প্রবন্ধ রচনা: শ্রমের মর্যাদা (The Dignity of Labor)
শ্রমের মর্যাদা
ভূমিকাঃ মনীষী কার্লাইল তাঁর একটি রচনায় বলেছিলেন, যাঁদের হাতের ছোঁয়ায় পৃথিবী সভ্যতার পথে অগ্রসর হয়েছে এবং যাঁদের প্রচন্ড কায়িক পরিশ্রমে সভ্যতার চাকা এখনো সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারছে তিনি কেবল তাঁদেরকে এবং কেবল তাদেরকেই শ্রদ্ধা করেন। শ্রমের মর্যাদা এবং শ্রমজীবী মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ থেকেই এ কথাগুলো বলেছিলেন। উন্নত বিশ্বে শ্রমের প্রকৃত মর্যাদা দেয়া হয় এবং শ্রমজীবী মানুষকে তাঁরা সম্মানের চোখেই দেখে থাকে।
অথচ আমাদের মত এই হতভাগ্য দেশে বিষয়টি ঘটছে সম্পূর্ণ উল্টো। এখানে তারাই শ্রদ্ধা পান যারা অন্যের পরিশ্রমের ফল ভোগ করেন। শ্রমজীবী মানুষ যেমন, তেমনি শ্রমও অত্যন্ত অসম্মানের ও লজ্জার বিষয় বলে আমরা মনে করি। বস্তুত, স্বল্প মূল্যে পর্যাপ্ত শ্রম এদেশে সুলভ বলেই আমাদের মানসিকতার এই দৈন্য দশা ঘটেছে; আমরা শ্রমের মর্যাদা দিতে শিখি নি। আজকের পৃথিবীতে সমাজের প্রয়োজনেই ঘটে গেছে নানা রকম শ্রমবিভাগ। আমাদের মধ্যে যদি এই চেতনা থাকতো যে, বৃত্তি যাই হোক না কেন, সবার সম্মিলিত চেষ্টার ফলেই সভ্যতা এগিয়ে চলেছে; আমাদের জীবন সবার ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকে, তাহলে সম্ভবত আমরা শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠতে পারতাম। তবে আশার কথা হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ তাদের অধিকার বুঝতে শিখছে, তারা আদায় করে নিচ্ছে তাদের প্রকৃত মর্যাদা। আর শ্রমবিমুখ মানুষেরা বাধ্য হচ্ছে নিজেদের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়াতে।
![]() |
প্রবন্ধ রচনা: শ্রমের মর্যাদা। ৬ষ্ঠ হতে দশম শ্রেণির জন্য। |
বৃত্তিমূলক শিক্ষাঃ ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোর মধ্যে শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল শাসক ও শাসনযন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য কতিপয় কেরানী সৃষ্টি করা। তারা সে কাজে সফল হয়েছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে আমরা বেরিয়ে এলাম বটে কিন্তু ঐ কেরানী তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে ভাঙতে পারলাম না। এ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। এখনো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিসহ অসংখ্য বেকার সৃষ্টি করছে।
অথচ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি বৃত্তিমূলক হতো, যদি আমরা আমাদের সম্পদ ও চাহিদার দিকে তাকিয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারতাম তাহলে জাতি হিসেবে আজ যে ভাঙনের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়েছি, তেমনটি হতো না। স্বাধীন দেশের অধিবাসী হয়েও আমরা এ সত্য উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছি যে ডিগ্রি অর্জনই বড় কথা নয়, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাণরসের সংস্থান করতে পারার প্রশিক্ষণই হওয়া উচিত শিক্ষার উদ্দেশ্য।
আমরা এমন শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চাই, যে শিক্ষা বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে অন্যের মুখাপেক্ষী না করে। আমরা মেনে নিচ্ছি প্রতিভাবানের সোনালী স্পর্শে দেশ স্বর্ণময় হয়ে ওঠে। কিন্তু সে ধরনের প্রতিভা সুলভ নয়। সব দেশেরই অধিকাংশ লোক সাধারণ মানের; তাদের জন্য উচ্চ শিক্ষা একটি মূল্যহীন বিলাস মাত্র- তাদের জীবনকে ঐ শিক্ষা সম্ভাবনাময় করে তোলে না। আধুনিক সভ্য দেশে মানুষকে বিবেচনা করা হয় তার সামর্থ দিয়ে। যার সামর্থ যেমন তাকে সেই ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হয়। আমাদের দেশেও প্রবল সম্ভবনা রয়েছে। রয়েছে বিপুল জনসংখ্যা। সেই বিপুল জনসংখ্যাকে বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে জনশক্তিতে পরিণত করতে পারলে আমাদের সামগ্রিক মুক্তি সম্ভব। তাই সামগ্রিক মুক্তির জন্য, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার পথ প্রশস্ত করার জন্য আমাদের চাই বৃত্তিমূলক শিক্ষা, কেরানি তৈরির এবং শিক্ষিত বেকার তৈরির শিক্ষা নয়।
সংবাদপত্রঃ আধুনিক সভ্যতা মূলত সংবাদপত্র সৃষ্ট- এ ধরনের একটি কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়ে থাকে সংবাদপত্রের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে। কথাটার মধ্যে খানিকটা অতিরঞ্জন থাকলেও সত্যের অভাব নেই। কারণ আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে সংবাদপত্র এবং তার প্রভাব জড়িয়ে আছে নানা দিক দিয়ে। নাগরিক মানুষের দিনই যেন শুরু হয় সংবাদপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে।
অথচ পৃথিবীর ইতিহাসের তুলনায় সংবাদ পত্রের ইতিহাস কিন্তু খুব পুরাতন নয়। সংবাদপত্রের সূত্রপাত হয়েছিল চীন দেশে। আধুনিক ইউরোপে একে জনপ্রিয় করে তোলে ইতালীয়রা। আমাদের দেশে জনসাধারণের জন্যে সংবাদ পত্রের সূচনা হয় ১৮১৮ সালে- প্রথম সংবাদপত্রের মর্যাদা প্রাপ্য 'সমাচার দর্পণের আর প্রথম দৈনিক সংবাদপত্রের মর্যাদা প্রাপ্য 'সংবাদ প্রভাকরের- যা প্রকাশিত হয় ১৮৩৯ সালে। এই দেড় বা দুশো বছরের মধ্যে সংবাদপত্র যে আমাদের সমাজে তার বহু-বিস্তৃত প্রভাব দৃঢ় করতে পেরেছে তার বহুবিধ কারণ রয়েছে। আমাদের সমাজে সংবাদপত্র মানুষের চিন্তা ও কর্মের প্রেরণা দেয়।
সাধারণ মানুষের রুচি গঠনেও সংবাদপত্র পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গণতান্তিক রাষ্ট্রে প্রতিটি মানুষকেই নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হয়। সংবাদপত্রের মাধ্যমেই জনগণ সে সম্পর্কে অবহিত হয় এবং সংবাদপত্রই জনমত গড়ে তোলে কোন সমস্যার সমাধান করতে। আবার সংবাদপত্রের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবই এর বড় দুর্বলতা। কারণ সংবাদপত্র যদি সরকার, ব্যক্তি বা গোষ্ঠির মতামত সম্বলিত হয়ে প্রকাশিত হয় তবে তা দেশ বা জাতির প্রতি দায়বদ্ধ না হয়ে ঐ ব্যক্তি বা গোষ্ঠির কাছে দায়বদ্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে সাধারণ মানুষ সত্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তাছাড়া ইয়োলো জার্নালিজমের কু-প্রভাবে সংবাদপত্র হয়ে উঠতে পারে মারাত্মক ক্ষতিকর একটি প্রতিষ্ঠান। তবে আশা করা যায় সংবাদপত্র সেবী হিসেবে অধিকতর শিক্ষিত ব্যক্তিদের আত্মনিয়োগ এবং সামগ্রিক সমাজ চেতনার মাধ্যমে সংবাদপত্র তার প্রধান উদ্দেশ্যকে সার্থকতার পথে অগ্রসর করে নিয়ে যাবে।
বিজ্ঞাপনঃ প্রচারেই প্রসার- আর বিজ্ঞাপন হচ্ছে তার প্রধান মাধ্যম। আজকের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পণ্য বিপননের অন্যতম উপায় হচ্ছে বিজ্ঞাপন। কারণ এর মাধ্যমেই ক্রেতা পণ্যের গুণাগুণ জানতে পারে এবং পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিজ্ঞাপন প্রচারের অনেক মাধ্যম রয়েছে- রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, বিলবোর্ড ইত্যাদি। এদের মধ্যে কোন পদ্ধতিটি কখন সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত হবে সে ব্যপারে বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারপর বিজ্ঞাপনকে করে তুলতে হবে সংক্ষিপ্ত কিন্তু চমৎকার হৃদয়গ্রাহী। সেই সঙ্গে থাকতে হবে পণ্যের যাবতীয় গুণাগুণ।
তবে আজকাল বিজ্ঞাপন কেবল পণ্য বিপননের জন্যেই ব্যবহৃত হয় না, কর্মখালির বিজ্ঞাপন, দরপত্র আহ্বানের বিজ্ঞাপন, হারানো বা প্রাপ্তির বিজ্ঞাপন, এমনকি পাত্র পাত্রি অনুসন্ধানের জন্যেও বিজ্ঞাপন ব্যবহৃত হয়। মূলত বিজ্ঞাপন সমাজে চাহিদা সৃষ্টি করে অর্থাৎ বাজারের সম্প্রসারণ ঘটায় ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। আর উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন খরচ কমে গিয়ে তা ক্রেতা সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। অর্থাৎ বাজারের অনুচ্ছেদ্য সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে বিজ্ঞাপন। কিন্তু কেবল বিজ্ঞাপনের চটকদারিত্বের কারণে অনেক সময় ক্রেতা সাধারণভাবে প্রতারিত হতে পারেন। সুতরাং পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে কেবল বিজ্ঞাপন নয় তার গুণাগুণ বিবেচনাটাই মুখ্য হওয়া দরকার।
সময়ানুবর্তিতাঃ মহাকালের তুলনায় আমাদের জীবনের পরিসর অত্যন্ত ছোট কিন্তু আমাদের কর্মের ব্যাপ্তি বিশাল। ফলে সুশৃঙ্খল জীবন যাপন, সময়ের যথাযথ ও পরিকল্পনামূলক ব্যবহার আমাদেরকে দিতে পারে সাফল্যের চাবি। শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও পৌঢ়ত্বের ঘেরা টোপে বন্দী আমাদের যে জীবন তার প্রতিটি পর্যায়েই রয়েছে একটি নির্দিষ্ট কর্মতৎপরতা। তাই প্রতিটি পর্যায়ের কাজগুলো যদি সুচারুরূপে সম্পাদন করা যায় তবেই জীবন সার্থক হয়, নতুবা তা ব্যর্থতার গ্লানিতে তলিয়ে যায়। সময়ের যথাযথ ব্যবহারের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। তারপর প্রয়োজন পরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর হওয়া।
মনে রাখতে হবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তার সমগ্র সম্ভাবনা নিয়ে উপস্থিত হয়, আর পর মুহূর্তেই তা অনন্তকালের গহ্বরে হারিয়ে যায়। এ জন্য জীবনের কোন পর্যায়ের কোন কর্তব্য অসম্পূর্ণ থাকলে পরে তা সম্পূর্ণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে; পরে তা সম্পূর্ণ করতে গেলে জীবনের প্রতিটি কর্মেরই অঙ্গহানি ঘটে। এ অবস্থা যাতে না ঘটে তার জন্য যতক্ষণ কর্মক্ষমতা থাকে ততক্ষণ পরিকল্পনা মাফিক নিজেকে কোন না কোন কাজে নিয়োজিত রাখতে হবে।
তবে জীবন কেবল কর্মময় নয়, সেখানে বিশ্রাম ও বিনোদনেরও একটি অধ্যায় আছে। কর্ম, বিশ্রাম ও বিনোদন এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন করে সময়ের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে মানব জীবন সার্থক হয়। জীবনের সাফল্যের মূলমন্ত্রই হচ্ছে সময়ানুবর্তিতা। মনে রাখা প্রয়োজন যে ঘড়ির টিকটিক শব্দ আমাদের কানে এ সাবধান বাণীই উচ্চারণ করছে, 'সাবধান, সময়কে ভুলো না; তোমার চৈতন্যকে জাগ্রত কর, গৌরব তোমারই হবে'।
উপসংহারঃ আলোচনার পরিশেষে এসে বলা যায় যে, শ্রম এবং শ্রমজীবীদের শ্রদ্ধা করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। কারণ, বলা আছে যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি ততোবেশি উন্নত। তাই আমাদের উচিত জীবনে প্রত্যেকটি ধাপে ধাপে প্রয়োজন মাফিক শ্রমকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির শিখরে আরোহন করা এবং শ্রমজীবীদের সম্মান প্রদর্শন করা।