মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: কোয়াক পাখির ডাক। লেখক মনি হায়দার


মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প 

লেখকঃ মনি হায়দার 

গল্পের নামঃ কোয়াক পাখির ডাক



কোয়াক-কোয়াক-কোয়াক-

নিশুতি রাতের স্তব্ধতা ভেঙে ভেসে আসে দূরের কোয়াক পাখির ডাক। রাতের আকাশ তারায় ভরা। নীল এবং তার মাঝে সাদা পালকের মেঘ, হাসের মতো আকাশ গাঙে সাঁতার কাটে। ঘুমিয়ে গেছে সারা গ্রাম। ও পাড়ার গভীর জংগল থেকে শোনা যায় শিয়ালের ডাক। গাছের পাতারা অল্প অল্প নড়ছে বাতাসে। আমির আলী এগিয়ে যাচ্ছে একা।

উদোম শরীর। মাথার চুল পরিপটি করে আঁচড়ানো ওর প্রিয় অভ্যাস। পকেটে একটা চিরুনি সবসময় থাকে। পাঁচ-দশ মিনিট পর পর চিরুনি বের করে চুল আঁচড়াবে। কোঁকড়ানো-ফোলানো-ফাঁপানো চুল। বন্ধুরা ওর চুলের দিকে অবাক চেয়ে থাকে। প্রশংসা করে। ভালো লাগে আমির আলীকে।

মেধাবী ছাত্র আমির আলী। বোথলা হাই স্কুলে নাইনে পড়ে। ওর রোল নম্বর এক। সুন্দর স্বাস্থ্য। নাদুস-নুদুস। রাজপুত্র রাজপুত্র মনে হয়।

মুক্তিযুদ্ধের গল্প কোয়াক পাখির ডাক লেখক মনি হায়দার
ছোটদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের গল্প "কোয়াক পাখির ডাক"

মাঝেমধ্যে ওর মা আদর করে ডালিমকুমার বলে ডাকে। তিন ভাই বোনের মধ্যে আমির আলী বড়। মেজো বোন দোলা। শাওন ছোট ভাই। বড় ভাইয়ের মতোই স্বাস্থ্য। আবার ডাকে নিশুতি রাতের কোয়াক পাখি -কোয়াক-কোয়াক-কোয়াক। বিলের পানিতে শাপলা ফুল হাসে চাঁদের সাথে। আউশ ধানের পাতায় বাতাস হেলেদুলে নেচে বেড়ায়। বিলের পানিতে মৃদু ঢেউ জাগে।

এগিয়ে যায় আমির আলী। সামনে বিল। গলা সমান পানি। বিলের পানিতে শ্যওলা ভাসে শাপলা হাসে। বাতাস কাঁপে। মায়ের নাকের নখ যেভাবে বাতাসে দোলে সেভাবে দুলছে শাপলা ফুল।

কোয়াক-কোয়াক-কোয়াক। পাখির ডাক বাতাসে ভেসে ভেসে বোথলা গ্রামের প্রতিটি ঘরের বদ্ধ দরজা-জানালায় আঘাত করে। কেউ শোনে না কষাঘাত। আমির আলীর মা শাওনকে বুকে নিয়ে পাশ ফিরে শোয়।

আমির আলী। ও আমির আলী। মা ডাকেন।

কী মা?

ভাইয়াসহ আসাদ, মিলন, নান্না, দেলোয়ার, মফিজ কাউকে দেখা যায় না। মা সবসময় চোখে চোখে রাখেন। দাদী তো পারলে ওকে খুচরো আধুলি-সিঁকির মতো আঁচলের খোটে বেঁধে রাখতে পারলে বাঁচে। তা কি আর পারে! সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ঘরের বাইরে চলে আসে।

একটা দারুণ মজা হয়েছে এখন। শাওন বাইরে, খালের পাড়ে, এখানে সেখানে গেলে এখন আর দোলাপা পিছু ধরতে আসে না। মনে হয় না দোলাপার মতো একটা ঝগড়াটে মেয়ে আছে ঘরে। সবসময় ঘরের ভেতর থাকে। বাইরে একদম বের হয় না মা। মনটা খারাপ ওর। এ কেমন ধরার? ভাইয়াটা থাকে দুলু ভাইয়ের সঙ্গে। ও একা হয়ে গ্যাছে।

অমন ষাঁড়ের মতো চিল্লাস কেন? মা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন। ঘরে আয়, তোর মোটা গলা আজকে চিকন বানাবো।

দূর, মনটা আবার খারাপ হলো শাওনের। কথাটা জিজ্ঞেস করা হলো না আপাকে।

আমির আলীর কেবল মনে পড়ে মায়ের কালো মুখ। ভেবে পায় না-কেমন করে মায়ের ম্লান মুখটাকে হাসি আনন্দে ভরিয়ে দেবে। এমন কি বলতে পারে ও? কিছুই বুঝতে পারছে না। বাবার লেখা একটা চিঠি যদি দিতে পারতো মায়ের হাতে, তাহলেই মায়ের মুখে সাত আসমানের চাঁদের ঝলক নেমে আসতো।

চার মাস বাবার কোনো খোঁজ খবর নেই। বাবা কখনো এমন করে নি। প্রতি মাসে তিন চারটে চিঠি দিয়েই থাকেন। সে সবে থাকে কতো রকমের খবর আর উপদেশ। অনেক স্নেহ আর মমতার কথা। ও বাবার চিঠির উত্তর লেখে ঝটপট তিন চার লাইনে। অথচ মা হেরিকেন জ্বালিয়ে রাত জেগে জেগে বাবাকে চিঠি লেখেন। অনেক বড় সে চিঠি। কী যে মা লেখেন বুঝতে পারে না আমির আলী। তবে এটা ভালোভাবেই বুঝতে পারে, ছেলেমেয়ে সম্পর্কে মিষ্টি অভিযোগ পাঠাচ্ছেন বাবার কাছে। তো সেই বাবা এখন কোন একটা চিঠিও পাঠায় না মাসে মাসে। চারমাসে অন্ততঃ আটটি চিঠি পাওয়ার কথা। তাছাড়া বাবা প্রতি দু'মাস পরপর বাড়ি আসেন। সবার জন্য নতুন জামা কাপড় আনেন। মা এবং দাদীর জন্য শাড়ি, জায়নামাজ, তসবিহ ইত্যাদি আরো কত কি? আমির আলীর জন্য আলাদা কিছু আনবেনই বাবা। শাওন গাল ফুলায়। দোলা আড়চোখে তাকায়। মা বাবা দাদী হাসেন। বাবার বড় অহঙ্কার তাঁর ছেলে ক্লাসে ফার্স্ট বয়।

আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: "অতিক্রম"

বাড়ি এসে বাবা সারাদিন ওকে নিয়ে কাটান। জীবনে বড় হতে হলে অনেক পরিশ্রম করতে হয়- বাবা বলেন। আমির আলী তন্ময় হয়ে শোনে আর ভেতরে ভেতরে ইউক্যালিপ্টাসের মতো এক ইচ্ছের বৃক্ষ জন্ম নেয়।

বাবা?

কী?

তোমার সঙ্গে এবার কিন্তু যাবো আমি।

কোথায় যাবি?

শহরে।

কেন?

সেখানে থেকে পড়াশোনা করবো।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

আমির আলী শুনেছে-শহরের লেখাপড়ার বেশ মজা। গ্রামের মতো ভাঙা স্কুল, চেয়ার, টেবিল নয়। সেখানে অনেক কিছু দেখা যায়। শহরে থেকে লেখাপড়া করতে খুব ইচ্ছে ওর।

বাবা মৃদু হাসেন, না বাবা আমির আলী, এখন না।

এখন না?কবে তাহলে? ওর চোখ কপালে।

নেবো তোকে শহরে। তবে আরো পরে। আরো বড় হ। তারপর নেবো। তাছাড়া তুই চলে গেলে তোর মা, দাদী, ছোট-ভাইবোনদের দেখবে কে? শাওন আরো একটু বড় হোক, তারপরই নিয়ে যাবে।

কী আর বলতে আমির আলী। বুকের ভেতর আশার খঞ্জনা পাখিটি চুপ করে থাকে। বাবা বুঝতে পারেন আমির আলীর মন খারাপ হয়েছে।

মাথায় হাত রাখেন- দূর বোকা! এতে রাগ করতে নেই। এবার শহরে গিয়ে তোর দু'ভায়ের জন্য একটা বল পাঠাবো।

সব ভুলে যায় আমির আলী। আনন্দে চোখ দু'টো চিক্‌চিক্ করে ওঠে-

সত্যি পাঠাবে?

বাবা মাথা নাড়েন- পাঠাবো।

কথা রেখেছিলেন বাবা। বাড়ি থেকে যেয়েই একটা সুন্দর বল পাঠিয়েছিলেন। বলটা নিয়ে দু'ভাই রাতদিন মাঠে পড়ে থাকতো। মা, দাদী

ডাকাডাকি করলেও ঘরে আসতো না। পঙ্গপালের মতো গ্রামের ছেলেরা লেগে থাকতো পিছনে। মাঝখানে বাধ সাধলো পাকহানাদার। সেই বাবার কোনো খোঁজ নেই। নেই একটা চিঠিও। কী যে সুনসান কষ্ট। লাল নীল সব কষ্টেরা এসে বুকের ভেতর মৌমাছির বাসা বাঁধে। চোখ ফেটে পানি আসে। যদি একটা মেশিন পেতো যার বোতামে চাপ দিলেই বাবার লেখা ঝকমকে একটা চিঠি বেরিয়ে আসবে। চিঠিটা নিয়ে দৌড়ে মায়ের কাছে আসবে।

মা, মা।

কী হয়েছে? অতো চেঁচাচ্ছিস কেন? উঠোন কুড়োতে-কুড়োতে মা ওর কাছে আসেন।

চিঠি।

চিঠি। কার চিঠি। কই দেখি?

কার আবার! বাবার!

আগে বলবিতো আমাকে? মায়ের মুখে বর্ণালী হাসি। ঘামে ভরা মুখটা আঁচলে মুছে হাত বাড়ান-কই, দে আমাকে।

এই নাও। আমির আলী হাত বাড়িযে মাকে চিঠিটা দেয়।

পড়তে যেয়েই মা দেখেন- চোখে ভালো দেখতে পান না।

দোলা? এই দোলা?

মা দোলাকে ডাকলেন। দোলা মায়ের শাড়ি পরার চেষ্টা করছে। পারছে না। শাড়িটা শরীরে এলোমেলোভাবে পেঁচিয়ে মায়ের কাছে আসে- কী মা?

যা তো দোলা আমার চশমাটা নিয়ে আয়। কী যে হয়েছে আজকাল চশমা ছাড়া কোনো লেখাই পড়তে পারি না। দোলা দৌড়ে যায়। মা আজ আর দোলাকে বকলেন না তাঁর শাড়ি পরবার জন্য। অন্য সময় হলে ঠিকই বকতেন। মা এখন বাবার চিঠি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। দাদী লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুকঠুক করে আসেন। ঠোঁট দুটো পান খেয়ে একেবারে

লাল করে ফেলেছেন।

তোর বাবার চিঠি এসেছে?

হ্যাঁ দাদী। জবাব দেয় আমির আলী।

বুড়ির কালো মুখের রং পাল্টে যায়। ঘনঘন দাঁতহীন মাড়ি নাড়েন। খুশি হলে দাদী এ রকম করেন। জোরে জোড়ে পড়। আমি শুনি। কবে বাড়ি আসবে? আমার কথা কী লিখেছে? ভালো আছে তো?

আমির আলীর বুকটা গনগনে আগুনের এক লাল কৃষ্ণচূড়ার রঙ ধারণ করে। চোখের কোণে আবার পানি জমে। কোথায় আমাদের বাবা? কেমন আছে বাবা? বেঁচে আছেন তো? প্রতিদিন শত শত লাশ ভেসে যায় কচা নদীর স্রোতে! ঐ স্রোতের সঙ্গে কী বাবার লাশও আছে? মানুষের কাছে শুনেছে কোনো লাশ পানিতে ভাসতে থাকলে তা ভাসতে ভাসতে নিজের ঘাটে এসে লাগে একদিন না একদিন। বাবাও কী এরকম এসেছিলেন? গভীর রাতে কাউকে না পেয়ে বাবার লাশ কী অভিমানে চলে গ্যাছে।

আরও পড়ুনঃ A teenage story about the Liberation War Waiting

বাবা তুমি জানো তোমার জন্য মা রাত জেগে সবাইকে লুকিয়ে কাঁদেন। এখন শ্রাবণ মাস। মা পিঠে বানান না। তুমি খৈ, নারকেল খেজুরের গুড় ভালোবাসো মা সব মাচায় উঠিয়ে রেখেছেন। তুমি এলে মা পিঠে বানাবেন। খৈ ভাজবেন। আমরাও তোমার অপেক্ষায় আছি। দাদী দিন রাত তসবিহ নিয়ে দরজায় বসে থাকেন। দাদী সবার আগে খেতে চান- তুমি দুই হাতে দুটো বড় ব্যাগ নিয়ে দ্রুত পা ফেলে ফেলে আসছো।

বাবা তুমি না দাদীকে খুউব মানো, ভালোবাসো। সম্মান করো। তোমার কানে কী তোমার মায়ের কান্নাও পৌঁছে না? তুমি না দোলাকে ছোট মা বলে ডাকো? এখন দোলা ঘরের বাইরে যেতে পারে না। এতসব ঘটনা ঘটে যাবার পরও বাবা তুমি কেন ফিরে আসছো না?

কচা নদী দিয়ে প্রতিদিন অনেক লঞ্চ যায়- সবাই অপেক্ষায় থাকে। যে

কোনো লঞ্চে তুমি আসতে পারো।

দোলা, শাওন বারান্দায় বসে বাজি ধরে। দেখিস আপা, এই লঞ্চে

বাবা আসবেন।

দোলা বলে আসবেন না।

যদি আসেন?

আমার জন্য বাবা যা যা আনবেন সব তোকে দিয়ে দেবো।

দিবি তো?

মাথা নাড়ায় দোলা- দেবো।

ঠিক আছে দাদীকে সাক্ষী রাখ।

আচ্ছা।

দু'জনে মিলে দাদীকে সাক্ষী রাখে। লঞ্চ আসে। লঞ্চ যায়। বাবা

আসেন না। শাওন, দোলার মুখ মলিন হয়। দাদীর হাতের তসবিহ দানা দ্রুতগতি পায়। মায়ের মুখের গাম্ভীর্য আরো বাড়ে।

আমির আলি?

কে? ফিরে তাকায় ও।

ঝোপের আড়ালে দুলুভাই। দৌড়ে যায় কাছে। দুলুভাই গোপনে গ্রামের যুব-কিশোরদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। হালকা পাতলা মানুষটি। ট্যারা চোখ। নাকের নিচে কালো কুচকুচে এক গোছা গোঁফ। চঞ্চল খুব। তাঁর দলে যোগ দিতে চেয়েছে। দুলুভাই নেয়নি। মেধাবী ছেলে আমির আলী। দেখতে রাজকুমার। এ গ্রামের সবাই ভালোবাসে। ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে। বড় হলে গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে। মান রাখবে দেশের। স্বাধীনতার যুদ্ধ মানেই মৃত্যু। কখন কোথায় কীভাবে মৃত্যু আসবে কেউ জানে না। হানাদার পাকবাহিনী এবং তার এদেশীয় দালাল আল-বদর, রাজাকার, আল শামস, জামাতে ইসলামীর খুনীরা চারদিকে চিনে-জোঁকের মতো কিলবিল করছে।

দুলুভাই?

বলো।

আমাকে আপনাদের দলে নেন। ওই শুয়োরের বাচ্চাদের জন্য আমরা বাবার চিঠি পাই না। বাবা কোথায় কেমন আছে তাও জানি না। মা, দাদী সবাই কাঁদেন। ঘরে টাকা পয়সা নেই। ওদেরকে এখনই ঠেকানো দরকার, নইলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।

কোনো কথা বলেন না দুলুভাই।

শাওন, দোলা ওরাও কাঁদে। দোলা ঘর থেকে ভয়ে বের হয় না। কেঁদে ফেলে আমির আলী।

আমির আলী- ডাকেন দুলুভাই। তোকে এখন আমাদের খুবই প্রয়োজন।

সত্যি বলছেন?

হ্যাঁ, তোর সঙ্গে জয়নাল পড়তো, ও আমাদের সাথে। জয়নালই তোর কথা বলেছে। তুই নাকি কোয়াক পাখির ডাক ডাকতে পারিস?

পারি।

অনেকদিন এ ডাক ও ডাকেনি। মনেই ছিলো না। আমির আলী

কোয়াক পাখির মতো অবিকল নকল করে ডাকতে পারে। কত জনকে ও এ পাখির ডাক শুনিয়ে অবাক করেছে। কোয়াক, কোয়াক, কোয়াক।

চল তাহলে।

চলেন দুলুভাই।

কোথায়?

আরে চল না আমার সঙ্গে।

চলেন।

দুলুভাইয়ের পিছনে পিছনে হাঁটে আমির আলী। মন খারাপ। বুঝতে পারছে না কোয়াক পাখির ডাকের সঙ্গে স্বাধীনতার যুদ্ধের কী সম্পর্ক? স্কুলে পাক-হানাদার এবং রাজাকার আস্তানা গেড়েছে। গ্রামের অনেক মানুষ ঘরের বাইরে যায় না। পথে-ঘাটে মানুষজন নেই বললেই চলে। খেলাধুলা করা হয় না অনেকদিন স্কুলের মাঠে। আমির আলী নিতে চায় চরম প্রতিশোধ। চরম প্রতিশোধ। কারো বাবাকে আটকে রাখার কিংবা চিঠি লিখতে না দেয়ার জন্য হানাদারদের উচিৎ শিক্ষা দিতে চায়। দোলাকে ঘরের বাইরে, গ্রামের শ্যামল বিজন প্রান্তরে নামিয়ে আনা দরকার। কী আশ্চর্য আমাদের মাঠ। স্কুলের মাঠ। অথচ কোনো অধিকার নেই। সব ঐ কুত্তারা কেড়ে নিয়েছে।

তুই সাঁতার কাটতে পারিস? হাঁটতে হাঁটতে দুলুভাই জিজ্ঞেস করেন।

পারি। মাথা নাড়ে আমির আলী।

তাহলেই হবে।

কী?

কেল্লাফতে।

দুলুভাই ওকে আরো ভেতরে নিয়ে যায়। চারদিকে ঘন গাছপালা। ভেতরে ছোট্ট ছোট্ট একটা তাঁবু। এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো কয়েক জন লোক। কাউকে চেনে। কাউকে চেনে না। আশপাশের গ্রামের মানুষ। কারো কাঁধে রাইফেল। কয়েকটি বন্দুক ঠেস দেয়া গাছের সঙ্গে। জয়নাল বসে আধশক্ত নারকেলের শাঁস খাচ্ছে।

তুই এসেছিস? জয়নাল ছুটে আসে। খুব ভালো হবে। হাসে আমির আলী। দুলুভাই ডাকেন। শুকনো মাটির ওপর পা ছড়িয়ে বসে সবাই। কেমন যেনো লাগে। দুলুভাই বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অনেক

অস্ত্র। আমাদের তেমন কিছু নেই। কয়েকটা বন্দুক আর রাইফেল ছাড়া।

ওদেরকে কাবু করতে হবে কৌশলে, বুঝলি?

বুঝলাম। আমির আলীর পাশে জয়নাল। শাঁস খাচ্ছে, ওকেও দিয়েছে।

দুলুভাই আবার বলেন আমাদের লোকজনও কম। সবাইকে প্রয়োজন। কাউকে হারানো চলবে না। পাকহানাদার বাহিনী বিলের পাশে স্কুলে আস্তানা গেড়েছে। ওদেরকে পানিতে ডুবিয়ে মারার একটা বুদ্ধি আছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। কিন্তু ব্যাপারটা খুবই রিস্কি।

কী করতে হবে- বলেন। শুনি। আমির আলীর আগ্রহ বাড়ে।

ঐ আস্তানার সামান্য দূরে যে বেড়িবাঁধ, ওটা রাতের অন্ধকারে কেটে দিতে চাই। পানির স্রোত ঢুকবে। তোড়ে ওরা ভেসে যাবে। যদি বেঁচেও যায় আক্রমণ করার সুযোগ পাবে না। ওরা পানিরে ভীষণ ভয় পায়। সাঁতার জানে না। তাছাড়া বিনা যুদ্ধে পাকহানাদারদের ঘায়েল করতে পারলে আমরা অনেক অস্ত্র পেতাম।

আমাকে কি করতে হবে? ব্যস্ত হয়ে জানতে চায় আমির আলী।

আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের গল্প: রাত পোহালেই পনেরোই আগস্ট

বলছি। থামেন দুলুভাই। তারপর বলেন, তুই আজ রাতে বাঁধ কাটার আগে, বিলের ঐ পার থেকে সাঁতরে ঘাটের ডানপাশে বিলের মধ্যে ঝোপের আড়ালে লুকোবি।

তারপর? চোখ বড় বড় করে জান চায় ও।

ওদের গতিবিধি দেখবি। ঝোপের আড়ালে পৌঁছার পাঁচ মিনিট পর কোয়াক পাখির ডাক দিবি, তিন বার। আমরা তোর ডাক শুনে কাজ শুরু করবো।

ঠিক আছে। আমির আলী খুশিতে ডগমগ। যাক তুবু একটু কাজের মতো একটা পাওয়া গ্যাছে। আজ রাতে মজা বোঝাবে। অতদূর থেকে এদেশে এসে খবরদারি করার মজা কতো ভয়াবহ।

হরামজাদা-

দুলুভাই আবার বলেন, যদি দেখিস শুয়রের বাচ্চারা আমাদের টের পেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে পাঁচবার কোয়াক পাখির ডাক দিবি। আমরা নিরাপদে চলে আসবো। আর তুই আস্তে আস্তে আউশ ধানের মধ্যে দিয়ে চলে আসবি। পারবি না?

পারবো না মানে? খুব পারবো।

না, বাধা দেন দুলুভাই। পাক হানাদার কুত্তারা যদি কোনভাবে টের পায় তাহলে?

ওরা আমার কচু করবে। পানির ভেতর দিয়ে একডুবে আউশধানের মধ্যে এসে নাক জাগাব। আবার ডুব। আবার ডুব। ওদের ফাঁকি দিয়ে অনেক দূরে চলে আসবো। আমার কিছু করতে পারবে না।

পারবি তো ওদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসতে?

বুকে হাত রাখে আমির আলী। মনে পড়ে বাবাকে। বলে, দুলুভাই, পারবো।

তোর মাকে বলে যাবি না?

না। তাহলে মা আমাকে ঘরের বাইরে আসতে দেবেন না। দাদী কেবল কান্নাকাটি করবেন। দোলা, শাওন ওরাও। কাজ সেরে ওদেরকে বলবো, সবাই অবাক হবে। হাসে আমির আলী।

ভেবে দেখ আমির আলী। এখনো সময় আছে। ওকে সাবধান করে দিচ্ছে দুলুভাই।

আমির সাঁতার কাটছে। পায়ের নিচে বিলের নরম কাদামাটি। চুপি চুপি ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। পানিতে যেন ঢেউ না ওঠে। এ বিলের সবকিছু ওর নখদর্পনে। পৌষ-মাঘ মাসে এখানে গরু চড়াতে আসে। তখন নাড়ার ফাঁকে খোঁজে শালুক। বর্ষার সময় আসে শাপলা নেয়ার জন্য। মা অবশ্য বারবার বারন করেন বিলে নামতে। বিলে জোঁক, সাপ থাকে। তাঁর খুব ভয়। শোনে না সেসব বারণ ও। সাঁতার কাটতে কাটতে মায়ের মুখটা মনে পড়ে। ইস্ কী করুণ। বুকটা হু হু করে ওঠে।

ভাইয়া, তোর কাছে আজ ঘুমোবো। বায়না ধরেছে শাওন ভাত খাওয়ার পর।

না। সোজা বারণ করে ও।

কেন? তোর কাছে ঘুমুলে অসুবিধাটা কি?

দাদী বলেন, দুই ভাই একসঙ্গে থাকবি জড়াজড়ি করে।

আমি একসঙ্গে ঘুমুতে পারি না।

ঠিক আছে।

শাওনের কণ্ঠে রুদ্ধ অভিমান। সে দাদীর কাছে ঘুমুতে যায়। মা

কোনো কথা বলেন না। আজকাল মা বড় চুপচাপ থাকেন। কেমন যেন দূরের মানুষ হয়ে গ্যাছেন। খারাপ লাগে। কেউ জানে না আজ রাতে আমির আলীর দু'চোখে ঘুম আসবে না। বিলে বিলে সাঁতার কাটবে। কোয়াক পাখির ডাক ডাকবে। পাক হারামজাদাদের মজা দেখাবে। বিষদাঁত টেনে বের করে আনবে। মনে মনে আমির আলী হাজার হাজার কথা বলে। ভালো লাগে। খারাপ লাগে না। নীল লাবন্য ছুঁয়ে দিক থেকে দিগন্তে উড়ে চলেছে একটানা, অবিরাম।

আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: বর্ণমালার মিছিল। লেখক মনি হায়দার

শ্রাবণের রাত হলেও আকাশে একফোঁটা মেঘ নেই। আকশটা বুঝি জানে আমির আলীর কথা। সে আজ রাতে বিলের জলে সাঁতার কাটবে। মেঘ থাকলে অন্ধকারে কষ্ট হবে। তাই সে সব মেঘ অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে। সারা আকাশে লাখো তারার ভয়নক মিছিল। ওদের ছায়া বিলের টলমল জলেও। চাঁদ, তারা এবং বিলের পানি কেটে কেটে আমির আলী পৌঁছে যায় ঝোপের কাছে। নিজেকে লুকিয়ে ফেলে আড়ালে। চোখ রাখে হানাদারের ক্যাম্পের দিকে। ক্যাম্পের দরজায় দুটো হারিকেন জ্বলে। আবছা-আবছা খোয়া। কয়েকজন হানাদার পাহারায়। এরা চক্রকারে ঘুরছে। কাঁধে রাইফেল। রাতের অখণ্ড নীরবতা ভেঙে রাত্রি জাগা কোয়াক পাখি বিলের জলে গলা ডুবিয়ে ডাক দেয়- কোয়াক, কোয়াক, কোয়াক।

বাঁধ কাটা হয়ে যায়। আমির আলী পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প থেকে মানুষের করুণ কারানি, গোঙানির শব্দ শোনে। ভয়ে বুক কাঁপে। শক্ত হাতে ঝোপের শিকড় ধরে। অল্প অল্প শীত করছে। প্রায় আধঘণ্টা হয়েছে। দুলুভাই আধঘন্টা পর আবার ডাকতে বলেছে। ততক্ষণে বাঁধ কাটা হয়ে যায়। ডাক দিতে যাবে, হঠাৎ চোখে পড়ে হানাদার বাহিনী দলে দলে বের হচ্ছে, শোনে কুলকুল শব্দ। আটকানো পানি ওদের দিকে ধেয়ে আসছে। গ্রাস করবে। আনন্দে মনটা ভরে যায় আমির আলীর। অজগরের লকলকে জিহবা নিয়ে ছুটে আসছে উপচে পড়া পানির তীব্র স্রোত।

সাবধান করে দেয়া দরকার দুলুভাইদের। আবার একটা রাত জাগা পাখি হঠাৎ ডেকে ওঠে কোয়াক, কোয়াক, কোয়াক, কোয়াক, ......।

গর্জে ওঠে পাকিস্তানি হানাদারের রাইফেল। রাতের সুনসান বাতাস কেটে ঝোঁপের ভেতর অজস্র গুলি এসে ঝুপ করে পানিতে পড়ে। ডুব দেয় আমির আলী। কিছুদূর যাবার পর ভেসে ওঠে। আবার ডুব দেয়। হাতে

ধাক্কা লাগে পানির। শব্দ ওঠে ছলাৎ ছলাৎ। মাথার ওপর ঝাঁক ঝাঁক গুলির পাখি। ওকে গিলে খেতে আসছে। দু'পক্ষ থেকে গুলি বিনিময় হচ্ছে। দিশেহারা। মৃত্যুর হলাহল ওদের ক্রমেই গ্রাস করছে। তারপরও লড়ছে। শেষ লড়াই। পরাজয়ের আগে শত্রুর শেষ কামড়। পারছে না শত্রু। ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসছে ওরা। আমির আলী মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। হঠাৎ গুলি লাগে আমির আলীর মাথায়। শেষ সময়ে। কোয়াক পাখিটি বিলের জলে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ও চোখে অন্ধকার দ্যাখে। বাবার চিঠি চোখের সামনে অস্পষ্ট, ঝাপসা মনে হয়। মা, দাদী, শাওন, দোলা-কাউকে চিনতে পারছে না। রক্তের রঙে চার পাশের পানি লাল। নিজের রক্তে রাঙা পানি। মুখ ভরে খায়। চোখ উলটে গ্যাছে। শ্বাস বইছে না। শেষ সময়ে আর একবার ডাকতে চেয়েছিলো কোয়াক, কোয়াক ...।

না। গলা চিরে চিরে শব্দ বের হয় না। শ্বাস চলে না।

রাতের দামাল ছেলে, বোথলা গাঁয়ের অসীম কোয়াক পাখিরা একসময় বিলে অথৈ জলের ভেতর তলিয়ে যায়। আশ্রয় নেয় শাপলা শালুকের গোড়ায়।

আরও পড়ুনঃ মনি হায়দারের লেখা মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "আজও কড়া নাড়ে"

সকাল হয়েছে। পূর্বাকাশে লাল টকটকে একটা তাজাসূর্য। বিলের পানির রক্ত রংয়ে আরো লাল হয়ে উঠছে সব। সাদা শাপলা ফুলগুলো আজ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। দুলুভাইয়েরা হানাদারদের পুরো ক্যাম্প দখল করে নেয়। সব হানাদার ধরা পড়েছে। কেউ পালাতে পারেনি। সঙ্গে এদেশীয় রাজাকার-আলবদর। অনেক অস্ত্র দখল করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। সারা গ্রামের মানুষ ভেঙে পড়েছে। সবার মুখে জয়বাংলা। নীল আকাশেল গায় পতপত করে উড়ছে লাল সবুজের পতাকা।

খোঁজ পড়ে আমির আলীর।

কোথায়? কোথায় সেই কোয়াক পাখি?

সেই পাখি অচিনপুরের মায়ার দেশে গ্যাছে। তাঁর বাবাকে খুঁজতে। মা অপেক্ষা করছে বাবার জন্য। দাদী, শাওন সবাই অপেক্ষা করছে বাবার জন্য। বাবাকে না নিয়ে সেই পাখিটি আর কখনো কোনোদিন ঘরে ফিরবে না।

কচানদীর পারের সেই গ্রামের মানুষেরা শ্রাবনের প্রতিরাতে এখনো শুনতে পায়- বিলের মধ্যে, ঝোঁপের আড়ালে, আকণ্ঠ পানিতে ডুবিয়ে একটা কোয়াক পাখি সাদা জ্যোৎস্নায় শরীর ভিজিয়ে ডাকছে কোয়াক,-কোয়াক- কোয়াক ...।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url