বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর

আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ও পরিচালনার জন্য একটি স্বতন্ত্র নির্বাচন কমিশন রয়েছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে নির্বাচন ব্যবস্থা সংগঠন, নির্বাচনি আইন এবং নির্বাচনি এলাকার সীমা নির্ধারণের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের গঠনঃ 

বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৮নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত সংখ্যক নির্বাচন কমিশনার নিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। নির্বাচন কমিশনারের সংখ্যা হবে অনধিক চারজন। তবে একাধিক নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সভাপতিরূপে কাজ করবেন।

সাংবিধানিক নিয়মানুসারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য কমিশনারের পদের মেয়াদ কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে ৫ বছর হবে। তবে ৫ বছর প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকার পর তিনি প্রজাতন্ত্রের অপর কোনো কাজে নিয়োগ লাভ করতে পারবেন না। অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পরবর্তীকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ লাভ করতে পারবেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের ন্যায় পদমর্যাদা সম্পন্ন। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনারের দাপ্তরিক কাজকর্ম পরিচালনার জন্য একজন সচিবের নেতৃত্বে একটি জনবল কাঠামো রয়েছে। তবে কমিশনের চাহিদা মোতাবেক রাষ্ট্রপতি কর্তৃক এ জনবল কাঠামো নির্ধারণ হয়ে থাকে। নির্বাচন কমিশনের সচিব একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যাবলিঃ

বাংলাদেশের নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৮নং অনুচ্ছেদের ৪নং উপধারায় নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন এবং কেবল এ সংবিধান আইনের অধীন হবেন। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন সম্পন্ন করতে গিয়ে যখন, যেভাবে প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সেভাবে কাজ করেন। শুধু নির্বাচন পরিচালনা ছাড়াও নির্বাচন সংক্রান্ত আরোও অনেক কাজ নির্বাচন কমিশন সম্পন্ন করে থাকে। নিম্নে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করা হলো:

১. ভোটার তালিকা তৈরিঃ

সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের অন্যতম কাজ। প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তকরণের মাধ্যমে ভোটারদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ, সে অনুযায়ী নির্বাচনি কেন্দ্রগুলোতে সরঞ্জামাদি সরবরাহ ইত্যাদি নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপূর্ণ কর্তব্য।

২. সীমানা নির্ধারণঃ

সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ নির্বাচন কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব। নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন অঞ্চলের আয়তন, জনসংখ্যা, ভূ-খণ্ডগত অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ করে।

৩. ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণঃ

নতুন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, মৃত ভোটারদের নাম বাদ "দেওয়া, ভোটার তালিকায় ভুল সংশোধন, নির্বাচকমণ্ডলীর নির্বাচনি এলাকা পরিবর্তনের কারণে তালিকা পরিবর্তন ইত্যাদি হালনাগাদকরণের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে থাকে।

৪. প্রার্থিতা যাচাইঃ 

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের অন্যতম প্রধান কাজ হলো রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র বিতরণ, গ্রহণ এবং তা বাছাইকরণ, নির্বাচনের জন্য আগ্রহী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র গ্রহণের পর সেখানে প্রদত্ত তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই করে নির্বাচন কমিশন প্রার্থীর যোগ্যতা -অযোগ্যতার নির্ধারণ করে।

৫. নির্বাচনি সদস্যের অযোগ্যতা যাচাইঃ 

কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তার সদস্য কমিশনের অযোগ্যতা সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন বা বিতর্ক দেখা দিলে বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের নিকট প্রেরিত হয়। উত্ত বিষয়ে কমিশন যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

৬. নির্বাচনি তফসিল ঘোষণাঃ

নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যকে সামনে রেখে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করে। নির্বাচনি তফসিলে নির্বাচনি এলাকা, নির্বাচনের নিয়ম-কানুন, ভোটদানের নিয়ম, প্রার্থীদের যোগ্যতা নির্বাচনি প্রচারের বিধিবিধান, ভোটারের যোগ্যতা প্রভৃতি বিষয় স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। এ তফসিল মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

৭. রির্টানিং অফিসার নিয়োগঃ 

সঠিক নিরপেক্ষ নির্বাচন কাজের জন্য রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ।

৮. নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল গঠনঃ

নির্বাচনি অভিযোগ ও মোকদ্দমা মীমাংসার লক্ষ্যে নির্বাচনি কমিশন নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং এ সম্পর্কিত যাবতীয় কার্যাদি সম্পাদন করে থাকে।

৯. ভোট গ্রহণঃ

নির্বাচনি তফসিল অনুযায়ী ঘোষিত দিনে সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের কাজ নির্বাচন কমিশন করে থাকে।

১০. চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশঃ

নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা, ফলাফল একত্রীকরণ এবং সরকারি গেজেটে তা প্রকাশ করে থাকে।

উপসংহারঃ

পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সংবিধানে বিধান লিপিবদ্ধ করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। একই সাথে একে আইনগতভাবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ করে দেওয়া হয়েছে। এদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন উল্লিখিত কার্যাবলি সম্পাদন করে যাচ্ছে, যদিও একে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে নির্বাচন কমিশনকে আরোও শক্তিশালী ও কার্যকর করা প্রয়োজন, যাতে করে আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে পারি।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url