বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয়তাবাদী দল এবং জাতীয় পার্টির ভাঙন প্রক্রিয়া আলোচনা

বাংলাদেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান এবং ক্রমেই এখানে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি ভাঙন প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বাপেক্ষা পুরাতন রাজনৈতিক দল। এ রাজনৈতিক দলটি বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতার নেতৃত্ব নিয়ে ভিন্নমতের সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে দলটিকে বেশ কিছু ভাঙনের সমুখীন হতে হয়েছে।


বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভাঙন প্রক্রিয়া আলোচনা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয়তাবাদী দল এবং জাতীয় পার্টির ভাঙন প্রক্রিয়া আলোচনা 

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভাঙন প্রক্রিয়া 

ভাঙন বা বিভাজনের রাজনীতির অস্তিত্ব বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান। নিম্নে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভাঙন প্রক্রিয়া আলোচনা করা হলো।

১. মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব

মুসলিম লীগের একটি অংশ হতে আওয়ামী লীগের সৃষ্টি হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৮ সালে মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের নিয়ে পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ নামে নতুন একটি দল গঠন করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে ১৯৪১ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। এটিই বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করেছে।

২. কাগমারী সম্মেলনের বিভাজন 

১৯৫৭ সালে কাগমারীতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাগমারী সম্মেলনে দলের দুটি ভাগ লক্ষ করা যায়। একটি ছিল মাওলানা ভাসানীর অধীন এবং অন্যটি ছিল সোহরাওয়াদীর অধীন। ভাসানী দল ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি দল গঠন করে।

৩. স্বাধীনতা উত্তর বিভাজন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর (১৯৭০-৭২) এ সময়ে দলে বিভাজন সৃষ্টি হয় এবং ২টি গ্রুপ বের হয়ে দল গঠন করে। যথা-

(ক) একটি হলো আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে জাতীয় লীগ গঠন এবং

(খ) আর একটি হলো বামপন্থি ছাত্রদের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) প্রতিষ্ঠা।

৪. বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের উপর। নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালানোর পর আওয়ামী লীগ ভেঙে কয়েকটি নতুন দলের সৃষ্টি হয়।

৫. ড. কামাল হোসেনের সাথে দ্বন্দ্ব

১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিতে শুরু করে দেয় তখন ড. কামাল হোসেন তার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান। পরবর্তীতে ড. কামাল হোসেন গণফোরাম নামে নতুন একটি দল গঠন করেন।


বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভাঙন প্রক্রিয়া

১৯৭০ এর দশক থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভাজন লক্ষ করা গেছে। নিম্নে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর ভাঙন প্রক্রিয়া আলোচনা করা হলো।

১. জিয়াউর রহমানের মৃত্যু

১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যার পর বিএনপি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। যথা-

(ক) আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে এফটি দল যেটি পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আসে এবং

(খ) অন্যটির নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী সামছুল হুদা চৌধুরী।

২. ওবায়দুর রহমানের জনতা দল গঠন

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর মধ্য থেকে কে. এম. ওবায়দুর রহমান বের হয়ে যান এবং জনতা দল গঠন করেন।

৩. এলডিপি গঠন

২০০১-০৬ সালের দিকে বিএনপিতে বড় ভাঙন দেখা যায়। একদল সিনিয়র নেতা বিএনপি থেকে বের হয়ে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) গঠন করেন।

৪. ২০০৭-০৮ সালের ভাঙন

২০০৭-০৮ সালের দিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর মধ্যে দুটি ভাগ দেখা যায়। যথা-

(ক) একটি হলো পুনর্গঠনের পক্ষে যার নেতৃত্ব ছিলেন মান্নান ভূঁইয়া।

(খ) অন্যটি খালেদার পক্ষে যার নেতৃত্বে ছিলেন খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। কিন্তু মান্নান ভূঁইয়া খালেদা জিয়ার পক্ষের গ্রুপের কাছে হেরে যান। পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার মুক্তির পর মান্নান ভূঁইয়াকে দলের মহাসচিব থেকে অপসারণ করে খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়।


জাতীয় পার্টির ভাঙন প্রক্রিয়া 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টি হলো অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল। নিম্নে জাতীয় পার্টির ভাঙন প্রক্রিয়া আলোচনা করা হলো।

১. ১৯৮৬-৯০ সাল

১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় ফ্রন্ট 'জাতীয় পার্টি' নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল ইসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জেনারেল এরশাদ ১৯৮৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন এবং ২ সেপ্টেম্বর এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। বর্তমানেও তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ১৯৮৬-৯০ এর সময়কালে জাতীয় পার্টির যখন ক্ষমতায় ছিল তখন জাতীয় পার্টির মধ্যে তেমন বড় কোনো ভাঙন দেখা যায় নি। তবে ১৯৯০ সালে বিরোধী দলের গণঅভ্যুত্থানের মুখে রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে জাতীয় পার্টিও দেশের ক্ষমতার মঞ্চ থেকে অপসারিত হয়।

২. ১৯৯০ পরবর্তী ভাঙন

১৯৯০ সালে ক্ষমতা থেকে অপসারণের পর জাতীয় পার্টির মধ্যে কয়েকবার ভাঙন দেখা দেয়। যথা-

(ক) জাতীয় পার্টি (এরশাদ)।

(খ) জাতীয় পার্টি (মনজু)।

(গ) জাতীয় পার্টি (নাজিউর)।

(ঘ) জাতীয় পার্টি (এম এ মতিন)।

৩. বর্তমান সময়ে ভাঙন

২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ করে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ২১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ১৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। বর্তমানে জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এ দলের মধ্যে কোন্দল মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তাই জাতীয় পার্টির টিকে থাকার প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।


পরিশেষে

পরিশেষে বলা যায় যে, ভাঙন প্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলের একটি অংশ। জাতীয় পার্টিও এই ভাঙন প্রক্রিয়ার বাইরে নয় তা উল্লিখিত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট। কখনো কখনো ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্ব দলটিতে ভাঙনের রূপ নিয়েছে। এমনকি বর্তমান বিরোধী দল হয়েও এ দলের মধ্যে কোন্দল চরমে পৌঁছেছে। এ নেতিবাচক দিক থেকে দলটি বের হয়ে আসতে পারলে দেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

Next Post Previous Post