মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: ডানপিটে। মনি হায়দার


মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প 
লেখকঃ মনি হায়দার 

গল্পের নামঃ ডানপিটে



মা?

মা ফিরে তাকান- কী?

এখন তো কতো রাত হয়েছে। বাবা ফিরে আসছে না কেন? মা হাসেন, মিষ্টি হাসি। জোনাক জ্বলা হাসি। হাতে তাঁর একটা বই। জানালা খোলা। দোতলা বাড়ি। একেবারে শাদা। আকাশে রূপালী চাঁদ। হেসে হেসে ভেসে যায়। বাড়িটার সামনেই বিশাল ঝিল। ঝিলে স্বচ্ছ জল টলমল করে। সেখানে ছেলে মাঝে মাঝে মাছ ধরতে যায় ছিপ নিয়ে। মা ভাবনায় পড়েন। কোথায় যে গেল ছেলেটা। এই ছেলেটাকে নিয়ে মায়ের বড়ো ভাবনা। চঞ্চল, ডানপিঠে। কারো শাসন বারণ মানে না। কালো দুটি ডাগর চোখ। প্রগাঢ় মায়ার শান্ত ছায়া সবসময় খেলা করে ওর চোখের তারায়। ঝাকড়া চুল মাথায়। মা কখনো কখনো ভাবেন- ছেলেটি কী নজরুল হবে?

তাঁর এই ভাবনার জন্য বাবা প্রায়ই অনুযোগ করেন- তুমি আমার চেয়েও রাসেলকে বেশি ভালোবাসো।

মা হাসেন।

মুক্তিযুদ্ধের ছোট গল্প "ডানপিটে"
মনি হায়দারের লেখা কিশোর গল্প "ডানপিটে"

তাঁর সেই সারা বাংলা জুড়ানো কোমল ধবল হাসি। মনে হয় বাংলাদেশ কথা কয়- ভালোবাসবো না? বাসবোইতো। ও আমার

শান্তনা। ও আমার আশ্রয়।

তাই নাকি? বাবা তাঁর পাইপে তামাক ভরেন। চোখের মোটা ফ্রেমের কালো চশমাটা নামিয়ে রাখেন টেবিলে। বসেন মায়ের কাছে। সারা শরীরে ক্লান্তির প্রজাপতি ডানা মেলে দিয়েছে। তাঁর কতো কাজ! সমগ্র দেশ চেয়ে আছে তার দিকে। চারদিকে অসহায় দরিদ্র মানুষ। সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে স্বদেশ। কোটি মানুষের সীমাহীন অভিযোগ। জনতার কাতার থেকে তাঁর আগমন। জনতাকে সে ভুলতে পারছেন না। গ্রামে গঞ্জে লক্ষ কোটি জনতা তাঁর দিকে চেয়ে আছে। এক দণ্ড বসে থাকার অবসর নেই। সে কারণে প্রায়ই বাসায় আসা হয় না। সমগ্র দেশটাই জননী। সবাই তাঁর আপন মানুষ। নিজের মানুষ। প্রায়শই ঘরের খবর রাখতে পারেন না।

হ্যাঁ- মা বলেন। তুমিতো বাইরে পরে থাকে। বাইরে তোমার ঘর। এ ঘর তোমার পর। তুমি যখন কাছে থাকো না- আমি কেমন করে সময় কাটাই? ওই রাসেল সারাটাদিন আমাকে আলো ছায়ার মতো ঘিরে থাকে। হাসে, কাঁদে, কথা বলে, আমার সময় কেটে যায়। ও আমার সুরের বাঁশী।

হো হো হো করে হেসে ওঠেন বাবা। বিকট হাসি। হাসির শব্দে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ। আকাশ বাতাস নদী জল। বলেন- ওর জন্মটাই স্বার্থক।

স্বার্থক না- কচু। মায়ের কণ্ঠে খানিকটা অভিমান। ওর জন্মটাই যেন একটা উত্তাপ্ত অভ্যুত্থান। সারাটা বছরে তোমার ঠিকানা ঝুঁজে পেলাম না। একা থাকলাম বন্দি হয়ে বাড়িতে। গেটে স্বশস্ত্র শাস্ত্রী। কে ছিলো আমার দুঃখ বেদনা আনন্দ হাসি আর কষ্টের সাথী? ওই রাসেল। ও সারাটা দিন আমাকে জড়িয়ে থাকতো। তোমার কথা হাজার বার জিজ্ঞেস করতো।

আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: কোয়াক পাখির ডাক। লেখক মনি হায়দার 

তাহলে রাসেল তোমাকেই নয় আমাকেও ভালোবাসে?

হ্যাঁ, বাসে। কোন সন্তানই তার বাবা মাকে ভালো না বেসে পারে না।

রাসেলের বড়ো আরো দুই ভাই আছে। দু'জনেই বিয়ে করেছে। ভাবীদের সঙ্গে ওর নিবিড় সম্পর্ক। দুই ভাবীর মাঝখানে ও যেন একটা কলা গাছের ভেলা। কখনো বড়ো ভাবী ডাকে তো ছোট ভাবী কান ধরে

টেনে নিয়ে যায়।

ভাবী ব্যথা লাগছে তো?

লাগুক।

মাকে বলে দেবো কিন্তু উহ্-উ-উ- ব্যাথায় ককিয়ে ওঠে।

ভাবী ছেড়ে দেন।

রাসেল দৌড়ে বাইরে গিয়ে ফড়িং নাচন জুড়ি দিয়ে তাল তমালের মতো হেসে ওঠে- ব্যথা পাইনি। তোমাকে মিথ্যা বলেছি।

ওরে দুষ্টু ভাবী ওকে ধরতে যান।

মা! বলে দৌড়ে ছুটে পালায় রাসেল। ভাবী পিছু পিছু। ধানমণ্ডি লেকের পাশের দোতলা সাদা বাড়িটা নিষ্পাপ হাসির ফোয়ারায় হেসে ওঠে।

মা দূর থেকে দেখেন আর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসেন। বড়ো ভাবী জানালায় দাঁড়িয়ে হাত ইশারায় ওকে কাছে ডাকেন। রাসেল বড়ো ভাবীর কাছে ছুটে আসে। তার কাছে আশ্রয় নেয়। এভাবেই কেটে যায় দুরুন্ত সময়। এ বাড়ির প্রাণ রাসেল।

রাসেল কোথায়? সারা বাড়িতে খোঁজ পড়ে যায়। বেকায়দা অবস্থায় পড়ে যায় পাহারাদারেরা। কোথায় গেল ছেলেটি তাদের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে? সবাই যখন খুঁজে খুঁজে হয়রান- তখন রাসেল ছিপ আর মাছ নিয়ে হাজির।

মা বুকে জড়িয়ে ধরেন- কোথায় ছিলি?

ঝিলের কাছে।

কেন?

মাছ ধরতে গিয়েছিলাম।

আর কখনো আমাকে না বলে কোথাও যাবি না। মাথার চুলে আদর করেন।

আচ্ছা।

বাবার সঙ্গে রাসেলের প্রায়ই অভিমানের পালা চলে। বাবা হয়তো অবসরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিশাল বাংলাদেশ দেখছেন এ সময়ে ও এসে ডাকে- বাবা?

কে? ও রাসেল। কী?

চলো।

কোথায়?

বাইরে।

কেন?

বেড়াতে।

বাবা মাথায় হাত বুলান। আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরেন। হাসেন। বলেন- আজ আমার কাজ আছে। আরেক দিন নিয়ে যাবো।

না, আজ এক্ষুণি যাবে আমার সঙ্গে। জানো বাবা প্রায়ই আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি রিকসায় কিংবা হেঁটে বাবা মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যায়। আমার খুব যেতে ইচ্ছে করে। চলো- রাসেল হাত ধরে টানে।

বাবা বোঝাতে পারেন না আর কিছুক্ষণ পরই তাকে জরুরি জনসভায় যেতে হবে। অপেক্ষা করছে জনতা। জনতার নেতা হয়ে তো ছেলের হাত ধরে ঘরে বসে থাকা যায় না। তিনি চলে যান। অভিমানে রাসেলের চোখ ফেটে জল আসে। মা সান্তনা দেন। কোন শান্তনা বাধা মানে না। ও মনে মনে ভাবে বাবার সঙ্গে কথা বলবে না।

আরও পড়ুনঃ General Knowledge about Oxford University

অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে রাসেল। বাবা বাসায় ফিরে আসেন আরো অনেক রাতে। ক্লান্ত শরীরে শুয়ে শুয়ে মাকে জিজ্ঞেস করেন- রাসেল কি ঘুমুচ্ছে?

হ্যাঁ।

আমার কথা কিছু বলেছে?

কি বলবে? মায়ের কণ্ঠে একটু অভিমানের ছোঁয়া। বাবা হাসেন।

রাগ করো না রাসেলের মা। কালকে উঠে রাসেলকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাবো। রাসেলের ঘুমন্ত মুখটাকে দেখেন। কি পবিত্র এক ফালি রূপালী চাঁদ। স্বচ্ছ আলোর বিন্দু কনা হয়ে জ্বলে রাসেলের মুখ। বাবা মুখে হাত বুলান। পাইপে ফিল্টার ভরেন। জানালা দিয়ে দেখেন রূপালী স্বদেশের মুখ। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত শেষে আসবে আর একটি সকাল।

কিন্তু সে সকাল আর আসে না। মাঝরাতের নিস্তদ্ধতা কেড়ে নেয় ঝাঁক ঝাঁক বুলেট। কেড়ে নেয় মা বাবা ভাইবোন, ভাবীকে। সবার সঙ্গে রাসেল নামের সেই দুরন্ত ডানপিটে নিষ্পাপ প্রজাপতি রক্তাক্ত আল্পনা হয়ে মুখ থুবরে পড়ে আছে। কেঁদে ওঠে ঘাস, পাতা, আকাশ, নদী আর বাংলার ধুসর মাটি। কাঁদো বাংলাদেশ।

আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: বর্ণমালার মিছিল। লেখক মনি হায়দার

রাসেলের কবরে এখন ফোটে প্রতিদিন লাল কৃষ্ণচূড়া। বৃষ্টির জল ফুলের মুঠি মুঠি পাপড়ি বয়ে নিয়ে যায়- পদ্মা, মেঘনা, আর যমুনায়। এভাবেই গ্রাম থেকে গ্রমান্তরে পৌঁছে যাবে রাসেলের কবরে ফোটা লাল কৃষ্ণচূড়া। ঘুম ভাঙবে মানুষের। ওরা আবার জেগে উঠবে দুরন্ত, বাধা না মানা সেই কৈশোর ডানপিটে ছেলেটির মতো। যার সমাধি এখন কেবল সবুজ ঘাস আর ফুলে ফুলে ঢাকা।


সবশেষেঃ 

প্রিয় পাঠক, আপনাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমার ওয়েবসাইটের লেখা ক্রমান্বয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পাঠকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, আর এই কাজটির একমাত্র ঐকান্তিক ভালোবাসা হচ্ছে আপনাদের। 

প্রিয় পাঠকগণ, এই ওয়েবসাইটের অধিকাংশ লেখাই অন্যান্য লেখকদের, আমরা শুধুমাত্র বার্তা বাহক। আমরা অভিজ্ঞ লেখকদের লেখাগুলোকে আমাদের ওয়েবসাইট শুধুমাত্র একটি মাধ্যম হিসেবে আপনাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।

কাজেই আপনাদের যদি এই আর্টিকেলটি পড়ে ভালো লেগে থাকে তাহলে উক্ত লেখকের হার্ডকপি বইটি বিভিন্ন লাইব্রেরী, বাজার কিংবা নির্দিষ্ট প্রকাশনী হতে ক্রয় করে পড়ার জন্য অনুরোধ করছি। কেননা লেখাগুলো লিখেছেন যিনি, সম্মাননার প্রাপ্যও তিনি। আর যদি বই কেনার সামর্থ্য না থাকে তাহলে আমাদের ওয়েবসাইট থেকে ফ্রীতে পড়ুন এবং পাশাপাশি আপনার মতো অন্যান্যদের মাঝে শেয়ার করে পড়ার সুযোগ করে দিন। ধন্যবাদ।। 

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url