প্রাচীন বাংলার ভৌগোলিক অবস্থার ইতিহাস

প্রাচীন বাংলার ভৌগোলিক অবস্থা (ভূ-প্রকৃতি)

মানুষের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ও কীর্তিকলাপ এবং তার অবস্থান ও পরিবেশের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। ইতিহাস ও ভূগোলের মধ্যকার সম্পর্ক নিবিড়। কারণ মানুষের কর্মকাণ্ড এক বিশেষ ভৌগোলিক পরিবেশে সংঘটিত হয়। তাই ভূগোলকে বলা হয় ইতিহাসের ভিত্তিভূমি। আর এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই প্রাচীন বাংলার ভৌগোলিক পরিচয় দানের প্রয়াস।

'বাংলা' বলতে আদিকাল থেকে ১৪০০ খ্রীস্টাব্দ অর্থাৎ ইলিয়াসশাহী শাসনামল পর্যন্ত যে বিস্তৃত ভূ-খণ্ডকে বোঝাতো তাই আমাদের আলোচ্য ভূখণ্ড। প্রথম দিকে এই ভূখণ্ডের মধ্যে বিভিন্ন ভৌগোলিক নামের (বঙ্গ, পুণ্ড্র, গৌড়, বরেন্দ্র, রাঢ়, সমতট প্রভৃতি) অবস্থিত ছিল। মোটামুটিভাবে ১৯৪৭ এর পূর্বে ব্রিটিশ-ভারতের 'বেঙ্গল' প্রদেশের ভূ-খণ্ডই আমাদের আলোচনার বিষয়। এই ভূ-খণ্ড বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ।

ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাংশে বালার অবস্থান মোটের উপর ২১০-২৮০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৭০-৯০০ ৩০′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। বাংলার পূর্বে ত্রিপুরা, গারো ও লুসাই পর্বতমালা; উত্তরে শিলং মালভূমি ও নেপালের তরাই অঞ্চল, পশ্চিমে রাজমহল ও ছোটনাগপুর পর্বতরাজির উচ্চভূমি এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই চিহ্নিত সীমানার মধ্যে বাংলার আয়তন ৮০,০০০ বর্গমাইলের বেশি।

History of the geographical conditions of ancient Bengal
প্রাচীন বাংলার ভৌগোলিক অবস্থার ইতিহাস 

বাংলা ভারত উপমহাদেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও ভৌগোলিক দিক থেকে এর একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। এখানে কোন মরুভূমি, বড় পর্বত, মালভূমি বা উপত্যাকা নেই। উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমের সীমান্তে কিছুটা উচ্চভূমি বাদ দিলে বাংলার ভূ-প্রকৃতি মোটামুটি সমতল। ইহা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও এদের শাখা-প্রশাখা নদ-নদীর ব্যাপক পলি দ্বারা গঠিত বলে সমগ্র বাংলাকে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বা Delta বলা হয়। এর অধিকাংশ ভূ-খন্ড নবসৃষ্ট। গঠন প্রকৃতি অনুসারে বাংলার অধিকাংশ ভূ-ভাগ অপেক্ষাকৃত নতুন বা নবভূমি হলেও প্রাচীন বাংলার ভৌগোলিক পরিবেশ পশ্চিমাংশে বেশ কিছুটি প্রাচীন বা পুরাভূমি বিদ্যমান। বাংলার পশ্চিমাংশের রাজমহল, সাঁওতাল পরগণা, মানভূম, সিংভূম, ধলভূমের জঙ্গলকীর্ণ পার্বত্য অঞ্চল এই পুরাভূমির অন্তর্গত। মেদিনীপুর-বাঁকুড়া-বর্ধমান-বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের লালমাটি অঞ্চলও পুরাভূমির অংশ। বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের কিয়দংশ, রাণীগঞ্জ-আসানসোলের অংশ বিশেষ এই পুরাভূমিরই নিম্নাঞ্চল।

আবার এই পুরাভূমিরই একটি শাখা রাজমহলের উত্তরে গঙ্গা নদী পার হয়ে উত্তর বাংলারও বিস্তৃত হয়েছে। বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের মতই এখানকার মাটিও লাল, স্কুল বালুময়। মালদহ, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুরের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে তার দুই তীর বেয়ে আসামের পার্বত্য অঞ্চল পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়েছে লাল মাটির এই রেখা। উত্তর রাজশাহী, পূর্ব দিনাজপুর আর রংপুরের পশ্চিমাঞ্চলব্যাপী অপেক্ষাকৃত উঁচু এই এলাকায় হল ইতিহাস প্রসিদ্ধ 'বরেন্দ্র ভূমির' কেন্দ্রস্থল। বাংলার পশ্চিম-উত্তরাঞ্চলের পুরাভূমি এবং পূর্বে চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলের কিছু অংশ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ নবভূমি (New Alluvium) গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও তাদের শাখা প্রশাখা নদীসমূহের পলি দ্বারা গঠিত। পশ্চিমে লালমাটির বুক ভেদ করে নেমে এসেছে ময়ূরাক্ষী, অজয়, রূপনারায়ন, ইতিহাস প্রসিদ্ধ কপিশা (আধুনিক কসাই) গঙ্গার বিভিন্ন উপনদীসমূহ। এদের জলে উর্বর হয়েছে পুরাভূমি সংলগ্ন সমতল ভূমি। রূক্ষ লালমাটির স্থলে দেখা দিয়েছে স্তরে স্তরে জমে উঠা পলিতে উর্বর শস্য শ্যামল নবভূমি। উত্তরেও ঠিক পশ্চিমের মতই লালমাটি অঞ্চলকে ঘিরে আছে আত্রাই-মহানন্দা-করতোয়ার জল আর পলিমাটি দিয়ে গড়া ভূ-ভাগ। আর পূর্ব বাংলায় সিলেটের পূর্বাঞ্চল, ময়মনসিংহের মধুপুর গড়, ঢাকার ভাওয়ালের গড়, পার্বত্য ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাদ দিয়ে প্রায় সবটুকুই নবভূমি। খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর সমতল ভূমি অঞ্চল আরও নতুন, সে জন্যই এ অঞ্চলকে বলা হয় নাব্য মন্ডল। মধ্য ও দক্ষিণ বাংলারও একই অবস্থা। সমূদ্রের নিকটবর্তী বিরাট অঞ্চল নদীর জলে সিঞ্চিত, নদী-নালা-খাল-বিল-জলাভূমি সমাকীর্ণ বৃক্ষশ্যামল, শস্যবহুল জনপদ।

তাই ভূপ্রাকৃতিক গঠন বৈশিষ্ট্যের আলোকে আর.কে. মুখোপাধ্যায়ের অনুসরণে এই ভূখন্ডকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়: (১) প্রাচীন ব-দ্বীপ অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ ও মধ্যবঙ্গ, (২) গঙ্গ-ব্রহ্মপুত্র দোয়াব অঞ্চল অর্থাৎ উত্তর বঙ্গ এবং (৩) নতুন ব-দ্বীপ অর্থাৎ দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গ। 

বাংলার নদ-নদীর ইতিহাস

"বাংলার ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাংলার ছোট বড় অসংখ্য নদ-নদী। এই নদ-নদী গুলিই বাংলার প্রাণ; ইহারাই বাংলাকে গড়িয়াছে, বাংলার আকৃতি প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে যুগে যুগে, এখনও করিতেছে। এই নদ নদীগুলিই বাংলার আর্শীবাদ; এবং প্রকৃতির তাড়নায়, মানুষের অবহেলায় কখনও বোধ হয় বাংলার অভিশাপ" নীহাররঞ্জন রায়ের এই উক্তিতে বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে নদীর গুরুত্ব খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ নদীবহুল দেশ। গঙ্গা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, করতোয়া, মহানন্দ, ভাগীরথী, যমুনা, মেঘনা, প্রভৃতি বাংলার উল্লেখযোগ্য বড় নদী। ছোট বড় অনেক উপনদী এসে মিশেছে এসব নদীতে। আবার এগুলো থেকে অসংখ্য স্রোত ধারায় অগনিত শাখা প্রশাখা বের হয়ে শিরা-উপশিরার মত সাগর পানে বয়ে চলেছে। এত সংকীর্ণ পরিসরে এত অধিক নদ-নদীর সমাবেশ আর কোথাও নেই। এই নদীগুলো বাংলাদেশকে উর্বরা ও শস্যশ্যামলা করেছে এবং এর আর্থিক জীবনে বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছে।

উত্তর ভারত আর আসামের সমতল ভূমি বেয়ে নেমে এসে অসংখ্য শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে নদীগুলো একদিকে যেমন বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৈচিত্রে সুশোভিত করেছে, অন্যদিকে বাঙ্গালীর জীবনে বহু ভাঙ্গাগড়ার কাজও করেছে। যুগে যুগে বড় বড় নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে এবং এর ফলে সমৃদ্ধ নগর ও জনপদ বিলীন হয়ে গেছে এবং নতুন নতুন শহর, বন্দর ও জনপদ গড়ে উঠেছে। গৌড়, তাণ্ডা, ত্রিবেণী, সপ্তগ্রাম ও সোনারগাঁও এক সময় বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ নগর ও বন্দর ছিল। গঙ্গা নদীর গতি পরিবর্তিত হওয়ায় এই নগর ও বন্দরগুলো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে এবং কলকাতার মত নতুন বন্দর গড়ে উঠে। তাই বাংলার অতীত ইতিহাস জানতে বা বুঝতে হলে নদ-নদীর প্রাচীন গতি ও প্রবাহ সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

গঙ্গা, পদ্মা, ভাগীরথী নদীর ইতিহাস 

গঙ্গা বাংলার অন্যতম প্রধান নদী। হিমালয়ে এর উৎপত্তি। তেলিয়াগড়ি ও সিকরিগলির সরু গিরিপথ বেয়ে রাজমহল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে উত্তর ভারত থেকে গঙ্গা বাংলার সমতল ভূমিতে প্রবশে করেছে। সমভূমিতে প্রবশে করেই প্রাচীন গৌড়ের পঁচিশ মাইল দক্ষিণে (বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি থানার ছবঘাটির নিকটে) গঙ্গার প্রবাহ দুভাগে ভাগ হয়েছে। একটি প্রবাহ পূর্ব-দক্ষিণগামী, নাম পদ্মা; অন্যটি সোজা দক্ষিণমুখী, নাম ভাগীরথী। ভাগীরথী বর্তমানে জঙ্গীপুর, লালবাগ, কাটওয়া, নবদ্বীপ ও কলকাতার পাশদিয়ে ডায়মন্ড হারবারের নিকটে সমুদ্রে পড়েছে। সমুদ্রের কাছাকাছি ভাগীরথী হুগলী নদী নামে পরিচিত। আর বর্তমানে গঙ্গার মূল প্রবাহ পদ্মা পূর্ব দক্ষিণগামী হয়ে বাংলাদেশের মধ্যভাগ দিয়ে প্রভাহিত হচ্ছে। পদ্মা গোয়ালন্দের নিকট যমুনার সাথে এবং চাঁদপুরের নিকটে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে জলপ্রবাহ উৎসারিত করেছে। একসময় ভাগীরথীই ছিল গঙ্গার প্রধান প্রবাহ পথ। কবে, কোন সময় থেকে ভাগীরথী ক্রমে শীর্ণ হয়ে উঠেছে তা ঠিক করে বলার উপায় নেই। তবে ষোড়শ শতকের প্রথম দিকেই গঙ্গার প্রধান জলস্রোত যে পদ্মা খাতে বইতে শুরু করেছে তাতে সন্দেহ নেই। ভাগীরথী বহুবার তার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। যতদূর জানা যায়, প্রাচীনকালে ভাগীরথীর ধারা পূর্ণিয়ার দক্ষিণে রাজমহল পার হয়ে রাজমহল-মানভূম-ধলভুমের কোন ঘেঁষে সোজা দক্ষিণাবাহী হয়ে সমুদ্রে পড়ত। তখনো কিন্তু এই প্রবাহ পথেই ছিল অজয়, মোর-এর মত নদীগুলোর সঙ্গম। এসব নদীর জল বুকে নিয়ে ত্রিবেণী (হুগলির নিকটে) পর্যন্ত সোজা দক্ষিণে এসে পরে ভাগীরথী ত্রি-ধারায় (ভাগীরথী, সরস্বতী ও যমুনা) ভাগ হয়ে গিয়েছিল। সপ্তগ্রামকে (সাতগাঁও) পাশে রেখে দক্ষিণ-পশ্চিমবাহী প্রবাহ সরস্বতী নদী সমুদ্রে পড়ত আধুনিক তমলুকের কাছাকাছি কোন জায়গায়। রূপনারায়ণ আর দামোদর তখন এই সরস্বতীর প্রবাহের সাথে নিজেদের জলধারা উৎসারিত করে দিত। ভাগীরথীর প্রধান ধারা বুকে নিয়ে সরস্বতী তখন জমজমাট নদী, তার সঙ্গমে জমজমাট ইতিহাস প্রসিদ্ধ তাম্রলিপ্তি বন্দর। সে সময় ত্রিবেণী বা সপ্তগ্রামের নিকট ভাগীরথী থেকে বের হয়ে যমুনা দক্ষিণ-পূর্বাবাহী হয়ে সাগরে পড়ত। আর সরস্বতী ও যমুনার মাঝে ছিল ভাগীরথী।

অষ্টম শতকের আগে কোন এক সময় ভাগীরথী তার প্রাচীন প্রবাহ পথ থেকে আরও পূর্বদিকে সরে এসে রাজমহল থেকে গৌড় নগরীকে ডান দিকে রেখে বর্তমান কালিন্দী-মহানন্দার খাতে বইতে শুরু করে। অষ্টম শতকের উপর সমুদ্রের কাছে সরস্বতীর মুখও বুজে যায়। জমজমাট তাম্রলিপ্তি বন্দর পরিত্যাক্ত হয়। সরস্বতীর ধারাপথ বদলে যায়। তাম্রলিপ্তির স্থান নেয় সপ্তগ্রাম। চতুর্দশ শতকে এই সপ্তগ্রাম ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার রাজধানী। ষোড়ষ শতকে ভাগীরথীর প্রধান স্রোত হুগলীর সীমান্তবর্তী প্রবাহ দিয়ে বইতে শুরু করে। তখন সপ্তগ্রাম তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।

আগেই পদ্মার কথা বলা হয়েছে। পদ্মা বর্তমানে গঙ্গার প্রধান প্রবাহ পথ। দশম শতাব্দীর পূর্বে পদ্মার কোন উল্লেখ না পাওয়া গেলেও অনুমান করা হয় এর অবস্থিতি ছিল। অনেকের মতে খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকেই পদ্মার প্রবাহ পথের অস্তি ত্ব ছিল। সহস্রাধিক বৎসর পূর্বে যে পদ্মা নদী ছিল তার বিশেষ প্রমাণ আছে বৌদ্ধ চর্যাপদে। এতে পদ্মাখাল বেয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার উল্লেখ আছে। ফলে মনে হয় হাজার বছর আগে পদ্মা অপেক্ষাকৃত ছোট নদী ছিল। তবে ষোড়শ শতকের পূর্বেই পদ্মা বিশাল আকার ধারণ করেছে। প্রাচীন পথ কি ছিল তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও অনুমান করা হয় গোড়ায় পদ্মা রাজশাহীর রংপুর বোয়ালিয়া হয়ে চলন বিলের মধ্য দিয়ে ঢাকাকে পাশে রেখে বুড়ীগঙ্গা, ধলেশ্বরীর খাত বেয়ে মেঘনার খাড়িতে মেঘনার সাথে সমুদ্রে পড়ত। বোধ হয় এই পথই ছিল পদ্মার প্রাচীনতম পথ, আর সে জন্যেই ঢাকার পাশে যে নদী তার নাম বুড়ীগঙ্গা। ভাগীরথী, পদ্মা ছাড়াও আরও কয়েকটি নদীপথে গঙ্গার জল নিকাশ হয়। জলঙ্গী ও মাথাভাঙ্গা পদ্মা থেকে বেরিয়ে ভাগীরথীতে পড়েছে। ভৈরব, কুমার মধুমতি, আড়িয়ালখাঁর প্রবাহ পথেও পদ্মার জল সমুদ্রে উৎসারিত হয়। এদের মধ্যে কুমারই সবচেয়ে প্রাচীন নদী। মধ্যযুগে ভৈরব গুরুত্বপূর্ণ নদী ছিল। বর্তমানে মধুমতি ও আড়িয়ালখাঁই পদ্মার প্রধান শাখা নদী।

ব্রহ্মপুত্র-যমুনার ইতিহাস 

ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি তিব্বতের মানস সরোবরে। এর প্রাচীন নাম লৌহিত্য। এটি বাংলার দ্বিতীয় প্রধান নদী। উৎপত্তির পর এ নদী মোটামুটি পূর্বগামী এবং দক্ষিণ দিকে বাঁক দিয়ে আসামে প্রবেশ করেছে। আসামের ভিতর দিয়ে গতিপথ কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিমগামী এবং রংপুর-কুচবিহারের সীমান্ত দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেছে। বাংলা পর্যন্ত পৌছতে ব্রহ্মপুত্রকে প্রায় ১৮০০ মাইল পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশের পর ব্রহ্মপুত্র বেশ কয়েকবার গতিপথ পরিবর্তন করে বর্তমানে যমুনা-পদ্মার পথে চাঁদপুরে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে সমুদ্রে পড়েছে। পূর্বে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ এরকম ছিল না। তখন গারো পাহাড়ের পূর্ব-দক্ষিণভাগ ঘেঁষে দেওয়ানগঞ্জের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শেরপুর, জামালপুরের ভিতর দিয়ে মধুপুর গড়ের পাশ দিয়ে ময়মনসিংহ জেলাকে দ্বিধা-বিভক্ত করে ঢাকার পূর্বাঞ্চল দিয়ে সোনারগাঁয়ের দক্ষিণ পশ্চিমে লাঙ্গলবন্ধ অতিক্রম করে ধলেশ্বরীতে নিজেকে উৎসরিত করে দিত। ঢাকা জেলায় প্রবশের পথে মূল ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে বেরিয়ে শাখা নদী লক্ষাও মূল নদীর প্রায় সমান্ত রালে প্রবাহিত হয়ে ধলেশ্বরীতে এসে মিশত। সপ্তদশ শতকে এটি ছিল ব্রহ্মপুত্র ও লক্ষার গতিপথ। অষ্টাদশ শতকে এই পথ পরিত্যাক্ত হয়। ব্রহ্মপুত্র তখন আরও পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরববাজারের নিকট উত্তর দিক থেকে আগত সুরমা-মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে আবার মেঘনা নামে সমুদ্রে পড়েছে। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ব্রহ্মপুত্র আবার তার খাত বদল করে। এ সময়ে ব্রহ্মপুত্রের অন্যতম শাখা যমুনা প্রধান হয়ে উঠে এবং বগুড়া-সিরাজগঞ্জ-পাবনার পূর্বসীমা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যমুনাই ব্রহ্মপুত্রের বিপুল জলরাশি গোয়ালন্দের নিকটে পদ্মার প্রবাহে এনে ফেলছে।

মেঘনা নদীর ইতিহাস 

বাংলার পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীপ্রবাহ মেঘনা। খাশিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ে এর উৎপত্তি। উত্তরাংশে এই নদীর নাম সুরমা। সুরমা সিলেট জেলার ভেতর দিয়ে নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জের পূর্বসীমা স্পর্শ করে আরমিরিগঞ্জকে বাম তীরে রেখে ভৈরব বাজারের নিকট ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে তা মিলিত হয়েছে। ভৈরববাজার থেকে সমুদ্র পর্যন্ত নদীর নাম মেঘনা। রেনেলে মানচিত্র অনুযায়ী মেঘনার গতিপথ খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি।

তিস্তানদী (করতোয়া-পূণর্ভবা-আত্রাই) ইতিহাস 

তিস্তা বা ত্রি-স্রোতা উত্তর বঙ্গের প্রধান একটি নদী। ভুটান সীমান্তের উত্তরে হিমালয়ে উৎপন্ন হয়ে দার্জিলিং-জলপাইগুড়ির ভিতর দিয়ে তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জলপাইগুড়ি থেকে তিস্তা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে। দক্ষিণবাহী পূর্ব স্রোতের নাম করতোয়া, দক্ষিণবাহী পশ্চিম স্রোতের নাম পূণর্ভাবা এবং মধ্যবর্তী স্রোতের নাম আত্রাই। তিন স্রোতে প্রবাহিত বলেই এর নাম সম্ভবত ত্রি-স্রোতা বা তিস্তা। করতোয়া ক্ষীণধারা মহাস্থান গড়ের পাশ দিয়ে প্রবাহিত। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত তিস্তা ছিল গঙ্গা-পদ্মার শাখা নদী। ১৭৮৭ খ্রীস্টাব্দের প্রলয়ংকরী বন্যার পর পুরানো খাত ছেড়ে দক্ষিণ-পূর্বাবাহী হয়ে তিস্তা ব্রহ্মপুত্রে প্রবাহিত হতে শুরু করে। সেই থেকে তিস্তা ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী।

উত্তর বঙ্গের আর একটি প্রধান নদী কোশী (কৌশিকী)। কোশীর খাত পরিবর্তন তিস্তার চেয়েও চমকপ্রদ। বর্তমানে কোশী বিহারের পূর্নিয়া জেলার ভিতর দিয়ে রাজমহলের অনেক পশ্চিমে গঙ্গায় প্রবাহিত হয়। কোশী ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হত। ক্রমেই নদীর খাত পশ্চিমে সরে গেছে। কোশীর খাত পরিবর্তনের ফলেই এক কালের সমৃদ্ধ গৌড় অঞ্চল জলাভূমিতে পরিণত হয়েছিল। এর ফলেই পরিত্যাক্ত হয়েছিল গৌড়-লক্ষ্মণাবর্তী-পাওয়া নগরী। আজ উত্তর বাংলায় অসংখ্য মরা নদীর সোঁতা দেখা যায়। এগুলোর অধিকাংশই নাকি কোশীর পরিত্যাক্ত খাত।

ত্রি-স্রোতা-কোশীর মত গঙ্গা-পদ্মা-লোহিত্য-করতোয়া প্রভৃতি বাংলার সবগুলো বড় বড় নদীই ঐতিহাসিক কালের ভিতরে বার বার খাত পরিবর্তন করেছে। ফলে শুধু যে নদীর প্রবাহ পথেরই পরিবর্তন হয়েছে তা নয়, জনবহুল জনপদ জলাভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে; পরিত্যাক্ত হয়েছে সমৃদ্ধ নগরীর, অনেক ক্ষেত্রে কিছু পরিমাণে ভৌগোলিক পরিবেশেরও পরিবর্তন ঘটেছে। তাই নদী অভিহিত হয়েছে কীর্তিনাশা নামে আবার যুগ যুগ ধরে এই পরিবর্তনই বাংলার বুকে ছড়িয়ে দিয়েছে উর্বর নরম পলিমাটির আস্তরণ। সেজন্যই তো এতোসব সত্ত্বেও নদী বাঙালির এতো আদরের। আদর করে বাঙালি তাদের নাম দিয়েছে ইছামতি, ময়ূরাক্ষী, কপোতাক্ষ, চূর্ণী, রূপনারায়ন।

রাজনৈতিক ও জনজীবনে প্রকৃতির প্রভাব (ইতিহাসের উপর ভৌগোলিক পরিবেশের প্রভাব)

প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের উপর এর ভৌগোলিক পরিবেশের প্রভাব ছিল অপরিসীম। নিম্নে এই প্রভাব সম্বন্ধে আলোচনা করা হল:

সমগ্র বাংলাদেশ নদীর পলিদ্বারা গঠিত। নদী বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক শোভায় সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। বর্ষার মৌসুমে অধিকাংশ নদীই দু'কুল ছাপিয়ে প্রবাহিত হয়। এসময়ে বাংলার সমতল ভূমির অনেকাংশ বন্যার পানিতে ডুবে থাকে। নদীগুলো প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার কৃষ্টি গঠনে সহায়তা করেছে। বাংলার ভাটিয়ালী সুর ও সারিগান এদেশের নদ-নদীরই অবদান।

বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও আবহাওয়া স্বভাবতই অধিবাসীদের জীবনের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। মৃদু আবহাওয়া বাংলাদেশের অধিবাসীদেরকে প্রকৃতিগতভাবে কোমল ও শান্ত স্বাভাবের করে গড়ে তুলেছে। বাঙালিদের জীবনের ঘনিষ্টতায় এ প্রকৃতি বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।

ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যই বাংলার অধিবাসীদের খাদ্য, পোষাক, পরিচ্ছদ, বাসস্থানের স্বরূপ নির্ধারণ করেছে। বাংলার প্রধান কৃষিজ খাদ্যশস্য যেমন ধান, তেমনি এর অগণিত নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় যোগান দিয়েছে প্রচুর পরিমাণ মাছ। তাই এর অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য মাছ ও ভাত। বাঙালিকে বলা হয় 'মাছে-ভাতে বাঙালি'। আবার বর্ষাকাল, বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝা ও নদীর ভাঙ্গাগড়ার সাথে লড়াই করেই বাংলার মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। আর এ জন্যই সংগ্রামশীলতা এদেশের অধিবাসীদের প্রকৃতিতে আর এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ঘর-দুয়ার, বাসস্থান প্রভৃতি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার দিকে লক্ষ্য রেখেই তৈরী করতে হয়।

ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বাংলার ইতিহাসের ধারাকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত করেছে। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, করতোয়া, মেঘনা প্রভৃতি বাংলার বড় বড় নদীগুলো যুগে যুগে বহুবার তাদের গতিপথ পরিবর্তন করে নতুন নতুন খাতে প্রবাহিত হয়েছে। এর ফলে কালে কালে বহু সমৃদ্ধ নগর, বন্দর, রাজধানী ও রাজ্যপট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আবার নতুন নতুন শহর বন্দর, নগর প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গৌড়, তাণ্ডা, সোনারগাঁও, সাতগাঁও ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এককালে এগুলো প্রসিদ্ধ নগর, বন্দর ও রাজধানী ছিল।

নদ-নদী ও পানি দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকায় বাংলায় অধিবাসীরা প্রাচীনকাল থেকেই নৌকা নির্মাণ ও নৌযুদ্ধে অসাধারণ পারদর্শিতা অর্জন করেছিল। নৌযুদ্ধে বাঙালির খ্যাতি সম্পর্কে আবুল ফজল লিখেছেন, "তারা বিভিন্ন প্রকারের নৌকা যুদ্ধের কাজে এবং পরিবহনের কাজে ব্যবহার করে। দুর্গ আক্রমণের জন্য তারা নৌকাগুলো এমনভাবে তৈরি করে যাতে নৌকার গলুয়ের অগ্রভাগ দুর্গের উচ্চতা ছাড়িয়ে যায় এবং দুর্গ দখলে সৈন্যদের পক্ষে সুবিধা হয়।" মুসলিম শাসনামলে বাংলার শাসনকর্তাগণ নৌযুদ্ধের গুরুত্ব উপলব্ধি করে নৌবহর প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দিতেন।

বাংলার প্রাকৃতিক সীমারেখা, নদ-নদী, জলাভূমি, বৃষ্টিপাত, দীর্ঘস্থায়ী বর্ষাকাল ও আর্দ্র আবহাওয়া বহিরাক্রমণের বিরুদ্ধে এদেশের প্রতিরক্ষার কাজ করে এসেছে। এসব প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষার আশ্রয়ে বাংলাদেশ প্রাচীনকাল থেকে বহুযুগ পর্যন্ত স্বাধীন রাজনৈতিক জীবন অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিল। উত্তর ভারত থেকে বাংলায় প্রবেশের দু'টি পথ ছিল। কেটি ত্রিহুত (উত্তর বিহার) ও অন্যটি তেলিয়াগড়ি গিরিপথ। ত্রিহুত বাংলায় প্রবেশের পথ ছিল বলে এর নাম হয় দ্বারভাংগা (দ্বার-ই-বংগ)। কিন্তু এ দু'টি পথই ছিল অত্যন্ত দুর্গম। ত্রিভৃতের পথে বাংলায় আসতে হলে কুশী, গণ্ডক, মহানন্দা প্রভৃতি খরস্রোতা নদী অতিক্রম করতে হত। তাই উত্তর ভারতীয় সৈন্যদের অভিযান পথ হিসেবে এ পথে আসা সহজসাধ্য ছিল না। তারা সচরাচর তেলিয়াগড়ির পথেই বাংলায় প্রবেশের চেষ্টা করতো। তবে এ পথ অত্যন্ত সংকীর্ণ ছিল বলে বাংলার অল্প সংখ্যক সৈন্য দ্বারা উত্তর ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হত। এই ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই উত্তর ভারতীয় সম্রাটরা বাংলায় স্থায়ী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ভৌগোলিক প্রতিকূলতার সুযোগ নিয়ে বাংলার শাসনকর্তারা সহজেই দিল্লীর অধীনতা ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করতো। দিল্লীর ঐতিহাসিকরা বাংলাকে বলতেন 'বালগাক খানা' বা বিদ্রোহের নগরী। বিদ্রোহ ছিল বাংলার দ্বিতীয় প্রকৃতি। মুসলিম আমলে দিল্লীর অধীনতা ছিন্ন করে সমগ্র বাংলায় স্বাধীন সুলতানী শাসন প্রতিষ্ঠা হয় এবং তা প্রায় দুইশত বৎসর (১৩৩৮-১৫৩৮) পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই স্বাধীন রাজনৈতিক জীবনের আওতায় বাঙালিদের জাতীয় জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়।


Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url