সুশীল সমাজের মূলনীতি। সুশীল সমাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সুশীল সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত। সুশীল সমাজের শ্রেণীবিভাগ
সুশীল সমাজ রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য অংশ। কারণ সুশীল সমাজ রাষ্ট্রের অন্যতম উপাদান জনগণ তথা জনসমষ্টি নিয়ে গঠিত হয়। আধুনিক রাষ্ট্রের সুশীল সমাজে জনগণের স্থান সবার উর্ধ্বে। সুশীল সমার ব্যক্তিসত্তার পূর্ণবিকাশ, শিক্ষার অধিকার, সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
![]() |
সুশীল সমাজ কি? সুশীল সমাজের মূলনীতি। সুশীল সমাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি? সুশীল সমাজের প্রকারভেদ আলোচনা। |
সুশীল সমাজের মূলনীতি
নিম্নে সুশীল সমাজের মূলনীতিগুলো আলোচনা করা হলো।
- ব্যক্তিসত্তার পূর্ণবিকাশ
গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিসত্তার পূর্ণবিকাশের সুযোগ থাকে। ব্যক্তির মধ্যে যে অন্তর্নিহিত শক্তি আছে, সমাজের সহযোগী ভূমিকার কারণে সেই প্রচ্ছন্ন শক্তি পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। সেখানে কতকগুলো সামাজিক শর্ত বিদ্যমান যা সুশীল সমাজ নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
- ব্যক্তিসত্তার পূর্ণবিকাশের জন্য ব্যাপক শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য
শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। হ্যারল্ড জে লাঙ্কি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে, রাষ্ট্রে Uniform system of education ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। সকল শ্রেণীর জন্য মৌলিক শিক্ষা উন্মুক্ত রাখতে হবে।
- পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্মান
সুশীল সমাজের একটি অন্যতম মূলনীতি হলো পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস ও সৌহার্দ যা গণতান্ত্রিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণের যেমন-আমলা, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী গোষ্ঠী, ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও এনজিওর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে।
- সমতার সমাজ
সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদি ও ব্যক্তিবর্গের আচরণের বৈষম্যের কারণে সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। সমাজের প্রভাব-প্রতিপত্তিশালীদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষিত থাকলে সে সমাজের স্বাভাবিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়। সমাজের হতাশা, নৈরাজ্য ও উন্নয়নের হুমকি দূর করার জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমতা নিশ্চিত করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বিভিন্ন মূলনীতির আলোকে সুশীল সমাজ পরিচালিত হয়। সমাজে সকলের শিক্ষার অধিকার, সমতা বিধান সুশীল সমাজের অন্যতম মূলনীতি। আদর্শ সমাজের যেসব মূলনীতি থাকা প্রয়োজন সুশীল সমাজের মধ্যে তার সবকিছুই বিদ্যমান।
সুশীল সমাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
আধুনিক বা Civil Society এর ভূমিকা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সুশীল সমাজ হলো এমন এক জনসমষ্টি যারা সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দেয়। এর সদস্যরা সবসময় তাদের গোষ্ঠী ও সমাজের উন্নয়নে স্বেচ্ছামূলকভাবে কাজ করে থাকে।সুশীল সমাজের সদস্যরা উন্নয়ন ও কল্যাণমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে দায়িত্ব ও কর্তব্যে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করে।
সুশীল সমাজ যেসব কার্যাবলি সম্পাদন করে তার পিছনে কিছু লক্ষা ও রাদ্দশ্য কাজ করে। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো।
১ সংবিধান বর্ণিত মৌলিক মানবাধিকারসমূহ বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ।
২ মুক্তির জন্য সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করা।
নাগরিক অধিকার আদায়ে সংগঠন গড়ে তোলা এবং আন্দোলন পরিচালনা করা।
৪ আইনের শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করা। যাতে সবাই সমান সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় অধিকারসমূহ ভোগ করতে পারে।
৫ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন এবং মানবাধিকারের জন্য প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখা।
৬ সম্প্রদায়ভিত্তিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা যাতে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও শিক্ষার উন্নয়নসহ নানাবিধ সমস্যা মোকাবিলা করা।
৭. ভূমিজ ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ।
৮ মানবিক নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য কাজ করা।
৯. গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।
১০ সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সু-সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা।
পরিশেষে বলা যায়, সুশীল সমাজ এমন এক সংগঠন যার সদস্যরা শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত এবং গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী। এর সদস্যদের মূল উদ্দেশ্যই হলো মৌলিক মানবাধিকার আইনের শাসন, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ করা। এসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সুশীল সমাজ কখনো পরোক্ষ কখনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়।
সুশীল সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত
আধুনিক বিশ্বে সুশীল সমাজ একটি বহুল আলোচিত বিষয়। বিশেষ করে উদার ও গণতান্ত্রিক সমাজগুলোতে সুশীল সমাজকে একটি বিশেষ শক্তি বা নির্ধারক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাষ্ট্রে সুশীল সমাজ গড়ে উঠা ও অর্থবহ করার পিছনে বিভিন্ন উপাদান সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও এর কিছু পূর্বশর্ত আছে।
ব্রাটন (Bratton) তার Civil Society and Political Institution in = Africa শীর্ষক এক প্রবন্ধে সুশীল সমাজ গঠন ও অর্থবহ করার জন্য তিনটি পূর্বশর্তের কথা বলেছেন। যথা- ১. অর্থ-■ সম্পদের জোগান, ২. সাংগঠনিক এবং ৩ আদর্শগত। নিম্নে সুশীল সমাজ গঠনের পূর্বশর্তসমূহ আলোচনা করা হলো।
- অর্থ-সম্পদের জোগান
শক্তিশালী সুশীল সমাজ গড়ে তোলার জন্য দরকার অর্থ-সম্পদের প্রাপ্যতা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা। সম্পদের জোগান বেশি হলে সুশীল সমাজ সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় - কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
- সাংগঠনিক
সুশীল সমাজ গঠন ও কার্যকর করতে হলে সমাজে বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিশেষত নাগরিক অধিকার রক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলা দরকার। সংগঠনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় - এবং এক ধরনের সংগঠিত সম্প্রদায়ে রূপান্তর করে যার মাধ্যমে সুশীল সমাজ বিভিন্ন অধিকার আদায়ে আন্দোলন গড়ে ভুলতে পারে।
- আদর্শগত
নাগরিক সংগঠনগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতির ভিত্তি রচনা করা। তারা নাগরিক সংস্থাগুলোর সামর্থ্য সীমা বদিত করাব। এই সাথে নাগরিক সমাজের যে দায়িত্ব থাকে তা পালনের জন্য সঠির বৃদ্ধি রেখে জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও সামাজিক ইস্যু ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন বাংলাদেশের পরিচালক (amidal Milli সুশীল সমাজের চারটি পূর্বপার্তের কথা বলেছেন।
১ তথ্য সঞ্চালনের সুবিধাদি সম্প্রসারণ,
২. শিক্ষার পরিসর বৃদ্ধি ও আত্মপ্রকাশের সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত করা,
৩. আইনের শাসন সুনিশ্চিত করা ও নাগরিক সংগঠনগুলো শক্তিশালী করার জন্য উৎসাহ দেওয়া যাতে উদ্বৃত্ত সম্পদ সৃষ্টি হয়।
পরিশেষে বলা যায়, সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা ও সফলতার জন্য বিভিন্ন পূর্বশর্ত রয়েছে। কার্যকরী সুধীদ সমাজ যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এটি সহজেই অর্জন করা যায় না।
সুশীল সমাজের প্রকারভেদ
সকল দেশে সুশীল সমাজের ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। কেননা সুশীল সমাজ ব্যতীত নাগরিক অধিকারসমূহ সঠিকভাবে রক্ষিত হয় না। সুশীল সমাজ সম্পর্কে আলোচনার জন্য এর অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। সুশীল সমাজের ধারণাটি প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
- প্রাথমিক শ্রেণী
প্রাথমিক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ধনী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, রাজনীতিবিদ, আমলা প্রভৃতি বাজনৈতিক ব্যবস্থায় এদের প্রভাব এত বেশি যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কারা অধিষ্ঠিত হবে তা অনেক ক্ষেত্রে এদের দ্বারা নির্ধারিত হয়। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অনেক সময় নির্ভর করে এদের নেতৃত্বদানের উপর। প্রতিটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার লক্ষ্য চ্যুতি ঘটে।
- মাধ্যমিক শ্রেণী
মাধ্যমিক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে- শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কবি সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, ছাত্রসমাজ ইত্যাদি। রাষ্ট্র ও তার অধিনস্ত্র প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার এবং জনস্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এই শ্রেণী সবসময় সোচ্চার থাকে। বিভিন্ন আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এই শ্রেণীকে বিবেচনা করা হয়।
- প্রান্তিক শ্রেণী
এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষ। এরা সংখ্যায় বেশি এবং কর্মের প্রয়োজনে শহরে বসবাস করে। এদের কাজ হলো প্রাথমিক শ্রেণী ও মাধ্যমিক শ্রেণীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করা।
উপরিউক্ত শ্রেণীবিভাগ ছাড়াও এল ডায়মন্ড (L.) Diamond) সুশীল সমাজকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে যথা ১. অর্থনৈতিক গোষ্ঠী, ২. সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, ৩. তথ্যপ্রবাহ ও শিক্ষামূলক সংগঠন, ৪. স্বার্থভিত্তিক গোষ্ঠী, ৫. উন্নয়ন সংগঠন, ৬. ইস্যুভিত্তিক সংগঠন এবং ৭ নাগরিক সংস্থা।
পরিশেষে
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, প্রতিটি সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের সুশীল সমাজের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। প্রতিটি সমাজব্যবস্থায় জনকল্যাণ নিশ্চিতকরণে সুশীল সমাজ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও কখনো কখনো এরা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য নেতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।