রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের বাহক হিসেবে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা মূল্যায়ন
আধুনিকীকরণ এক চিরন্তন ও জটিল বিষয়। যেখানেই, যখনই ও যেকোনো উদ্যোগেই আধুনিকীকরণ সাধিত হয়েছে, সেখানেই তখন মানুষ যুক্তিভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিক নিয়ন্ত্রণে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী হয়েছে। এই বিশ্বাসই আধুনিকীকরণের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কিছুটা ভিন্নতর ভাষায় বলতে গেলে, আধুনিকীকরণ বলতে, 'বিশ্ব-কৃষ্টির' প্রসার লাভ করাকেই বুঝায়। রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ ব্যাখ্যা করার পূর্বে আধুনিকীকরণ কি তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
![]() |
রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের বাহক হিসেবে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা মূল্যায়ন |
রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ
রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ বলতে এমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিকাশ সাধন করাকে বুঝায় যেটা তার উপর আরোপিত বা তার কাছে উত্থাপিত দাবিসমূহকে মোকাবিলা করার বা সেগুলো মিটানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট নমনীয় ও শক্তিশালী। রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অবস্থানের ক্ষেত্রে এক অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটায়, যার ফলে সনাতনধর্মী পরিবারভিত্তিক ও বর্ণগত কর্তৃত্বের স্থলে একটি একক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নির্দেশ করে। সহজকথায় বলতে গেলে, কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে কতিপয় বৈশিষ্ট্যের বিকাশ লাভেই রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের মূলকথা। এসব বৈশিষ্ট্য আধুনিকীকরণের অগ্রদূত এবং প্রারম্ভিক আধুনিকীকরণের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে কাজ করেছে।
রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের বাহক হিসেবে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা
রাজনৈতিক দলকে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের অন্যতম বাহক বললেও অত্যুক্তি হয় না। নিম্নে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের বাহন হিসেবে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা আলোচনা করা হলো:
১. সনাতন সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দল:
এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকাসহ উন্নয়নশীল দেশসমূহে একদা ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের ক্রিয়াকলাপের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন সমাজ কাঠামো ক্রমে ভেঙে পড়ে। জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশ লাভ করে এবং জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়। তারা একটি গণভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এ ধরনের দলকে একটি দ্বিমুখী সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়। প্রথমত, বিদ্যমান বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে এবং দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ সনাতন সমাজ কাঠামো এবং এর রক্ষকদের বিরুদ্ধে। এই দ্বিমুখী সংগ্রাম পরিচালনার জন্যই ব্যাপকভিত্তিক গণজমায়েতের প্রয়োজন হয় আর ফলশ্রুতিতে গণভিত্তিক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের নেতৃত্ব প্রদান করেন একজন সম্মোহনী নেতা।
২. আধুনিকতাগামী সমাজে রাজনৈতিক দল
রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ফলে নতুন নতুন গোষ্ঠী অনেক নতুন কাজ ও ভূমিকা গ্রহণ করে। ফলে সৃষ্টি হয় এক বৃহত্তর ও ভিন্নমুখী সমাজের। এই সকল সামাজিক শক্তিকে একটি একক জাতিভিত্তিক রাজনৈতিক সমাজের মধ্যে সংহত করা প্রয়োজন। আর এই সংহত করার কাজটি সুসম্পন্ন করতে হলে রাজনৈতিক ব্যবস্থাতে তাদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল এক একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে।
৩. রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দল প্রাচীন সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না। কিন্তু আধুনিককালে শিক্ষাদীক্ষা, প্রযুক্তি, কলাকৌশল, শহরায়ন ও গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতির ফলে বৃহত্তর গণঅংশগ্রহণ একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই কারণে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেও অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা জনগণকে উৎসাহিত ও আগ্রহী করে তোলে। এহেন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের সকল অঞ্চল ও পর্যায় থেকে সদস্য নিয়োগ করে রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণের সংকট দূর করতে সচেষ্ট হয়। রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণকে সংবেদনশীল হতে সাহায্য করতে পারে।
৪. রাজনৈতিক বৈধতা আনয়নে রাজনৈতিক দল
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক বৈধতা আনয়নে বা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। কেননা এসব দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদি থাকে অত্যন্ত দুর্বল। সাধারণত উপনিবেশ পরবর্তীকালে উন্নয়নশীল দেশে এই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল একদিকে দেশের অর্থবল, শ্রেণী, বর্ণ, ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে এর সদস্য নিয়োগ করে এবং অপরদিকে দলের অভ্যন্তরে বহুজাতীয় মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটিয়ে একটি নির্দিষ্ট আদর্শ গড়ে তোলে। এভাবে রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি বৈধতার মনোভাব তৈরি করতে তৎপর হয়।
৫. রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে রাজনৈতিক দল
যেকোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের অর্থ হলো মানুষের মনে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটানোর এক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং এর বহুমুখী ভূমিকার প্রতি কতকগুলো মনোভাব, ধ্যানধারণা, মূল্যবোধ ও অনুভূতি মানুষের মনে সৃষ্টি করে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলের ভূমিকা এক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ। রাজনৈতিক দলের আদর্শ, কর্মসূচি বিভিন্ন দলীয় পুস্তিকায় অন্তর্ভুক্ত করে তা মানুষের মধ্যে বিলিবণ্টন করে তাদের মনমানসিকতাকে প্রভাবিত করা হয়। উল্লেখ্য যে, এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া হঠাৎ করে হয় না। পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ মাধ্যম, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে এ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
৬. জাতীয় সংহতি সৃষ্টিতে রাজনৈতিক দল
নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক দল জাতীয় সংহতি আনয়ন করে। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক দল জনগণের মধ্যে একাত্মতার চেতনাও আনয়ন করে। এসব রাষ্ট্রের আদিম সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে কার্যকর ও সংহত করার মাধ্যমে তাদের আদিম চেতনা ও সংকীর্ণ আনুগত্যকে দূর করা রাজনৈতিক দলের অন্যতম কাজ বলে পরিগণিত হয়। এসব সংকীর্ণ চেতনা ও আনুগত্যকে দূরীভূত করে এক ধরনের ন্যূনতম মূল্যবোধ সংক্রান্ত ঐকমত্য সৃষ্টি করতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রচেষ্টা চালায়। তারা এজন্য জনগণকে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ প্রদান ও রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে এবং রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের পথ প্রশস্ত করে।
৭. দ্বন্দ্ব-বিরোধের মীমাংসাকরণে রাজনৈতিক দল
একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজের বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী স্বার্থের দ্বন্দ্ব-বিরোধ মীমাংসা করার বিষয়টি প্রধান স্থান দখল করে থাকে। বিভিন্নমুখী দাবি-দাওয়া ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উদ্ভবের ফলে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংকটের মুখোমুখি হয়। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা কিভাবে বিভিন্ন উপদল কর্তৃক উত্থিত বহুমুখী দাবি-দাওয়া পূরণে এদের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব-বিরোধ নিরসনে সে কতখানি সাফল্য অর্জন করতে পারে তার উপরই ঐ রাজনৈতিক ব্যবস্থার গুণাগুণ নির্ভর করে। রাজনৈতিক দল হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি নির্দিষ্ট কাঠামো, যা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিভিন্নমুখী দাবি-দাওয়ার সমষ্টিকরণ এবং এদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসন করতে সক্ষম।
৮. রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনয়নে রাজনৈতিক দল
সনাতন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। রাজনৈতিক দল বরং আধুনিককালেই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গড়ে উঠেছে। সনাতন সমাজে এটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে এবং আধুনিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনের সাথে নিজেকে খাপখাইয়ে নেয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন, ভোট প্রদান এবং প্রার্থী নির্বাচন করে শাসকবর্গকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করে তোলে। এভাবে রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা আনয়নে সচেষ্ট হয়।
৯. জনগণকে একত্রীকরণ ও সংগঠিতকরণে রাজনৈতিক দল
যেকোনো রাজনৈতিক দলে শক্তি নির্ভর করে রাষ্ট্রের জনগণকে একত্রীকরণ ও সংগঠিতকরণের সামর্থ্যের উপর। কাজেই বলা হয়ে থাকে যে, যে দল ও দলীয় ব্যবস্থা এই দুটি কাজকে সমন্বিত করতে সক্ষম হয় সে দল ও দলীয় ব্যবস্থা রাজনৈতিক আধুনিকীকরণকে রাজনৈতিক উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত করেছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
১০. গ্রাম ও শহরের ব্যবধান দূরীকরণে রাজনৈতিক দল
যেকোনো দেশে আধুনিকীকরণের ফলে গ্রামীণ ও শহর এলাকার মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়। শহরাঞ্চলগুলো শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নত হয়। গ্রামাঞ্চলগুলো শহরাঞ্চলের চেয়ে পশ্চাতে পড়ে থাকে। ফলে শহুরে জনগণ ও গ্রামীণ জনগণের মধ্যকার ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তারা দেশের সকল অঞ্চল থেকে সদস্য নিয়োগ করে দলীয় আদর্শের পিছনে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে গ্রাম ও শহর এবং গ্রামীণ ও শহুরে জনগণের মধ্যকার পার্থক্য দূর করে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা যায় যে, রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব ও প্রভাব অপরিসীম। রাজনৈতিক দল ব্যতীত কোনো রাষ্ট্র ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের দিকে অগ্রসর হতে পারে না। সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের অন্যতম বাহক।