মুজিব শাহ'র দেশে। মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প। লেখকঃ মনি হায়দার
গল্পের নামঃ মুজিব শাহ'র দেশে
অনেক কাল আগের কথা। এক দেশে ছিলো সবুজগ্রাম নামে এক গাঁ। সেই গাঁয়ের পাশে ছিলো এক তেপান্তরের মাঠ। বিশাল মাঠ। সবুজগ্রাম থেকে তাকালে যতদূর চোখ যায় কেবল খাঁখাঁ বিরান মাঠ। তিনরাত তিনদিন হাঁটলে পরে তেপান্তরের মাঠের পর পাওয়া যায় গভীর বন। এত ঘন গাছপালায় বনটা ঢাকা যে, দিনের বেলায় সূর্যের আলোও সেখানকার মাটিতে পৌঁছায় না। সে বনের ভেতর কেউ একবার ঢুকলে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়।
সবুজগ্রামে বাস করে এক ত্রিকালদর্শী মানুষ। তার বয়স কতো কেউ জানে না। সবাই বলে আমি জন্মের পর দেখছি ত্রিকালদর্শী বুড়োকে, ওই অমন ভাবে। অর্থাৎ বুড়োর মাথার চুল, শরীরের লোম, দাড়ি, গোঁফ সব সাদা। অদ্ভুত দুধসাদা। শরীর বলিষ্ঠ। উন্নত নাসা। চোখ দুটো মায়াময়। সবার সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি হেসে রাজ্যের গল্প বলে যায় বুড়ো। সেই বুড়ো বলে- তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে ঘন বনের ভেতরে ঢুকে যে ফিরে আসতে পারবে তার থাকতে হবে তিনটে গুণ? এক. তাকে হতে হবে পরোপকারী, দুই. সে মিথ্যা বলে না, আর তিন. সে কখনো মৃত্যুকে ভয় পায় না। বুড়োর কথায় অনেকে লোভে পড়ে সেই তেপান্তরের মাঠ পার হয়ে ছুটে যেত বনের ভেতর। বন থেকে যে বেরিয়ে আসবে সে হবে অনেক টাকা-পয়সার মালিক আর পাবে পরমাসুন্দরী এক রাজকন্যে।
![]() |
মুজিব শাহের দেশে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। |
অনেক টাকা-পয়সা আর পরমা সুন্দরী রাজকন্যের লোভে অনেক মানুষ যাত্রা করে চিরকালের মতো বনের গভীরে হারিয়ে গেছে। বহু যুগ, বহু বছর এভাবে পার হয়ে গেছে- কেউ রহস্যঘেরা গভীর বনকে জয় করতে পারে নি। সবার কাছে ভয় আর রহস্যের পৃথিবী হয়ে রইলো সেই গভীর বন। কিন্তু বেশিদিন আর থাকলো না রহস্যেঘেরা সেই গভীর বন। সবুজ গ্রামে জন্ম নিয়েছে এক সত্যবাদী, ন্যায়ের জন্য সংগ্রামী এক ছেলে- নাম মুজিব শাহ। মুজিব শাহ'র বাবা-মা খুব দরিদ্র। বাবা পাঠশালার পণ্ডিত। মা ঘরকন্না করে। বাবা সবসময় ছেলে মুজিব শাহকে সত্য ন্যায় বিদ্যা শিখাতেন। দেখতে দেখতে কিশোর মুজিব শাহ কয়েক বছর পর বলশালী তরুণে পরিণত হয়েছে। মুজিব শাহ শৈশব থেকে শুনে এসেছে তেপান্তরের মাঠ পেরুলে এক গভীর বনের গল্প। অনেকের মতো তারও ইচ্ছে হলো বনের আদিম রহস্যের দুয়ার খোলার। মুজিব শাহ তার বাবা-মাকে ইচ্ছার কথা খুলে বললে মা তো কেঁদেকেটে আকুল।
কিন্তু পাঠশালার পণ্ডিত বাবা বললেন- না, বীর বাঁচে লড়াই করে।
আমি যদি আমার পুত্রকে ন্যায়, সততা আর দেশপ্রেম শিখিয়ে থাকি অবশ্যই সে ওই রহস্যে ঘেরা বন জয় করে ফিরে আসবে।
সবুজগ্রামে ছেলেবুড়ো সবাই ভীষণ ভালোবাসতো মুজিব শাহকে।
আরও পড়ুনঃ গল্পের নাম: পাশের বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মনি হায়দার
কারণ সে ছিলো পরম উপকারী বন্ধু। কারো বিপদে সে স্থির থাকতে পারত না। অসহায়, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াত সবসময়। গভীর বনের যাত্রার আগে মুজিব শাহ যায় সবুজগ্রামের ত্রিকালদর্শী বুড়োর কাছে। বুড়ো থাকত অনেক উঁচু একটা টংঘরে। নিচে ঝুলানো থাকত একটা দড়ি। যে কেউ দড়ি ধরে ধরে ঘণ্টা বাজালে বুড়ো দরজা খুলে জানতে চাইত কেনো তাকে ডাকা হচ্ছে? বুড়ো ওখানে বসেই উত্তর দিত। প্রয়োজন হলে মই বেয়ে নিচে নেমে আসত।
কিন্তু মুজিব শাহ গিয়ে অবাক!
বুড়ো নিজেই নেমে ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে মিষ্টি হেসে বলে- আমি তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।
মানে। অবাক মুজিব শাহ।
আমি জানি তুমি আসবে- তাই। আর আমি এটাও জানি যদি কেউ ওই দূর রহস্যঘেরা ডাকিনী বন থেকে ফিরে আসতে পারে সে একমাত্র তুমিই।
তুমি কীভাবে জানো?
মৃদু হাসতে হাসতে ত্রিকালবুড়ো জবাব দেয়, মুজিব শাহ- আমি যে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ দেখতে পাই।
তাই?
হ্যাঁ। বুড়ো তার বহুদিনের পুরনো জীর্ণ শতছিন্ন ব্যাগ হাতড়াতে হাতড়াতে কথা বলে মুজিব শাহর সঙ্গে। কথা বলতে বলতে বুড়ো ব্যাগের তলানি থেকে একটা ছোট্ট রুপোর আংটি বের করে মুজিব শাহর হাতে দিয়ে বলে- এটা সঙ্গে রেখো। যখন বনের ভেতর ঢুকবে, মনে হবে তোমার ঘাড়ে, চোখে-মুখে অজস্ত্র নিঃশ্বাস পড়ছে, ভয় পেও না-একমনে সামনে হাঁটবে। ডানে-বাঁয়ে তাকাবে না। প্রথম বাধা পার হয়ে দ্বিতীয় বাধায় পড়বে যখন- শুনবে পেছন থেকে অনেকে তোমার নাম ধরে ডাকছে। মনে হবে তোমার বাবা, মা ডাকছে- এমনও হতে পারে- আমিই ডাকছি। কিন্তু খবরদার, পেছনে তাকাবে না, দৃঢ়পায়ে সামনের দিকে হেঁটে যাবে। একেবারে শেষ ধাপে তোমার মনে হবে, চারপাশে তোমার অজস্র বাঘ-সিংহ-ভাল্লুক মুখ হা করে এগিয়ে আসছে। তুমি একটুও বিচলিত হবে না- কেবল সামনের দিকে যাবে। আর এই আংটিটা হাতের মুঠোয় নেবে। সঙ্গে সঙ্গে এই আংটি একটি তীক্ষ্ণ ধারালো তরবারি হয়ে যাবে। তারপর তুমি তোমার বুদ্ধি আর বিবেচনায় কাজ করবে।
সবুজ গ্রামবাসীর চোখের কান্না আর বুড়োর পরামর্শ সঙ্গে নিয়ে পাখিডাকা এক পবিত্র ভোরে যাত্রা আরম্ভ করে মুজিব শাহ রহস্যঘেরা বনের দিকে। যেতে যেতে তিন দিন তিন রাত পার হয়ে মুজিব পৌঁছে যায় ঘন অন্ধকার আচ্ছাদিত বনের কাছে। বুড়োর আংটি পকেটে আছে কিনা পরখ করে মুজিব অসীম সাহসে ঢুকে পড়ে বনের মধ্যে। একে একে তিনটি বাধা অতিক্রম করে সাত দিন সাত রাত হেঁটে হেঁটে মুজিব পৌঁছে যায় একটি সুন্দর অট্টালিকার সামনে। এমন অট্টালিকা জীবনে দেখে নি মুজিব।
রাত তিন প্রহর। আকাশে চাঁদ নেই। নেই কোথাও আলোর কণা। তারপরও সুন্দর বাড়িটি আলোয় ঝলমল করছে। কোথেকে আসছে এমন মিষ্টি পুঁতির দানার আলো? মুজিব আরো লক্ষ্য করে ঘরটির কোথাও একটি দরজা বা জানালা নেই। তাহলে সে কীভাবে ঢুকবে ঘরের ভেতরে? চরকির মতো সে ঘরটির চারদিকে ঘুরতে থাকে। হঠাৎ তার মনে আসে আংটির তৈরি তরবারির কথা। মনে পড়ে বুড়োর পরামর্শ- নিজের বুদ্ধি ও সাহসের প্রমাণ রাখার কথা। সে তরবারি দিয়ে ঘরটার উপর আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরটার দরজা সব খুলে যায়। মুজিব লাফ দিয়ে ভেতরে ঢোকে। অবাক হয়ে দেখে ঘরের মেঝেতে সোনার তৈরি একটি খাটে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে অপরূপা এক রাজকন্যা। মুজিব আবার
তরবারি স্পর্শ করে সেই পাথরের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে পাথরের মূর্তিতে জীবন ফিরে আসে। অবাক হয়ে মুজিবের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর রাজকন্যা জিজ্ঞেস করে- তুমি কে?
আমি মুজিব শাহ।
কেনো এসেছো?
তোমাকে নিয়ে যেতে।
রাজকন্যা ম্লান হাসে- গভীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে- এখান থেকে কেউ আমাকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে পারবে না।
দৃঢ়কণ্ঠে বলে মুজিব শাহ- আমি পারব।
জানালা দিয়ে তাকাও চারপাশে- বলে রাজকন্যা- কী দেখতে পাচ্ছো? হাজার মানুষের মূর্তি, ঘোড়ার মূর্তি! ভাবছো সব বুঝি কোনো শিল্পীর তৈরি? না, ওগুলো সব জ্যান্ত মানুষ আর ঘোড়া। যারাই আমাকে উদ্ধার করতে এসেছে তারা সবাই পাথর হয়েছে। তবে তোমার সৌভাগ্য তুমি আমার কাছ পর্যন্ত এসেছো।
তোমার কাছে যখন আসতে পেরেছি, তখন তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতেও পারব। বলো রাজকন্যা আমাকে কী করতে হবে?
ওই যে ঘরের সামনে একটা শীতল পানির পুকর আছে, পুকুরের তলদেশে একটা কুমির আছে। বিশাল কুমির। সেই কুমিরের মুখের মধ্যে একটা সোনালি মাছ আছে। সেই মাছটা যদি মারতে পার তবেই আমার মুক্তি।
বেশ, তুমি অপেক্ষ করো, আমি সেই সোনালি মাছটাকে মেরে আসছি। বলেই মুজিব ঝাঁপিয়ে পড়ে শীতল পুকুরে। রাজকন্যা অনেক আশা নিয়ে দাঁড়ায় দরজায়। পুকুরে ঝাঁপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে দুষ্টু দৈত্য টের পেয়ে যায় তার বাগানে লোক ঢুকেছে। দুষ্টু দৈত্য পড়িমরি করে ছুটে আসতে থাকে বাতাসের বেগে, গাছপালা-মাঠ-প্রান্তর-নদীনালা মাড়িয়ে ঝড়ের বেগে, প্লাবনের মতো। দৈত্যের প্রাণভয়ে ছুটে চলায় পৃথিবীর পথঘাট ধুলোয় ঢেকে গেছে। রাজকন্যা করছে হায় হায়। নিচে, পানির তলায় মুজিব শাহ করছে কুমিরের সঙ্গে লড়াই। দৈত্য এসে পড়েছে পুকুরের ঘাটে, হা হা হাসিতে, বিকট গর্জনে কুড়ালের মতো দাঁত বের করে সে পানিতে নামতে যায়। রাজকন্যা ছটফট করছে আর কাঁদছে আর বুঝি তার মুক্তি হলো না। পুকরের পানি কুমির, মুজিব শাহ আর দৈত্যর সংঘর্ষে উত্থাল-পাথাল হয়ে তীরে উঠে যায়। ঠিক তখনই মুজিব শাহ এক কোপে কুমিরের মুখের ভেতরের সোনালি মাছটাকে কেটে দু'টুকরা করে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে দৈত্যটা মরণ চিৎকার দিয়ে ছটফট করতে করতে মারা যায়। দৈত্যটা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতল পুকুরের পানি স্বাভাবিক হয়। পাথর হয়ে যাওয়া মানুষ ও ঘোড়াগুলো জীবন ফিরে পায়। গভীর বনের পাখ-পাখালিরা আনন্দে গান গাইতে আরম্ভ করে। রাজকন্যা প্রাসাদ থেকে ছুটে এসে মুজিব শাহকে জড়িয়ে ধরে।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছোট গল্প "পিঁপড়ে যেদিকে যায়"। মনি হায়দার
মুজিব শাহ রাজকন্যাকে নিয়ে সবুজগ্রামে ফিরে আসে; সঙ্গে মুক্ত মানুষ আর ঘোড়াগুলোও। সবুজগ্রামের ত্রিকালদর্শী বুড়োই রাজকন্যার বাবা। অনেক অনেক কাল আগে এই দুষ্ট দৈত্য রাজাকে তার রাজ্য থেকে উচ্ছেদ করেছিল।
বুড়ো তার কন্যাকে ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে দেয় মুজিব শাহর সঙ্গে আর মুক্ত মানুষদের নিয়ে মুজিব শাহ নতুন আরেকটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। সেই দেশটির নাম 'সোনার দেশ'।