সাধু ও চলিত ভাষা কাকে বলে? সাধু ও চলিত ভাষার মধ্যে পার্থক্য কি?

অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাহিত্যের ভাষা মুখের ভাষা থেকে কিছুটা পৃথক হয়ে থাকে। সাহিত্যের ভাষা উন্নত চিন্তা, কল্পনা ও অনুভূতিকে প্রকাশ করে বলে তা অপেক্ষাকৃত মার্জিত, পরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত। অন্যদিকে আমরা মুখের ভাষা দৈনন্দিন জীবনে পথে, ঘাটে, হাটে, বাজারে, সাংসারিক প্রয়োজনে ব্যবহার করি বলে তা অপেক্ষাকৃত স্বতঃস্ফূর্ত ও জীবনস্পর্শী। লিখিত ও মুখের ভাষারূপের এ পার্থক্য সব ভাষাতেই রয়েছে। বাংলা ভাষাও এ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কিন্তু বাংলা লিখিত ভাষায় এক সময় দুটি ভাষারীতি গড়ে উঠেছিল।

সাধু ও চলিত ভাষা কাকে বলে?
সাধু ও চলিত ভাষা কাকে বলে?  সাধু  চলিত ভাষার মধ্যে পার্থক্য কি? 


সাধুরীতি বা সাধু ভাষা কি?

আদিমাত্রায় তৎসম শব্দবহুল, সংস্কৃত ব্যাকরণের সন্ধি-সমাস আশ্রয়ী। এ ভাষারীতিতে ক্রিয়া ও সর্বনাম পদের দীর্ঘ রূপ ব্যবহৃত হয়। মূলত সাহিত্যের ভাষাকে আশ্রয় করেই সাধুরীতি গড়ে উঠেছিল।

চলিতরীতি বা চলিত ভাষা কি?

বাংলার মানুষের মুখের ভাষার পাঁচটি প্রধান উপভাষা- রাঢ়ি, বঙ্গালি, বরেন্দ্রী, কামরূপী ও ঝাড়খন্ডী। এ গুলির মধ্যে রাঢ়ী কলকাতা ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলের হুগলি, নদীয়া, উত্তর চব্বিশ-পরগণার শিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণীর মানুষের মুখের ভাষা; আর এই ভাষার উপর ভিত্তি করে যে বাংলা ভাষারীতি (Standard Colloquial Bengoli-SCB) গড়ে উঠেছে তাকে বলা হয় চলিত ভাষা বা চলিত গদ্যরীতি।

চলিত ভাষার শব্দভান্ডারে বিশুদ্ধ কিছু সংস্কৃত শব্দ আছে। কিন্তু এর মূল শব্দ হল সংস্কৃত থেকে প্রাকৃতির মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে আসা বিপুল তদ্ভব শব্দ ভান্ডার, আর এ দেশের আর্যপূর্ব জাতিদের ভাষা থেকে স্বাভাবিকভাবে গৃহীত দেশী শব্দসমূহ। এ ভাষা শুধু সাহিত্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ ভাষা বর্তমানে যেমন সাহিত্যের ভাষা তেমনি শিক্ষিত জনের মৌখিক ভাববিনিময়েরও মাধ্যম।

সাধু ও চলিত রূপের প্রতিষ্ঠা

খ্রিস্টান মিশনারি ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের (১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়) লেখকেরা যখন বাংলায় ধর্মগ্রন্থ ও পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে উদ্যোগী হন, তখন তাঁদের সামনে সাহিত্যিক গদ্যের কোন আদর্শ ছিল না। তাঁরা সংস্কৃত গদ্যের আদর্শে বাংলা সাধু ভাষার মূল কাঠামোটি রচনা করেন। যাঁদের হাতে বাংলা সাধু গদ্যের প্রাথমিক রূপটি বিশেষভাবে গড়ে উঠেছিল তাঁদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর পর রামমোহন রায় সাধু গদ্যের আরো যুক্তিনির্ভর কাঠামো নির্মাণ করেন। রামমোহন রায় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সাধু ভাষা কথাটি তাঁর 'বেদান্ত গ্রন্থে" ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে সাধু ভাষা বিকশিত হয়ে সৃজনশীল ও মননধর্মী সাহিত্যের মাধ্যম হয়ে ওঠে।

বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের পর শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসের বর্ণনায় সাধু ভাষা ব্যবহার করলেও পাত্র-পাত্রীর সংলাপে চলিত গদ্য ব্যবহার করেছেন। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের ধারাই অনুসরণ করেছেন। উল্লেখযোগ্য, উইলিয়াম কেরীর কথোপকথোনের বিভিন্ন শ্রেণীর সংলাপে ব্যবহৃত গদ্য যদিও আদর্শ চলিত বাংলা ছিল না, তবুও এখানেই মৌখিক গদ্য সাহিত্যের প্রথম-প্রবেশাধিকার বলে ধরে নেয়া হয়। বিদ্যাসাগরের শকুন্তলার সংলাপ অংশে কিছু চলিত গদ্য ব্যবহার করেন। কলকাতা অঞ্চলের চলিত ভাষাকে কিঞ্চিৎ সাধুভাষার মিশ্রণসহ সাহিত্যে প্রথম রূপ দেন প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর 'আলালের ঘরের দুলাল' (১৮৫৮) উপন্যাসে। কিন্তু পুরোপুরি চলিত ভাষার ব্যবহার করেন কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' (১৮৬২) গ্রন্থে। বঙ্কিমচন্দ্র, প্যারীচাঁদ মিত্রের ব্যবহৃত কথ্য ভাষাকে স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং এই ভাষাকে 'অপর ভাষা' নামে অভিহিত করেছিলেন। একটি প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকে "প্রচলিত ভাষা" বলেছিলেন। সম্ভবত এই 'প্রচলিত ভাষা' থেকেই পরে 'চলিত ভাষা' কথাটির প্রচলন হয়। ১৯১৪ সালে প্রমথ চৌধুরী 'সবুজপত্র' পত্রিকা প্রকাশ করে চলিত গদ্যের পক্ষে ব্যাপক সাহিত্যিক আন্দোলন শুরু করেন। তখন রবীন্দ্রনাথও তাতে উৎসাহিত হয়ে পুরোপুরি চলিত গদ্য লেখা আরম্ভ করেন এবং এভাবে সাহিত্যে ক্রমে চলিত গদ্য একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য

সাধারণত সাধু ভাষার শব্দভান্ডারে তৎসম (সংস্কৃত) শব্দ বেশি থাকে। কিন্তু চলিত ভাষায় তদ্ভব ও দেশী, বিদেশী শব্দের আধিক্য দেখা যায়।

সাধু ভাষায় সর্বনামের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন- তাহা, যাহা, যাহার, ইহা, তাহাদের, যাহাদের ইত্যাদি। চলিত ভাষায় সর্বনামের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন- তা, যা, যাব, তাদের, এ, ও ইত্যাদি।

সমাসবদ্ধ পদের সংখ্যা সাধু ভাষায় বেশি ব্যবহৃত হয়। যেমন- আসমুদ্র হিমাচল, কার্যকারণ শৃঙ্খলিত ইত্যাদি। চলতি ভাষায় সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার কম। যেমন: সমুদ্র থেকে হিমালয় পর্যন্ত, কার্য ও কারণের দ্বারা শৃঙ্খলিত ইত্যাদি।

সাধুভাষায় অনেক ক্ষেত্রে ক্রিয়ার দীর্ঘরূপ প্রচলিত। যেমন- করিয়া, করিতেছি, করিয়াছিলাম ইত্যাদি। চলতি ভাষায় ক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন- করে, করছি, করেছিলাম ইত্যাদি।

বিভক্তির বদলে ব্যবহৃত কতকগুলি অনুসর্গেরও সাধু ও চলিত ভাষার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেমন-সাধু ভাষা: দ্বারা, সহিত, হইতে, অভ্যন্তরে ইত্যাদি। চলিত ভাষা দিয়ে, সঙ্গে, ভিতরে, ভেতরে বা মধ্যে ইত্যাদি।

অন্য ভাষায় প্রচলিত প্রবাদ প্রবচন (Proverbs) ও বিশিষ্টার্থক পদগুচ্ছ (Idioms) চলিত ভাষায় সহজেই খাপ খেয়ে যায়। কিন্তু সাধু ভাষায় সেগুলোর প্রয়োগ বিরল। যেমন- জোর যার মলুক তার, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো, কলা দেখানো ইত্যাদি।

সাধু ভাষার মধ্যে কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া এই বিন্যাসক্রম সাধারণত ল-ঘন করা হয় না। কিন্তু চলিত ভাষার ক্ষেত্রে বাক্যে পদের বিন্যাসক্রম অনেক খানি নমনীয়। যেমন- বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে।

যৌগিক ক্রিয়াপদের ব্যবহার সাধু ভাষায় বেশি। কিন্তু চলিত ভাষায় কিছুটা কম। যেমন- সাধু ভাষা: গমন করা, শয়ন করা, শ্রবণ করা ইত্যাদি। চলিত ভাষা: যাওয়া, শোয়া, শোনা ইত্যাদি।


নিচে সাধুরীতি থেকে চলিত রীতিতে পরিবর্তনের কয়েকটি নমুনা দেয়া হল:

ক. সাধু ভাষাঃ এক ব্যক্তির দুইটি পুত্র ছিল। তন্মধ্যে কনিষ্ট পুত্র পিতাকে বলিল, "পিতা আপনার সম্পত্তির মধ্যে আমার প্রাপ্য অংশ আমাকে দিন।" তাহাতে তাহাদিগের পিতা নিজ সম্পত্তি তাহাদিগের মধ্যে বিভাগ করিয়া দিলেন।

চলিত ভাষাঃ একজন লোকের দুটি ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে ছোটটি বাবাকে বলল, "বাবা, আপনার বিষয়ের মধ্যে যে অংশ আমি পাব, তা আমাকে দিন।" তাতে তাদের বাবা নিজের সম্পত্তি তাদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন।

খ. সাধু ভাষাঃ আমাদের ভীরুতা কি চিরদিনই থাকিয়া যাইবে? ভরসা করিয়া এইটুকু কোন দিন বলিতে পারিব না যে, উচ্চ শিক্ষাকে আমাদের দেশের ভাষায় দেশের জিনিস করিয়া লইতে হইবে। পশ্চিম হইতে যাহা কিছু শিখিবার আছে, জাপান তাহা দেখিতে দেখিতে সমস্ত দেশ ছড়াইয়া দিল। ইহার প্রধান কারণ, সে শিক্ষাকে তাহারা দেশী ভাষার আধারে বাধাই করিতে পারিয়াছে।

চলিত ভাষাঃ আমাদের ভিরুতা কি চিরদিনই থেকে যাবে? ভরসা করে এটুকু কোন দিন বলতে পারব না যে, উচ্চশিক্ষাকে আমাদের দেশের ভাষায় দেশের জিনিস করে নিতে হবে। পশ্চিম থেকে যা কিছু শেখবার আছে, জাপান তা দেখতে দেখতে দেশে ছড়িয়ে দিল। এর প্রধান কারণ, সে শিক্ষাকে তারা দেশী ভাষার আধারে বাঁধাই করতে পেরেছে।

গ. সাধু ভাষাঃ মানুষ কোন দিন উপাসনা না করিয়া থাকিতে পারে নাই, থাকিতে পারে না। উপাস্যের সন্ধানে ও নির্বাচনে তাহার ভুল হইয়া থাকিতে পারে। কিন্তু আভ্যন্তরীণ তৃষ্ণায় মানুষ চিরদিন মহত্তর শক্তির সম্মুখে দেহ ও মস্তক লুণ্ঠিত করিয়া আসিতেছে।

চলিত ভাষাঃ মানুষ কোন দিন উপাসনা না করে থাকতে পারে নি, থাকতে পারে না। উপাস্যের সন্ধান ও বাছাইয়ে তার ভুল হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ তৃষ্ণায় মানুষ চিরদিন মহত্তর শক্তির সম্মুখে দেহ ও মাথা লুটিয়ে আসছে।

ঘ. সাধু ভাষাঃ প্রয়োজনের দিক হইতে দেখিলে বিদ্যায় মানুষের কত প্রয়োজন সে কথা বলা বাহুল্য; অথচ সে দিক দিয়া আলোচনা করিতে গেলে তর্ক ওঠে। চাষীকে বিদ্যা শিখাইলে তার চাষ করিবার শক্তি কমে কিনা, স্ত্রীলোককে বিদ্যা শিখাইলে তার হরীভক্তি, পতিভক্তির ব্যাঘাত হয় কিনা এসব সন্দেহের কথা প্রায়ই শুনিতে পাওয়া যায়।

চলিত ভাষাঃ প্রয়োজনের দিক থেকে দেখলে বিদ্যায় মানুষের কত প্রয়োজন সে কথা বলা বাহুল্য: অথচ সে দিক দিয়ে আলোচনা করতে গেলে তর্ক ওঠে। চাষীকে বিদ্যা শেখালে তার চাষ করবার শক্তি কমে কিনা, স্ত্রীলোককে বিদ্যা শেখালে তার হরীভক্তি, পতিভক্তির ব্যাঘাত হয় কিনা এ সব সন্দেহের কথা প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়।


পরিশেষেঃ 

প্রিয় পাঠক এবং শিক্ষার্থী বন্ধুরা, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমেই আমি সাধু ও চলিত ভাষা কাকে বলে? সাধু ও চলিত ভাষার উপত্তি, সাধু ও চলিত ভাষার মধ্যে পার্থক্য উদাহরনসহ আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আমি আশা করছি আজকের আলোচনা থেকে আপনারা সাধু ও চলিত ভাষা সম্পর্কে খুঁটিনাটি সম্পুর্ন ধারণা লাভ করতে পেরেছেন। সাধু ও চলিত ভাষা সম্পর্কে আরোও জানতে আমাদেরকে কমেন্ট বক্সে জানাতেন পারেন এবং পাশাপাশি আমাদের ফেসবুক ইউটিউব চ্যানেল থেকেও জানতে পারবেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url