মাসের মাথায় রাষ্ট্রের মর্যাদাসম্পন্ন পদ থেকে অভিসংশনের আওতাবহির্ভূত একজন রাষ্ট্রপতিকে দলীয় কারণে অপসারণ করার অপ্রত্যাশিত বিষয়টি বেগম খালেদা জিয়া সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করে। দলীয় সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৫০(৩) নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ২০০২ সালের ২১ জুন পদত্যাগ করেন। পরক্ষণই সংসদ সদস্যের পদ ত্যাগ করেন তার পুত্র মাহী, বি. চৌধুরী।
২. এলডিপি নামক রাজনৈতিক দল গঠন
২০০৪ সালের ৮ মে মেজর (অব) আব্দুল মান্নানকে মহাসচিব, মাহী বি. চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক, অধ্যাপক বি. চৌধুরীকে সভাপতি এবং অন্যান্য বিএনপি বিমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নিয়ে গড়ে তোলা হয় 'বিকল্পধারা বাংলাদেশ' নামে একটি রাজনৈতিক দল। এভাবে ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর উভয় নেতা মিলে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
৩. প্রধান বিচারপতির বয়স বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে বিরোধ
বিচারপতি (অব) কে. এম. হাসানকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ এবং বিচারপতিদের বয়স বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের সাথে বিরোধের সূত্রপাত হয়। কারণ বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ ছিল বিচারপতি কে. এম. হাসান বিএনপির দলীয় লোক। তাছাড়া বিচারপতিদের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হয়েছিল মূলত কে. এম. হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দানে সাংবিধানিক জটিলতা নিরসনের জন্য। অবশেষে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন দলীয় জোটের আন্দোলনের মুখে বিচারপতি কে. এম. হাসান তত্ত্ববধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।
৪. বিরোধী দলের ২৩ দফাভিত্তিক আন্দোলন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশন পূর্ণভাবে সংস্কার ও হালনাগাদ নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নসহ ২৩ দফা দাবিতে বিরোধী ২৯ যে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল তা ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের দাবিতে ২০০৬ সালের ৩০ মার্চ সচিবালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে।
৫. দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি
বিরোধী দল সংস্কার প্রস্তাব আদায়ের লক্ষ্যে ২০০৬ সালের ২০ জুন ঢাকার সিইসি কার্যালয় ও জেলায় জেলায় নির্বাচনী কার্যালয় অবরোধের ঢাক দেয়। ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে বিরোধী জোট মহাসমাবেশ ডাকে। এই মহাসমাবেশে ১৪ দলীয় জোট নেত্রী শেখ হাসিনা সংস্কার প্রস্তাব নেওয়ার জন্য কড়া হুঁশিয়ারি ব্যক্ত করেন। এভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনকে কেন্দ্র করে দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা। অবরোধ ও হরতালের জন্য জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে।
৬. আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট কর্তৃক নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা
২০০৭ সালের ২৯ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট জানুয়ারির এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় ৭, ৮ ও ৯ জানুয়ারি সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়। অবরোধ ঠেকানোর জন্য সরকার গণগ্রেপ্তার শুরু করে। এতে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মহাজোটের আন্দোলন জনগণের দাবি এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমদ ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। উপদেষ্টা ফজলুল হককে অন্তবর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৭. প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ফখরুদ্দিনের শপথ গ্রহণ
২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দিন আহমদকে দ্বিতীয় দফায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেন এবং শপথ বাক্য পাঠ করান।
৮. নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান
২০০৮ সালের ২ নভেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষিত হয়। ১৮ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ এবং ২৮ ডিসেম্বর উপজেলা নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালের ২৩ নভেম্বর নির্বাচনের পুনঃতফসিল ঘোষণা করে। এই সময় ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ এবং ২২ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা দিন বদলের ডাক দেন। আর খালেদা জিয়া "দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও” এই স্লোগান নিয়ে এ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে।
পরিশেষে
পরিশেষে বলা যায় যে, খালেদা জিয়ার শাসনামলে অষ্টম জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বিরোধী দলীয় রাজনীতি এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। এই সময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল তাদের ২৩ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্থির করে তোলে।