রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট বাংলা ভাষায়। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার
রাতের খাওয়ার পর বেড়াতে বেরিয়েছিল তিন বন্ধু রোমিও, বেনভোলিও ও মারকুশিও। খানিকটা গিয়ে হঠাৎ-ই রোমিও উধাও! বন্ধুররা তাকে দেখেছে একটা বাগানের পাঁচিল ডিঙোতে, তারপর কোথায় গেছে জানে না। রোমিওর নাম ধরে তারা ডাকাডাকি করল কিন্তু তার সাড়া পেল না। বেনভোলিও বলল, ও নিশ্চয় কোন গাছের আড়ালে লুকিয়ে বসে প্রেমিকার ধ্যান করছে। শেষ পর্যন্ত হদিশ না পেয়ে ফিরে গেল বন্ধুরা।
এদিকে রোমিও পাঁচিল ডিঙিয়ে সোজা জুলিয়েটদের বাড়ির দোতলায় যে ঘরে জুলিয়েট শোয় তার তলায় গিয়ে দাঁড়াল। জুলিয়েটের ঘরে জ্বলছিল মৃদু আলো। রোমিও বলে, জুলিয়েটের ঘরটা পূর্ব দিকে আর জুলিয়েট সেই পুবের সূর্য, তুমি ওঠো আর ওই ফ্যাকাশে হয়ে আসা হিংসুটে চাঁদটাকে হত্যা করো। ও আমার প্রেয়সী; ও কোন কথা না বলেও চোখের ভাষায় অনেক কিছু বলে। আমাকে তার উত্তর দিতে হবে।
![]() |
| Romeo Juliet- Translate Bangla |
রোমিও দেখে ঘরের মধ্যে জুলিয়েট কি যেন বলছে, রোমিও ভাবে, ও আমাকে কিছু বলছে না।
ও কথা বলছে সুদূর আকাশের তারাদের সঙ্গে। আর ওই মুখ যদি আকাশে বিরাজ করতো তাহলে তার উজ্জ্বল গাল দুটো তারাদের লজ্জা দিতো- যেমন দিনের আলো বাতির আলোকে লজ্জা দিয়ে থাকে। আকাশে প্রবাহমান বাতাসের মধ্যে ওই চোখ এত জ্বলজ্বল করতো যে পাখিরা ভুল করে ভোর হয়ে গেছে ভেবে গান গেয়ে উঠতো। জানলা দিয়ে জুলিয়েটকে দেখে রোমিও বলে, ও এখন হাতের ওপর চিবুকটা দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে ওঃ আমি যদি ওর দুই হাতের দস্তানা হতাম তাহলে সব সময় ওই চিবুক আমি স্পর্শ করতে পারতাম। ওপরের জানলায় মাথা ঠেকিয়ে জুলিয়েট আপন মনে কি যেন বলে। তাই দেখে রোমিও বলে, ও কথা বলছে- ওগো উজ্জ্বল পরী, তুমি আবার কথা বলো, তুমি যে আমার স্বর্গের নারী। রোমিওর অস্তিত্ব টের পায়নি জুলিয়েট, সে একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলে, রোমিও, তুমি রোমিও হলে কেন? তুমি যদি মন্টেগু না হতে তাহলে তোমার জন্যে আমি ক্যাপিউলেট নামটা ত্যাগ করতে একমুহূর্ত দ্বিধা করতাম না।
রোমিও নীচে দাঁড়িয়ে জুলিয়েটের কথা শোনে আর ভাবে, আমি কি এবার ওর সঙ্গে কথা বলব না আরও কথা শুনব?
জুলিয়েট বলে চলে, রোমিও-ওই নামটাই আমার শত্রু। কিন্তু সে তো সেই! মন্টেগু নামটা ত্যাগ করলে কি আসে যায়? গোলাপকে যে নামেই ডাকো সে তো সুগন্ধই ছড়াবে। সেইরকম রোমিওকে যদি রোমিও নামে না ডাকা হয় সে তো একই রকম সুন্দর থাকবে। রোমিও, তুমি তোমার নামটা ছাড়ো। -আমি তোমার কথা মানছি, নীচ থেকে এবার চেঁচিয়ে বলে রোমিও, তুমি বরং আমায় 'ভালবাসা' বলে ডেকো, নতুন করে জন্ম হবে আমার!
জুলিয়েট তখনও রোমিওকে দেখতে পায়নি, গলা শুনে সে বলে ওঠে, তুমি কে? কে রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমার ব্যক্তিগত কথা শুনছ?
আমি জানি না কেমন করে আমার পরিচয় দেব, বলে রোমিও, সাধ্বী নারী, আমার নামটা আমার কাছেই ঘৃণার বস্তু কারণ ওই নামটা তোমার শত্রু।
যদিও তোমার মুখের একশোটা শব্দও এখনও পর্যন্ত আমার কানে যায়নি তবু ওই কণ্ঠস্বর আমি চিনি-তুমি রোমিও আর মন্টেগু। তাই না? রোমিও বলে, সুন্দরী, যদি তুমি অপছন্দ করো তো আমি কোনটাই না।
তুমি এখানে এলে কেমন করে? বাগানের পাঁচিল তো বেশ উঁচু আর ওর ওপর ওঠা বেশ কঠিন। বলে জুলিয়েট, আমার কোন আত্মীয়ের চোখে পড়লে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত।
রোমিও বললে, প্রেমের ডানা মেলে আমি বাগানের পাঁচিল টপকেছি কারণ পাথরের দেওয়াল ভালবাসার গতিরোধ করতে পারে না। আর তাই তোমার আত্মীয়রাও পারে না।
তোমায় দেখলে যে তারা খুন করে ফেলবে!
তাদের কুড়িটা তরবারি নয়, আমার সর্বনাশ যে শুধু তোমার চোখে। শুধু তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও তাহলে আমি স্বচ্ছন্দে তাদের মুখোমুখি হতে পারি।
রোমিও, কোন কারণেই তোমাকে আমি তাদের নজরে পড়তে দিতে পারি না।
রোমিও বললে, তাদের কাছ থেকে আড়াল করার জন্যে আমার গায়ে রাতের ঢিলেঢোলা পোষাকটা রয়েছে কিন্তু তুমি যদি আমায় ভালবাস তাহলে তারা আমায় দেখুক, তাদের ক্রোধের পরিণামে আমার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটুক কিন্তু তোমার ভালবাসার অভাবে আমার মৃত্যুর ক্ষণ যেন বিলম্বিত না হয়।
এই জায়গার কথা তোমায় কে বলল? জিজ্ঞেস করে জুলিয়েট।
ভালবাসাই আমাকে খোঁজ করতে বাধ্য করেছে আর সেইসঙ্গে চোখও খোলা রেখেছিলাম। আমি জাহাজের চালক নই তবু জানি তুমি গভীর সমুদ্রে সুদূর কোন দ্বীপের মানবী যার খোঁজে আমাকে বাণিজ্যেতে যেতেই হবে।
রাতের অন্ধকার আমার মুখে তা না হলে দেখতে আমি যা বলেছিলাম তার জন্যে আমার মুখ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠেছে। আমি যা বলেছি তা ভুলে যাও। বিদায়। কিন্তু বিদায় জানিয়েও চলে যেতে পারে না জুলিয়েট, পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করে, তুমি কি আমায় ভালবাস? তারপর সে নিজেই বলে, জানি বলবে হ্যাঁ আর আমি তা বিশ্বাস করি। কিন্তু তুমি তো মিথ্যেও বলতে পারো! সত্যি করে বলো তো আমায় ভালবাসো কিনা? যদি তুমি মনে করো যে আমাকে সহজেই পাওয়া যাবে তাহলে আমি বলব, না।
আমি তোমাকে অন্তরের থেকে ভালবাসি, তুমি শুনেছ আমি তোমাকে কতটা চাই। আমার অনুরোধ, তুমি যেন এটাকে খেলা ভেবো না। -জুলিয়েট, আমি চাঁদের নামে শপথ করে বলছি..... রোমিওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জুলিয়েট বলে, না, চাঁদের নামে নয়, সে তো প্রতিনিয়ত বদলায়, তোমার ভালবাসা তাহলে অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। তাহলে কার নামে শপথ করব বলো? জানতে চায় রোমিও।
শপথ কোরো না, জুলিয়েট বলে, যদি করো তো নিজের সুন্দর সত্তার নামে শপথ করো কারণ সেটি হলো আমার আরাধ্য দেবতা, আমি তাকেই বিশ্বাস করব।
সেইভাবেই শপথ করতে অগ্রসর হয় রোমিও কিন্তু তাতেও বাধা দেয় জুলিয়েট, না শপথ কোরো না। তোমাকে আমার ভাল লাগে, আজ রাতে কোন চুক্তির মধ্যে যেতে মন চাইছে না। সেটা যেন তাড়াহুড়া হয়ে যাবে। এ তো সবে কুঁড়ি ফুটেছে, গ্রীষ্মের উষ্ণতায় ফুল ধরলে তখন আমাদের আবার দেখা হবে। রোমিওকে বিদায় জানায় জুলিয়েট। কিন্তু রোমিও জিজ্ঞেস করে, তুমি আমাকে অতৃপ্তই ছেড়ে দেবে?
কোন তৃপ্তি চাও তুমি?
সে তো তুমি বলার আগেই আমি বলেছি। বেশ, আমি আবার বলছি, আমি তোমায় ভালবাসি, আমার ভালবাসা সমুদ্রের মতোই অসীম ও গভীর। যতই আমি সে ভালবাসা দেব ততই আমি তোমার ভালবাসা পাব।
এই সময় ভেতর থেকে নার্স জুলিয়েটকে ডাকে। জুলিয়েট রোমিওকে বিদায় জানায় কিন্তু তারপরেই বলে, আর একটু থাকো, আমি এখনই আসছি। জুলিয়েট ভেতরে যায়, রোমিও ভাবে এই রাতটা তার কাছে স্বপ্নের মতো। জুলিয়েট আবার ওপরের জানলার কাছে ফিরে আসে। বলে, যদি আমাদের এই সম্বন্ধকে পাকাপাকি করার উদ্দেশ্যে আমায় ভালবেসে থাকো তাহলে কাল আমি কাউকে তোমার কাছে পাঠাবো; তুমি তার হাতে লিখে জানিও কবে কখন আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। তাহলে আমি আমার সর্বস্ব তোমায় সমর্পণ করব। আর যদি তেমন কোন উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে আমার দুঃখ আমাকে সইতে দিও। বিদায় জানিয়ে জুলিয়েট বলে, হাজার শুভরাত্রি।
রোমিও বললে, তার মানে তো হাজারবার আমি ওই আলো থেকে বঞ্চিত হব। স্কুলের ছেলের যেমন বই-এর ওপর টান ভালবাসার টানও যে সেই রকম!
জুলিয়েটকে জানলার পাশে আবার দেখা যায়, সে বললে, তোমার কণ্ঠস্বরের মোহে আমি আবার এসেছি, শিকারীর গলার আওয়াজে যেমন বাজপাখি এসে ধরা দেয়। আমি যে আমার বাবার অধীনে, নয়তো সব বন্ধন ছিন্ন করে আমি তোমার কাছে চলে যেতাম।
রোমিও বলে, জুলিয়েট, আমার আত্মাই যেন আমায় নাম ধরে ডাকছে। এই রাতে প্রেমিকের
কণ্ঠস্বর যে সুমধুর সঙ্গীতের মতো মনে হচ্ছে।
রোমিও আবার ডাকে, জুলিয়েট।
বলো।
কাল ক'টার সময় আমি তোমার কাছে লোক পাঠাব?
ন'টা।
আমি ওই সময়েই পাঠাব। আমার কাছে এই সময়টাই যেন কুড়ি বছর। তোমায় কেন যে ডাকলাম সেটাই ভুলে গেছি বললে, জুলিয়েট।
তাহলে যতক্ষণ না মনে পড়ে আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি?
তুমি দাঁড়িয়ে থাকলে আমার মনেই পড়বে না। ভোর হয়ে এল। আমি তোমায় যেতে দেব তবে খুব দূরে নয়; আমার নাগালের মধ্যেই তুমি থাকবে।
আমিও তো তাই চাই, বলে রোমিও।
ভোর হওয়ার কিছু আগেই ফাদার লরেন্স তাঁর ছোট ঝোলাটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন ভেষজ গাছপালা সংগ্রহের কাজে। সূর্যোদয়ের আগেই ওষুধ তৈরীর উপযুক্ত তরুলতা, আগাছা ও মূল্যবান রসাল ফুলে তাঁর ঝোলাটিকে ভর্তি করে নিতে হবে। তিনি ভাবছিলেন, এই প্রকৃতি এই পৃথিবী মানুষকে কত কিছুই না দিয়েছে, তাদের মধ্যে কতই না গুণাগুণ, কতই না বৈচিত্র্য, গাছপালার মধ্যে ঝোপেঝাড়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে তাদের অস্তিত্ব। কিন্তু ভুল প্রয়োগে গুণও দোষ হয়ে যেতে পারে আবার দোষও ভাল ফল দিতে পারে। এইসব ছোটখাটো বুনো গাছপালার মধ্যেই রয়েছে বিষ, আবার নিরাময়ের ক্ষমতাও। মানুষের মধ্যেও এই দুটো দিকই আছে-সৌন্দর্য ও নিষ্ঠুরতা। অবশ্য কোন গাছে মধুর বদলে বিষের প্রাধান্য থাকলে গাছটি নিজেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। রোমিও তখন বনের পথ দিয়ে ফিরছিল, ফাদারকে দেখতে পেয়ে সে সুপ্রভাত জানায়। তাকে দেখে ফাদার লরেন্স অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার, এত সকালে? কোন কারণে মন অস্থির রয়েছে মনে হচ্ছে তাই এত ভোরে বিছানা ছেড়েছ। বুড়ো মানুষদের ঘুম কম তারা খুব ভোর ভোর উঠে পড়েন কিন্তু তোমার বয়সে তো এমনটা হওয়ার কথা না। আর তা যদি না হয় তাহলে আমার অনুমান তুমি কাল ঘরেই ছিলে না।-আপনার শেষের অনুমানই সত্যি, স্বীকার করে রোমিও, তারপর রহস্য করে বলে, কাল আমার বিশ্রাম মধুরতর হয়েছে।
ঈশ্বর তোমায় মার্জনা করুন, তুমি কি কাল রোজালিনের সঙ্গে ছিলে নাকি? জিজ্ঞেস করলেন ফাদার। রোজালিনের সঙ্গে? না ওই নামটা আমি ভুলে গেছি, জবাব দেয় রোমিও।
তাহলে তুমি ছিলেটা কোথায়? জানতে চান ফাদার। রোমিও বললে, পরে আমি আপনাকে সব জানাবো, এখন শুধু এইটুকু বলছি যে আমি ছিলাম আমার শত্রুপক্ষের গুহায়। সেখানে হঠাৎই একজন আমার হৃদয়ে তীর বিঁধিয়েছে, তার হৃদয়েও তীর বিঁধেছে। এখন আমাদের দু'জনের নিরাময়ের ভার আপনার হাতে।
রোমিও, একুটু খুলে বলো, তো ভাই। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললে আমিও পরিষ্কার কোন পথ বাতলাতে পারবো না।
তাহলে সরাসরিই বলছি, বলে রোমিও, এখন আমার হৃদয়ের মণি ক্যাপিউলেটের কন্যা। আমরা পরস্পরকে ভালবাসি। এখন বিয়ের মাধ্যমে আমাদের দু'জনের মধ্যে মিলন ঘটানোর ভার আপনার ওপর। কখন, কোথায়, কি ভাবে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো আমি যেতে যেতে আপনাকে বলছি। তবে আজই আপনাকে আমাদের বিয়ে দিতে রাজি হতে হবে।
বিস্মিত ফাদার বলে ওঠেন, হা ঈশ্বর! কি পরিবর্তন! যে রোজালিন তোমার চোখের মণি ছিল সে' আজ হঠাৎ বাতিল হয়ে গেল! এখনকার ছেলেদের ভালবাসা কি তাহলে হৃদয়ে নয় চোখে। রোজালিনের জন্যে এত চোখের জল ফেলা- তার কোন মূল্যই রইল না। তোমার গালে এখনও চোখের জল শুকোয় নি আর তুমি রাতারাতি বদলে গেলে।
আপনিও তো একসময় রোজালিনকে ভালবাসার জন্যে বিদ্রূপ করতেন, অভিযোগ করে রোমিও।
সেটা ভালবাসার জন্যে নয় প্রেমের ভান করার জন্যে, উত্তর দিলেন ফাদার। রোমিও বলে, এখন আমি যাকে ভালবাসি সেও আমায় ভালবাসে কিন্তু আগের জনের কাছ থেকে আমি কোন সাড়াই পেতাম না।
সে নিশ্চয় তোমার ভালবাসাকে উপলব্ধি করতো কিন্তু নিজে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারতো না, ফাদার লরেন্স বলেন, যাইহোক এখন আমার সঙ্গে চলো আমি তোমাদের মিলনের ব্যাপারে সাহায্য করবো কারণ ওই মিলনে তোমার সংসার সুখের হবে।
রোমিও তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ফাদার, আমি এখন যাই তাড়া আছে।
ফাদার বললেন, আস্তে চলো, দেখেশুনে চলো, যে দৌড়য় সে-ই পড়ে।
রোমিওর আকস্মিক অন্তর্ধান নিয়ে বেনভোলিও ও মারকুশিওর মধ্যে কথা হচ্ছিল, হতচ্ছাড়া গেল কোথায়? আজ রাতে কি ও ঘরেই আসেনি?
অন্ততঃ নিজের বাড়িতে আসেনি, মারকুশিওর প্রশ্নের উত্তরে বেনভোলিও বললে, ওর বাড়ির লোকের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, মারকুশিও বললে, ওই পাষাণ-হৃদয় রোজালিনটা দেখছি ওকে পাগল করে দেবে।
কথায় কথায় বেনভোলিও জানাল যে ক্যাপিউলেটের ভাইপো টাইবল্ট রোমিও-র কাছে একটা চিঠি পাঠিয়ে তাকে দ্বন্দু-যুদ্ধে আহ্বান করেছে।
বেচারী রোমিও, বলে মারকুশিও, একে ও কালো চোখের ফর্সা মেয়েটির ছুরিতে মরেই আছে,
এখন আবার তাকে টাইবল্টের মুখোমুখি হতে হবে।
কেন টাইবল্টকে ভয় পাওয়ার কি আছে?
আছে। সে দক্ষ তরোয়ালবাজ, তাল-ছন্দ-লক্ষ্য-বজায় রেখে সে লড়াই করে; খুব অল্প সময়ের জন্যে বিশ্রাম নেয় আর এক দুই তিন বলতে না বলতেই তরবারি বুকে বসিয়ে দেয়।
দুই বন্ধুর কথাবার্তার মাঝখানে রোমিও আসে। তার উস্কোখুস্কো চেহারা দেখে মারকুশিও ঠাট্টা করে বলে, বাঃ চেহারাখানা যা বানিয়েছ একেবারে শুকনো হেরিং মাছের মতো। রোমিও গতরাতের ঘটনার জন্যে ওদের কাছে ক্ষমা চায়। বলে আমি একটা বড় ব্যাপারে গিয়েছিলাম; ও-রকম একটা ব্যাপারে একটু অভদ্র হওয়া যেতেই পারে। ওদের কথাবার্তা চলার সময় অদ্ভুত পোশাকে এসে হাজির হয় জুলিয়েটের এক পরিচারিকা ও তার স্বামী মিঃ পিটার। তাদের দেখে তিন বন্ধুতে হাসিঠাট্টা করে। পরিচারিকা ওদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, রোমিওকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে বলতে পারেন? রোমিও রহস্য করে বলে, পারি কিন্তু যখন তাকে খুঁজে পাবে তখন তোমার বয়েস তার তখনকার বয়েসের চেয়ে বেশী হয়ে যাবে। তবে ওই নামে যারা আছে তাদের মধ্যে আমি কনিষ্ঠতম। পরিচারিকা হেসে বললে, স্যার, আপনি যদি তিনি হন তাহলে আমি আপনাকে গোপনে কিছু কথা বলতে চাই। বেনভালিও ঠাট্টা করে বলে, ও বোধহয় রোমিওকে রাতের খাবারে নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছে। রোমিও পরিচারিকাটিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যায়।
রোমিওকে একা পেয়ে তার বন্ধুদের সম্পর্কে বিরক্ত পরিচারিকা বলে, কেমন মানুষ তোমার বন্ধরা-খালি তামাশা করে। রোমিও জবান দেয়, ওরা সেইরকম ভদ্রলোক যারা নিজেদের কথা নিজেরাই শুনতে ভালবাসে আর এক মাস ধরে জমানো কথা এক মিনিটেই বলে দেয়। পরিচারিকা বলে, ভাল কথা, তবে আমার বিরুদ্ধে কিছু বললে আমিও ছেড়ে দেব না।
রাগ করছ কেন? এবার কথা বললে তার ভালমানুষ স্বামীটি, তোমাকে নিয়ে ওরা রসিকতা করেনি, করলে, কি আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম? সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র বার
এবার পরিচারিকা বলে, আপনার কাছে আমায় পাঠিয়েছে তরুণী। সে আমাকে বলেছে কথাটা গোপন রাখতে। তবে আমি বলব আপনি যদি তাকে মিথ্যে আশা দেন তাহলে সেটা অন্যায় কাজ হবে কারণ তার বয়েন কম। আপনি যদি মনে মুখে এক না হন তাহলে সেটা দোষের হবে নিশ্চয়। রোমিও বলে, তুমি বরং তাকে গিয়ে বলো সে যেন কোন রকমে ফাদার লরেন্সের ঘরে চলে আসে। সেখানেই আজ আমাদের বিয়ে। বেশ, ও আজ দুপুরে ওখানেই যাবে, খুশি হয়ে বলে পরিচারিকা।
তাকে আরও বোলো আমার এক ভৃত্য গীর্জার পেছনে দড়ি ও মই নিয়ে অপেক্ষা করবে। জুলিয়েট যেন সেই দড়ি বেয়ে উঠে ভেতরে চলে আসে। পরিচারিকা জুলিয়েটের অসংখ্য গুণগান করে, তারপর বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
এদিকে পরিচারিকাকে রোমিওর কাছে পাঠিয়ে জুলিয়েট তার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল আকুল আগ্রহের সঙ্গে। সে নিজের মনেই ভাবছিল, আমি তো ওকে পাঠিয়েছি সকাল ন'টার সময় আর ও বলছিল আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরবে... হয়তো ওর দেখা পায়নি, না তা নয়, ওতো আবার খোঁড়া, যেতে আসতেই সময় নেবে। কিন্তু এখন তো বারোটা বাজলো, তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে, এখনও ওর পাত্তা নেই কেন! ওই বুড়ির মনটা যদি তরুণীদের মতো হতো তাহলে ও নিশ্চয় তাড়াতাড়ি করে গিয়ে খবরটা আনতো। কিন্তু বুড়ো মানুষদের নিয়ে মুশকিল, ভারী শরীর গুটি গুটি যায়, এক তাল সীসের মতোই নিষ্প্রাণ।
এই সব ভাবনার মাঝখানে পিটারকে সঙ্গে নিয়ে পরিচারিকা এল। তাকে দেখেই জুলিয়েট বলে উঠল, এসো, কি খবর আমায় বলো। পরিচারিকা পিটারকে পাঠিয়ে দিল দরজার কাছে পাহারায় থাকতে যাতে কেউ এসে না পড়ে। জুলিয়েট আর অপেক্ষা করতে পারে না বলে, তোমায় মনমরা দেখাচ্ছে কেন? খারাপ খবর হলে তাড়াতাড়ি বলো আর খবর ভাল হলে ওই রকম গোমড়া মুখে থেকে তার মাধুর্যই নষ্ট করে দিচ্ছ। বৃদ্ধা পরিচারিকা বলে, একটু দম নিতে দাও দিকি। আমি একদম হাঁপিয়ে গেছি হাড়গুলোয় ব্যথা হয়ে গেছে।
খবর। পারলে আমি আমার হাড় তোমায় দিতাম, দোহাই তোমার, চুপ করে থেকো না, বলো কি
তাড়ার কি আছে, ধৈর্য ধরো বাপু, দেখছ না দম বন্ধ হয়ে আসছে।
জুলিয়েট এবার বিরক্তির সঙ্গে বলে, তোমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস তো দিব্যি পড়ছে। যতক্ষণ তুমি অজুহাত দিচ্ছ ততক্ষণে তোমার আসল কথাটা বলা হয়ে যেত। খবরটা ভাল না খারাপ? শুধু এটুকু বলো।
ভালরে বাপু! তুমি তো ভাল মন্দ বলেই খালাস। তবে তুমি কিন্তু লোক বাছতে জান না। রোমিও? যদিও ওর মুখ যে কোন লোকের থেকে ভাল কিন্তু তার পা সব মানুষের সেরা। তার হাত পা শরীর অতুলনীয়-খুব যে ভদ্রতা আছে বলা যাবে না তবে হ্যাঁ ভেড়ার মতোই শান্ত। ঠিক আছে যা ভাল বোঝো করো। তুমি কি খেয়েছ?
না, জুলিয়েট বলে, তুমি যা বললে সব আমি জানি কিন্তু আমাদের বিয়ে সম্পর্কে ও কি বললে তাই বলো।
উঃ ভগবান আমার কি মাথা ধরেছে! কি যে হয়েছে মাথায়, মনে হচ্ছে ভেঙ্গে টুকুরো টুকরো হয়ে যাবে। আমাকে যেন তুমি মরতে পাঠিয়েছিলে, চড়াই উৎরাইয়ের পথে চলতে গিয়ে মরি আরকি।
তোমায় কষ্ট দেওয়ায় আমি খুব দুঃখিত, জুলিয়েটের ধৈর্য তখন শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। সে অনুনয় করে বলে, সোনা, তুমি বলো আমাদের ভালবাসার সম্পর্কে সে কি বলল?
তোমার ভালবাসার মানুষটা ভাল লোক। দয়ালু আর গুণ মানুষের মতোই। সে বলল, আচ্ছা তোমার মা কোথায়?
মা? মা ভেতরে, আবার কোথায়। তুমি কি অদ্ভুত কথাবার্তা বলছ-তোমার প্রেমিক ভাল মানুষের। মতো বলল বলেই জিজ্ঞেস করছ তোমার মা কোথায়?
আরে বাবা অত চটছ কেন? পরিচারিকা বলে, আমার বাতের ব্যথার কি ওটাই পুলটিশ? এরপর থেকে তোমার ম্যাসেজ তুমি নিজেই করে নিও।
কি হৈচৈ পাকাচ্ছ? কি বলল রোমিও তাই বলো, জুলিয়েট রেগেই ওঠে।
এবার পরিচারিকা জিজ্ঞেস করে, তুমি আজ গীর্জায় যাবার অনুমতি পেয়েছ?
হ্যাঁ।
তাহলে আজ ফাদার লরেন্সের ঘরে যেও। সেখানে তোমার স্বামী তোমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার জন্যে অপেক্ষা করবে। হ্যাঁ, এখন তোমার কান লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে। তুমি গীর্জার দিকে যেও। আমি যাব একটা মইয়ের খোঁজে। অন্ধকার হলে তোমার প্রেমিক একটা পাখির বাসার খোঁজ করবে। তোমার খুশির জন্যে আমি কেবল ছুটেই মরছি। যাও, তুমি গীর্জায় সোজা ফাদারের ঘরে।
গীর্জায় ফাদার লরেন্সের ঘরে রোমিও জুলিয়েটের অপেক্ষায় বসেছিল। ফাদার রোমিওকে আশীর্বাদ করলেন, দুঃখের অবসানে, তোমার প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক!
রোমিও বললে, দুঃখ যাই পাই না কেন তাকে মাত্র এক মিনিট চোখের দেখা দেখলে যে আনন্দ পাই তার তুলনায় দুঃখ কিছুই না। আজ আমাদের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করুন, তারপর আমার জীবনে মৃত্যু এলেও মেনে নেব। সে আমার এইটুকু বলতে পারলেই আমি খুশি।
ফাদার লরেন্স বললেন, আনন্দের তীব্রতা কিন্তু অনেক সময় বিষাদের তীব্রতায় পরিণত হয়। যে মধু খুব মিষ্টি তা কিন্তু ভাল নয়, তাতে আমাদের খিদে নষ্ট হয়। তাই ভালবাসাকেও তীব্র করে তুলো না তাতে তোমার ভালবাসার স্থায়িত্ব বাড়বে। যে খুব জোরে ছোটে সে বহু সময়েই দেরীতে পৌঁছয়।
জুলিয়েটকে তাড়াতাড়ি করে আসতে দেখে ফাদার বলেন, ওই যে ও আসছে। ওর হালকা পায়ের ছন্দে পায়ের নীচে পাথরের এতটুকুও ক্ষতি হবে না। ভালবাসার আনন্দ এমনই হালকা ছন্দে চলার মতো ব্যাপার। ফাদারকে দেখে জুলিয়েট সম্ভাষণ জানায়। তাকে দেখে রোমিও উচ্ছ্বাসিত হয়ে ওঠে। মৃদু ধমক দিয়ে জুলিয়েট বলে, অত কথা নয়, অত উচ্ছ্বাসও নয় বরং তোমার প্রেমে সারবস্তু যেন কিছু থাকে। তবে আমার ভালবাসাকে কিন্তু কোন কিছু দিয়েই মাপা যাবে না।
ফাদার লরেন্স তাদের বললেন তাঁকে অনুসরণ করতে। সহাস্যে বললেন, পবিত্র ধর্মমতে একাত্ম করে না দেওয়া পর্যন্ত তোমাদের তো একা ছেড়ে দিতে পারি না।
নোট: প্রিয় পাঠক, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের লেখা রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট অসাধারণ একটি বাংলা ভাষায় অনুবাদকৃত প্রেমের নাটকের ২য় পর্ব আজ শেষ করলাম। গল্প প্রেমিকদের সারা পেলে পরবর্তীতে আবার ৩য় পর্ব খুব শীঘ্রই পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ।
