প্রবন্ধ রচনা: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

সূচনাঃ

সমগ্র বিশ্ব আজ একটি পরিবার। সেখানে রয়েছে নানা জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষের বসবাস। তাদের সম্মিলিত ও আন্তরিকতাপূর্ণ সহাবস্থানের কারণেই পৃথিবী সুন্দর হয়, বৈচিত্র্য লাভ করে। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায় সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে অনাকাক্ষিত বিভেদ, জাতিতে-জাতিতে হিংসা, দ্বেষ। আর তার মধ্য দিয়ে ঘটে ঘৃণার জাগরণ, বিরোধের সূচনা। আর পরিণামে পৃথিবীতে নেমে আসে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বিষ, মানুষকে করে তোলে খন্ডিত, বিপর্যস্ত, রক্তাক্ত। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি কোন শুভ শক্তির প্রতীক নয়- বরং তা কালে কালে বিশ্ব সভ্যতাকে ম্লান করে দিয়েছে, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ধরা আছে সে কলঙ্কের আখ্যান।

Essay Writing: Communal Harmony
প্রবন্ধ রচনা: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

সাম্প্রদায়িকতার কারণঃ

নানা অশুভ উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য পৃথিবীতে কালে কালে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, ছড়ানো হয়েছে এর বিষাক্ত বীজ। প্রধানত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও দুরভিসন্ধি সফল করার জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে ব্যবহার করা হয়। এক ধর্মের বা এক জাতির লোক ক্ষমতার দম্ভে অন্যের ওপর প্রভুত্ব করবে তা কখনো মেনে যায় না। ফলে দাঁনা বাঁধতে থাকে নির্যাতিতদের মধ্যে অসন্তোষ। আর এক সময় তা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে সমাজের প্রতিটি মানুষের মধ্যে। সমাজ থেকে শুভ-অশুভ বোধ লোপ পায়। ক্ষমতাধরেরা তাদের রাজনৈতিক প্রভুত্ব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভুত্ব ও বিস্তারে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। আর এ-উদ্দেশ্যে তারা ব্যবহার করে ধর্মের মত একটি স্পর্শকাতর বিষয়। কারণ ধর্মের দোহাই তাদের অকল্যাণকর কর্মে প্রথম হাতিয়ার; যা তাদের অন্যায় প্রতিষ্ঠা সহজতর করে। ফলে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ধর্মের নামে বা জাতিসত্ত্বার নামে সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি বা জাতিগত ভেদবুদ্ধির আড়ালে তখন সূচিত হয় হিংসার, ক্ষমতার, নির্যাতনের এক অন্ধকার অধ্যায়। শুরু হয় হত্যা, ধর্ষণ, দাঙ্গা, লুণ্ঠন বা নানা প্রকার সামাজিক বিশৃঙ্খলা।

উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতাঃ

এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা একটি বহু আবর্তিত সমস্যা। ১৭৩০ সালে মোঘল সম্রাট ফররুক শিয়রের রাজত্বকালে দোল খেলা নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষ হয়েছিল। ১৯২০ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের নানা জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল- ইতিহাস থেকে সে তথ্য আমরা জানতে পারি। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ১৯২২ থেকে ১৯২৭-এর মধ্যে এ দেশে ১১২টি ছোট বড় দাঙ্গা সংঘটিত হয় এবং তাতে ৪৫০ জনের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত প্রতি বছরই কোন না কোন কারণে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা হয়েছিল তার পেছনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও মাড়োয়ারীদের গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। ভারত বিভাগের পর ১৯৬৪, ১৯৯০ এবং ১৯৯২ সালেও ছোট খাট সাম্প্রদায়িক অংসহিষ্ণুতার কথা আমরা জানি। তবে ভারতের বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা এবং মসজিদের অবমাননা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল তা ক্রমশ দাঙ্গায় রূপ নিয়েছিল।

দেশে দেশে সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতিঃ

বিশ্বব্যাপী সাম্প্রদায়িক অসম্প্রতির কথা আজ আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। শুধু ধর্মের নামেই নয় জাতিতে-জাতিতে গোত্রে-গোত্রে এমন কী সাদা-কালো মানুষদের পারস্পরিক ভেদবুদ্ধি পৃথিবীকে আজ নিয়ে যাচ্ছে এক অজানা অন্ধকারের সীমানায়। কম্যুনিস্ট আমলের পতনের পর চেক, ক্রোয়েট ও স্লাভদের মধ্যে যে জাতিগত দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে তাতে সমগ্র ইউরোপ লজ্জিত হয়েছে। কসোভো, বসনিয়া-হার্জেগোভিনয়া কিংবা আল বেনিয়াতে ধর্মের নামে, জাতির নামে যে সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির নজির আধুনিক বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে তাতে বিশ্ববাসী বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়েই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। সুদীর্ঘকাল প্যালেস্টাইনী জনতা তাঁদের অধিকার ফিরে পাবার জন্য রক্ত দিয়েছে। লেবাননে ইসরাইল দীর্ঘ ২২ বছর যাবত অবৈধ দখলদারিত্ব করছে। এ-সবই হচ্ছে ইহুদি এবং মুসলমানদের মধ্যেকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাবে। ধর্মান্ধতা কিংবা জাতিগত বিদ্বেষ মানুষকে কী পরিমাণ অমানুষ, নিষ্ঠুর ও বর্বর বানিয়ে ফেলে তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতা দেখলে।

সাম্প্রদায়িকতা প্রতিকারের উপায়ঃ

সাম্প্রদায়িকতা প্রকৃত পক্ষে অশুভ শক্তির একটি সবল হাতিয়ার। সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে মুনাফা অর্জনই হচ্ছে ঐ অশুভ শক্তির মূল উদ্দেশ্য। সুতরাং এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। ভারত বর্ষে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে এই অশুভ শক্তির উন্মেষ ঘটিয়ে বৃটিশ রাজশক্তি ফায়দা লুটেছে। তাই বৃটিশদের মত নতুন কোন নয়া ঔপনিবেশিক শক্তি এ ধরনের কোন অপকর্মে লিপ্ত কী-না সে-বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। জনগণকে অবহিত করতে হবে যে কোন সাম্প্রদায়িক বিভেদই মানবজাতির জন্য সুখকর নয়। তাদের দিতে হবে সহনশীলতার দীক্ষা। এ-ছাড়া মৌলবাদী রাজনৈতিক দলসমূহ, যারা ধর্মকে তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না, তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। দেশে ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটিয়ে নতুন প্রজন্মকে উদার মানবিক ও মুক্ত চিন্তার মানুষে পরিণত করতে হবে। তাদের শেখাতে হবে সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা পোষণ মানবিকতার অঙ্গীকার।

এছাড়া শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করে, সংখ্যা লঘুদের মৌলিক সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো আশু সমাধানের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে এবং পরস্পরের প্রতি সন্দেহ, বিদ্বেষ ও ঘৃণার মনোভাব লোপ পাবে। 

উপসংহারঃ

সাম্প্রদায়িকতা নিঃসন্দেহে একটি ঘৃণ্য দিক। তবে মনে রাখা দরকার যা মানব কল্যাণের পরিপন্থী এবং মানব সভ্যতার কদর্যরূপের ধারক তা কখনো স্থায়িত্ব লাভ করে না। সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমে এবং ঐকান্তিক সাধনায় বিশ্ব থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষকে নির্মূল করা সম্ভব। সাম্প্রদায়িকতার বিষ থেকে মুক্ত হলে পৃথিবী সুন্দর হবে। সম্ভাব, সহাবস্থান ও সম্প্রীতিতে পৃথিবী মুখরিত হবে। 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url