মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: বর্ণমালার মিছিল। লেখক মনি হায়দার।
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
লেখকঃ মনি হায়দার
গল্পের নামঃ বর্ণমালার মিছিল
স্বপ্নের মতো সুন্দর একটি দেশ। সবুজে সাজানো দেশটি নতুন বেড়ে ওঠা কিশোরীর মতো উজ্জ্বল উচ্ছল আর প্রাণবন্ত। রাতে আকাশের সূদূর চূড়ায় নীলের দেশে থোকা থোকা জোনাকী জ্বলে। তারাগুলো হাসে গাঢ় মাটির বুকে দীঘির জলে ভাসা রাজহাঁসের সাথে, চোখের কিনারে মিষ্টি হাসির ছটায় ছিলিক হানে দুষ্টুমি। গাছে গাছে ফুল ফোটে। গন্ধে আকুল হয়ে দূর দূরান্ত থেকে আসা অলি জড়িয়ে ধরে ফুলের রেণু। ঝিঁঝিঁর ডাকে ঘুম ভাঙে খোকার। আকাশে ওঠে পুর্ণিমার চাঁদ। মায়ের কোল থেকে কচি দু'হাত বাড়িয়ে খোকা আধো আধো কণ্ঠে ডাকে মা-মা-মা-মা।
![]() |
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: বর্ণমালার মিছিল |
দেশটির বুক জুড়ে আঁকা বাঁকা হাজারো নদীর মেলা। নদীর দুই পারে ছবির মতো সবুজ গাঁ। গাঁয়ের লজ্জা রাঙা নতুন বৌ কলসি নিয়ে আসছে পানি ভরতে। মাঠে কৃষক হাল ধরে। মটরশুটি শিম, কলা, পেয়ারা চাষ করছে। নদীতে নানান রঙের পাল তুলে মাঝি যায় ভিন গায়ে। ছোট্ট শিশুদের হাসি, গান আর আনন্দের নিবিড় উচ্ছ্বাসে অজস্র প্রাণের ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে উচাটন। হাসনাহেনা, গোলাপ, শিমুল, পলাশ, জুঁই, চামেলী, টগর, বেলী আর সূর্যমুখি ফুলের গন্ধে মনটা উদাসীন। সকালে বাঁশঝাড়ে পাখির ডাকে রাতের আঁধার পালিয়ে গেলে ফুলের সুবাসে জাগে ঘুমিয়ে থাকা শিশুরা। পায়রার মতো বাকবাকুম বাকবাকুম স্বরে জেগে ওঠে ওরা। পায়ের ছোঁয়ায় ঘাসের ডগায় শিশিরেরা হয় এলোমেলো। হাতে হাতে শিকল বেঁধে ওরা জীবনের স্পন্দনে মেতে ওঠে। জীবনের জয়গানে মুখরিত হয় রাজপথ। ওরা দল বেঁধে আইটাই করে খোঁজে পাখির বাসা। পেয়ারা গাছের সবুজ পাতার আড়ালে লুকিযে থাকা পেয়ারাগুলো খুঁজে বের করে। হাসির উচ্ছলে লুটিয়ে পড়ে মাটির বুকে। হঠাৎ ওদের হাসি থেমে যায়।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: "অতিক্রম"
সামনে দাঁড়ানো এক অদ্ভুত জীব। চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে। দাঁতগুলো হিংস্রতায় বের করা। মাথায় ঝাকড়া চুল। কানে গোজা জবা ফুল। হাতে উন্মুন্ত কৃপাণ।
ওরা ভয় পায়। পিছনে ডানে বাঁয়ে চারদিকে অসংখ্যা ঐরকম অদ্ভুত জীব। মা-ওরা চিৎকার করে ওঠে।
খবরদার। গড় গড় আওয়াজ তোলে। মাকে ডাকবি না। আমরা যা বলি তাই শুনবি। নইলে এই নদী, ফুল, পাখি, গান, চাঁদ তোর মা-বাবা সবাইকে চিরকালের জন্য মেরে ফেলবো।
না তোমাদের কথা আমরা শুনবো না। ছেলে মেয়েরা চিৎকার করে তীব্র প্রতিবাদ করে। ভয় পায় না ওরা। আমরা আমাদের মাকে ডাকবো।
মা-
সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেক সোনার ছেলে চিৎকার করে ওঠে চোখে মুখে অস্বীকারের দুরন্ত সাহস। ভয়ের লেশমাত্র নেই। বুকটানা করে দাঁড়ায় একঝাঁক পায়রা।
চোপরাও। আমরা তোদের মালিক মোক্তার। রাজা বাদশা। রাজার কথা মানতে হবে। রাজার ভাষা খান্দানী, তোদের ভাষায় কথা বলবি না।
আমাদের শিখিয়ে দেয়া ভাষায় কথা না বললে মাথা কেটে নেবো।
না, তোমাদের কথা মানবো না। শুনবো না তোমাদের কথা। সোনার ছেলেরা বজ্র নিনাদে পৃথিবী কাঁপিয়ে উচ্চারণ করে, আমরা এই ফুল পাখির দেশে জন্মেছি। এই সুনীল আকাশ, মিষ্টি পাখির অপূর্ব গান, খঞ্জনা নদীর তীর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমরা এগিয়ে চলেছি। তোমরা বিদেশী বেনিয়া এসেছো- আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় মায়ের ভাষা বর্ণমালা অ, আ, ক, খ কেড়ে নিতে। আমাদের বুকে রক্তের একটি ফোঁটা থাকতে তোমাদের মানবো না। শত সহস্র অযুত কণ্ঠে ডাকবো- মা।
শুনুক পৃথিবী। জানুক সবাই। দেখুক মানুষ।
ওদের ডাকে মায়েরা বেরিয়ে আসে।
খোকা-
মায়েরা ছুটে আসে। কিছুক্ষণ আগে যেসব সোনার ছেলে সদ্য ঘুমভাঙা চোখে মায়ের কপালে চুমু খেয়ে এসেছে ফুল কুড়াতে, ঝরা ফুলে গাঁথবে মালা। পরাবে শ্যামল মাকে।
আরও পড়ুনঃ A teenage story about the Liberation War Waiting
মা, ওরা আমাদের বর্ণমালা কেড়ে নিতে চায়। তোমাকে মা বলে ডাকতে দিতে চায় না। ওরা ডাকাত, ওরা লুটেরা-
মুখের কথা মুখে থাকতেই আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসে ওদের কণ্ঠ চিরে।
ভিনদেশী জানোয়ারদের উন্মুক্ত কৃপাণের নির্মম গায়ে তাজা রক্তে লাল হয়ে গেছে ঘাসের গালিচা। পাখিরা ডানা ঝাপটায়। ওড়ে না। নদীর স্রোত থেমে যায়। মাঝিদের কণ্ঠে ভাটিয়ালির সুর কান্না হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে সমুদ্রে। ফুল ফোটে না। ডালে ডালে দোয়েল শ্যামা-পাপিয়া ফিঙ্গে গান গায় না।
ছেলে হারানো মায়েদের শোকে পৃথিবীর সব পতাকা পথে পথে মিছিল করে লজ্জা অবনত মস্তকে। ঘাসের বুকে শিশিরেরা কাঁদছে। ফড়িং নাচে না। পাহাড়ের কোলে ময়ূর পেখম মেলে না। কলাপাতার ওপর রোদের খেলা থেমে গ্যাছে। মায়ের কণ্ঠে বর্ণমালার শোকাহত গান।
হাজার হাজার ছেলে মেয়ে ছুটে আসছে। থোকা থোকা রক্তের টানে তুলি হয়েছে রাজপথ। লাখো পায়ের ছোঁয়ায় আকাশের নীল-রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। চাঁদ বুঝি গায়ে রক্ত মেখে সেখানে লিখে বর্ণমালা অ, আ, ক, খ।
ভিনদেশী জানোয়ারেরা মানুষের প্রতিবাদ মিছিল শ্লোগান জাগরণ দেখে ভয় পায়। কৃপাণ গুটিয়ে নেয়। রক্তাক্ত বর্ণমালারাও মিছিল বের করে। সামনে সালাম রফিক, সফিক, জব্বারের রক্তমাখা সূর্যলাল কফিন।
কৃষ্ণচূড়ার ডালে, নদীর কূলে, পাখির সৌরভমাখা পালকে, কণ্ঠে, মেডিক্যাল কলেজের সামনের ছায়াঘেরা আমগাছের পাতারা, চাঁদের মতো শিশুরা বর্ণমালার মিছিল বের করে। বর্ণমালার মিছিল।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: মনি হায়দারের লেখা- "অরু ডাক শুনেছে"
শ্লোগান দেয়-রক্ত দিয়েছি-মায়ের ভাষার মান রেখেছি।
সারা বিশ্ব দেখেছে ওরা জীবনের বিনিময়ে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছে। জীবন দিয়েছে তবু মান দেয় নি। রক্ত দিয়েছে তবু বর্ণমালাকে পরাজিত হতে দেয়নি। সেই দেশটির নাম বাংলাদশে। জাতির নাম বাঙালী। রক্তে লেখা ভাষার নাম বাংলা। বর্ণমালা অ, আ, ক, খ।