কবিতা: আত্মহত্যার ইতিকথা। Attohottar Eti Kotha । লেখক আল আব্বাস রবিন
"একদিন পূর্ণ শান্তি নিয়ে বাঁচার তরে" "আত্মহত্যার ইতিকথা" কবিতাটি আধুনিক মানুষের আত্মিক সংকট, নৈতিক অবক্ষয় এবং এক অন্তহীন চক্রের মধ্যে আটকা পড়ার এক মর্মস্পর্শী চিত্রায়ন। এটি কেবল একটি কবিতা নয়, বরং মানবজাতির বর্তমান অবস্থার উপর এক গভীর দার্শনিক মন্তব্য, যা পাঠকের বিবেককে নাড়া দেয় এবং আত্মজিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। কবি এখানে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সাহসী ভাষায় মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের এক অন্ধকার দিক উন্মোচন করেছেন, যেখানে সুখের অন্বেষণে মানুষ বারংবার নিজেকেই ধ্বংস করে এবং এক কলঙ্কিত ইতিহাস রেখে যায় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
কবিতার নাম: আত্মহত্যার ইতিকথা
লেখক: আল আব্বাস রবিন
একদিন পূর্ণ শান্তি নিয়ে বাঁচার তরে
আমরা প্রতি মুহুর্তে হাজারবার আত্মহত্যা করি,
অথচ কেউ দেখেনা এই মৃতগুলোকে।
আবার ফিরে এসে পৃথিবীর হাল ধরে পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচিয়া রাখতে।
প্রতিবার মানুষগুলো রাজনীতিকদের মতো
ভালোবাসতে ভুলে যায়।
তাদের দেখে শতসহস্র প্রেমিক প্রেমিকা যুগল
যুবক যুবতী ছাত্র বৃদ্ধ ধার্মিক অধার্মিক সবাই
লজ্জাহীনতায় মুখ থুবরে পরে লজ্জাস্থানের
দাস হয়ে যায়।
তারপর আবার হত্যা হয়,
নাহ্ হত্যা নয় আত্মহত্যা।
প্রতিদিন সে নিজের চোখের, কানের, মুখের,
অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মৃত্যু ঘটায় আবার সে ফিরে আসে
পরবর্তীদের হাল ধরবে বলে।
অথচ সে যখন আসে তখন একটা লজ্জাজনক
ইতিহাস নিয়ে আসে!
তার ধর্ষক নামের ইতিহাস।
সুখ পাখিগুলো ফের এসে ঘুরে যায়
এই ডাল ওই ডাল হয়ে,
কিন্তু তারা কোনো ডালে স্থির হয়ে কোনো বোনের
বুকফাটা চিৎকারের সাক্ষী হতে চায়না।
পরবর্তী প্রজন্মরাও আসে,
পূর্ববর্তীদের সাজানো গুছানো একটা রঙিন
পৃথিবী পায় হাতের মুঠোয়।
আর সাথে পায় হাজারবার আত্মহত্যা করা পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত একটা নোংড়া ইতিহাস।
যেখানে বসবাস করে লজ্জাহীন লজ্জাস্থানের
দাস বনে যাওয়া লজ্জাজনক কিছু অন্তর।
সেই ইতিহাস পড়ে লজ্জাস্থানও লজ্জায় আত্মহত্যা করে।
"আত্মহত্যার ইতিকথা" কবিতার মুলভাব বিশ্লেষণ:
প্রিয় পাঠক, আত্নহত্যার ইতিকথা কবিতার মূলভাব নিচে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
আত্মহত্যার প্রতিচ্ছবি: দৈনন্দিন জীবনের এক নীরব ট্র্যাজেডি
কবিতার শুরুতেই কবি এক তীব্র চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন: "আমরা প্রতি মুহুর্তে হাজারবার আত্মহত্যা করি, / অথচ কেউ দেখেনা এই মৃতগুলোকে।" এই পংক্তিগুলো তাৎক্ষণিকভাবে পাঠককে এক গভীর উপলব্ধির মুখোমুখি করে। এখানে 'আত্মহত্যা' কেবল শারীরিক মৃত্যু নয়, বরং নৈতিক, আত্মিক এবং মানবিক মূল্যবোধের মৃত্যু। প্রতিদিনের জীবনে আমরা নানাভাবে নিজেদের মূল্যবোধকে বিসর্জন দিই, নিজেদের স্বপ্নকে হত্যা করি, নিজেদের আদর্শ থেকে সরে আসি। এই নীরব আত্মহনন সমাজের চোখে ধরা পড়ে না, কারণ এর কোনো বাহ্যিক ক্ষত নেই। কিন্তু এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী, যা ব্যক্তির অন্তর এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের উপর এক অন্ধকার ছায়া ফেলে। এই আত্মহত্যার ফলেই মানুষ তার মানবিক গুণাবলী হারিয়ে ফেলে, যা পরবর্তী পংক্তিতে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ভালোবাসার অবক্ষয় ও নৈতিক স্খলন
"প্রতিবার মানুষগুলো রাজনীতিকদের মতো / ভালোবাসতে ভুলে যায়।" এই পংক্তিটি বর্তমান সমাজের এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা তুলে ধরে। যেখানে রাজনীতিতে স্বার্থপরতা এবং ভণ্ডামি প্রকট, সেখানেই মানব সম্পর্কেও সেই একই স্বার্থপরতা সংক্রমিত হয়েছে। ভালোবাসা, যা মানব সম্পর্কের মূল ভিত্তি, তা যেন আজ এক ম্লান স্মৃতি। ভালোবাসার অভাবের ফলস্বরূপ জন্ম নেয় এক চরম নৈতিক স্খলন: "তাদের দেখে শতসহস্র প্রেমিক প্রেমিকা যুগল / যুবক যুবতী ছাত্র বৃদ্ধ ধার্মিক অধার্মিক সবাই / লজ্জাহীনতায় মুখ থুবরে পরে লজ্জাস্থানের / দাস হয়ে যায়।" এই পংক্তিগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট এবং নির্মমভাবে আধুনিক সমাজের যৌন অবক্ষয়কে নির্দেশ করে। ধর্ম, বয়স বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে মানুষ যখন শুধুমাত্র পাশবিক প্রবৃত্তির দাস হয়ে যায়, তখন মানব সমাজের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এটি এক গভীর লজ্জা এবং অবমাননার চিত্র, যা ব্যক্তির আত্মসম্মান এবং নৈতিকতার মৃত্যুকে ইঙ্গিত করে।
আত্মধ্বংসের পুনরাবৃত্তি এবং কলঙ্কিত উত্তরাধিকার
কবিতাটি একটি চক্রাকার প্রক্রিয়ার কথা বলে: মানুষ আত্মহনন করে, আবার ফিরে আসে "পৃথিবীর হাল ধরে পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচিয়া রাখতে।" কিন্তু এই ফিরে আসা কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, বরং "সে যখন আসে তখন একটা লজ্জাজনক / ইতিহাস নিয়ে আসে! / তার ধর্ষক নামের ইতিহাস।" এই অংশটি আরও বেশি বেদনাদায়ক, কারণ এটি শুধু ব্যক্তিগত অবক্ষয় নয়, বরং এর সামাজিক প্রভাব তুলে ধরে। মানুষ যখন নৈতিকভাবে স্খলিত হয়, তখন তারা শুধু নিজেদেরই নয়, বরং অন্যদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করে। 'ধর্ষক নামের ইতিহাস' কেবল যৌন নিপীড়নের প্রতীক নয়, এটি সমাজের সকল প্রকার শোষণ, অবিচার এবং অন্যায়ের প্রতীক। এটি সেই কলঙ্ক যা এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে বাহিত হয়, এবং যার কারণে মানব সভ্যতা কখনও প্রকৃত শান্তি অর্জন করতে পারে না।
সুখের মরীচিকা ও নীরব সাক্ষী
"সুখ পাখিগুলো ফের এসে ঘুরে যায় / এই ডাল ওই ডাল হয়ে, / কিন্তু তারা কোনো ডালে স্থির হয়ে কোনো বোনের / বুকফাটা চিৎকারের সাক্ষী হতে চায়না।" এই উপমাটি অত্যন্ত শক্তিশালী। সুখ যেন এক চঞ্চল পাখি, যা কখনোই কোনো এক স্থানে স্থির থাকে না, বিশেষ করে যখন সেখানে বেদনা ও যন্ত্রণার হাহাকার থাকে। এটি সমাজের সেই অংশকে নির্দেশ করে যারা অন্যের কষ্ট দেখেও নীরব থাকে, যারা সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলেছে। 'বোনের বুকফাটা চিৎকার' এখানে কেবল একজন নারীর আর্তনাদ নয়, বরং সমাজের সকল নির্যাতিত, শোষিত মানুষের নীরব ক্রন্দনের প্রতীক। এই পংক্তিটি মানবতার প্রতি এক তীব্র অভিযোগ: আমরা সুখের পিছনে ছুটতে গিয়ে অপরের দুঃখ-কষ্টকে উপেক্ষা করি, এবং এর ফলস্বরূপ আমাদের সমাজ আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে।
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক পচা ইতিহাস
কবিতার শেষ অংশটি সবচেয়ে হতাশা এবং বিষাদের সুর নিয়ে আসে। "পরবর্তী প্রজন্মরাও আসে, / পূর্ববর্তীদের সাজানো গুছানো একটা রঙিন / পৃথিবী পায় হাতের মুঠোয়।" আপাতদৃষ্টিতে এটি এক আশাব্যঞ্জক চিত্র, যেখানে নতুন প্রজন্ম এক সমৃদ্ধ বিশ্ব পায়। কিন্তু এই সমৃদ্ধির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা: "আর সাথে পায় হাজারবার আত্মহত্যা করা পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত একটা নোংড়া ইতিহাস।" এই 'পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত ইতিহাস' হলো পূর্ববর্তী প্রজন্মের আত্মিক অবক্ষয়, নৈতিক স্খলন এবং অন্যায়ের ফসল। নতুন প্রজন্ম উত্তরাধিকারসূত্রে শুধু সম্পদই পায় না, পায় এক কলঙ্কিত অতীত, যেখানে "বসবাস করে লজ্জাহীন লজ্জাস্থানের / দাস বনে যাওয়া লজ্জাজনক কিছু অন্তর।" এই ইতিহাস এতটাই নোংরা যে "লজ্জাস্থানও লজ্জায় আত্মহত্যা করে।" এই শেষ পংক্তিটি এক চরম হতাশা এবং শ্লেষের বহিঃপ্রকাশ, যা ইঙ্গিত করে যে মানব সমাজের এই অবক্ষয় এতটাই গভীর যে এমনকি নির্লজ্জ বস্তুটিও লজ্জায় আত্মহনন করে।
উপসংহার
"একদিন পূর্ণ শান্তি নিয়ে বাঁচার তরে" কবিতাটি আধুনিক সমাজের এক নির্মম আয়না। এটি মানবজাতির আত্মিক শূন্যতা, নৈতিক স্খলন এবং এক অন্তহীন চক্রের মধ্যে আটকা পড়ার এক গভীর উপলব্ধি তুলে ধরে। কবি এখানে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সেই দিকগুলোকে উন্মোচন করেছেন যা আমরা সাধারণত উপেক্ষা করি বা অস্বীকার করি। এই কবিতাটি পাঠককে তার নিজের জীবনের দিকে তাকাতে বাধ্য করে, তার মূল্যবোধকে প্রশ্ন করতে শেখায় এবং এই ধ্বংসাত্মক চক্র থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে উৎসাহিত করে। এটি এক নীরব আর্তনাদ, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃত শান্তি কেবল তখনই সম্ভব যখন আমরা আমাদের নৈতিকতা, মানবিকতা এবং ভালোবাসার মূল্যে বিশ্বাস স্থাপন করব এবং এই আত্মঘাতী পথ থেকে ফিরে আসব। এটি এক শক্তিশালী বার্তা যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাদের দায়িত্ব এবং নৈতিকতার প্রতি আরও সচেতন হতে আহ্বান জানায়।