ছোট গল্প: জনাব টিক্কা খান। মনি হায়দার। মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
গল্পের নামঃ জনাব টিক্কা খান
ছুটছি। আমি প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটছি। চারপাশে গভীর কালো অন্ধকার। গাছপালা, আঁকাবাঁকা রাস্তা। ছোটার মধ্যেও চোখ কান সজাগ রাখতে হচ্ছে, কেউ দেখে ফেলল না তো? কিংবা দূর থেকে করতে পারে গুলি। ঠিক জায়গা মতো একটা গুলি লাগলে কম্ম সাবাড়। শরীর ক্লান্ত। দুর্বল। হামাগুড়িও দিতে পারছিলাম না। সেখানে এখন শেষ রাতে আমাকে দৌড়ে পালাতে হচ্ছে। ন'দিন আমি পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে বন্দি ছিলাম।
বড় দু'ভাই মুক্তিযুদ্ধে গেছে। যেতেই পারে। যাওয়াই উচিৎ। তারা দু'জন কলেজে পড়ে। আমি সবার ছোট। পড়ি ক্লাস এইটে। সমস্যা হলো আমাকে দেখতে বড় ভাইদের মতোই লাগে। মা বলেন, আমার শরীরের গঠন ভালো। ভালো না ছাই!
শরীরের গঠনের জন্য পাকিস্তানিরা কোনোভাবেই বিশ্বাস করল না, আমি ক্লাস এইটের ছাত্র।
![]() |
বাংলা ছোট গল্প: জনাব টিক্কা খান। |
এমনিতেই দেশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমাদের বাসা পুরনো ঢাকায়। বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। পেনশনের টাকায় বড় একটা বাড়ি কিনেছেন। আমরা কয় ভাইবোন মিলে বাবার স্নেহ ও শাসনে বড় হচ্ছি। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। এর আগে আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল, জ্বালাও পোড়াও তো ছিলই। ওইসব মিছিলে আমরা পাড়ার ছেলেরাও অংশ নিয়েছি। ভাইদের দেখতাম আরও বড় মিছিলে, পল্টনে, গুলিস্তানে যাওয়ার তাড়া।
ইতোমধ্যে নেমে আসল কালো অন্ধকার রাত, অভিশপ্ত পঁচিশে মার্চ। ঘুমিয়ে ছিলাম বাসায়। হঠাৎ, মাঝরাতে আগুন, চিৎকার, গুলির শব্দে আমাদের পুরনো ঢাকা কেঁপে উঠল। কাউকে জাগাতে হলো না। পরিস্থিতির কারণে সবাই জেগে উঠল। বাবা সবাইকে নিয়ে আলো নিভিয়ে মেঝেতে গোল হয়ে বসে রইলেন। বাসার খুব কাছেই মানুষের মরণ চিৎকার। শুনে কল্পে শুকিয়ে যাবার যোগাড়। ভয়ে ছোট্ট বুকটা আমার কাঁপছিল। সারারাত আমরা সবাই চুপচাপ বসে রইলাম। একসময় আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে মা আমাকে ঘুম থেকে তুললেন। বাবা, ভাইয়েরা আগেই ঘুম থেকে উঠে বাইরে ঘুরে এসেছেন। তাদের মুখে শুনলাম, পাকিস্তানিদের নির্মম লোমহর্ষক হত্যার কথা। সারাদিন ঘর থেকে বের হলাম না। মাত্র একটি রাতের পরে চিরকালের শান্ত মনোরম চারপাশটা পাল্টে গেল।
এভাবে কয়েক দিন কাটল। দিনের পর মাস। একদিন জানতে পারলাম মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালিরা রুখে দাঁড়িয়েছে। রাত জেগে বাবা, ভাইয়েরা, মা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছেন। তাদের সঙ্গে আমিও শুনছি। শুনছি গান, 'জয় বাংলা, বাংলার জয়...।'
কোথাও কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের যুদ্ধ আরম্ভহয়েছে। হঠাৎ এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, ভাইয়েরা বাসায় নেই। মা বাবা কিছু বলছেন না। আমার কাছে লুকিয়ে রাখতে চাইছেন। কিন্তু আমি তো ব্যাপারটা বুঝে গেছি। ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে। আমার ভালোই লাগছে। বুকের মধ্যে কেমন একটা কটকটে আনন্দ। অথচ বাবা-মাযে কী!
ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধে যাবার মাসখানেক পর, এক দুপুরে আমি, বাবা এবং মা খেতে বসেছি। দরজার কর্কশ কড়া নাড়ার শব্দ। মা-বাবার মুখে আতঙ্কের ছায়া। দু'জন দু'জনের দিকে তাকিয়ে। সময় বয়ে যাচ্ছে। আরও তীব্র শব্দে কড়া নাড়ে কেউ। বাবা অবশেষে উঠে দরজা খুললেন। কালো চকচকে পাথরের জুতো পরে, খোলা বন্দুক হাতে কয়েক জন পাকসেনা ঢুকে ঘরের মধ্যে দাঁড়াল। চারদিকে ভয়ঙ্কর চোখে তাকাল। মুহূর্তের মধ্যে ঘরের আসবাবপত্র, থালা, বাটি, গ্লাস, কলস, চেয়ার, টেবিল, বই বিছানার চাদর, বালিশ সব, সব ওলটপালট করে ফেলল। ভয়ে আমি ঝরাপাতার মতো কাঁপছি বাবার হাত ধরে।
বাবাকে জিজ্ঞেস করলো ওদের অফিসার, তোমার ছেলে দুটো কোথায়?
গ্রামে। বাবা শান্ত কণ্ঠে বললেন।
গ্রামে কেন?
বেড়াতে গেছে।
অফিসার এগিয়ে এসে বাবার মুখোমুখি দাঁড়াল-অ্যাই বুড়ো, মিথ্যা বলছ কেন?
মিথ্যা নয়। সত্যি বলছি।- কাঁপা কাঁপা গলায় বাবা কথা বলছেন, আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলাম। গত বছর অবসর নিয়েছি।
তাই নাকি?
জ্বি।
অফিসার তার লোকজনদের সঙ্গে কিসব কথা বলল। বলার পর ফিরল বাবার দিকে। লোকটার মুখে অদ্ভূত এক হাসি। সে বাবাকে বলল, শোনো, তোমার ওই ছোট ছেলেটাকে আমরা নিয়ে গেলাম।
অফিসারদের কথা শুনে আমার মনে হল আমি মরে গেছি। আমার পা দুটো হারিয়ে গেছে। আমার বুক জুড়ে পিপাসা। কেবল পিপাসা। মা চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের মধ্যে। বাবা অসহায় চোখে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছেন। অফিসারের ইশারায় তিনজন সৈন্য আমাকে আমার মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়াল অফিসার আর বাবার মাঝখানে।
তোমার যে দু'জন ছেলে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেছে, তাদের যেদিন এনে আমাদের কাছে পৌছে দিতে পারবে, সেদিন এই ছোটটাকে ফেরত পাবে। কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে অফিসার লাড্ডুর গতিতে ঘুরে দরজার দিকে হাঁটতে লাগল।
মা লোকটার সামনে দৌড়ে হাঁটু মুড়ে বসলেন, অনুনয় করে বললেন, দয়া করুন। দয়া করুন। আমরা মুসলমান। আমার রিয়াজ কলেমা পাঠ করতে পারে। দয়া করে ওকে নেবেন না।
অফিসার অনেকটা দম দেয়া মেশিন। কান নেই যেন। মায়ের কথা, আর্তনাদ লোকটার কানেই ঢুকল না। সে মাকে খুব সহজে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল। পিছনে তিন জন সৈন্য আমাকে কাগজের নৌকার মতো কাঁধে নিয়ে চলল। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। কেবল অসহায় একটি কষ্ট আমার বুকটার মধ্যে গোল্লাছুট খেলতে লাগল। গোল্লাছুটের মধ্যে ওরা আমাকে ক্যাম্পে এনে রাখল।
যেদিকে তাকাই কেবল সৈন্য, সৈন্য আর সৈন্য। কিছুক্ষণ পর আমাকে নেয়া হলো অন্য আর একটি ক্যাম্পে। ওমা! এই ক্যাম্পে আরও অনেক বন্দি। সব বন্দিই অসুস্থ, আহত, রক্তাক্ত। কেউ শুয়ে, কেউ বসে, কেউ আধশোয়া কোঁকাচ্ছে। কেউ কাঁদছে ইনিয়ে-বিনিয়ে, নাকি স্বরে। আমার মতো কয়েকটি বাচ্চাও দেখলাম। ওরা কেউ আহত নয়। বাচ্চাদের মধ্যে একজনকে পরিচিত মনে হলো। কাছে গেলাম। হ্যাঁ, পাশের পাড়ার ছেলে। ওর নাম জানি না। তবে গত বছর ঘুড়ি ওড়ানোর সময় ছেলেটি আমার ঘুড়িটা বাকাট্টা করেছিল। আমার খুব রাগ ওর ওপর। অনেক দিন ভেবেছি আমাদের পাড়ায় ওকে কখনও একা পেলে অ্যায়সা মার দেব না। কিন্তু একদিনও একা পাই নি। সবসময় কয়েক জন সঙ্গী-সাথী নিয়ে ঘোরে। ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান। আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। হেঁটে ওর পাশে বসলাম।
তোমার নাম কী?
হাসান।-ও বলল।
মুখটা শুকনো। চোখ দুটোয় কেমন মায়া।
আমি রিয়াজ।
শুকনো মুখে হাসি ফুটল হাসানের, আমি জানি।
জানো?
হ্যাঁ। ঘাড় নাড়ে হাসান।
কীভাবে?
তোমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমি প্রায়ই আমাদের নবারুণ দাবা ক্লাবে খেলতাম। তখন সে একদিন কথায় কথায় তোমার কথা বলেছিল। আমি ঘুড়ি বাকাট্টার কথা বললে সে বলেছিল, তোমার সঙ্গে আমার মিল করিয়ে দেবে।
ভাইয়ের কথায় হঠাৎ আমার চোখে পানি জমল। অনেক পানি। আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। হাসানের চোখ এড়ানো গেল না। ও ভালোভাবে আমার কাঁধে হাত রাখল, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?
চোখ মুছে আমি ধীরে ধীরে সব বললাম হাসনাকে। শুনে হাসান মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। এ সময়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
তোমাকে কেন এনেছে ওরা?
আমার বাবা সরকারি চাকুরে। সচিবালয়ে অফিস। গত সাত দিন ধরে বাসায় ফিরে আসছে না। মা কান্নাকাটি করছে। আমার কোনো বড় ভাই নেই।
তারপর?
মায়ের কান্না আমার সহ্য হচ্ছিল না। মাকে বললাম আমি বাবার অফিসে যাই। মা রাজি হলেন না। শেষে কাউকে না বলে গত পরশু রাতে
বাসা থেকে বের হলাম।
কেন?
বাবার খোঁজে...।
তারপর?
কিছুদূর আসার পর রাজাকারেরা আমাকে ধরে এখানে নিয়ে আসে। আজ তিন দিন তিন রাত আমি এখানে। - কথা বলতে বলতে হাসানের চোখে পানির ধরা নামে। কণ্ঠ আবেগে রুদ্ধ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, জানি না, মা কেমন আছে।
হাসানের কষ্ট আমার মধ্যে চলে এসেছে। চোখেও পানি। দু'জন পাশাপাশি বসে নীরবে কাঁদছি। ক্যাম্পের লোকজন নিতান্ত অবহেলায় চোখ তুলে আমাদের কান্না দেখে। কেননা এখানে কারো পক্ষে অন্যের জন্য কিছু করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে নীরব থাকাই ভালো।
বসে থাকতে থাকতে সন্ধ্যা হয়ে এল। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পে বন্দি মানুষগুলোর চোখে মুখে ভয়ানক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এক অসহ্য আর্তনাদ প্রতিটি মানুষের চোখের তারায় খেলা করছে। আমি মানুষগুলোর এই অবিশ্বাস্য অবিন্যস্ত আতঙ্কগ্রস্ত রূপ দেখে জিজ্ঞেস করি হাসানকে, ক্যাম্পের এরা এমন করছে কেন?
প্রতি সন্ধ্যার পর এখান থেকে ডেকে ডেকে নিয়ে যায় দুই চার পাঁচ জনকে।
কোথায়?
পাশের আর একটা ক্যাম্পে।
কেন?
নির্যাতন করার জন্য।
কেন?
মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঠিকানা জানতে চায় পাকিস্তানিরা। সেই কারণে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে এরা ভয়ে এমন করে। কেউ জানে না, আজ কাকে কাকে নেবে নির্যাতন ক্যাম্পে।
রিয়াজ তাকায় ক্যাম্পের অসহায় মানুষগুলোর দিকে। ওর ইচ্ছে হয়, এই মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধা হতে। রাতে রাইফেল নিয়ে বাজপাখির ক্ষীপ্রতায় পাকবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। ওদের সমূলে বিনাশ করে বাংলাকে নতুন করে সাজাতে, ভাবতে ভাবতে আমি আবার হাসানকে প্রশ্ন করি, নির্যাতনের পর আবার নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দিয়ে যায়?
না।
না।
হ্যাঁ। যারা গেছে গত তিন সন্ধ্যায় তারা কেউ ফিরে আসে নি। পাশের ক্যাম্প থেকে ভেসে আসবে মরণ চিৎকার।
হাসানের কথা শেষ হতে পারে না, ক্যাম্পের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে সাত আট জন সৈন্য। বীভৎস চেহারা একেকটার। দেখলেই ভয় লাগে। ঢুকেই রাইফেলের বাট দিয়ে পটাপট কয়েক জনকে বেদম মারল। লোকগুলোর আর্তচিৎকারে মুহূর্তের মধ্যে ক্যাম্পে কেয়ামত নেমে এল। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। সৈন্যদের মধ্যে যে নেতা সে ক্যাম্পের কয়েক জন বন্দির উপর হাতের আঙুল গুরিয়ে দেখাল এবং ওদেরকে নিয়ে আসতে বলে চলে গেল। তার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্দিষ্ট বন্দির কাঁধ, মাথা, চুল যে যেটা পারল খামচে ধরল এবং এক প্রকার জবাই করা মুরগির মতো টেনে-হেঁচড়ে আছড়ে-পাচড়ে নিয়ে গেল। যাবার সময় প্রত্যেকটি মানুষের যে কী মর্মান্তিক আকুল আর্তনাদ। আমার রক্ত চলাচল থেমে যাবার অবস্থা। হাঁটুর উপর মুখ লাগিয়ে চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে বসে থাকি। বন্দিদের নিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর অন্য কয়েক জন সৈন্য আসে খাবার নিয়ে। সবাইকে একটি করে শুকনো ঠাণ্ডা পাতলা পোড়া রুটি আর এক টুকরা গুড় দিয়ে গেল। দুপর থেকে রাত অবধি ক্ষুধার প্রসঙ্গ মনেই আসেনি আমার। রুটি আর গুড় দেখে মনে হলো দুপুরে খাবার সঙ্গে ইলিশ ভাজা, গোল আলুর ভর্তা আর ডাল দিয়ে খেতে বসেছিলাম।
কেবল প্রথম লোকমা মুখে দিয়েছি, এমন সময়ে দরজায় কড়া নাড়ার কড়া শব্দ। ইলিশ ভাজি রেখে এখন কিনা পোড়া পাতলা রুটির সঙ্গে এক টুকরো গুড়। কী আর করা, পেটে ক্ষুধা। কামড় দিলাম রুটিতে। কিন্তু এত শক্ত যে কামড়ে ছেঁড়া যায় না। দাঁতে দাঁতে চেপে প্রথম এক টুকরো খেলাম। রুটি চিবানোর চেয়ে রাবারের টায়ার চিবানো অনেক সহজ। ধীরে ধীরে আমি আর হাসান খেলাম। তারপরে ময়লা মগে এক মগ পানি। মগ নাকের কাছে নিতেই কেমন একটা বোটকা গন্ধ নাকে লাগল। সারাদিন পর পেটের সামান্য খাবার গন্ধের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। পানিটা না খেয়ে ফেলে দিলাম। হাসান করুণ চোখে হাসল।
আমি সারাদিনের অসহ্য মানসিক পীড়নে ক্লান্ত এবং দুর্বল। ক্যাম্পে ঘাসের উপর পাতলা চাটাই বিছানো। শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যে দুটি চোখে ঘুম নেমে আসে। হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎ পাশের ক্যাম্পে বন্দি মানুষদের উপর নির্যাতনের করুণ চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল।
উঠে বসলাম। হাসান বোবা, চোখ খোলা।
শুয়ে পড়ো। আমাকে বলল ও।
চিৎকার। আরও অনেক চিৎকার শুনতে পাবে।
কতক্ষণ?
সারারাত।
সারারাত? আমার ভয়ানক পানির তৃষ্ণা। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঢোক গিলতে পারছি না।
কী হয়েছে?-হাসান জানতে চায়।
তৃষ্ণা.....পানি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
ফাটলে ফাটবে। কিন্তু পানি পাবে সকালে।
না, সকালে ওরা কিছু দেয় না খেতে। দুপুরে দেবে।
কী দেবে?
হয়তো আটার রুটি। নয় তো আধা প্লেট সেদ্ধ ভাত।
তখন পানি পাবে, হাসানের কথা শুনে মনটা বিষিয়ে উঠল। এখন খারাপ লাগছে। কেন পানিটা ফেলে দিলাম? রেখে দিলে এখন নাক চেপে খেয়ে ফেলতে পারতাম। তাকিয়ে দেখি, পানির মগটা দূরে পড়ে আছে। উঠে গেলাম মগটার কাছে। তুললাম। তলানিতে সামান্য পানি জমে আছে। মুখে ঢাললাম। জিহ্বা চাটলাম। গলাটা সামান্য ভিজল। আশ্চর্য এবার সামান্যতম গন্ধ পেলাম না। আমার অবস্থা দেখে দাঁত বের করে হাসে হাসান। আমারও হাসি পেল। আবার আগের জায়গায় শুয়ে পড়লাম। কিন্তু চোখে ঘুম আসছে না। পাশের ক্যাম্প থেকে করুণ আর্তনাদ, অসহায় চিৎকার, পাকিস্তানিদের অট্টহাসি, নির্যাতন না করার আকুল আবেদন ভেসে আসছে। কান পেতে শোনা যায় না। এরা কেউ কারও ভাই, কারও বাবা...।
আর ভাবতে পারছি না, বাবাকে মনে পড়ে গেল। অবস্থার কারণে আমি মনে মনে বললাম, এই ভালো। ওরা বাবাকে আনে নি। আমাকে এনেছে। বাবা হার্টের রোগী। এইসব একদম সহ্য করতে পারতেন না। বাবা এখন কী করছেন? মা? মা কি কাঁদছেন? তারা কি ঘুমুচ্ছেন? আমি যে এখানে, বাবা-মা কি জানেন? আমাকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য কি কোনো চেষ্টা করছেন? সত্যি সত্যি কি আমার দু'ভাইয়ের বিনিময়ে আমাকে মুক্ত করবেন মা-বাবা? না, আমি চাই না, আমার ভাইয়েরা এই নরপশুদের হাতের মুঠোয় আসুক। তার চেয়ে আমি, আমার যা হয় হোক, আমার ভাইদের বিনিময়ে আমি আমার মুক্তি চাই না। চাই না, কখনও না। কখনও না।
আবার চিৎকার কান্না আর্তনাদ-আর তো সহ্য হচ্ছে না। অন্যরা দেখছি দিব্যি নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। বোধহয় কয়েক দিন গেলে আমারও এসব সহ্য হয়ে যাবে। হাসান নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
আচ্ছা, আমাদের কুকুরটা কোথায়? ওই ব্যাটা একবার এসে আমার খবরটা নিতে তো পারত। মাস ছয়েক আগে কুকুরটা বলা নেই, কওয়া নেই আমাদের বাড়ি ঢুকল।
সরাইলের কুকুর।-বাবা দেখেইে বললেন।
মা বললেন, তাড়াও। এখনই তাড়াও।
বাবা হাসেন, সরাইলের কুকুর খুব ভালো, বাড়ি পাহারা দেয় নিখুঁতভাবে।
আমি কুকুরটার কাছে গেলাম। একটুও নড়ল না। চুপচাপ শুয়ে থাকল, কাছে গিয়ে দেখলাম, কুকুরটার লেজ অর্ধেক কাটা। রক্ত পড়ছে।
বাবা, কুকুরটার লেজ কাটা। রক্ত পড়ছে।
তাই নাকি?
বাবা নেমে আসলেন বারান্দা থেকে। মাকে বললেন পানি গরম করতে। আমাকে নির্দেশ দিলেন আলমারি থেকে তুলা আর আয়োডিন নিয়ে আসার জন্য। বাবা খুব যত্নের সঙ্গে গরম পানিতে আয়োডিন মিশিয়ে লেজটা ধুলেন। আশ্চর্য কুকুরটাও চুপচাপ থেকে বাবাকে সাহায্য করল ওর যত্ন নিতে।
মা কিন্তু শুরু থেকেই কুকুর রাখার বিরুদ্ধে। বাবা বলেন, একটা কুকুর
বাড়িতে থাকা ভালো।
কিসের ভালো, শুনি?
সারারাত পাহারা দেয়, তাছাড়া কুকুরের মতো প্রভুভক্ত প্রাণী দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই।
আমিও বাবার পক্ষে, আমার একটা সঙ্গী জুটবে।
খেঁকিয়ে ওঠেন মা, কুকুর হবে তোর সঙ্গী? যেমন বাপ তেমন ছেলে।
মা আপনমনে বকতে লাগলেন, কুকুর কখন কোথায় মুখ দেবে, ঠিক আছে? সারা দুনিয়ার ময়লা নোংরা ঘেঁটে আসবে, এখানে-সেখানে হাগা-মুতা করবে- এসব আমার একদম অসহ্য।
মা, আমি ওকে সব শিখিয়ে দেব।
ওরে আমার কুত্তার শিক্ষক, ভাগ এখান থেকে। -মা রান্নার চামচ নিয়ে আমাকে মারতে আসেন।
আমি এক দৌড়ে গেটের বাইরে। বাবা হাসেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে দেখি কুকুর সাহেব আমাদের এক চিলতে উঠোনের কোনোটার বরইগাছের নিচে আলগোছে রাখা কয়েকটি ইটের উপর শরীর রেখে ঘাড় বাঁকিয়ে নিশ্চিতে ঘুমুচ্ছে।
বুঝলি, বাবা আমাকে বলেন, ওটাই ওর বাড়ি, আজ থেকে।
কুকুরটা সেই থেকে আমাদের বাড়ি থাকে। তবে আমি অনেক খেলা শিখিয়েছি। ওয়ান বললে কুকুরটা একটা পা তুলে তিন পায়ে দাঁড়ায়। টু বললে দুই পা তোলার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। পড়ে যায়। মা-বাবা-ভাইয়েরা হাসেন। আমি একা একা ক্রিকেট খেললে, ব্যাটের মারে বল দূরে গেলে ও দৌড়ে গিয়ে মুখে করে নিয়ে আসে। আমার ইচ্ছা, ওকে আমি ক্রিকেটার বানাব। মানে ও মুখ দিয়ে বল করবে, আমি ব্যাটে খেলব।
বছর খানেক হয়ে গেল। ওর একটা নাম আমরা দিতে পারি নি। বাবা, ভাই দু'জন এক একটা নাম বলেন, আমরা সবাই নাকচ করে দেই।
আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে মা হাসেন।
আমার স্কুলে যাওয়ার সময় কুকুর সাহেব আমার সঙ্গে সঙ্গে গেট পর্যন্ত যায়। আমি গেটের মধ্যে ঢুকলে সে লেজ নাড়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তারপর সোজা বাড়িতে চলে আসে। খেলার মাঠে যাই, সেখানেও সে আছে। বন্ধু-বান্ধবরা আমাকে নানা কথা বলে টিটকারি দেয়। আমি পাত্তা দেই না। সেই কুকুরটা কোথায়? আমাদের বাড়িতে যখন পাকিস্তানিরা ঢুকল তখন ও কোথায় ছিল? কোনো সাড়া শব্দ পাই নি। ব্যাটাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা মেরে ফেলল নাকি? আমার মনে এটাই বদ্ধমূল হলো, কুকুরটাকে পাকিস্তানিরা কোনো এক ফাঁকে হঠাৎ মেরে ফেলেছে।
আপন মনে কুকুরের চিন্তায় ডুবেছিলাম বলে পাশের ক্যাম্পের চিৎকার শুনতে ভুলে ছিলাম। কুকুরটার চিন্তা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আবার, আবার পাশের ক্যাম্পের ভিতরে পাকিস্তানিদের নির্যাতনে বাঙালিদের আর্তনাদ ভেসে আসছে। আহ্, সহ্য করা যাচ্ছে না। কী করব, হঠাৎ দুই হাতে দুই কান চেপে ধরলাম এবং বাঁশের তৈরি চাটাইয়ে শুয়ে পড়লাম কুকুর কুণ্ডলী দিয়ে। এবং একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে কারও ধাক্কায় যখন ঘুম ভাঙল, তখন পর্দার ফাঁক চিরে ভিতরে নরম উষ্ণ রোদ ঢুকেছে। চোখ খুলে চারদিক তাকালাম। ঘাড়ে শক্ত একটা হাতের চাপ অনুভব করছি। ফিরে তাকালাম। তাকাতেই চক্ষু আমার চঞ্চল, বুঝতে পারছিলাম না কী করব! আমার ঘাড়ে যে হাত রেখেছে সে আমাদের পাড়ার পার্থ ভাই। পার্থ ভাই আমার দুই ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সকাল-বিকাল আমাদের বাসায় আড্ডা জমাতেন। পার্থ ভাই আমাকে ক্রিকেট শেখান। খুব ভালো ব্যাট করেন। আমি কতদিন তার বল কুড়িয়ে দিয়েছি। সেই পার্থ ভাই পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে। কাঁধে রাইফেল। শরীরে পাকিস্তানি আর্মিদের পোশাক। মুখটা রুক্ষ।
পার্থ ভাই? আমি রিয়াজ।
আমাদের দিকে অন্যান্য পাক আর্মি, তাদের সঙ্গে কয়েক জন বাঙালি সৈনিকও আছে সবাই তাকিয়ে আছে। পার্থ ভাইয়ের হাত আমার ঘাড়ে, মাংসের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে।
আক্কাস! পার্থ ভাই জিজ্ঞেস করছে আর একজন সঙ্গীকে, ওর দুই
ভাই মুক্তিবাহিনীতে গেছে না?
হ্যাঁ।
সঙ্গে সঙ্গে পার্থ ভাই আমার দুই গালে দুটো করে চারটে থাপ্পর মারলেন। ক্ষুধার্ত ক্লান্ত শরীর, মাথার মধ্যে মগজ বোধ হয় নড়ে গেল।
আমি মাটিতে শুয়ে পড়লাম আবার।
পার্থ ভাই আমাকে ওই অবস্থায় আরও দুটো লাথি মারলেন। মুখে অকথ্য গালি। আমার দুই ভাইকে যাচ্ছেতাই বললেন এবং সঙ্গীদের নিয়ে চলে গেলেন।
আমি কী করব? আমার দু'চোখ ফেটে আবার কান্না নামল। কতক্ষণ শুয়ে শুয়ে কাঁদলাম জানি না, কারণ আমি এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আবার দুপুরে খাবারের সময় আমাকে ডেকে তোলা হলো। বাথরুমে যেতে চাইলাম। আমাকে একজন পাকিস্তানি সৈন্য পাহারা দিয়ে নিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে। চারদিকে মলমূত্র। এসব দেখে আমার বাথরুমের ইচ্ছে মরে গেল। আবার ফিরে এলাম ক্যাম্পে। আবার একটা রুটি, একটি বাটিতে সামান্য ডাল দিল একজন সৈন্য। পেটে ক্ষুধা। ভয়ানক ক্ষুধা। সুতরাং কোনোদিকে না তাকিয়ে খেয়ে নিলাম রবারের শুকনো রুটি আর ডাল। খুব ভালো লাগল ডাল আর রুটি। খাওয়ার পর পানি খেলাম। গতকালের মতো পানিটা ফেলে দেই নি। গন্ধ পাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছু করার নেই। খাওয়ার পর আবার শরীর ভেঙে ঘুম আসল। এত ঘুম কেনো আমার দু'চোখে? বাসায় তো আমি খুবই কম ঘুমাতাম। অথচ এখন কী হচ্ছে আমার? কেন এত ঘুম পাচ্ছে? আবার ঘুমিয়ে গেলাম। সন্ধ্যার পরে আবারও কারও ধাক্কায় ঘুম ভাঙল। আলো মাথার উপর। আবারও পার্থ ভাই। আমাকে কি নির্যাতন ক্যাম্পে নিয়ে যাবে? দুই হাতে পা জড়িয়ে ধরলাম, পার্থ ভাই, আমাকে...।
পার্থ ভাই আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন। চুপিচুপি বললেন, কথা বলিস না, একটাও না। আমি যা বলব, কেবল শুনবি। এই ক্যাম্পে এখন আমার লোক। আমরা ছদ্মবেশে ওদের মধ্যে ঢুকেছি। আমরা মুক্তিযোদ্ধা। তোর দু'ভাই আমাদের সঙ্গে। আমরা একসঙ্গেই আছি। তোকে এখন বাইরে নিয়ে ছেড়ে দেব- এখান থেকে বাসা আট নয় মাইল দূরে। তোর হাতে কিছু কাগজ দেবো, ঠিকানা অনুসারে কাগজগুলো পৌছে দিবি। আমরা ওদের ছাড়বো না। সকালে তোর সঙ্গে যা করেছি সেটা অভিনয়। আমাকে ক্ষমা করে দিস ভাই। ওটা না করলে পাকিস্তানিরা সন্দেহ করতো, বুঝলি।
আমার ভেতরে এক লক্ষ পায়রা ডেকে উঠল- বাক বাকুম বাক বাকুম। পার্থ ভাই আমাকে পাশে বসালেন।
আমি বললাম, পার্থ ভাই, দরকার হলে আপনি আরও মারুন। আমি কিছু বলব না। কিছু মনে করব না।
আচ্ছা, পরে কথা বলব দেশ স্বাধীন করে। আর হ্যাঁ, তুইও কিন্তু এখন
থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা। আয়, তোকে জঙ্গল পার করে রাস্তায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
আমরা দু'জনে গভীর বনে হাঁটছি। আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছেন পার্থ ভাই। অনেকক্ষণ হাঁটার পর আমরা রাস্তার দেখা পেলাম।
পার্থ ভাই আমাকে আবার আদর করলেন। কপালে চুমু খেলেন- যা-ভাই-
আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমি মুক্ত হলাম। এবং ছুটতে আরম্ভকরলাম। ছুটছি, কেবল ছুটছি। অন্ধকার। আমার কানে ভেসে আসছে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে বাঙালিদের আর্ত চিৎকার। আহা। কষ্ট! যন্ত্রণা। আর্তনাদ। আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। দৌড়াচ্ছি। কাঁদছি। ছুটছি আর শপথ নিচ্ছি- বাসায় পৌঁছে অবশ্যই যুদ্ধে যাব। যুদ্ধে যাব। যুদ্ধের ডাক আমি শুনছি-
হঠাৎ দেখলাম রাস্তার ওই মাথায়, অনেক আলো, লুকালাম রাস্তার ধারে গাছের আড়ালে। সারাটা রাত রাস্তাটা পাহারা দিল ওরা। আমিও থাকলাম গাছে। সকালে দেখলাম ওরা নেই। আমিও গাছ থেকে নেমে আবার ছুটতে লাগলাম। ছুটতে ছুটতে আমি আমাকে প্রস্তুত করছি, আমার বড় দু'ভাই আসিক আর কামাল ভাইয়ের মতো অবশ্যই যুদ্ধে যাব। মাকে, বাবাকে কিছুই বলব না। বললে আমাকে যেতে দেবে না।
ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত অবসন্ন আমি, বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। গেট খোলা। ক্লান্ত শরীর টেনে টেনে ভিতরে ঢোকার মুখে অবাক চোখে দেখতে পেলাম-আমাদের কুকুরটা দাঁড়িয়ে- তার অর্ধ কাটা লেজ নাড়ছে। আর আমরা অনেক দিনেও যে কুকুরটার নাম দিতে পারছিলাম না, সেই কুকুরের গলায় ঝুলছে একটি নামের প্ল্যাকার্ড। সাদা মোটা কাগজে লেখা নাম নিয়ে কুকুরটি লেজ নাড়ছে। হাতের লেখা দেখে বুঝলাম, লেখাটা বাবার।
কালো কালিতে চমৎকার করে লেখা- টিক্কা খান।