মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: "অতিক্রম"। Muktijuddher Kishore Golpo Otikrom
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
গল্পের নাম: অতিক্রম
লেখক: মনি হায়দার
টুলুটার সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।
ওকে বললাম- না, আজকে এবং এখনই পটকাদের বাসায় যাবার কোনো দরকার নেই।
কেন? গেলে কী হবে? টুলুর একরোখা জেদি কণ্ঠ।
অসুবিধা আছে।
টুলু ওর ঝাঁকড়া চুলের বড়ো মাথাটাকে ডানে-বামে হিমালয় টলানো দুটো ধাক্কা দিয়ে বললো- অসুবিধা? কিসের অসুবিধা?
মন্টি বলে- পটকার বাবা বাড়ি থাকলে সবাইকে ভ্যারেণ্ডা ভাজা খাওয়াবে। তার ওপর আজ শুক্রবার। ছুটির দিন- পটলার বাবা সারাদিন বাসায় থাকে।
থাকলে কী হবে?
ঐ যে বললাম- ভ্যারেণ্ডা ভাজা খাওয়াবে।
খাওয়াক। তারপরও যাবো। টুলু আরো বলে- পটলার বাবা যদি ভ্যারেণ্ডা ভাজা খাওয়ায়- খাবো। মন্দ কী? পয়সা তো আর লাগছে না?
নাছোড়বান্দা টুলু। সে যাবেই। এটা ওর চিরাচরিত অভ্যাস। একটা কথা মুখ দিয়ে বের হলেই হলো- না করে ছাড়বে না। আমি, মন্টি, টুলু আর গিলটু একসঙ্গে চলাফেরা করি। পাড়ার সবাই জানে এটা। যেখানে একজন- সেখানেই চারজন। মাঝে মধ্যে আমাদের চারজনের সঙ্গে পাঁচজন হয়ে আসে- তমাল। আমরা চারজন চঞ্চল। এলাকার ছোটখাটো দুষ্টুমি যা হয় সেটাও আমরা করি। ক্লাসে পড়া না পেরে মার খাওয়া, বেঞ্চের ওপর দাঁড়ানো- তাও আমাদের ভাগ্যেই জোটে। মাঝে মধ্যে চোখ ফেটে জল নামে। কিন্তু তারপরও পরের দিন আমাদের পড়া
![]() |
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: "অতিক্রম" |
হয় না। আবার দাঁড়াতে হয় বেঞ্চের ওপর।
কেবল উল্টোটা হচ্ছে তমাল। একদম সরল-সোজা ও। দুষ্টুমি করবে না। পাড়াময় টো টো করে ঘুরবে না। শান্ত সুবোধ বালকটি হয়ে ঘুরবে
আর মনে মনে যেন বলে- সারাদিন আমি যেনো ভালো হয়ে চলি।
লিডার আমাদের টুলু। আর ও লিডার হবেই না কেন? যা স্বাস্থ্য! ইয়া মোটা। শরীরে রাখে অসম্ভব শক্তি। পাকা কলা খায় চিবিয়ে। কোনো কিছু কেয়ার-টেয়ার করে না। মারামারি পিটাপিটিতে দারুণ ওস্তাদ ছেলে।
আমরা ওর বন্ধু। আমাদের সঙ্গেও যেমন ব্যবহার করে, মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়- সবাই মিলে ওকে একদিন রামধোলাই না থাক।
মনের কথা মনেই থাকে। কাউকে বললে সে যদি আবার ওর প্রিয় পাত্র হবার জন্য বলে দেয়- তাহলে হয়েছে। আজিমপুরের আমলিগোলায় ওদের বাসার সামনে দিয়ে গেলে ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবে।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের গল্প: রাত পোহালেই পনেরোই আগস্ট
টুলু যে খুব শক্তি রাখে বাহুতে- এটা দেখাবার সুযোগ পেলে আর ছাড়ে না। তাই পারতপক্ষে ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করি না। কারণ ও যখন 'কেমন আছিস?' বলে হাত বাড়ায়, তখন বাধ্য হয়ে আমাদেরও হাত বাড়াতে হয়। সেই সুযোগটা ও হাতছাড়া করে না। ওর হাতের তীব্র চাপে বিকৃত মুখে উচ্চারণ করি- ভালো।
টুলুর হাতের চাপে আমাদের হাতের তালু থেকে কাগজি লেবুর রস বের হবার অবস্থা। তো এই রকম রকবাজ টুলুকে বাগানো চাট্টিখানি কথা নয়। এভাবেই পরাজিত হই টুলুর কাছে। অবশ্য মাঝে মধ্যে গলির মোড়ের গদাই মিয়ার মিষ্টির দোকান থেকে আলুর চপ, জিলাপি ভাজা খাওয়ায়। আমরাও খাই। আর যাই হোক খাবারের লোভ কার না আছে?
দলের মধ্যে সবচেয়ে গোবেচারা তমাল। ওকে দেখলেই মনে হয় কেউ ওকে মেরে আমসত্ত্ব বানিয়ে এইমাত্র ছেড়ে দিয়েছে। কথা বলে খুব কম। তাও আবার যদি কেউ জিজ্ঞেস করে- বেশি কথাবর্তা না বলে চুপচাপ থাকাটাই নাকি প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ। অর্থাৎ কিনা সে নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবে। অবশ্য এইসব কথা জানার পর ওকে আমরা বুদ্ধিমান বলেই ডাকতাম। একদিন হঠাৎ তমালের একটা বিষয় আবিষ্কার করে ফেললাম। বাংলা স্যারের টেবিল থেকে খাতা নিয়ে আসার সময় হঠাৎ ওর খাতাটা আমার পায়ের কাছে পড়ে। আমি খাতাটা উঠিয়ে উল্টিয়ে দেখি এক জায়গায় লেখা কবিতার নাম- 'শুয়োপোকা'। কবি তমাল মিয়া। বলে কী। তমাল কবিতা লেখে? বাংলা স্যার চলে যাবার পর সবার সামনে তমালকে কবি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলাম। এবং 'শুয়োপোকা' কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালাম। সারা ক্লাসে হাসির উদ্দাম সাইক্লোন বয়ে গেলো। কবি বলে কথা! আমাদের ক্লাসে আস্তো এবং জীবন্ত একজন কবি বসবাস করছে। ভাবতেই কেমন আশ্চর্য লাগে। ঐদিন থেকেই তমালকে কবি নামে ডাকতে লাগলাম। প্রথম দিকে তমাল একটু ভ্রূ কোঁচকালেও পরে দেখলাম মিটিমিটি হাসছে। অর্থাৎ কবি তমাল মিয়া আমাদের কবি সম্বোধন মেনে নিয়েছে। কবি হওয়ার সাধ আর কি!
কয়েক দিন পর টিফিন পিরিয়ডের সময় স্কুলের সামনে আমগাছটার নিচে বসে কবি সম্পর্কে আলাপ করছিলাম। সুকান্ত, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ কে কার প্রিয়।
মন্টি সবকিছু ছাপিয়ে বলে- আমার প্রিয় কবির নাম শুনবি?
মুখিয়ে উঠি আমরা না বললে কেমনে শুনবো?
কবি তমাল মিয়া।
আমরা হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ি। তমাল নির্বিকারে বসে বসে আমাদের হাসির ফোয়ারা দ্যাখে। নিজেও মিটিমিটি হাসে।
টুলু হঠাৎ বলে উঠলো- অতো হাসাহাসির কী আছে? আজ না হয় কাল আমাদের তমাল কবি হলে তো হতেও পারে। জানিস, আমার দাদা এক সময় কবিতা লিখতেন?
তাই নাকি? আমাদের কয় জোড়া চোখ ওর দিকে ফেরাই। তাহলে টুলু তুই তো কবির নাতি- কী বলিস তোরা?
তা তো বটেই টুলু নিজেকে নিজে কবির নাতি হিসেবে সমর্থন করে। অনেক কবিতা লিখেছেন দাদা। সে সব কবিতা বেদেশী পত্রিকায়ও ছাপা হতো।
আচ্ছা, বুঝলাম তোর দাদা কবিতা লিখতো। ছাপা হতো। তোর বাবা
কবিতা-টবিতা লেখে না? প্রশ্ন করে মন্টি।
বেশ গাম্ভীর্যের সঙ্গে জবাব দেয় টুলু-লিখতো তো।
লিখতো মানে। এখন লেখে না?
না।
কেন?
লিখবে কী করে বল? বাবার যা কাজ। সারাদিন ব্যস্ত থাকে। অনেক বড়ো পুলিশ অফিসার তো! সারাদিন বিশ্রাম পায় না। অফিসেই কাটে সারা সময়। আমার বাবাকে দেখে অনেক পুলিশ স্যালুট দেয়। মাঝে মধ্যে আমাকেও দেয়।
আরও পড়ুনঃ মনি হায়দারের লেখা মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "আজও কড়া নাড়ে"
কী দেয়?
স্যালুট।
আমার প্রশ্নের জবাবে টুলু এমনভাবে জবাবটা দেয়- মনে হলো সাবার চোখের সামনে এই মাত্র এক ডজন পুলিশ ওকে স্যালুট দিয়ে গেলো।
তোকেও পুলিশ স্যালুট দেয়? গিলটু বাঁকা চোখে তাকায় ওর দিকে। কেন? তুইও পুলিশ অফিসার বনে গিয়েছিস নাকি?
ক্ষেপে যায় টুলু। চোখমুখ লাল করে বলে- হাঁদারাম, তোকে বোকা আর সাধে বলি না। মাথায় যদি সামান্য পরিমাণ ঘিলু থাকতো! আরে বাবা, আমি যখন বাবার সঙ্গে থাকি, তখন পুলিশেরা বাবাকে স্যালুট দেয়। সঙ্গে কী আমাকেও দেওয়া হয় না?
হয় না মানে? কে বললো হয় না? অবশ্যই হয়। হাজার বার হয়।
আমরা সবাই একসঙ্গে ওর কথায় সমর্থন জানালাম। টুলু আবেগে গাল ফোলায়। বুঝতে পারি এখনই পকেট থেকে বিশ টাকার নতুন কড়কড়ে নোট বের করে বলবে- চল, গলির মোড়ের দোকান থেকে মিষ্টি খাই।
কিন্তু না- আমাদের সবাইকে অবাক করে টুলু বললো, জানিস-টুলুর এই এক ভয়ানক বদঅভ্যাস। কথার শুরুতে এবং শেষে জুড়ে দেবে ঐ শব্দটি জানিস? আরে বাবা বুদ্ধরাম- কোথায়, কখন, কবে, কী ঘটেছে সেটা না বললে জানবো কী করে? ভয়ে সে সব কথা মুখ ফুটে বলতে পারি না। ওদের বাসার সামনে থেকে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে হয়।
বলি- কী বলবি, ঝটপট বল।
বাসায় বাবার কাছে যেসব লোক আসে, তারা অনেক কিছু নিয়ে আসে।
কী কী নিয়ে আসে? জানতে চায় গিলটু।
এই যেমন ধর বাজারের সেরা আম, আনারস, আপেল। বিরাট পাঙ্গাস মাছ। মরণ চাঁদের মিষ্টি, দই, সাগরকলা আরো কতো কী-
চুকচুক করে গিলটুর জিভ, আহারে।
আমার বাবা কী করে শুনবি? চোখ উল্টায় মন্টি।
বল। তোর বাবা কী করে? আমি জিজ্ঞেস করি।
প্রতি বছর নতুন গাড়ি কেনে। তারপর সবাই মিলে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে যাই বেড়াতে। অনেক ছবি আছে আমাদের অ্যালবামে। একদিন নিয়ে আসবো। দেখবি-
আরে যা- গিলটু গরম গলায় বলে, তোর বাবা তো যায় শুধু বাড়ির কাছে, কক্সবাজার। আমার বাবা কোথায় যায় জানিস?
কোথায়?
আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স বেড়াতে যাই আমরা। আমাদের ঘরে অনেক অ্যালবাম আছে। তাছাড়া ভিডিও করে রেখেছি। একদিন বাসায় চল-
ভিসিআরে দেখাবো তোদের।
গিলটুর বোলচাল শুনে আমরা থ। কী করবো, কী বলবো, কোথায় যাবো এসব ভাবছি, এমন সময় টুলু তমালকে জিজ্ঞেস করে- বল তো
তমাল তোর বাবা কী করে?
আমার বাবা? তমালের চোখজোড়া ছানাবড়া। ওকে এ রকম কথা কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে, ও ভাবতেই পারেনি।
হ্যাঁ হ্যাঁ হাঁদারাম, তোর বাবা।
আমার বাবা কী করেন, আমি জানি না। তমালের শান্ত সুন্দর গম্ভীর
উচ্চারণে আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েও গেলাম। এর-ওর মুখের দিকে তাকাই।
জানিস না?
না।
কেন তোর বাবা কোনো কাজ করেন না? আমি জিজ্ঞেস করি।
না।
না না করছিস কেন? তোর বাবা কী অসুস্থ?
না রে, আমার বাবা বেঁচে নেই।
বেঁচে নেই তোর বাবা? গিলট তমালের বাবার মৃত্যুটাকে কনফার্ম করতে চাইছে।
না। বেঁচে নেই।
মুহর্তে আমরা সবাই শোকে জমে গেলাম। আমরা কেউ জানতাম না তমালের বাবা নেই। বাবা না থাকা খুব দুঃখের। কষ্টের। বাবা হচ্ছে ছায়াময় বৃক্ষের মতো। ঝড়ে বাবা ছায়া দিয়ে আগলে রাখে সন্তানদের।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "ভেলায় ভেসে যায়"
আমরা কেউ জানতাম না রে তমাল- তোর বাবা বেঁচে নেই। বেদনা ভরা কণ্ঠে বলি আমি।
না না। ঠিক আছে। সব কথা জানতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তমালের দার্শনিক জবাব।
মন্টি ভেজা স্বরে জানতে চায়- কবে মারা গেলো, বললি না তো।
কী করে বলবো? তোমার সঙ্গে পরিচয় মাত্র বছর খানেকের। বাবা তো মারা গেছে অনেক আগে। বাবা মারা যাবার তিন মাস পরে আমি জন্মেছি। আমি বাবাকে দেখিনি। বাবাও আমাকে দেখে নি। বাবার একটা ছবি আছে। ওটা দেখে বাবাকে দেখার স্বাদ মেটাই।
কী হয়েছিলো তোর বাবার?
বাবার বুকে গুলি লেগেছিলো।
গুলি লেগেছিলো? কেন?
বাবা যে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একাত্তর সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর এদেশের রাজাকার আলবদর বাহিনীর বিরুদ্ধে বাবা লড়াই করতে গিয়েছিলেন।
তারপর?
তমাল এমনিতেই শান্ত, নীরব। আরো শান্ত কণ্ঠে বলে- আমার বাবা অনেক বড়ো একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাবা অনেক যুদ্ধে অসম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর বন্ধুদের অনেকে যুদ্ধের পরে এসে মাকে এসব কথা বলেছেন। মা আমাকে বলেছেন এসব। একদিন পাকিস্তানি সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাবার বুকে গুলি লাগে এবং বাবা সেখানেই মারা যান। পিরোজপুর জেলার কচানদীর পাড়ে বাবার কবর।
আমি মা প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসে যাই। বাবার কবরে ফুল দিয়ে আসি। বাবার সিথানে একটা শিরীষ গাছ আছে। বাবার সঙ্গে যেসব মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তারা লাগিয়েছিলেন। গাছটা এখন অনেক বড়ো হয়েছে। বাবাকে নিবিড় ছায়ায় ঢেকে রাখে। আমার ধারণা- বাবা ঐ শিরীষ গাছটার চেয়েও অনেক বড়ো একজন মানুষ।
আমি, টুলু, মন্টি, গিলটু থমকে গেলাম তমালের কথায়। আর সত্যিই দেখতে পেলাম- আমাদের সবার বাবাদের ছাড়িয়ে, তমালের বাবা তাঁর সিথানের শিরীষ গাছটাকে অতিক্রম করে, ঐ নীল চূড়া স্পর্শ করতে চলেছেন।
আর আমাদের বাবারা তার পায়ের কাছে মুষিকের মতো বাদাম খুঁটছে।