দলীয় ব্যবস্থা কাকে বলে? দলীয় ব্যবস্থার সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা
সরকার গঠনের জন্য কোনো রাষ্ট্রের যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাকে দলীয় ব্যবস্থা বলে। আধুনিক রাষ্ট্রের সব সরকারেরই দলীয় ব্যবস্থা রয়েছে। আধুনিক সরকারের অর্থই হলো দলীয় সরকার। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতীয় ব্যবস্থা একান্ত আবশ্যকীয়। কেননা বর্তমান প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সরকারের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে জাতীয় ব্যবস্থা ও এর সুষ্ঠুসংগঠনের উপর।
দলীয় ব্যবস্থা কি?
সাধারণত সরকার গঠনের জন্য কোনো রাষ্ট্রের যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাকে দলীয় ব্যবস্থা বলে। অর্থাৎ দল ব্যবস্থা বলতে কোনো দেশের রাজনৈতিক দলের সংখ্যা, গঠন, সরকারের সঙ্গে দলের সম্পর্ক ইত্যাদি বুঝায়। অধুনিক বিশ্বের সকল রাষ্ট্রেই দলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। তবে সকল রাষ্ট্রের দলীয় ব্যবস্থা একরূপ নয়। সমাজ ব্যবস্থাভেদে এবং প্রতিটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে ভিন্ন ধরনের দলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। কোথাও একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ও কর্তৃত্ব স্বীকৃত (যা একদলীয় ব্যবস্থা নামে পরিচিত)। যেমন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কোথাও দুটি দলের প্রাধান্য এবং এদের মধ্যে ক্ষমতার হাত বদল বা দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বিরাজমান। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য। আবার অন্যত্র দু'য়ের অধিক দল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্রিয়াশীল। যেমন- ভারত, সুইডেন। কোথাও দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্য শিথিল যেমন- যুক্তরাষ্ট্র; আবার কোথাও তা দৃঢ়, যেমন-যুক্তরাজ্য।
![]() |
দলীয় ব্যবস্থা কাকে বলে? দলীয় ব্যবস্থার সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা |
দলীয় ব্যবস্থার সুবিধা
দলীয় ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক ব্যবস্থার এক বড় আবিষ্কার। নিম্নে দলীয় ব্যবস্থার সুবিধাসমূহ উল্লেখ করা হলোঃ
১. সরকারকে স্থিতিশীল রাখে
কোনো রাষ্ট্রের দলীয় ব্যবস্থা সরকারকে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করে তোলে। রাজনৈতিক দল সরকারের শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের বিভিন্ন কার্যক্রমের পক্ষে জনমত গঠন করে শাসন ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখে।
২. বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সংহতি রক্ষা করে
দলীয় ব্যবস্থা সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সংহতি রক্ষা করে। রাজনৈতিক দল সরকারের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সার্বক্ষণিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। যাতে এদের মধ্যে অচলাবস্থা দেখা না দেয় সেদিকে দৃষ্টি রাখে।
আরও পড়ুনঃ অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নাবলি: দলীয় ব্যবস্থা
৩. জাতীয় সমস্যার সমাধান
দলীয় ব্যবস্থার একটি অন্যতম সুবিধাজনক দিক হলো জাতীয় সমস্যার সমাধান। দলীয় ব্যবস্থার সুযোগে রাজনৈতিক দল বিভিন্ন বিষয়ে জাতীয় সমস্যা চিহ্নিত করে এবং সেগুলো সমাধানের জন্য বাস্তবমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।
৪. সরকারের স্বৈরাচারিতা রোধ করা
দলীয় ব্যবস্থা সরকারের স্বৈরাচারিতা রোধ করে। কেননা বিরোধী দল সরকারের দোষ-ত্রুটি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সমালোচনা করে জনগণকে সজাগ করে। ফলে জনমতের সমালোচনার ভয়ে সরকার স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে।
৫. অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে
দলীয় ব্যবস্থা দেশের জনগণকে তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে। এর ফলে জনগণ তাদের অধিকার সম্পর্কে জানতে পারে। সরকার জনগণের অধিকার হস্তক্ষেপ করতে সাহসী হয় না।
৬. শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের পরিবর্তন।
উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দলীয় রাজনীতির একটি অন্যতম সুবিধা হলো শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের পরিবর্তন এবং সংবিধানের গণ্ডির মধ্যে থেকে গণতন্ত্রের প্রসার সাধন। বস্তুত দলীয় ব্যবস্থা ব্যতীত শান্তিপূর্ণভাবে সরকার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই থাকে না।
আরও পড়ুনঃ অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর: (রাজনৈতিক দলের তত্ত্বসমূহ)
দলীয় ব্যবস্থার অসুবিধা
দলীয় ব্যবস্থা গণতন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ বলে বিবেচিত হলেও এর কিছু অসুবিধা পরিলক্ষিত হয়। দলীয় ব্যবস্থার অসুবিধাসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
১. ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করে
দলীয় ব্যবস্থার অসুবিধাসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো এটি ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করে। এটি দলীয় আনুগত্যের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে বলে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকে না।
২. রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক
দলীয় ব্যবস্থা অধিকাংশ সময় রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, কেননা দলীয় কর্মীগণ তাদের নিজ নিজ দলের প্রতি অধিক অনুগত থাকে বলে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য কমে যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থ বড় হয়ে উঠে। ফলে তা রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক হয়।
৩. জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি দেশ-শাসনে বঞ্চিত হয়
দলীয় ব্যবস্থা জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গকে অনেক সময় দেশ শাসনে বঞ্চিত করে। রাজনৈতিক দলের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ দলীয় শৃঙ্খলার স্বার্থে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেয় এবং দলের চাপে নিজস্ব স্বাধীন মতামত প্রকাশ করে না। আবার অনেকে কঠোর দলীয় শৃঙ্খলা, নির্বাচন প্রভৃতির কারণে এ থেকে দূরে থাকেন।
৪. দুর্নীতির প্রশ্রয় দেয়
দলীয় ব্যবস্থার কারণে সরকারের শাসনকার্যে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তাগণ দুর্নীতির প্রশ্রয় ল্যদেয়। দলীয় সমর্থনপুষ্ট কর্মকর্তাগণ স্বীয় দলের সদস্যদেরকে অন্যায়ভাবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে।
৫. অশান্তি ও অস্থিরতা বাড়ে
দলীয় ব্যবস্থা বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ও শত্রুতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিপক্ষকে অহেতুক আক্রমণ ও হেয়প্রতিপন্ন করে রাজনৈতিক পরিবেশকে দূষিত করে তোলে।
৬. জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হয়
তত্ত্বগতভাবে সার্বিক জনকল্যাণসাধন দলীয় ব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য হলেও কার্যত রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় স্বার্থসিদ্ধিকেই প্রাধান্য দেয়। দলীয় স্বার্থসিদ্ধির কারণে সরকারি দল অনেক সময় সরকারি প্রশাসনকে ব্যবহার করে। ফলে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা
সবশেষে
পরিশেষে বলা যায় যে, নানাবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দলীয় ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। দলীয় ব্যবস্থা জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে সংকীর্ণ আনুগত্যবোধ দূর ও জাতীয় চেতনাবোধ জাগ্রত করে পরিচিতি ও সংহতির সংকট দূর করতে পারে এবং একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আত্ম-শক্তিসম্পন্ন ও টিকে থাকার যোগ্য করে তুলতে পারে। বস্তুত দলীয় ব্যবস্থার এরূপ গঠনমূলক ভূমিকা বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্পষ্টতই দৃশ্যমান।