রোমিও জুলিয়েট এর প্রেম কাহিনী। Romeo Juliet Bangla

নাটকের নামঃ রোমিও ও জুলিয়েট
লেখকঃ উইলিয়াম শেক্সপিয়ার 
(বাংলা ভার্ষণ)

পর্ব- ০৩


দুপুরবেলায় শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মারকুশিও ও বেনভোলিওর মধ্যে কথা হচ্ছিল। বেনভোলিও বন্ধুকে বললে, চলো বাড়ি যাই, এই রকম গরমের দিনে ক্যাপিউলেটদের কাউকে দেখলে ঝামেলা হবে কারণ, এই গরমে শরীরের রক্ত যেন ফুটতে থাকে। মারকুশিও বেনভোলিওর কথায় সায় দিয়ে বলে, হ্যাঁ, আর তুমিও সেই রকম মানুষ যে রেস্তোরায় ঢুকে টেবিলে তরোয়াল রেখে বলবে রইল তরোয়াল, ওতে আমার প্রয়োজন নেই কিন্তু দ্বিতীয় পেয়ালা মদ পেটে পড়লেই সেই তরোয়াল নিয়ে বিনা কারণেই ওয়েটারের দিকে তেড়ে যাবে।

আমি কি ওই রকম লোক নাকি? বেনভোলিওর প্রশ্নে মারকুশিওর অভিযোগ অস্বীকারের সুর।

হ্যাঁ, তুমি ইটালির যে কোন লোকের মতো বদমেজাজী।

কি রকম?

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের প্রেমের উপন্যাস "রোমিও জুলিয়েট" বাংলা
উপন্যাস রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট বাংলা 

কোন লোকের দাড়িতে চুল কম না বেশী তুমি তা নিয়েও ঝগড়া করবে। সব সময়েই তুমি ঝগড়ার বিষয় খুঁজে বেড়াও। ডিমের কুসুমের মতো তোমার মাথাতেও ঝগড়া গিজগিজ করছে। একবার একটা লোক কেশে তোমার কুকুরের ঘুম ভাঙ্গিয়েছিল আর তুমি তার সঙ্গেও ঝগড়া করেছিলে। ইস্টারের আগে গরমের পোশাক পরার জন্যে তুমি একটা দর্জির সঙ্গে ঝগড়া করোনি? পুরনো ফিতে দিয়ে নতুন জুতো পরার জন্যেও তো তুমি একজনের সঙ্গে তর্ক লাগিয়ে দিয়েছিলে। আর তুমি কিনা আমায় বদমেজাজের বিরুদ্ধে উপদেশ দিচ্ছ মারকুশিও কথা শেষ করে।

টাইবল্ট পেট্রচিও ও অন্যান্যদের আসতে দেখা যায়। বেনভোলিও বন্ধুকে বলে ওই ক্যাপিউলেটরা আসছে। আমি পরোয়া করি না, মন্তব্য করে মারকুশিও। টাইবল্ট এসেই ওদের দেখে বললে, এই যে মশায়, আপনাদের একজনের সঙ্গে আমার দু'একটা কথা আছে।

মারকুশিও বললে, আমাদের একজনের সঙ্গে দু'একটা কথা-তাহলে ওর সঙ্গে ঘুষির কথাটাও মনে রাখবেন। -ও ব্যাপারে আমিও তৈরী, টাইবল্ট বলে, তারপর জিজ্ঞেস করে, তুমি রোমিওর চ্যালা মারকুশিও, তাই না?

বেনভোলিও মারকুশিওকে মৃদুভাবে বলে, হয় ঠাণ্ডা মেজাজে কথাবার্তা বলো নয়তো কোন ফাঁকা জায়গায় চলো। এখানে লোকজনের ভিড়ে ঝামেলা কোরো না।

মারকুশিও সে কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলে, দেখার জন্যে যাদের চোখ রয়েছে তাদের দেখতে দাও, লোককে খুশি করার জন্যে আমি কোথাও যেতে রাজি নই।

এমন সময় রোমিও এসে হাজির হয়। টাইবল্ট বলে ওঠে, সবাই চুপ করো, আমার লোকটা এসে গেছে।

হ্যাঁ, রোমিওর হাতেই তোমার মৃত্যু। সেই হিসেবে ও তোমারই লোক, মারকুশিও মন্তব্য করে।

তরোয়াল নাচিয়ে টাইবল্ট রোমিওকে বলে, তোমার মতো শয়তানের সঙ্গে আমার যা প্রেম তাতে এটাই তোমার প্রাপ্য।

জবাবে রোমিও শান্ত মেজাজেই বলে, টাইবল্ট, তোমার সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক তাতে তোমায় আমার ভালবাসারই কথা তাই তোমায় ক্ষমা করলাম আর আমি মোটেই শয়তান নই, তুমি আমায় জানো না। রোমিওর কথায় টাইবল্টের রাগ পড়ে না, বলে, ওসর কথায় আমার মন ভোলাতে পারবি না, তুই আমার অনেক ক্ষতি করেছিস।

আমি তোমার কোন ক্ষতি করিনি বরং তোমায় ভালবাসি। ভালবাসার কারণ তোমার জানা নেই। আর সেই কারণেই ক্যাপিউলেট নামটা এখন আমার নিজের নামের মতোই প্রিয়; সুতরাং শান্ত হও।

রোমিও অবস্থা আয়ত্তে আনার চেষ্টা করলেও মারকুশিও তরোয়াল বের করে এগিয়ে যায়। শুরু হয় লড়াই। রোমিও থামাবার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত রোমিও দু'জনের তরোয়ালের মাঝখানে দাঁড়ায় কিন্তু টাইবল্ট রোমিওর হাতের তলা দিয়ে মারকুশিওর শরীরে তরোয়াল বিধিয়ে দেয়। তারপর সে পালিয়ে যায়। আহত মারকুশিও যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মন্টেগু ও ক্যাপিউলেট, এই দুই পরিবারকে অভিসম্পাত করতে থাকে। রোমিও বন্ধুকে সাহস দিয়ে বলে, মনে হচ্ছে তোমার আঘাত খুব বেশী নয়। 

যন্ত্রণার মধ্যেও রসবোধের পরিচয় দিয়ে মারকুশিও বলে, না কুয়ার মতো গভীর নয় কিংবা গীর্জার দরজার মতো চওড়া নয়, তবে তাতেই কাজ হবে। কাল হয়তো এই পৃথিবীতে আমায় পাবে না। রোমিও, তুমি মাঝখানে এসে না দাঁড়ালে আমার এই অবস্থা হতো না। বেনভোলিও আহত মারকুশিওকে ধরে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। রোমিও আক্ষেপ করে, আমার জন্যে টাইবল্টের হাতে আমার প্রিয় বন্ধু মরতে বসেছে। অথচ মাত্র ঘন্টা খানেক আগে টাইবল্ট আমার আত্মীয় হয়েছে। জুলিয়েট, তোমার সৌন্দর্য আজ আমায় দুর্বল করে তুলেছে।

বেনভোলিও এসে জানাল মাধকুশিও মারা গেছে, তার আত্মা অকালেই পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গের উদ্দেশ্য পাড়ি দিয়েছে।

রুদ্র মূর্তিতে আবার ছুটে আসে টাইবল্ট। এবার রোমিও প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ ছাড়ে না, বলে, তুই মারকুশিওকে হত্যা করেছিস এবার আমার রাগটা দেখ, মারকুশিওর আত্মা তোর অপেক্ষায় আছে। হয় তুই বা আমি তার সঙ্গ দেব।

টাইবল্ট বলে, তার সঙ্গী হবি তুই।

আমার এই আঘাতটাই তা ঠিক করবে, রোমিও ও টাইবল্টের মধ্যে লড়াই শুরু হলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই টাইবল্ট পড়ে যায় ও তার মৃত্যু হয়। বেনভোলিও চেঁচিয়ে বলে, রোমিও, পালাও, লোকেরা ছুটে আসছে, ভ্যাবাচাকা মেরে দাঁড়িয়ে থেকো না ধরা পড়লে রাজা তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবে। পালাও।

হায় কপাল, দুর্ভাগ্য আমায় তাড়া করে চলেছে, রোমিও দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকরা চলে আসে। বেনভোলিওকে সেখানে দেখে তারা প্রথমে জানতে চায় মারকুশিওর খুনী টাইবল্ট কোথায়? তারপরই তাদের রাস্তায় পড়ে থাকা টাইবল্টের মৃতদেহ নজরে পড়ে। নাগরিকরা তখন বেনভোলিওকে টাইবল্টের খুনী হিসেবে অভিযুক্ত করে। সেই সময় সেখানে এসে পড়লেন রাজা, মন্টেগু, ক্যাপিউলেট, তাদের স্ত্রীরা এবং অন্যান্যরা। রাজা জানতে চান এই অশান্তির সূত্রপাত কি করে হলো। বেনভোলিও জানায় যে টাইবল্টকে হত্যা করেছে রোমিও এবং মারকুশিওকে হত্যা করেছিল টাইবল্ট। লেডী ক্যাপিউলেট তার ভাইপোর মৃত্যুতে বিলাপ করতে করতে রাজার কাছে আবেদন করেন, আমার আত্মীয়ের রক্ত ঝরেছে, মন্টেগু পরিবারের এই রক্তপাতের জন্যে আমি আপনার কাছে বিচার চাইছি।

রাজা বেনভোলিওর কাছে আবার জানতে চাইলেন গণ্ডগোলের আরম্ভ হয়েছে কি ভাবে। বেনভোলিও সব ঘটনা বিবৃত করে বলে, ঝগড়া শুরু করেছিল টাইবল্ট। রোমিও তাকে শান্তভাবে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সে সেসব কথায় কান না দিয়ে তরোয়াল বার করে। রেগে উঠে মারকুশিও-ও তরোয়াল বার করে-শুরু হয় লড়াই। রোমিও মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুজনকে ছাড়াতে চেষ্টা করে কিন্তু তার হাতের তলা দিয়ে মারকুশিওর বুকে তরোয়াল বসিয়ে দেয় টাইবল্ট। টাইবল্ট পালিয়ে যায় কিন্তু একটু পরে আবার ফিরে আসে। রোমিও এবার প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়সংকল্প ছিল, সঙ্গে সঙ্গে লড়াই শুরু হয়। আমি ছাড়াবার আগেই টাইবল্ট পড়ে যায় ও রোমিও দ্রুত পালায়। এই হল সত্য ঘটনা।

লেডী ক্যাপিউলেট অভিযোগ করলেন, বেনভোলিও মণ্টেণ্ডর আত্মীয়, তাই সে নিজেদের দিক টেনে মিথ্যে বলছে অন্ততঃ কুড়ি জন এই লড়াইয়ে সামিল ছিল, কুড়িজন মিলে এই একজনকে মেরেছে, রাজা আমি বিচার চাইছি রোমিও টাইবল্টকে হত্যা করেছে, তাকে বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে না।

রাজা বললেন, রোমিও টাইবল্টকে মেরেছে, টাইবল্ট মেরেছে মারকুশিওকে- তার রক্তের দাম দেবে কে? মন্টেও এতক্ষণ চুপ করেছিলেন, সুযোগ পেয়ে বললেন, রোমিও নয়, সে তা মারকুশিওর বন্ধু। তার দোষ সে আইন নিজের হাতে নিয়েছে। কিন্তু মারকুশিওকে হত্যার জন্যে টাইবল্টের মৃত্যুদণ্ডও হতে পারতো।

রাজা সঙ্গে সঙ্গে রোমিও নির্বাসনদণ্ড দিলেন এবং এর পরে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে দুই পরিবারকে বিপুল অর্থদণ্ড দিতে হবে বলে জানালেন।

রোমিওর বিরহে আকুল জুলিয়েট নিজের মনেই বলছিল, দিনের আলো নিভে যাক, মেঘলা রাত্রির অন্ধকার এখনই নেমে আসুক, আর সবার অলক্ষ্যে রোমিও যেন এই বাহুপাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রেমিক তার আপন সৌন্দর্যে পথ চিনে নিতে পারে। প্রেম যদি অন্ধও হয় তবু সে অন্ধকারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। রাতের অন্ধকার নামুক, রোমিও ফিরে এসো, রাতের অন্ধকার আলোময় হয়ে উঠুক। রাত্রির ডানায় শায়িত তাকে দাঁড়কাকের পিঠে পড়া নতুন বরফের মতো মনে হবে। রাতের অন্ধকার, আমায় রোমিওকে ফিরিয়ে দাও। আমার মৃত্যুর পর ওকে ফিরিয়ে নিও, ওর শরীর টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিও আকাশে- ও আকাশকে এত এত রমণীয় করে তুলবে যে সারা পৃথিবী রাত্রির প্রেমে পড়বে আর দিনের ঝলসানো সূর্যের দিকে ফিরেও তাকাবে না। আমি প্রেমের সৌধ রচনা করেছি কিন্তু তা আমার অধিকারে আসেনি। এই দিন তাই আমার কাছে বড় দীর্ঘ বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি যেন সেই শিশু যে নতুন পোশাক পরবে বলে পরবের প্রতীক্ষায় রয়েছে। এমন সময় নার্সকে দেখতে পেয়ে জুলিয়েট ভাবল ও নিশ্চয় রোমিওর কোন খবর এনেছে- রোমিও নামেই যেন কি এক স্বর্গীয় যাদু আছে। তারপরেই সে নার্সকে জিজ্ঞেস করে, রোমিওর খবর কি, ও কোথায়?

সে মারা গেছে, সে মারা গেছে, নার্স বিলাপ করতে থাকে, আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেল জুলিয়েট, সে আর নেই, তাকে হত্যা করা হয়েছে।

ঈশ্বর কি আমাদের প্রতি এত নির্দয় হতে পারেন, শুধু এইটুকু বলতে পারে জুলিয়েট।

ঈশ্বর না পারলেও রোমিও পারে ওঃ রোমিও, কে এ কথা ভেবেছিল, বিলাপ করে নার্স।

কিন্তু জুলিয়েটের বিলাপ যেন বাঁধ মানে না, বলে কেন তুমি আমাদের এত যন্ত্রণা দিলে। নার্স, রোমিও কি আত্মহত্যা করেছে? একবার হ্যাঁ বলো, তাহলে সাপের বিষের চেয়েও জোরাল বিষ গ্রহণ করব। তুমি হ্যাঁ বললে আমি যদি তা না করি তা আমি আমিই নয়।

কিন্তু নার্স বলে, আমি ওর আঘাতটা দেখেছি, সেটা ওর বুকে। রক্তাক্ত শরীরে সে পড়ে আছে। আমি তা দেখতে পারিনি-ওঃ আমার হৃদয় এখনই ফেটে যাক, সে আজ দেউলিয়া হয়ে গেছে।

এখনই যেন হৃদয় ভেঙে টুকুরো হয়ে যায় পৃথিবীর গতি যেন স্তব্ধ হয় যায়! তারপরেই টাইবল্টের শোকে আকুল হয়ে উঠে নার্স বলে, টাইবল্ট, টাইবল্ট, তুমি ছিলে আমার প্রিয় বন্ধু, একজন সৎ ভদ্র মানুষ, আমি কি তোমার মৃত্যু দেখার জন্যে বেঁচে ছিলাম।

শোকের মধ্যেও বিস্মিত জুলিয়েট প্রশ্ন করে, হঠাৎ অন্য রকম বলছ কেন? তাহলে কি রোমিওর সঙ্গে টাইবল্টও মারা গেছে? আমার প্রিয় আত্মীয় ও আমার প্রিয় স্বামী দু'জনেই আর নেই? দু'জনেই যদি চলে যায় তাহলে রইল কে?

নার্স জানায় টাইবল্ট মৃত আর রোমিওকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। রোমিও টাইবল্টকে হত্যা করেছে, তাই সে নির্বাসিত।

বিশ্বাস করতে মন চায় না জুলিয়েটের, আবার জিজ্ঞেস করে, রোমিও টাইবল্টকেও হত্যা করেছে?

হ্যাঁ, তাই, তাই... আমাদের কি দুর্ভাগ্য, সে-ই তাকে হত্যা করেছে।

জুলিয়েট আক্ষেপ করে, তোমার ওই সুন্দর চেহারা কি তাহলে ছদ্মবেশ? তোমার ওই ফুলের মতো মুখের আড়ালে কি একটা বিষধর সাপের বাস? তুমি আসলে ঘুঘুর পালকে সজ্জিত দাঁড়কাক, ভেড়ার চামড়ায় ঢাকা নেকড়ে, তোমাকে দেখলে যা মনে হয় তুমি তার বিপরীত স্বভাবের মানুষ? সাধুর ছদ্মবেশে শয়তান? আর কি কখনও একটা খারাপ বইকে চমৎকার ভাবে বাঁধাই করা হয়েছে?

জুলিয়েটের আক্ষেপের সঙ্গে নার্স সায় দিয়ে বলে, এখন মানুষের মনে বিশ্বাস ও সততা বলে কোন জিনিষ নেই। সব মুল্যবোধ হারিয়ে গেছে। জুলিয়েট, আমাকে একটু ব্র্যান্ডি দাও, এই দুঃখ যেন আমার বয়েস অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। রোমিওর লজ্জা হওয়া উচিত।

এবার কিন্তু নার্সের কথায় ফুঁসে ওঠে জুলিয়েট, ওসব বললে তোমার জিভ খসে পড়বে। লজ্জা পাওয়ার জন্যে তার জন্ম হয়নি, তার কপালে ভর করতে লজ্জাও লজ্জা পাবে। সে সম্মানের যোগ্য।

এই বিশ্বের অধিকারী যে আমি কিনা তাকে বিদ্রূপ করেছিলাম। আফশোস করে জুলিয়েট। সে তোমার ভাইকে হত্যা করেছে আর তুমি তার সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলছ। অভিযোগ করে নার্স।

আমি কি আমার স্বামী সম্পর্কে খারাপ কথা বলব? বললে জুলিয়েট, রোমিও, আমি তোমার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী, আমি যদি তোমাকে কটু কথা বলি তাহলে কেই বা তোমার সম্পর্কে ভাল কথা বলবে? কিন্তু কেন, কেন তুমি আমার ভাইকে মারলে? আচ্ছা ওই শয়তান ভাইও তো আমার স্বামীকে হত্যা করতে পারত! আমার চোখের জল আজ শুকিয়ে গেছে। তবে মনের গভীরে একটি সন্তুষ্টিও আছে আমার স্বামী বেঁচে আছে, টাইবল্ট তাকে হত্যা করতে পারেনি। এ তো সান্ত্বনা। কিন্তু টাইবল্ট মৃত ও রোমিও নির্বাসিত। নির্বাসিত একটা শব্দ যেন দশ হাজার টাইবল্টের মৃত্যুর সমান। টাইবল্টের মৃত্যু দিয়েই যদি ঘটনার শেষ হতো তাহলেই যথেষ্ট দুঃখের ব্যাপার হতো-কিন্তু তার ওপর আবার রোমিও নির্বাসিত। আচ্ছা বাবা, মা, টাইবল্ট, রোমিও, জুলিয়েট, সবাই কি মারা গেছে! রোমিও নির্বাসিত। ওই কথাটার মধ্যেই তো কোন সীমা পরিসীমা নেই। নার্স আমার বাবা মা কোথায়?

টাইবল্টের মৃতদেহ জড়িয়ে কাঁদছে, তুমি কি তাদের কাছে যাবে?

নার্সের কথায় জুলিয়েট বলে, তাঁরা কি চোখের জলে টাইবল্টের আঘাত ধুইয়ে দিচ্ছেন! কিন্তু আমার দুঃখ তো রোমিওর নির্বাসনের জন্যে! আমার মনে হচ্ছে বিয়ের পরেই আমি বিধবা হয়ে গেলাম।

তুমি ঘরে থাকো, আমি রোমিওকে তোমার কাছে এনে দেব, নার্স সান্ত্বনা দিয়ে বললে, আমি জানি সে কোথায় আছে। শোন, রোমিও আজ রাতে এখানে আসবে, আমি নিয়ে আসব, সে এখন ফাদার লরেন্সের ঘরে লুকিয়ে আছে। জুলিয়েট বললে, ওর কাছে যাও। এই আংটিটি তাকে দিও আর বোলো সে যেন শেষ বিদায় জানাতে আমার কাছে আসে।

নিজের ঘরে চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিয়ে ফাদার লরেন্স নিজের মনেই বললেন, দুর্ভাগ্য যেন রোমিওর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। তারপর তিনি পাশের ঘরে অপেক্ষারত রোমিওকে ডাকলে। রোমিও এসে জিজ্ঞেস করল ফাদার, খবর কি? রাজা কি নির্দেশ দিয়েছেন? আমার কপালে কোন দুঃখ অপেক্ষা করছে। ফাদার লরেন্স জানালেন মৃত্যুদণ্ড নয়, তাকে ভেরোনা থেকে নির্বাসিত করা হয়েছে। রোমিও সান্ত্বনা পায় না বরং সে বলে নির্বাসন! এর চেয়ে মৃত্যু ভাল ছিল। নির্বাসন আমার কাছে মৃত্যুর চেয়েও ভীতিজনক।

ভেরোনা থেকে তুমি নির্বাসিত হয়েছ কিন্তু ধৈর্য ধরো, পৃথিবীটা অনেক বড়, ফাদার বোঝাবার চেষ্টা করেন। -আমার কাছে ভেরোনাকে বাদ দিয়ে কোন জগৎ নেই, থাকলে সে তো নরক। জানালো রোমিও, আমার কাছে ভেরোনা থেকে নির্বাসন মানে পৃথিবী থেকে নির্বাসন। নির্বাসন মানে তাই মৃত্যু, মৃত্যুকে নির্বাসন বলার অর্থ সোনালী কুঠার দিয়ে গলা কাটা আর যে আঘাতে আমার মৃত্যু হয়েছে। তাকে কৌতুকের দৃষ্টিতে দেখা।

ফাদার লরেন্স বললেন, অকৃতজ্ঞ হয়ো না, যে অপরাধ তুমি করেছে তার শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যু কিন্তু রাজা তোমাকে নির্বাসন দণ্ড দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। এটা তোমায় ক্ষমা করার সমতুল্য অথচ তুমি সেটা বুঝতে চাইছ না।

না এটা ক্ষমা করা নয় যন্ত্রণা দেওয়ার ফাদারের যুক্তি মানতে রাজি নয় রোমিও, জুলিয়েট এখানে থাকবে, এখানকার প্রত্যেক কুকুর বেড়াল ইঁদুর তাকে দেখবে, আমি তার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হবো। কীট-পতঙ্গও যা পাবে রোমিও তা পাবে না। তারা জুলিয়েটকে স্পর্শ করতে পারবে, তার ঠোঁট স্পর্শ করতে পারবে আর রোমিওর ভাগ্যে নির্বাসন। আর আপনি বলছেন নির্বাসন মৃত্যু নয়! আমাকে মারার জন্যে কি অন্য কোন বিষ কিংবা ধারালো ছোরা ছিল না যে নির্বাসন দিতে হলো।

ফাদার লরেন্স বললেন, পাগল ছেলে, আমার কথা শোন, কিছুটা দার্শনিকতা দিয়ে ব্যাপারটা ভাব।

চুলোয় যাক দার্শনিকতা। দর্শন কি একটা জুলিয়েট তৈরী করতে পারে? পারে কি একটা শহরকে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসাতে। পারে কি রাজার আদেশ বদলে দিতে? কোনটাই পারে না তাই দর্শনের কথা আমায় বলবেন না। এবার ফাদার বিরুক্তির সঙ্গে বললেন, তাহলে তো বুঝতে হবে আমি একটা পাগলের সঙ্গে কথা বলছি কারণ পাগলেরা কিছু শুনতে পায় না।

আর জ্ঞানী লোক যখন দেখতে পায় না? প্রশ্ন করে রোমিও। ফাদার উত্তর দেন, তোমার অবস্থা সম্পর্কে আমি তোমার সঙ্গে একমত নই।

রোমিও কিছুটা উদ্ধতভাবেই বলে, যা আপনি নিজে উপলব্ধি করতে পারবেন না তা নিয়ে কোন কথা বলবেন না। আপনি যদি আমার মতো তরুণ হতেন, যদি জুলিয়েটকে ভালবেসে এক ঘণ্টা আগে বিয়ে করতেন, তারপর টাইবল্টকে হত্যা করে যদি আপনাকে আমার মতো নির্বাসনে যেতে হতো তাহলে বলতেন। তাহলে আপনিও আমার মতো মাথার চুল ছিঁড়তেন, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কবরের গভীরতা মাপতেন।

কে যেন দরজার কড়া নাড়ে। ফাদার রোমিওকে বললেন, লুকিয়ে পড়তে কিন্তু রোমিও রাজি হয় না। আবার কড়া নাড়ার শব্দ হয়। ফাদারের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও রোমিও ভেতরে যায় না। ফাদার যখন জানতে পারলেন যে জুলিয়েট-প্রেরিত নার্স দরজার কড়া নাড়ছে তখন তিনি দরজা খুলে দিলেন।

নার্স এসেই রোমিওর খোঁজ করে। ফাদার রোমিওকে দেখিয়ে বলেন, ওই যে মাটিতে বসে চোখের জলে ভাসছে। জুলিয়েটেরও ওই একই অবস্থা, নার্স জানায় তারপর রোমিওকে বলে, তুমি বাপু উঠে দাঁড়াও অন্ততঃ জুলিয়েটের জন্যে। অত ভেঙে পড়লে চলবে কেন?

রোমিও উঠে দাঁড়াল তারপর নার্সকে বলে, আমাকে তার কথা বলো। সে এই ঘটনা সম্পর্কে কি ভাবছে? আমি কি তার চোখে সাধারণ খুনী মাত্র? সে কোথায়, কেমন আছে? আমাদের এই ব্যর্থ প্রেম সম্পর্কে সে কি বলছে?

প্রশ্নবাণে জর্জরিত নার্স উত্তর দিল, সে কিছুই বলছে না, কেবল কেঁদেই চলেছে, এখন বিছানায় পড়ে আছে আর মাঝে মধ্যে রোমিও আর টাইবল্ট বলে চিৎকার করে উঠছে; তারপর আবার শুয়ে পড়ছে। নার্সের কথায় রোমিও আপুতভাবে বলে, আমার এই হাত তার ভাইকে হত্যা করেছে আর তাই আমার নামও তার বুকে বন্দুকের গুলির মতোই বিধছে, ফাদার, আপনি বলুন আমার শরীরের কোন অংশে আমার নামটা রয়েছে, সেই অশংটা আমি নিজে হাতে বাদ দিয়ে দেব। হাতের ছোরা তোলে রোমিও। বাধা দিয়ে ফাদার ধমক লাগান, রোমিও, তুমি কি পুরুষ মানুষ? মেয়েদের মতো চোখের জল ফেলছ! তোমার ওই পুরুষের চেহারার মধ্যে একটা নারী রয়েছে। তুমি আমায় অবাক করলে। আমি তোমায় স্বাভাবিক ভেবেছিলাম। তুমি কি সত্যি টাইবল্টকে হত্যা করেছ। এখন তুমি নিজেকে মারতে চাও! এবং সেইসঙ্গে সেই মেয়েটিকেও যে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে রয়েছে। ছিঃ তুমি পুরুষ জাতির লজ্জা! তোমার ওই মোমের চেহারায় পুরুষের সাহস বীর্য কিছুই নেই। তোমার ভালবাসায় নেই গভীরতা। তুমি তোমার ভালবাসাকেই হত্যা করতে চলেছ যেমন করে অদক্ষ গোলন্দাজ নিজেদের দিকেই কামান দেগে বসে। তোমার জুলিয়েট বেঁচে আছে তার, জন্যেই তুমি তার ভাইকে মারতে বাধ্য হয়েছ, তুমি না মারলে সেই তোমায় মারতো। সেদিক থেকে তুমি ঠিক আছ। বিচারেও প্রাণদণ্ডের বদলে তোমাকে নির্বাসনদণ্ড দেওয়া হয়েছে; তাতেও তোমার খুশি হওয়া উচিত। আর তুমি ঈশ্বরের এই করুণাকে হেলায় হারাচ্ছ। মনে রেখো এই রকম মানুষের ভাগ্যে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই জোটে না। যাও, তুমি তোমার ভালবাসার পাত্রীটির কাছে যাও, তবে প্রহরা বসা পর্যন্ত ওখানে অপেক্ষা কোরো না। মনে রেখো তোমার এখন মান্ডুয়া শহরে থাকার কথা। আমি তোমার বন্ধুদের বোঝাবার চেষ্টা করব যাতে তোমার হয়ে রাজার কাছে ক্ষমা চায়। আমিও তোমার হয়ে রাজাকে বলব যাতে তিনি তোমার শাস্তি মুকুব করেন। ভেবে দেখো তখন তুমি ফিরে এলে সকলের কত আনন্দ হবে। নার্স, তুমি আগে বাড়ি যাও আর আমার নাম করে জুলিয়েটকে বোলো যেন সে বাড়ির সবাইকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বলে। রোমিও যাচ্ছে।

নার্স রোমিওর হাতে জুলিয়েটের দেওয়া আংটিটা দেয়। ফাদার আবার রোমিওকে মনে করিয়ে, দিলেন ভোরের আগেই যেন সে মান্তুয়ার দিকে রওনা দেয়; সকাল হয়ে গেলে তাকে ছদ্মবেশে শহরের সীমা অতিক্রম করতে হবে। ফাদার বলেন যে একজন লোক মারফত তিনি রোমিওকে ভোরোনার সব খবরাখবর জানাবেন। রোমিওর হাত নিজের হাতে নিয়ে ফাদার তাকে বিদায় জানালেন।

সমস্ত ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে আমরা আমাদের মেয়েকে বোঝাবার সময় পাইনি, প্যারিসকে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন ক্যাপিউলেট, ও ওর ভাই টাইবল্টকে খুবই ভালবাসতো, আমিও বাসতাম। যাকগে, আমাদের সবাইকেই তো একদিন না একদিন মরতে হবে। আজ রাতে জুলিয়েট নীচে নামবে না, আমিও ঘণ্টাখানেক আগেই শুয়ে পড়তাম তোমার জন্যেই বসে আছি।

ক্যাপিউলেটের কথায় সায় দেয় প্যারিস, বলে, হ্যাঁ, দুঃখের সময় তো আর ভালবাসার কথা বলা যায় না। লেডী ক্যাপিউলেটকে বিদায় জানিয়ে প্যারিস বলে, আচ্ছা ম্যাডাম, আপনার মেয়েকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন।

লেডী ক্যাপিউলেট বললেন, তুমি চিন্তা কোরো না, কাল সকালেই আমি জুলিয়েটের মন জেনে নেব। আজ ও বড় মনমরা হয়ে আছে।

প্যারিস চলেই যাচ্ছিল কিন্তু ক্যাপিউলেট আবার তাকে ডাকলেন, স্যার প্যারিস, আমি ওকে খুব বোঝাবার চেষ্টা করব। আমার মনে হয় ও আমার কথা শুনবে। না, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহই নেই। স্ত্রীর দিকে ফিরে ক্যাপিউলেট বললেন, তুমিও ওকে প্যারিসের কথা বলে বুঝিও আর বোলো যে আগামী বুধবার... আজ কি বার? সোমবার, প্যারিস উত্তরটা দিয়ে দেয়।

সোমবার! হা-হা তাহলে বুধবার খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। বৃহস্পতিবার থাক, হ্যাঁ বৃহস্পতিবার, তাকে বোলো, এই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিটিকে তাকে বরমাল্য দিতে হবে। তুমি তৈরী হতে পারবে তো? তোমার কি মনে হয় একটু বেশী তাড়াহুড়া হয়ে গেল? বেশী হৈচৈ-এর দরকার নেই, দু'-একজন বন্ধুবান্ধব। টাইবল্ট, সে মারা গেছে-লোকে খারাপ ভাবতে পারে, তাই ধরো জনা ছ'য়েক বন্ধুবান্ধবকে ডাকব, ব্যাস আর নয়। কিন্তু প্যারিস, বৃহস্পতিবারের ব্যাপারে তোমার কি মত? প্যারিস বললে, আমার তো মনে হচ্ছে আগামী কালই বৃহস্পতিবার হলে ভাল হতো।

ঠিক আছে, তাহলে বৃহস্পতিবারই ঠিক রইল, প্যারিসকে বিদায় জানিয়ে ক্যাপিউলেট স্ত্রীকে বললেন, শোবার আগে জুলিয়েটের কাছে যেও, তাকে প্রস্তুত করো- আমার ঘরে আলো দাও, রাত অনেক হলো ভোরই হয়ে গেছে বলা যায়।

সেই রাতেই দড়ির মই বেয়ে রোমিও এসেছে জুলিয়েটের ঘরে। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে জুলিয়েট রোমিওকে জিজ্ঞেস করে, তুমি এখনই চলে যাবে? এখন তো ভোর হয়নি! তুমি যে পাখির উদ্বুক শুনছ সেটা নাইটিঙ্গেলের, লার্কের নয়। ওই নাইটিঙ্গেল পাখিটা কাছের বেদানা গাছটাতে বসে রোজ রাতেরবেলা গান করে। বিশ্বাস করে। ওই স্বর নাইটিঙ্গেলের।

না ওটা লার্ক, ভোর হয়ে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাত শেষ হয়ে আসছে, দূরে কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ে দিনের আলোর আভাস। হয় আমাকে এখনই চলে গিয়ে বাঁচতে হবে আর নয়তো তোমার কাছে থেকে মরতে হবে।

জুলিয়েট তবু অনুনয় করে, শোন, ওই আলো দিনের আলো নয়, আমি জানি, এ সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা কোন উল্কার আলো যা তোমাকে মাতুয়ার পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, তাই আর একটু থাকো, এখনই যাবার দরকার নেই। -বেশ তাই হোক, বলে রোমিও, আমাকে ওরা নিয়ে যাক, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করুক আমি তাতে রাজি, রাজি তুমিও। আমি তোমাকে বলব ওই যে ধূসর আলো তা দিনের আলো নয় ওই পাখির গান তা লার্কের নয়। তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। মৃত্যু আসুক, আমি তাকে স্বাগত জানাবো। তুমি আমায় ছাড়তে চাইছ না, আমি যাব না- এসো আমরা কথা বলি, এখনও ভোর হয়নি।

জুলিয়েট এবার সম্বিৎ ফিরে পায়, বলে না রোমিও, হয়েছে, হয়েছে, পালাও, তুমি পালাও-ওটা লার্কই, আজ বেসুরো গাইছে, তার গলা আজ কর্কশ। ওই পাখিটা আজ আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছে। আলো, আরও আলো হচ্ছে তুমি চলে যাও রোমিও, মিনতি করে জুলিয়েট। রোমিও বলে, আলো, আরোও আলো আর আমাদের মনে অন্ধকার, আরও অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।

নার্স দ্রুত ঘরে ঢুকে জানায়, যে জুলিয়েটের মা তার ঘরে আসছেন। রোমিও তুমি জানালা দিয়ে পালাও, অনুনয় করে জুলিয়েট বলে, জানলা দিয়ে দিয়ে আলো আসুক আর আমার প্রাণ বেরিয়ে যাক। রোমিও জানলা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে তারপর দড়ির মই বেয়ে নীচে নামতে থাকে। জুলিয়েট বলে, রোমিও, প্রতিদিন আমায় তোমার খবর দেবে। এখন আমার কাছে প্রতিটি মুহূর্ত সুদীর্ঘ। তাই আমি আবার যখন আমার রোমিওকে দেখব তখন আমার বয়েস অনেক বেড়ে যাবে। রোমিও তার সম্মতি জানায়, বলে সুযোগ পেলেই আমি তোমায় আবার খবর দেব।

আর কি আমাদের দেখা হবে? প্রশ্ন করে জুলিয়েট। রোমিও বলে, তাতে কোন সন্দেহ নেই, এই দুঃখের পরে আমাদের মিলন মধুরতর হয়ে উঠবে।

দড়ির মই বেয়ে রোমিও তখন অনেক নীচে নেমে গেছে। আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি না কেন? সেখান থেকে জুলিয়েটের কণ্ঠস্বরকে কান্নার মতো শোনায়। রোমিও চেঁচিয়ে বলে, তোমাকেও আমি দেখতে পাচ্ছি না, বিদায়।

জুলিয়েট বলে, ভাগ্যদেবী, লোকে তোমায় বলে চঞ্চলা, তুমি যদি চঞ্চলাই হও তাহলে তাকে আবার শিগগির ফিরিয়ে দিও।

লেডী ক্যাপিউলেট এসে জুলিয়েটকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ও তুমি ঘুম থেকে উঠে পড়েছ? মা, জুলিয়েট সম্বিত ফিরে পায়, তারপর ভাবে মা কি এত ভোরে উঠেছে না ঘুমোতেই যায়নি! কি জন্যে আজ এই সময়ে মা আমার কাছে এল! জানলার কাছ থেকে সরে এল জুলিয়েট। লেডী ক্যাপিউলেট জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ জুলিয়েট?

ভাল নেই মা, উত্তর দেয় জুলিয়েট?

ভাইকে হারিয়ে এখনও কাঁদছ? কাঁদলে কি সে ফিরে আসবে? এবার নিজেকে সামলে নাও। কিছু শোকেই ভালবাসার আধিক্য বোঝা যায় কিন্তু বেশী শোক করলে মনে হতে পারে যে বুদ্ধির অভাব আছে।

তবু আমাকে কাঁদতে দাও, মিনতি করে জুলিয়েট। লেডী ক্যাপিউলেট বললেন, তাতে তো মানুষটা ফিরবে না।

না ফিরুক, আমি তো তাকে হারানোর ক্ষতিকে অনুভব করব, বলে জুলিয়েট।

শোন্ মা, কান্নাকাটি করিস না কারণ সেই শয়তান যে ওকে হত্যা করেছে সে এখনও বেঁচে

আছে, বলেন, লেডী ক্যাপিউলেট।

কে মা?

কেন রোমিও।

মা, জুলিয়েট বলে, টাইবল্ট আর তার হত্যাকারী দুজনেই আজ বহু দূরে চলে গেছে তবু শোক

বাধা মানছে না।

লেডী ক্যাপিউলেট বললেন, তার কারণ হলো বিশ্বাসঘাতক হত্যাকারীটা বেঁচে আছে।

হ্যাঁ মা, ও আমাদের হাতের বাইরে। ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার কোন উপায় নেই, জুলিয়েট তার কান্নাভেজা গলায় বলে।

সান্ত্বনা দিয়ে লেডী ক্যাপিউলেট বললেন, তুই কাঁদিস না, আমরা রয়েছি কি করতে? আমি একজনকে মান্ডুয়া পাঠাব। যে প্রতিশোধ নেওয়ার কাজটা সমাধা করতে পারবে যাতে ও শিগগির টাইবল্টের সঙ্গী হতে পারে। ওই মানুয়াতেই শয়তানটা আছে। তাহলে তুমি নিশ্চয়ই তৃপ্তি পাবে।

সেই একই রকম কান্নামেশানো গলায় জুলিয়েট বলে, হ্যাঁ মা রোমিওকে মৃত না দেখা পর্যন্ত আমি সন্তুষ্ট হবো না-আমার আত্মীয়ের মৃত্যুতে আমি এতটাই বিচলিত। যদি তুমি কোন লোক পাও যে রোমিওকে হত্যার বিষ নিয়ে যাবে আপমি সেই বিষ তৈরী করে দেব যাতে রোমিও ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে। ওঃ ওর নাম শুনলে আমার হৃদয় ঘৃণার সঞ্চার হচ্ছে।

আমি তেমন লোকের খোঁজ করে দেখছি লেডী ক্যাপিউলেট বললেন, এখন তোমায় একটা সুখবর শোনাই।

হ্যাঁ, এই দুঃখের সময় সুখবরের দরকার আছে, বলো মা, খবরটা কি?

হ্যাঁ সোনা, তুই তো জানিস তোর বাবা তোর প্রতি কতটা নজর দেন-উনিই তোর বিয়ের দিন পাকা করে ফেলেছেন।

কবে মা?

সামনের বৃহস্পতিবার সকালে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে প্যারিসের সঙ্গে। সেন্ট পীটার্স গীর্জায়।

তোমাকে কনে হিসেবে সেখানে মানাবে ভাল, জুলিয়েট এবার বলে, সেন্ট পীটারের গীর্জায় কনে হিসেবে আমায় ভাল মানাবে না মা। এত তাড়াহুড়ো করছ কেন, আমি যাকে বিয়ে করব সে সুখী হবে না বরং কষ্টই পাবে। তুমি বাবাকে বলো আমি এখন বিয়ে করব না। আর বিয়ে করলেও প্যারিসকে নয়। আমি যাকে ঘৃণা করি বলে মনে করো সেই রোমিওকে করব।

জুলিয়েটের কথা শুনে লেডী ক্যাপিউলেট চমকে ওঠেন। তাঁর স্বামীকে আসতে দেখে বলেন, বাবা আসছেন যা বলবার তুমি নিজেই তাকে বলো-দেখ তিনি কিভাবে নেন্।

ক্যাপিউলেট এলেন, সঙ্গে নার্স। ক্যাপিউলেট বললেন, সূর্যাস্তের পরে বাইরে হিম পড়ে কিন্তু আমার ভাইপোর মৃত্যুতে ঝম ঝম করে বৃষ্টি নেমেছে। তারপর জুলিয়েটকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কেমন আছ জুলিয়েট? এখনও চোখের জল ফেলছ? তোমার চোখ তো দেখছি সমুদ্র, সেখানে চোখের জলের জোয়ার-ভাঁটা, তুমি যেন একটা ভাসমান তরী, নোনা জলের সমুদ্রে ভাসছ আর তোমার ওই দীর্ঘশ্বাস হলো ঝড়। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওকে খরবটা দিয়েছ তো?

বলেছি কিন্তু ও রাজি নয়, বললেন লেডী ক্যাপিউলেট। রাজি নয়! ক্ষেপে উঠলেন ক্যাপিউলেট, ওর তো আমাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত! ওর তো গর্বিত হওয়া উচিত! ও কি ওর ভাল বোঝে না! ওর তুলনায় বরং বেশী যোগ্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে হতে চলেছে!

জুলিয়েট শান্তভাবে বলে গর্বিত হওয়ার প্রশ্ন নেই তবে তিনি নিশ্চিয়ই আমাদের ধন্যবাদার্হ।

প্রচণ্ড রেগে ক্যাপিউলেট বললেন, কেন, কেন, কেন? কি যুক্তি তোমার? গর্বিত ধন্যবাদার্হ, গর্বিত হবার প্রশ্ন নেই-এসব কোন ধরনের কথাবার্তা! তবে যাই বলো না কেন, বৃহস্পতিবার সেন্ট পিটার্স গীর্জায় প্যারিসের সঙ্গে তোমার বিয়ে, তার জন্যে প্রস্তুত থেকো। নয়তো তোমায় আমি টানতে টানতে নিয়ে যাব। বোকা মেয়ে কোথাকার! এখন চোখের সামনে থেকে চলে যাও।

স্বামীকে শান্ত করতে এগিয়ে আসেন লেডী ক্যাপিউলেট। বললেন, চুপ করো। তুমি কি পাগল হয়ে গেছ! জুলিয়েট নতজানু হয়ে অনুনয় করে, বাবা, ধৈর্য ধরে আমার একটা কথা শোন।

কিন্তু কোন কথাই শুনতে রাজি নন ক্যাপিউলেট, বলেন, চুপ করো অবাধ্য মেয়ে। আমি তোমায় বলছি কি করতে হবে-তোমায় বৃহস্পতিবার গীর্জায় যেতে হবে আর নয়তো আমার মুখদর্শন করবে না। আমার সঙ্গে কথা বোলো না, তর্ক কোরো না। তারপর স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে ক্যাপিউলেট বললেন, ভগবান আমাদের একটা সন্তান দিলে আমরা ভেবেছিলাম ভালই হলো এখন দেখছি ওই একটা সন্তানও বোঝা হয়ে দাঁড়াইতে পারে। ওকে সন্তান হিসেবে পাওয়াটা যেন আমাদের কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও।

নার্স আর চুপ করে থাকতে পারে না, বলে, লর্ড, জুলিয়েট আপনাদের সংসারে আশীর্বাদ কিন্তু তার স্বভাবের জন্যে আপনি দায়ী।

ক্যাপিউলেট ধমক দিলেন, কেন পণ্ডিতানী? ভাল চাও তো তুমি তোমার বকবকানি থামাও।

বৃদ্ধা নার্স তবু চুপ করে থাকতে পারে না। বলে, আমি তো খারাপ কিছু বলিনি, কেউ কি কোন কথা বলবে না?-চুপ করো মূর্খ, বুড়িদের আড্ডায় গিয়ে বকবক করো, এখানে তার দরকার নেই।

শোনো তুমি বড় বেশী রেগে গেছ, লেডী ক্যাপিউলেট স্বামীকে শান্ত করতে চান। কিন্তু ক্যাপিউলেট একই রকম ভাবে বললেন, তোমরা আমায় পাগল করে দেবে- দিনে রাতে, কাজে, বিশ্রামে একা কিংবা বন্ধুদের মধ্যেও আমি ওর ভাল বিয়ের কথা ভেবেছি। এখন একটা সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে পাওয়া গেছে সুপুরুষ, ঝকঝকে চেহারা, গুণী ছেলে আর ও বলে কিনা আমি বিয়ে করব না।

-আমি ভালবাসতে পারব না, আমার বয়েস খুব কম, আমায় ক্ষমা করো। তোমাকে বিয়ে করতে হবে না, আমি ক্ষমাও করব কিন্তু আমার বাড়িতে তোমার জায়গা হবে না। ভাল করে ভেবে দেখ, কথার কথা কিছু বলা আমার ধাতে নেই। বৃহস্পতিবার এসে গেল, নিজেকে নিজে বোঝাও। আমার কথা শুনলে আমি আমার বন্ধুর হাতে তোমায় তুলে দেব আর কথা না শুনলে ভিক্ষে করে খাও, রাস্তায় পড়ে মরো আমি তোমায় মেয়ে বলে স্বীকারই করব না। ভাল করে ভেবে দেখ। ভারী ভারী পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন ক্যাপিউলেট। জুলিয়েট কাঁদে আর মাকে বলে, দোহাই মা তোমরা আমাকে ত্যাগ কোরো না, একমাস কি এক সপ্তাহের জন্যেও এই বিয়ে পিছিয়ে দাও যদি না পেছাও তাহলে আমার ফুলশয্যার বিছানা পেতো মাটির নীচে যেখানে টাইবল্ট শুয়ে আছে।

আমাকে কিছু বোলো না, তোমার যা খুশি তাই করো, লেডী ক্যাপিউলেট চলে যান। জুলিয়েট এবার নার্সের কাছেও বিলাপ করে চলে। নার্স পরামর্শ দেয়, যা বলছি তাই করো-রোমিও নির্বাসিত, সে তোমায় দেখতে আসছে না; যদি আসেও তাহলেও চুপিসাড়ে আসবে। এখানে যা পরিস্থিতি তুমি প্যারিসকে বিয়ে করে নাও-চমৎকার লোক, রোমিও ওর কাছে কিস্যু না। প্যারিসের যা সুন্দর ঝকঝকে চোখ তা ঈগলেরও নেই। আমি বলছি এই দ্বিতীয় বিয়েতে তুমি সুখী হবে। এই পাত্র প্রথমজন থেকেও ভাল। যদি তা নাও হয় ধরো প্রথমজন মারাই গেছে- তাকে তোমার কোন কাজেটা লাগবে।

তুমি তোমার মন থেকে ও কথা বলছ? নার্সকে প্রশ্ন করে জুলিয়েট।

তাছাড়া কি?

জুলিয়েট এবার নার্সকে বললে, বেশ, তাহলে তুমি ভেতরে যাও, মাকে বলো, আামি বাবাকে রাগিয়েছি, তাই আমি ফাদার লরেন্সের কাছে যাচ্ছি স্বীকারোক্তি করে পাপমুক্ত হতে।'

এটা তুমি ঠিক করছ, বলে নার্স তারপর ভেতরে যায় মনিব-গিন্নীকে বলতে।

জুলিয়েট নিজের মনেই স্বামী-নিন্দার জন্যে অনুশোচনা করে, তারপর বলে, যাই ফাদার লরেন্সের কাছে যাই পরামর্শ নিতে। যদি শেষ পর্যন্ত কিছু করে উঠতে না পারি মরার পথ তো খোলা রইলই।


নোট: প্রিয় পাঠক, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের লেখা রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট অসাধারণ একটি বাংলা ভাষায় অনুবাদকৃত প্রেমের নাটকের ৩য় পর্ব আজ শেষ করলাম। গল্প প্রেমিকদের সারা পেলে পরবর্তীতে আবার ৪র্থ পর্ব খুব শীঘ্রই পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url