'বাংলাদেশের জাতীয় শহীদ মিনার' সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের গল্প। লিখেছেন মনি হায়দার

মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
লেখকঃ মনি হায়দার 

গল্পের নামঃ শহীদ মিনার



পূর্ব দিক থেকে এসে বাম দিকে বেকে সোজা দক্ষিণে বয়ে গেছে কচা নদী। নদীর অথৈ বুকের গভীরে রুপালি ইলিশ হেসে খেলে বেড়ায়। এদিকে ওদিকে ছড়ানো ছিটানো পাল তোলা নৌকা কোন সূদুরের পানে। নদীটির উভয় পাশে ছবির মতো অসংখ্য সবুজে সবুজে আচ্ছাদিত গ্রাম। জাম, জামরুল, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা আরো অনেক গাছ-গাছালি মিলে মিশে আত্মীয়ের মতো জড়িয়ে আছে।

গ্রামের নাম কুসুমপুর। কুসুমপুর কচা নদীর তীরে অনেক গ্রামের মধ্যে একটি। প্রতিদিন সকালে এ গ্রামের মানুষ পাখ-পাখালীর কলগানে ঘুম থেকে ওঠে। তারপর সারাদিনের কাজের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের জীবনে একটি দুঃখের দিন আছে। দুঃখের দিন নয় সুখের, আনন্দের, বিজয়ের আর সংগ্রামেরও দিন এটি।

বাংলাদেশের শহীদ মিনার সম্পর্কে ছোট গল্প।
আমাদের জাতীয় শহীদ মিনার সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প। লিখেছেন মনি হায়দার। 

অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা, আর রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সেই স্বাধীনতার অজস্র স্রোতের একটি ধারা এখানেও রচিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের এক কালো রাতে। হানাদার বাহিনীর ঘুমন্ত মানুষের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণে কত যে মায়ের বুক খালি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ভয়, হতাশায় শহরের সমস্ত মানুষ নিজের প্রাণ নিয়ে গ্রামের দিকে দলে দলে ছুটছিল। যেন মহা কারবালা। কারো দিকে কারো খেয়াল নেই। মা তার বুকের সন্তানকে পথের মাঝে রেখে ছুটে চলেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। চারদিকে ভয়ংকর যুদ্ধ। এরি মধ্যে বাংলার আনাচে-কানাচে এখানে-সেখানে প্রবল আত্মবলে দেশ ও জাতির শৃংখল মুক্তির জন্য শত শত জোয়ান মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হায়নাদের উপর।

কুসুমপুরের রহিম মোল্লার তিন ছেলেমেয়ে। বড় ছেলে রাশেদ ঢাকার কলেজে পড়ে। তারপরের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে পাশের গ্রামে। ছোট ছেলে ফাহিম স্কুলে পড়ে। ফাহিমের কয়েকজন বন্ধু কলিম, রতন, আর ময়না। ময়না মেয়ে। ওরা সবাই একই গাঁয়ের। কুসুমপুরে ওদের বাড়ি।

কুসুমপুরের আকাশ, বাতাস, কাশবন, মেঠোপথ, সবুজ ঘাস, দেবদারু গাছ, সুপারী, নারকেল আর কেয়া সবার সাথে ওদের নিত্যদিনের জানাশোনা। বাগানের পেয়ারা গাছের পাকা পেয়ারা, জাম্বুরা গাছের জাম্বুরা সবই ওদের আছে। ওরা সারাদিন ঘুরে বেড়ায় বনের ছায়ায়-ছায়ায় মায়ায়-মায়ায়।

হঠাৎ একদিন ওদের এই আনন্দের ঝরনা ধারায় নেমে আসে বাধা। শহর থেকে দলে দলে লোক এসে আশ্রয় নেয় গ্রামে, গ্রামের বনজঙ্গলে। এদিকে গ্রামের সবার মুখে উদ্বেগ, বিষাদের কালো ছায়া। সব সময় দুশ্চিন্তা। কান যেন কিসের শব্দ শোনার আশায় উৎকণ্ঠিত থাকে। ও পাড়ার হবি মাঝির বড় ছেলে ঢাকায় থাকে। বাড়িতে খবর এসেছে হবি মাঝির ছেলে মিন্টু মৃত্যু অবস্থায় ঢাকার রাজপথের ড্রেনে পড়ে আছে। সারা বাড়িতে হাহাকার আর কান্নার রোল। হবি মাঝির ছোট ছেলে আমু ওদের সাথে একই স্কুলে পড়ে। বড় ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুতে ছোট ভাইটির সেকি সকরুণ রোদন!

ফাহিম গভীর দুঃখে বাড়ি ফেরে। ওর ভাইয়া রাশেদ ঢাকায়। না জানি তার ভাগ্যে কী ঘটছে। ওর ছোট্ট বুকটা ব্যথায় গুমরে গুমরে কাঁদে। কেন এমন হয়? আহা মানুষ কেন মানুষকে হত্যা করে? ওর চোখে পানি। বাড়ি এসে দেখে আব্বা আম্মার অবস্থাও ওর মতো। রহিম মাঝি ফাহিমকে বুকের মাঝে আকড়ে ধরে। রাশেদ কেন ফিরে আসছে না? কত মানুষতো পালিয়ে আসে। ও কেন আসছে না? গ্রামে মুক্তিবাহিনী তৈরি হচ্ছে। শত শত, হাজার হাজার নারীপুরুষ, শিশু-যুবক সবাই তৈরি হচ্ছে যুদ্ধে যাবার জন্য। একদিন ফাহিমেরাও ওদের দলে ভীড়ে যায়। সেখানে প্রথমে ওদের ট্রেনিং দেয়া হয়।

রাশেদ ভাইয়ার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আব্বা ঢাকা যেতে চাচ্ছে কিন্তু আম্মা কান্নাকাটি করছে। তাই যাচ্ছে না। যেখানে মানুষ প্রাণের মায়ার জন্য ঢাকা থেকে গ্রামে ছুটে আসছে সেখানে কোন ভরসায় সে ঢাকা যাবে।

গভীর রাতে ফাহিম ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে যায়।

ফাহিম? ফাহিম? এ যে ভাইয়ার ডাক।

তরাক করে আলো জ্বেলে ফাহিম দরজা খুলে সামনে কালো কাপড়ের আলখেল্লায় আচ্ছাদিত কয়েকটি মূর্তি দেখে আর্তচিৎকার দেয়।

ফাহিম আমি তোর রাশেদ ভাইয়া বলে সে মুখোশ খুলে ফেলে।

ফাহিম রাশেদের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ভাইয়া কোথায় ছিলে তুমি?

আমি সব সময় তোদের কাছেই থাকি। তোদের সবাইকে দেখি। আমাকে তোরা দেখিস না।

কেমন করে?

আস্তে কথা বলো। শুনতে পাবে কেউ। আম্মা-আব্বা বাড়ির অন্যান্য সবাই এর মধ্যে হাজির।

আম্মা-আব্বার চোখে পানি। রাশেদ মায়ের চোখের পানি নিজের হাতে মুছিয়ে দেয়।

কেন কাঁদছ মা? মা, তুমি কাঁদলে আমরা শক্তি পাব কোথায়? এই দেখ আমার মতো কত মায়ের সন্তান রাতের আঁধারকে মায়ের আঁচল মনে করে গ্রামবাংলার পথে ঘাটে শত্রু হানাদারদের খুঁজে ফিরছে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন মা? হাঁটু ভেঙ্গে জানু পেতে ওরা সবাই আব্বা-আম্মার সামনে বসে।

দুহাতে ওদের তুলে ওঠান। আম্মা আঁচল দিয়ে, আব্বা হাত দিয়ে ওদের পরশ বুলিয়ে দেয়।

মা এক সময় বলে- তোরা খেয়েছিস কোথায়? থাকিস কোথায়?

আব্বা বলে আগে ওদের কিছু দাও।

না-না আপনি ব্যস্ত হবেন না মা। আপনি আমাদের সামনে বসুন। আপনাকে দেখি। কতদিন মাকে দেখি না। আপনি রাশেদের মা, আমাদের মা।

কী নাম বাবা তোমার?

ওর নাম শহীদ, এর আমজাদ, আর ও আনোয়ার, পরিচয় করিয়ে দেয় রাশেদ। ওরা সবাই আমার ক্লাসের ছাত্র। মা আজ আমরা কলম ছেড়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছি।

কিন্তু পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন? তোরা তো কোনো অন্যায় করিস নি।

আমাদের কথাও তো তাই। পালাচ্ছি এই জন্য যে হানাদারেরা জানতে

যেন না পারে আমরা মুক্তিবাহনী গড়ে তুলেছি। বিশেষ করে মাঝ পাড়ার মোতালেব চাচা যেন কিচ্ছুটি জানতে না পারে। তাহলে সর্বনাশ হবে। আমরা চলি। রাতে এসে দেখা করবো। ফাহিম কই?

ফাহিম এগিয়ে যায় ভাইয়ার কাছে- এই তো আমি। আমি খুব খুশি হয়েছি তুই মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং দিচ্ছিস এজন্য। তোর আর তোর বন্ধুদের কাজে লাগবে আমাদের। প্রস্তুত থাকিস।

ফাহিম মহা খুশি। ওর বন্ধুরাও। ওরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারবে। ওর বন্ধু কলিম, রতন, ময়নাও খুশি। ওরা সারা পাড়াময় ঘুরে বেড়ায়। কোথাও কোনো নতুন লোক এলে খবর নেয়। রাতে রাশেদ ভাইয়ার কাছে সব জানায়। একটা নতুন পুলক অনুভব করে ওরা। চারদিকে সাজ-সাজ সব। তার মধ্যে যেন কিসের অশুভ বার্তা।

সেদিন মোতালেব চাচা এলো ওদের বাসায়। এই মোতালেব চাচার সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে ভাইয়ারা। সে আব্বার সাথে গল্প করছিল। ফাহিম পাশে যেয়ে বসে থাকে। মোতালেব চাচা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক গাল দিল। এমনকি আব্বাকে বলল- মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে। গ্রামে নাকি একটা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সে নাকি তার চেয়ারম্যান। ওর আব্বাকে শান্তি কমিটির সদস্য হতে বলেছিল। সে কিছু বলেনি। মোতালেব আরো বলেছে রাশেদকে শান্তি কমিটির কাজে লাগাবে ঢাকা থেকে এলে। কিন্তু সেতো জানে না রাশেদ কোথায়? ফাহিম মনে মনে বলে- দাঁড়াও মজাটা টের পাবে, ভাইয়াদের বলে নেই।

মোতালেব চাচা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের একটা তালিকা পাঠিয়েছে হানাদারদের কাছে। আর একটা প্রস্তুত করছে। রাশেদ শান্তি কমিটিতে না থাকলে তার নামও দেবে বলে ওর আব্বাকে শাসিয়ে গেছে।

তারপরের দিন রাতে কারা যেন মোতালেব চাচার বাড়িতে বোমা মেরে বাড়িটা উড়িয়ে দিয়েছে। সে তার নিচে চাপা পরে মারা গেছে। সারাটা গ্রামে খুব উত্তেজনা। এখানে রাজাকার ধরে মুক্তিযোদ্ধারা পিঠাচ্ছে, মারছে। আবার অন্য কোথাও মুক্তিবাহিনী হানাদারের হাতে মারা পড়ছে। দূরেবহু দূরে- আকাশে কুণ্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়া দেখা যায়।

কয়েকদিন আগে কচা নদী দিয়ে শত্রুদের কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজ চলে যেতে দেখেছে। এর মধ্যে খবর আসে হানাদার বাহিনী কুসুমপুরে আসছে। তারা খবর পেয়েছে কুসুমপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা।

রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে জলপাই রঙের অনেকগুলো গাড়ি এসে থামলো কুসুমপুরের প্রাথমিক স্কুলে। অনেক সৈন্য নামলো। আস্তানা গাড়লো স্কুলে। ক্লাস বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামের লোকজন ভয়ে যেদিকে পারলো পালালো।

কিন্তু রহমান মৌলভি, সোনাগাজী, আলীমুদ্দিন এরা তো পালালো না বরং হানাদারদের সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য উঠেপড়ে লাগলো। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি বাড়ি যেয়ে হানাদাররা বলে এসেছে সাতদিনের মধ্যে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। তানাহলে বাড়ি-ঘর ধ্বংস করে দেবে।

ফাহিমদের বাড়ি এসেছিল হানাদাররা। ওদের সাথে রহমান মৌলভী, সোনাগাজী। ওরা করিম মোল্লার জমিতে কাজ করে খায়। আজ এসেছে হানাদারদের সাথে শাসাতে। ফাহিমের আব্বাকে হানাদারদের ক্যাপটেন রহিম খান বলে- বলো তোমার ছেলে রাশেদ কোথায়?

আমি জানি না। ও তো ঢাকায়। ঢাকায়- আমি জানি না- মুখ ভেংচিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে রহমান মৌলভী। আমরা জানিনা বুঝি, না? স্যার এ লোক মিথ্যা বলছে। ওর ছেলে রাশেদ কুসুমপুরেই আছে। সে মুক্তিদের ট্রেনিং দিচ্ছে। এই বুড়ো দেখেছো এটা কী? ক্যাপটেন রমিজ তার পিস্তল দেখায়। দেখেছি। ভয়ে ভয়ে বলে রহিম মোল্লা। আগামী তিন দিনের মধ্যে রাশেদকে আমাদের হাতে তুলে না দিলে তোমাকে গুলি করে বুঝতে পারছ-হাহা করে হেসে উঠলো সে।

তার হাসিতে যোগ দেয় রহমান, সোনাগাজী। গ্রামে রাশেদ আসে। সাথে ওর দলের লোকজন নিয়ে আসে। উশকো খুশকো মাথার চুল। কাঁধে রাইফেল, স্টেনগান। মুখে দুর্জয় বিজয়ের দীপ্ত প্রত্যয়। আব্বা কালকে আপনি আর আম্মা মামার বাড়ি যাবেন।

ফাহিমের আব্বা এবং আম্মা রাতে চলে যায় ওর মামার বাড়ি। সেই রাতে রহমান মৌলভীকে কারা যেন পথের উপর মেরে ফেলেছে। রাতে যখন একা একা হানাদারদের শিবির থেকে ফিরছিল তখন রাশেদের দল ওকে হত্যা করে। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে হানাদাররা। তারা গ্রামের অনেক নিরীহ গ্রামবাসীর ঘর জ্বালিয়ে দেয়। অনেককে গুলি করে হত্যা করে।

ফাহিমকে রাশেদ আব্বার সাথে মামার বাড়ি পাঠায় নি। ফাহিম ময়নাদের বাড়ি থাকে। রহমান মারা যাওয়ার পর হানাদারেরা এসে রহিম

মোল্লাকে না পেয়ে ওদের ঘরে আগুন দেয়। বিরাট ঘরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বাড়ির কুকুরটাকে গুলি করে মেরে ফেলে।

ফাহিম রতন আর ময়না হানাদারদের ডাব, বেল পেড়ে দিয়ে খাতির গড়ে তুলেছে। রাশেদ বলেছে তাই। হানাদারদের সাথে ওদের জানাশোনা। ফাহিমরা মুরগি এনে দেয়। মাছ এনে দেয়। ওদের গোপন খবর রাশেদকে দেয়।

কয়েকদিন রাশেদ ওদের ট্রেনিং দেয়। এক গামলা মুড়ির ভিতর দুটো টাইম বোমা থাকে। ওরা তাই নিয়ে হানাদারদের ঘাঁটিতে রেখে চলে আসবে। টাইম বোমা ঠিক মতো ফাটলে সবাই মারা যাবে। কুসুমপুরের মাটি থেকে হানাদারদের ঘাঁটি ধ্বংস করে সেখানে স্বাধীন বাংলার সবুজ-সোনালি পতাকা উড়াবে

ফাহিম না জানলেও রাশেদ তো জানে এ কাজটি কত ঝুঁকিপূর্ণ। যদি ফাহিমের কোনো অঘটন ঘটে তাহলে কী জবাব দেবে ও মা বাবার কাছে। কিন্তু পাঠাতে হবে ফাহিমকেই।

সেদিন ছিল পনেরোই ডিসেম্বর। বিকালে ফাহিম আর ময়নাকে রাশেদ পাঠায় হানাদার বাহিনীর শিবিরে। এক গামলায় ভরা মুড়ি। তার মধ্যে সাজানো দুটি টাইম বোমা। ময়নার হাতে পানির জগ। ওরা দুজনে এগিয়ে যায়। হানাদারেরা বিকেলের নাস্তা নিয়ে ব্যস্ত। এ সময় ওদের মুড়ি নিয়ে আসতে দেখে খুশি হলো। ক্যাপটেন রমিজ মুড়ি খেতে শুরু করল। ময়না পানির জগটা নামিয়ে রাখে। ফাহিমের বুক ধরফর করতে থাকে। ভাইয়া বলেছে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বোমা ফাটবে। আর কত মিনিট বাকি। বোমা ফাটার আগেই যদি ওরা দেখে ফেলে? তাহলে? ফাহিমের বুকটা শুকিয়ে যায়। এরমধ্যে আরো কয়েকজনে মুড়ি খেতে থাকে। ফাহিম বলে, আপনারা খান। আমরা বাইরে দাঁড়াই। ময়নার হাত ধরে ওরা বাইরে এসেই দৌড় দেয়। হঠাৎ ওদের দৌড়াতে দেখে সন্দেহ হয় এক হানাদারের। সে রাইফেলটা নিয়ে তড়িৎ গতিতে বাইরে আসে। এমন সময় আকাশ ফাটিয়ে থমকে বিস্ফোরিত হলো বোমা দুটো। সমস্ত হানাদার চাপা পড়ে বোমার তলায়। বাইরের হানাদার মুহূর্তমাত্র ইতস্ততঃ না করে ওদের উপর গুলি ছোড়ে। ফাহিম ও ময়না 'ভাইয়া' বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রাশেদরা এতক্ষণ ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়েছিল।

বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে হানাদারদের ঘাঁটি ঘিরে ফেলে।

হঠাৎ ওরা দেখে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একজন হানাদার রাইফেল হাতে পাগলের মতো ঘুরছে। গুলি করে ওকে মেরে ফেলে রাশেদের দল। ওরা মুক্ত কুসুমপুরের জন্য স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দেয়।

গ্রামবাসীরাও বিজয় উৎসবে যোগ দিতে ঝোঁপ জঙ্গল থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসতে থাকে। ওদেরই একটা দল পথের মাঝে ফাহিম ও ময়নার লাশ দেখতে পেয়ে কাঁধে করে নিয়ে আসে।

রাশেদ, শহীদ কান্নায় ভেঙে না পড়ে সমবেত গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বলে- এই দুই অসম সাহসী কুসুমপুরের কুসুম সন্তানের বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করে।

এবার গ্রামবাসীরা একসঙ্গে শোকে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

তারপর তারা সিদ্ধান্ত নেয় ওদের মৃত্যুস্থলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে। ফাহিম ময়নার মৃত্যুর পরদিন অর্থাৎ ষোলই ডিসেম্বর বাংলাদেশ হানাদারদের কবলমুক্ত হয়। কুসুমপুরবাসীরা প্রতিবছর অশ্রুপূর্ণ নয়নে ফাহিম-ময়নার জন্য নির্মিত শহীদ মিনারে ফুল দেয়।

এমনি করেই ওরা প্রতিবছর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা স্মরণ করে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url