মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: মনি হায়দারের লেখা- "অরু ডাক শুনেছে" Oru Dhak Shuneche
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
লেখকঃ মনি হায়দার
গল্পের নামঃ অরু ডাক শুনেছে
গো-ও-ল।
মাঠের চারপাশের হাজার খানের দর্শক চিৎকার করে উঠলো। তাদের গগণবিদারি আওয়াজে কানে তালা লাগার জোগাড়। দলের প্রত্যেকটি খেলোয়াড় অরুণকে কাঁধে তুলে নিয়ে উচ্ছ্বাস করছে। এদিকে রেফারি বারবার বাঁশি বাজিয়ে খেলা শুরু করার চেষ্টা করছেন। আর খেলা শেষ হতে মাত্র পাঁচ-সাত মিনিট বাকি। বিপক্ষ দলের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত খুবই মূল্যবান। খেলা আবার শুরু হলো। কিন্তু বিপক্ষ দল গোল দিতে পারে নি। অরুণদের দল এক-শূন্য গোলে জয় লাভ করে। অরুণ দলের অন্যদের সঙ্গে নাচতে নাচতে বাড়ি ফেরে।
বাড়ি থকে কিছুটা দূরে সবাই একসঙ্গে হাঁটছে, কথা বলছে কে কী রকম খেলেছে, কে পায়ের কাছে বল পেয়েও কোন কারণে গোল করতে পারেনি, তার কৈফিয়ৎ দিচ্ছে। দলের ক্যাপ্টেন মঈন অরুণকে ধব্যবাদ জানাচ্ছে ঠিক সময়মতো গোলটা করার জন্য। অরুণ প্রাণ খুলে হাসছে।
![]() |
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: মনি হায়দারের লেখা- "অরু ডাক শুনেছে |
বাদল প্রস্তাব করলো, চল পদ্ম পুকুরে সবাই একসঙ্গে গোসল করি।
থানার সামনে সরকারি পুকুরটাকে লক্ষ্য করেই বাদলের প্রস্তাবে সমবেত সবাই এককথায় রাজি- চল।
ঠিক এই সময়ই অরুণ আবার শুনলো। বেশ কয়েক দিন ধরে সে শুনছে। কিন্তু এই মুহূর্তে শোনাটা অনেকটা স্পষ্ট। অরুণ কান পাতলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো সহপাঠী বন্ধুদের মুখের দিকে। না, কারো কোনো ভাবান্তর নেই। সে একলাই শুনেছে। যেদিন থেকে সে শোনার এই ব্যাপারটি শুনছে, অবাক বিস্ময়ে অরুণ অনুধাবন করেছে, অনেক লোকের মধ্যে সেই কেবল শোনে, আর কেউ শোনে না। প্রথম দিকে ভয় পেলেও এখন আর পায় না। বিষয়টা ওর কাছে চমৎকার একটা খেলা। কি আশ্চর্য, কেউ কোথাও একটা শব্দ করছে- অদ্ভুত একটা মায়াবী শব্দ, শব্দটা -বাতাসের ডানায় ভর করে তীব্র গতিতে আলো ছড়াতে ছড়াতে ওকে ডাকছে, সেই শব্দটা অরুণ ছাড়া আর কেউ শুনছে না। এমন কি মাও না।
সবাই দৌড় আরম্ভ করেছে সরকারি পুকুরটার দিকে। মাঝখানে দাঁড়ানো অরুণের সঙ্গে ধাক্কা লাগে মজনুর।
কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল।
চল। অরুণ ওদের সঙ্গে দৌড়াতে আরম্ভ করে পুকুরের দিকে।
ঘরে ফিরলে মা ডাকে অরু?
মা!
খেতে আয়।
আসছি।
অরুর মা একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। অরু, অরুর মা আঞ্জুমান আরা বেগম এবং বাবা সিদ্ধেশ্বর রায়। এই তিন জনের সংসার। সিদ্ধেশ্বর রায় স্থানীয় হাই স্কুলে বাংলা পড়ান। কাজের মেয়ে আছে একজন। তাকে সবাই লীলাবতীর মা বলে ডাকে। কোনো কারণে লীলাবতীর মা অরুকে দারুণ স্নেহ করে। অরুর এক বোন আছে। থাকে জেলা শহরে জামাই বাবুর সঙ্গে। থানা সদরের নাম ভাণ্ডারিয়া। এখানে অরুদের নিজেদের বাসা। ভাণ্ডারিয়া থানা সদর থেকে মাইল পাঁচেক পশ্চিমে কচানদীর পারে অরুদের গ্রামের বাড়ি। মাঝে মধ্যে সেখানে ওরা বেড়াতে যায়। কিন্তু নিয়মিত থাকাটা হয় থানা সদরে। এখানে বিদ্যুৎ আছে।
অরু ক্লাস এইটে পড়ে। ছাত্র হিসেবে খুব ভালো নয়। আবার খারাপও নয়। পড়াশুনার চেয়ে অরুর মনোযোগ হাতুড়ি-বাটালির দিকে। যন্ত্রপাতি বানাতে কিংবা জোড়া লাগাতে সে দারুণ ওস্তাদ। এই বয়সেই ইলেকট্রিসিটি বিষয়ে সে একেবারে পণ্ডিত। বন্ধুদের কারো বাসায় এ সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে ইলেকট্রিসিটি মিস্ত্রি না ডেকে ওরা অরুকেই ডাকে।
গোল হয়ে পাটিতে বসে খাচ্ছে অরু, মা এবং বাবা। লীলাবতী বাঁ পাশে দাঁড়ানো।
অরু? সিদ্ধেশ্বর রায় ডাকেন।
বাবা?
তোর গোলে নাকি আজ প্রভাতি দল জিতেছে?
এক গ্রাস পেয়ে অরু ঘাড় নাড়ে- হ্যাঁ বাবা।
গোলে দল জিতলে তো হবে না- পড়ালেখাটাও ভালোভাবে চালানো দরকার। সিদ্ধেশ্বর রায় কথা বলেন ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে।
পড়ছি তো বাবা।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: "অতিক্রম"
ভালো করে, মনোযোগ দিয়ে পড়ছো না অরু। অন্যান্য বিষয়ে তুমি যেমন পারদর্শী, পড়ালেখার ব্যাপারে একেবারে তার উল্টো।
কাকা, আমার একটা নালিশ আছে, লীলাবতীর মা বলে।
বলো।
সন্ধ্যায় পুকুরে পানি আনতে গিয়ে দেখি অরু-
অরু অবাক চোখে তাকায় লীলাবতীর মায়ের দিকে- কী করেছি আমি?
অরু পুকুরের ঐ উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ছে, ভয়ে আমার বুক হিম হয়ে গেলো।
তুমি এতো অল্পতে ভয় পাও- অরু হাসলো। হেসে পরিস্থিতিটা হালকা করার চেষ্টা করে।
ঠিক আছে, সিদ্ধেশ্বর রায় বলেন- এভাবে আর ঐ উঁচু জায়গা থেকে লাফিয়ে পড়ো না। যে কোনো সময়ে বুকে ব্যথা পেতে পারো।
ঘাড় নাড়ে অরু আর পড়বো না বাবা।
রাতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে ও। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। মা-
বাবা পাশের ঘরে অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছেন। অরু হাসান আজিজুল হকের কিশোর উপন্যাস 'লাল ঘোড়া আমি' বইটি পড়ছিলো। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। ঘুমোতে যাবার আগে জানালা খুললো সে। জানালায় দশমীর চাঁদ ঝুলে আছে। অবাক চোখে চাঁদটা কিছুক্ষণ দেখলো সে। তারপর তাকালো এলাকার সবচেয়ে বড় বাড়িটার দিকে। বাড়িটার নাম শরণ। 'শরণ' কোনো বাড়ির নাম হতে পারে? ঐ বাড়ির ছেলে দুর্জয় ওর বন্ধু। এক ক্লাসে পড়ে।
দুর্জয়কে জিজ্ঞেস করেছিলো ও, আচ্ছা, তোদের বাড়িটার নাম 'শরণ' কেন?
জানি না।
বাবা সিদ্ধেশ্বর রায় অরুকে পরিষ্কার করে বললেন 'শরণ' মানে আশ্রয়। আমরা তো প্রকৃতপক্ষে এক একটা বাড়িতে অল্প সময়ের জন্য আশ্রয় নিয়েছি মাত্র। জীবনের ডাক আসলে চলে যাবো কোন সুদূরে, কেউ জানে না।
দুর্জয় কি এখনো পড়ছে?
দেখলো অরু, ও বাড়িতে কোনো আলো নেই। সে জানালা বন্ধ করে, লাইট অফ করে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে পড়লো। অন্ধকার সয়ে নেয়ার জন্য চোখ বুঝলো। ঠিক তখনই আবার ডাকটা শুনতে পেলো সে। আরো স্পষ্ট এবং জোরাল কণ্ঠে। অরু নিঃসন্দেহ হলো, যে কেউ ডাকুক না কেন-ডাকছে ওকেই। মজার ব্যাপার হলো, যখনই শোনে একবারই শোনে। আর প্রত্যেকবার, আগের বারের চেয়ে ডাকটা স্পষ্ট হয়। এখন যেমন সে শুনলো- অ-উ। মাঝখানের র'য়ের উচ্চারণটুকু ছিলো না। সে নিশ্চিত হলো মনে মনে ক্রমান্বয়ে সে পুরো নামটাই শুনতে পারবে। ডাক শোনার প্রতি দারুণ কৌতূহল হলো অরুর।
এই ডাকের তিন দিন কেটে গেছে। আর শোনে নি অরু। কিন্তু প্রতীক্ষা করছে ডাকটির। ওই শব্দ যেনো যাদু করেছে। প্রবল আবেগে সে প্রতীক্ষা করে- কখন আসবে ডাক। তিন দিন পর রাতে খেয়ে, যখন ঘুমুতে যাচ্ছিলো, ঠিক আবার শুনলো ডাকটি-অ-উ। সঙ্গে সঙ্গে গোলাপের গন্ধে চারদিক ভরে গেলো। অরু বিছানা থেকে নামলো। লাইট জ্বালালো। মা-বাবাকে ডাকলো। কোনো সাড়া পেলে না তাদের। দেয়াল ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে বারো মিনিট। গোলাপের গন্ধটা ক্রমশ বাড়ছে। গন্ধের একটা প্রবল স্রোত আসছে দরজার দিক থেকে। কে আসবে তার কাছে এতো রাতে গোলাপের বিপুল গন্ধ নিয়ে? সে কি দরজা খুলবে? সামান্য ভয় ভয় লাগছে। চারপাশ নীরব। মাছের বাজারে একটা রাতজাগা কুকুর ডেকে উঠলো। দরজা খুললো অরু।
না, কেউ কোথাও নেই। দরজায়, জানালায়, বারান্দায়, গাছের পাতায় পাতায় থৈ থৈ সাদা জোছনা। অবশ্য গন্ধটা সে পাচ্ছে। আগের মতো তীব্র নয়। পায়ের কাছে তাকালো অরু। কয়েকটা গোলাপের পাপড়ি পড়ে থাকতে দেখলো। দু'হাতে তুললো সে। তাজা টাটকা পাপড়ি। অরুর স্পষ্ট মনে আছে, রাতে দরজা বন্ধ করার সময়ে সে এখানে কোনো কিছু দেখে নি। তাহলে কোথেকে আসলো এই পাপড়ি? কে রেখে গেলো? ডাকটা কে দেয়? কেন ডাকে অরুকে? যে ডাকে সে কি অরুকে চেনে?
অরু দরজা বন্ধ করে, লাইট নিভিয়ে, বিছানায় গোলাপের পাপড়িগুলো নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরের দিন ক্লাসে সুভাষ স্যার বাংলা ব্যাকরণ পড়াচ্ছিলেন।
ব্যাকরণের একটি অন্যতম অংশ ভাব-সম্প্রসারণ। বিষয়- 'জন্মভূমি মায়ের মতো পবিত্র'। সুভাষ স্যার যখন গভীর মমতায়, সাবলীল উচ্চারণে, স্নেহের ঢংয়ে পড়াচ্ছিলেন, ক্লাসের সবাই তন্ময় হয়ে শুনছিলো। অনেকের সঙ্গে শুনছিলো অরুও।
সুভাষ স্যারের পড়া শুনতে শুনতে অরু তাকায় জানালার বাইরে। স্কুল ঘরের সামান্য দূরে একটা শিরীষ গাছ বাতাসে দুলছে। হঠাৎ কোথেকে একটা দোয়েল এসে বসলো। শিরীষ গাছটা আরো জোরে নড়ে উঠলো। দোয়েলটি চঞ্চল গতিতে গুচ্ছ নাচিয়ে ডেকে উঠলো। সম্ভবত আশপাশের অন্য কোনো কাছের গাছে লুকানো ওর সঙ্গীকে ডাকলো। সুভাষ স্যারের পড়া, দোয়েলের গুচ্ছ দোলানোর মধ্যে আবার শুনলো সেই ডাকটি অরু-অ-উ। এবার র'য়ের অর্ধেক শুনতে পেয়েছে। অরু তাকায় সুভাষ স্যারের দিকে। না, সুভাষ স্যার পড়িয়ে যাচ্ছেন- মাকে যেমন আমরা আপন জানি, এই দেশকেও তেমনি আমরা আপন জানি। মনে রাখবে, কখনো কখনো মায়ের চেয়েও মাতৃভূমি আপন হয়ে ওঠে।
অরু তাকায় ক্লাসের অন্যান্য ছাত্রদের মুখের দিকে। না, কারো কোনো ভাবান্তর নেই। সবাই গভীর মনোযোগের সঙ্গে স্যারের পড়া শুনছে।
আরও পড়ুনঃ A teenage story about the Liberation War Waiting
এমনকি পাশে বসা মারওয়ানও শুনতে পায়নি। ও স্যারের প্রত্যেকটি শব্দ মাছরাঙা পাখির মাছ শিকারের মতো গিলছে। কী এক অদ্ভুত, অপার্থিব বিষয়। অরু সামান্য চঞ্চল হয়ে ওঠে। অন্য কেউ কেন শুনছে না? কেন সে একা শুনছে? কয়েক দিন আগে মেজো খালার মেয়ে ঝুনা আপা পরীদের একটা গল্প বলেছিলো। ঝুনা আপা পরী বিষয়ক গল্পে বলেছিলো- পরীরা বাতাসে বাতাসে উড়ে বেড়ায়। এই সময়ে মানব সমাজের কাউকে পছন্দ হলে ওরা নিঃশব্দ রাতে তার নাম ধরে ডাকে এবং তাকে নিজেদের রাজ্য কোকাব শহরে নিয়ে যায়। তাহলে অরুকে কি পরীরা ডাকছে? পরীরা ওকে মা-বাবার কাছ থেকে অনেক দূরের কোকাব নামক এক অচিন জায়গায় নিয়ে যাবে?
অরু?
জ্বি স্যার! সুভাষ স্যারের ডাকে ফিরে তাকায়।
তুমি অন্যমনস্ক কেন?
এমনি স্যার।
বসো। আর যা বলি মন দিয়ে শোনো।
জ্বি স্যার, শুনছি-
স্কুল থেকে বাসায় এসে দেখে বড় মামা বাসায়। সঙ্গে বড় মামার ছেলে বলাই আর মেয়ে কান্তা। ওদের দেখে অরুর আনন্দ ধরে না। এদের নিয়ে সারাদিন খেললো। নদীর পাড়ে বেড়ালো। বাঁধা জাল থেকে মাকে চিংড়ি মাছ এনে দিলো।
সঙ্গে বলাই থাকছেই। কান্তা খুব ঘরকুনো মেয়ে। কোথাও যেতে চায় না। বলাইকে দারুণ লাগে অরুর। অবশ্য ক্লাস সেভেনে পড়ে বলাই। তাতে কিছু যায় আসে না। দু'জন দুজনকে তুই তোকারি করেই ডাকে। সন্ধ্যার আগে নদীর পাড়ে বেড়াতে যায় অরু আর বলাই।
বলাই? ডাকে অরু।
বল। দু'জন পাশাপাশি বসে।
তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কর।
তুই কি গভীর রাতে, কিংবা খেলার মাঠে অথবা ক্লাসে বসে পড়া শোনার সময়ে কোনো শব্দ পাস?
শব্দ? ভুরু কুঁচকে যায় বলাইয়ের কিসের শব্দ?
যেমন ধর তোকে কেউ দূর থেকে ডাকছে। কিন্তু কে ডাকছে তাকে তুই দেখতে পাচ্ছিস না। বুঝতেও পারছিস না কে ডাকছে। কিন্তু ডাকছে। আর মাজার ব্যাপার কি জানিস বলাই- তুই যখন অন্যমনস্ক ঠিক তখনই
ডাকটা শুনতে পাস।
বলাই অবাক চোখে তাকায় অরুর দিকে- তুই এ রকম শুনিস নাকি? অরু কোনো কথা বলে না। নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
রাতে টিভি দেখে, ভাত খেয়ে বলাই আর অরু ঘুমুতে যায়। বলাই শুয়ে শুয়ে ওদের স্কুলের গল্প বলে। শুনতে শুনতে দু'জন ঘুমিয়ে পড়ে। রাত বারোটার দিকে অরু হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠে। মনে হচ্ছে কে যেনো দরজার ওপাশে। আর গোলাপের গন্ধে চারপাশ মৌ মৌ করছে। বলাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অরু বিছানা ছাড়ে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে দরজার ওপাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। অরুর সামান্য ভয় লাগে। তবুও সাহস সঞ্চয় করে দরজা খোলে। কেউ কোথাও নেই। আকাশে পূর্ণিমার গোলাকার চাঁদ। সাদা জোছনায় ভাসছে চারধার। অরু মেঝেতে তাকিয়ে দেখতে পায় কারো পায়ের স্পষ্ট চিহ্ন।
একজোড়া পায়ের স্পষ্ট ছাপ, আঙ্গুলের দাগ।
কে এসেছিলো? অরু নিজেকে প্রশ্ন করে। উত্তর মেলে না। অনেকক্ষণ সে পায়ের জোড়া চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকে। পায়ের দাগ তো গোলাপের পাপড়ি নয় যে সে হাতের মুঠোয় তুলে নেবে। তবে পায়ের জোড়া চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। সে গভীর তন্ময়তায় তাকিয়ে থাকছে।
ঠিক এ সময়ে আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের ভিতর থেকে কেউ ডাকলো, একেবারে স্পষ্ট মোলায়েম মায়াভরা কণ্ঠে অ-রু উ। ডাকটা অনেকক্ষণ ঝুলে থাকলো অরু আর আকাশের মাঝখানে।
বলাই ভয়ার্ত গলায় ডাকছে। ও ছুটে আসে বলাইয়ের কাছে।
কী? ডাকছিস কেন?
ভয়ে ঘামছে বলাই। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে অরুকে। অস্বস্তির মধ্যে পড়ে অরু। কি বলবে ওকে, ভাষা খুঁজে পায় না।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের গল্প: রাত পোহালেই পনেরোই আগস্ট
কোথায় গিয়েছিলি?
পেসাব করতে। চল ঘুমাই। অরু দরজা বন্ধ করে আবার বলাইয়ের
পাশে শুয়ে পড়ে।
চার-পাঁচ দিন হলো বলাই আর কান্তা চলে গেছে। আবার একলা অরু। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে টেবিলে একটা বই দেখে সে। নাম 'স্মৃতি একাত্তর'। উল্টেপাল্টে সে বইটা দেখে। মলাটের লেখা পড়ে বুঝতে পারে- একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেসব মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হয়েছিলেন যুদ্ধের মাঠে, জীবিত সতীর্থরা স্মৃতিচারণ করেছেন তাদের নিয়ে। বইটা পড়তে আরম্ভ করলো অরু। দারুণ লাগছে ওর। একেকজন যোদ্ধা তাঁর শহীদ সতীর্থ সম্পর্কে মায়াময় সাহসী বর্ণনা দিয়েছেন, পড়ে চোখ ফেটে পানি আসে।
অর্ধেক পড়ে বিকেলে মাঠে খেলতে যায় অরু। ও খেলতে যেতে চায়নি। বইটি ওকে দারুণভাবে টানছে। কিন্তু বাবা সিদ্ধেশ্বর রায়ের কড়া নির্দেশ- বিকেলে অবশ্যই মাঠে খেলতে যেতে হবে।
খেলা শেষে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে নাস্তা খায় সে। নাস্তা শেষে ক্লাসের পড়া তৈরি করতে বসে। ক্লাসের পড়া শেষে রাতের খাবার খায় মা-বাবার সঙ্গে। তারপর কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ানো পুকুর ঘাটে। ফিরে এলো বিছানায়। আবার পড়তে আরম্ভ করলো বাংলা একাডেমী থেকে রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত রক্ত বর্ণীল স্মৃতি আল্পনার বই- 'স্মৃতি একাত্তর'। একজন যোদ্ধা, ভাণ্যারিয়া এলাকার, চেনে অরু। নাম জিয়াউদ্দিন। তিনি লিখেছেন তার এক সহযোদ্ধার মৃত্যুর মুহূর্তগুলোর কষ্ট, যন্ত্রণা, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা আর রেখে যাওয়া একমাত্র ছোট ভাইয়ের জন্য অশ্রু নদী জলে কাব্য।
সুন্দরবন এলাকায় আমরা ক্যাম্প করেছি। আমি কমান্ডার। আমার দলে প্রায় চল্লিশজন মুক্তিবাহিনী। সবাই তরুণ, চৌকস। এই দলের মধ্যে চারণ নামে একজন তরুণ যোদ্ধার কথা আমি কোনো দিন ভুলতে পারবো না। চারণ ছিলো খুব চঞ্চল প্রকৃতির। যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে করতে চারণ গান গাইতো- 'ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা...।' চারণ খুব আনন্দ পেতো যখন কোনো যুদ্ধে জয়ী হতো তখন।
এ রকম এক যুদ্ধে, সম্ভবত নভেম্বর মাস। পাকিস্তানিরা মরণ কামড় দিতে আরম্ভ করেছে। আমরাও নানা জায়গায় যুদ্ধ করছি। এক যুদ্ধে আমরা দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করছি। যোদ্ধারা ক্লান্ত। সারাদিনে পানি ছাড়া মুখে কিছুই পড়েনি। ওদিকে পাকিস্তানিরা সংখ্যায় বেশি। অবস্থা খুবই খারাপ। এ সময়ে চারণের বুকে একটা গুলি লাগে। ও চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আমি চারুর মাথা কোলে তুলে নিলাম। মৃত্যু যন্ত্রণায় ও ছটফট করছে। বুকের সাদা চামড়া লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ওদিকে দু'পাশে চলছে ভয়াবহ যুদ্ধ।
মৃত্যুপথ যাত্রী চারু আমাকে বললো- স্যার?
বলো চারু।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, স্যার!
সহযোদ্ধারা কাঁদছে। সবাই বুঝতে পারছে যে ও বাঁচবে না। কারণ গুলিটা লেগেছে বুকের ওপর।
মরে যাবো স্যার তাতে দুঃখ নেই। দুঃখ-
কথা বলো না চারু। আমি নিষেধ করালাম ওকে কথা না বলতে।
আমি যুদ্ধ করতে এসেছি, আমার ছোট ভাই, যে এখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটছে, তাঁর জন্যে আমি একটি স্বাধীন দেশ রেখে যেতে চেয়েছিলাম।
চারু, তোমার স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়িত করবো।
স্যার, আমি আমার একমাত্র ছোট ভাইটিকে দেখতে চাই। ওকে আমি খুব ভালোবাসি। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিলো চারুর। রক্ত পড়তে পড়তে ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে ও। চোখের কোণ সাদা হচ্ছে। হায়! আমারই হাতে, আমারই কোলে আমারই সহযোদ্ধা এভাবে ছটফট করে মারা যাচ্ছে। আমি কিছু করতে পারছি না।
চারু-
খুব কষ্ট হচ্ছে আমার স্যার- চারু দীর্ঘশ্বাস নেয়।
চারু?
নাক চোখ মুখ ফুলে ওঠে চারণের। শেষ মুহূর্ত উপস্থিত ওর। আমাদের বুক বেদনায় কাঁদছে।
অ-রু শেষ উচ্চারণ ছিলো আমাদের অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা চারণের কণ্ঠে। এখনো প্রায়ই আমি মুক্ত স্বাধীন বাংলার নিঃসীম আকাশে বাতাসে ঝড়ে ঝঞ্ঝায় শোকে আনন্দে বীর মুক্তিযোদ্ধা চারণের সেই অন্তিম প্রগাঢ় স্নেহের উচ্চারণ শুনতে পাই।
আরও পড়ুনঃ মনি হায়দারের লেখা মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "আজও কড়া নাড়ে"
পরে জেনেছিলাম চারণের ছোট ভাইটির নাম অরুণ। চারণ আদর
করে ডাকতো 'অরু'।
অরু সেই ডাকটি আবার শুনতে পেল, সরাসরি, স্পষ্ট।
সাত সমুদ্দর আর তের নদীর ওপার থেকে মোহনবাঁশির সুরে ডাকটি ধানসিঁড়ি নদী, মুজিবনগর, টুঙ্গিপাড়া পার হয়ে ধান-কাউনের পথ পার হয়ে ছুটে আসছে অরু-উ-উ