বাংলা প্রবাদ বাক্য: প্রবাদ বাক্য কি? প্রবাদ বাক্যের উদ্ভব ও ব্যবহার
সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে, বিভিন্নমুখী ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনের বহুপরীক্ষিত উপদেশ ও নীতি প্রচার করাই প্রবাদের প্রধান উদ্দেশ্য। বাংলা ভাষায় যেমন প্রবাদ আছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ভাষায়ও প্রবাদ আছে। প্রবাদ দীর্ঘ অভিজ্ঞতার একটি সংক্ষিপ্ত অভিব্যক্তি। প্রবাদে উপদেশ ও সত্যতার প্রকাশ পাওয়া যায়। জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচয় ব্যক্ত হয় প্রবাদের মধ্য দিয়ে। তবে সব ক্ষেত্রে তা চিরসত্য বলে গ্রহণ করা যায় না। কারণ জীবনের বহু অভিজ্ঞতার সপক্ষে ও বিপক্ষে বহু প্রবাদের নিদর্শন মেলে।
![]() |
প্রবাদ বাক্য কি? প্রবাদ বাক্যের উদ্ভব ও ব্যবহার। |
প্রবাদের উদ্ভব
প্রবাদের উদ্ভব নানা উৎস থেকে হয়েছে। সাধারণভাবে দেখা যায় যে, এগুলোর উদ্ভদ হয়েছে:
মানুষের মুখ থেকেঃ
প্রসিদ্ধ লেখকগণ, যেমন: ভারতচন্দ্র, টেকচাঁদ ঠাকুর, ঈশ্বরগুপ্ত, দীনবন্ধু মিত্র, দাশুরায়ের পাঁচালী, নিধুবাবুর টপ্পা প্রভৃতি রসরচনা হতে। জনশ্রুতি থেকে। মেয়েলী ছড়া হতে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থাদি হতে।বিভিন্ন কাব্য ও লোক-সাহিত্য থেকে। খনা, ডাক প্রভৃতির বচন থেকে। দৈনিক কথাবার্তা, ভাবভঙ্গী, আচার, ব্যবহার, প্রভৃতি থেকে।
এ দেশীয় স্বকীয় চিন্তাধারা, রীতিনীতি, চাল-চলন, প্রাণসত্তা বাংলা প্রবাদের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। শাশুড়ির বাক্যবাণ, ননদের খোঁটা, সতীনের কাঁটার জ্বালা, সপত্নী-বিদ্বেষ, ঘরজামাই, প্রভৃতি বাঙালি জীবনের বিশেষত্বগুলি বাংলা প্রবাদে ফুটে উঠেছে।
সাম্প্রতিককালে বাংলা সাহিত্যে প্রবাদের ব্যবহার কমে এসেছে। বাঙালি জীবনে রুচির পরিবর্তনই সম্ভবত এর কারণ। প্রবাদের ভাষা সব সময়ে রুচিসম্মত বা মার্জিত হয় না। কিন্তু প্রবাদে বক্তব্যের দৃঢ়তা ও রসগর্ভ ভঙ্গী রসজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছে সমাদৃত হয়। নিচে প্রবাদের কিছু উদাহরণ ও সেগুলোর অর্থ ও ব্যবহার দেওয়া হলো:
১. অতি আশ, সর্বনাশ: বেশি লোভের পরিণাম ভাল হয় না।
২. অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর: অতিবড় সুন্দরী না পায় বর অনেক সময় যোগ্য লোকও তার উপযুক্ত কাজ বা স্থান পায় না।
৩. অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট: লোক বেশি হলে কাজ পন্ড হয়।
৪. অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ: অকারণে বেশি আদর-যত্ন করলে নানা সন্দেহ জন্মে।
৫. অভাগা যে দিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায় যার: অদৃষ্ট খারাপ সে সর্বত্রই নিরাশ হয়।
৬. অভাবে স্বভাব নষ্ট: অভাবের কারণে সৎ লোকও অসৎ হয়।
৭. আপন ঢাক আপনি বাজায়: নিজের প্রশংসা নিজেই করে।
৮. আপনি বাঁচলে বাপের নাম: আত্মরক্ষা করাই প্রধান কাজ।
৯. আর কি নেড়া বেলতলা যায়: যে একবার ঠকেছে সে ভবিষ্যতে সাবধান হয়।
১০. আল্লায় দিলেও মোল্লায় দেয় না: সৃষ্টিকর্তার দয়া থাকলে মানুষের দীর্ঘসূত্রতার জন্য তা নষ্ট হয়ে যায়।
১১. আসলের চেয়ে সুদ মিষ্টি: যা নিশ্চিত তার তুলনায় অনিশ্চিত জিনিস বেশি আনন্দের কারণ হয়।
১২. ইটে নেই ভিটে নেই বাহিরে মর্দানী: বেশ দরিদ্র কিন্তু বড় মানুষি ভাব আছে।
১৩. ইঁদুর মারতে ঘর পোড়ানো: তুচ্ছ শত্রুকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজের ক্ষতি করা।
১৪. উঁচু হলে ঝড়ে ভাঙবে, নিচু হলে ছাগলে খাবে: খুব অহংকারী হতে নেই, আবার খুব ছোটও হতে নেই।
১৫. উজার বনে শিয়াল রাজা: উপযুক্ত লোক না থাকলে বাজে লোক প্রাধান্য পায়।
১৬. উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে: একের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানো।
১৭. উলু বনে মুক্তা ছড়ানো: অযোগ্য পাত্রে উৎকৃষ্ট বস্তু দান।
১৮. উনা বর্ষায় দুনা শীত: যে বছর বৃষ্টি কম হয় সে বছর শীত বেশি পড়ে।
১৯. এক সাথে দুই কাজ সম্পন্ন করা: এক ঢিলে দুই পাখি মারা
২০. একবারেই শেষ হয় না বিপদ: একমাঘে শীত যায় না
২১. গাঁয়ে মানে না: আপনি মোড়ল মূর্খ ও অযোগ্য লোকের আত্মশ্লাঘা।
২২. গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল: প্রাপ্তির আগে ভোগের আয়োজন।
২৩. ঘরের লক্ষ্মী: পায়ে ঠেলা কাম্য বস্তুকে অনাদর করা।
২৪. ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া: যার অধীন তাকে না জানিয়ে স্বার্থ সাধনের বৃথা চেষ্টা।
২৫. চাপ পড়লেই বাপ: বিপদে পড়লে দোষ স্বীকার।
২৬. চেনা বামুনের পৈতে লাগে না: সুপরিচিত লোকের নতুন পরিচয়ের দরকার নেই।
২৭. চোরে চোরে মাসতুত ভাই: অসৎ কাজের সঙ্গীদের মধ্যে সম্ভাব।
২৮. চোরকে বলে চুরি করতে, গেরস্থকে বলে সজাগ থাকতে: দুই কুল বজায় রাখা।
২৯. চোরের মায়ের কান্না: এমন দুঃখ যা প্রকাশ করা যায় না।
৩০. ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো: সামান্য কাজের জন্য বাজে লোককে নিয়োগ করা।
৩১. ছেঁড়া চুলে খোঁপা বাঁধা: পরকে আপন করবার চেষ্টা বৃথা।
৩২. ছেলের হাতের মোয়া: যা অতি সহজে পাওয়া যায়।
৩৩. জাতও গেল, পেটও ভরল না: ক্ষতি স্বীকার করেও মঙ্গল হলো না।
৩৪. জুতো মেরে গরু দান: প্রথমে অপমান করে পরে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা।
৩৫. ঝাঁকের কই ঝাঁকে যায়: সমপ্রকৃতির লোক এক সাথে থাকতে ভালবাসে।
৩৬. ঝিকে মেরে বউকে শেখানো: পরোক্ষ উপায় অবলম্বন করে শিক্ষা দেয়া।
৩৭. ঠেলার নাম বাবাজি: বিপদে পড়ে তোষামুদি।
৩৮. পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা: বিনা পরিশ্রমে যা পাওয়া যায়।
৩৯. পরের ধনে পোদ্দারি: লোকে বলে লক্ষ্মীশ্বরী পরের অর্থ যথেচ্ছ ব্যয় করে বড় মানুষি দেখানো।
৪০. পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙাঃ পরের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধ করা।
৪১. পাকা ধানে মই দেওয়াঃ কাজ সফল হওয়ার সময় বিঘ্ন ঘটানো।
৪২. লোকের স্বভাব এক রকম হয় নাঃ পাঁচ আঙ্গুল সমান নয় সব
৪৩. পেট ভরে তো মন ভরে নাঃ নিজের প্রয়োজন মিটলেও আকাঙ্ক্ষা যায় না।
৪৪. ফাঁকি দিলে ফাঁকে পড়েঃ অপরকে ঠকাতে গেলে নিজেই ঠকতে হয়।
৪৫. বরের ঘরের পিসি, কনের ঘরের মাসিঃ দুটি বিরুদ্ধ পক্ষের উভয়ের সাথেই যে সদ্ভারের ভান করে।
৪৬. বড় হবে তো ছোট হওঃ বড় হতে গেলে খুব বিনয়ী হওয়া প্রয়োজন।
৪৭. বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়ঃ শাসনের দাপটে পূর্ণ শান্তি বিরাজ করে।
৪৮. বাড়া ভাতে ছাই ফেলাঃ প্রাপ্তির সময় বাধা-বিপত্তি।
৪৯. বাবারও বাবা আছেঃ প্রবলের উপরও প্রবল আছে।
৫০. বামন হয়ে চাঁদে হাতঃ অযোগ্য লোকের দুর্লভ জিনিসের প্রতি লোভ।
৫১. বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্তঃ প্রধান অপেক্ষা অপ্রধান দৃঢ়।
৫২. বুক ফাটে তো মুখ ফুটে নাঃ অন্তরের গোপন কথা প্রকাশ করার প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও বলা যায় না।
৫৩. বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁঃ বৃদ্ধের যুবকের মত সাজসজ্জা।
৫৪. বেল পাকলে কাকের কিঃ পরের সুখে বা ঐশ্বর্যে নিজের কি লাভ বা সুখ?
৫৫. ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে নাঃ জানা বিষয়ে অজানার ভান করা।
৫৬. ভাগের মা গঙ্গায় পায় নাঃ পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ না করলে কাজ সম্পন্ন করা যায় না।
৫৭. ভিক্ষার চালঃ কাঁড়া আর আকাঁড়া বিনা মূল্যে যা পাওয়া যায় তাই লাভ।
৫৮. মরা হাতি লাখ টাকাঃ গুণী লোক বিপদে পড়লেও তার গৌরব অক্ষুন্ন থাকে।
৫৯. মশা মারতে কামান দাগাঃ সামান্য ব্যপারে বড় আয়োজন।
৬০. যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশঃ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা পোষণ করা।
৬১. যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেতুলঃ শঠের সঙ্গে শঠ ব্যবহার।
৬২. যে মেঘ গর্জায় সে মেঘ বর্ষায় নাঃ বহু আড়ম্বরে লঘু ক্রিয়া হয়।
৬৩. রাই কুড়িয়ে বেলঃ অত্ম অত্ম জমা করে অনেক জমানো।
৬৪. ষোল কড়াই কানাঃ সবগুলিই ত্রুটিপূর্ণ।
৬৫. সমুদ্রে শয্যা যার, শিশিরে ভয় কি তারঃ চারিদিকের নানা বিপদের মধ্যে অত্ম বিপদ তেমন কিছু না।
৬৬. সস্তার তিন অবস্থাঃ সুলভ জিনিসের নানা দোষ।
৬৭. সবুরে মেওয়া ফলেঃ ধৈর্য ধারণে সুফল লাভ করা যায়।
৬৮. সাপ হয়ে কাটে, ওঝা হয়ে ঝাড়েঃ একই সাথে শত্রুতা সাধন ও মিত্রতা প্রদর্শন।
৬৯. সূচ হয়ে ঢোকা ফাল হয়ে বেরুনোঃ কৌশলে ঢুকে সর্বনাশ করা।
৭০. সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে নাঃ সরল হলে কাজ হয় না, কূট কৌশল দরকার।
৭১. হাটের মাঝে হাড়ি ভাঙাঃ বহু লোকের সামনে গোপন কথা প্রকাশ করা।
৭২. হাতি কাদায় পড়লে চামচিকেও লাথি মারেঃ বড়লোক বিপদে পড়লে সামান্য লোকও তাকে অপমান করে।