আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা বা গুরুত্ব পর্যালোচনা কর

অথবা, 

নির্বাচকমণ্ডলী কাকে বলে? নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা ও কার্যাবলি বর্ণনা কর


গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হওয়ার সাথে সাথে জনমনে এ ধারণার বিকাশ লাভ করেছে যে, সরকারের কার্যাবলি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। এ ধারণা ও বিশ্বাস হতেই নির্বাচকমণ্ডলী ও প্রতিনিধি সংক্রান্ত বিষয়াদি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠে। প্রাচীনকালে জনগণ শাসনকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর বিশাল আয়তন বিশিষ্ট রাষ্ট্রে জনগণ প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাই তারা প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং প্রতিনিধিরা আইন ও শাসন বিভাগীয় কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তাই দেখা যায়- গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচকমণ্ডলীর গুরুত্ব অপরিসীম।


আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা বা গুরুত্ব পর্যালোচনা কর
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা বা গুরুত্ব পর্যালোচনা কর


নির্বাচকমণ্ডলীর সংজ্ঞা 

নির্বাচকমণ্ডলী বলতে আইন অনুযায়ী তোটাধিকার প্রাপ্ত নাগরিকের সমষ্টিকে বুঝায়। অর্থাৎ নির্বাচনে যারা ভোটাধিকার প্রদান করে প্রতিনিধি বাছাই করে তাদেরকে নির্বাচকমণ্ডলী বলে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নির্বাচকমণ্ডলীর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের দেওয়া কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হলো।

নির্বাচন কমিশন কর্তৃক রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, অর্থায়ন, প্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচনী আচরণ।

১. জে. ডব্লিউ, গার্নার (J. F. Garner) বলেন, "নির্বাচকমণ্ডলী হচ্ছে নাগরিকের সেই অংশ যারা সরকারের গঠন-প্রকৃতি ও কার্যাবলি বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে।"

২. রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডব্লিউ, এফ, উইলোবি (W. F. Willoughby) বলেন, "প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে নির্বাচকমণ্ডলী যারা সরকারি কাঠামোর বিভিন্ন প্রার্থীদের নির্বাচিত করে।"

৩. আর. জি. গেটেল (R. G. Gettel) বলেন, "নির্বাচকমণ্ডলী কার্যত সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও অত্যন্ত প্রভাবশালী শাখা। কেননা এর ব্যাপক ক্ষমতা রয়েছে এবং তা সরকারী ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রযোজ্য।"

৪. এপাডোরাই (Appadorai)-এর মতে, "নির্বাচকমণ্ডলী বলতে এমন ব্যক্তিবর্গকে বুঝায় যারা নির্বাচনে ভোটাদানের ক্ষমতা প্রয়োগ করে।" (The Primairy means electorate by which the people exercise their voting power in the election.)

৫. অধ্যাপক লেকির (Lecky) ভাষায়, নির্বাচকমণ্ডলী বলতে ভোটারদেরকে বুঝায় যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে প্রতিনিধি মনোনীত করে। (Electorate implies voters those select the representatives to represent the state)

সুতরাং নির্বাচকমণ্ডলী বলতে আইন অনুযায়ী ভোটাধিকার প্রাপ্ত নাগরিকের সমষ্টিকে বুঝায়। অন্যভাবে বলা যায়, নির্বাচনে যারা ভোটাধিকার প্রদান করে প্রতিনিধি বাছাই করে তাদেরকে নির্বাচকমণ্ডলী বলে।

নির্বাচকমণ্ডলীর গুরুত্ব/ভূমিকা/কার্যাবলি 

গণতন্ত্রে জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। ভোট দান ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণ তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা কার্যকরী করে। সার্বভৌম ক্ষমতা নির্বাচকমণ্ডলীর হাতে ন্যস্ত থাকে। সুতরাং গণতন্ত্রে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা/গুরুত্ব/কার্যাবলি আলোচনা করা হলো:

১. প্রতিনিধি নির্বাচনঃ নির্বাচকমণ্ডলীর প্রধান কাজ হলো সরকার পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা। মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারে নির্বাচকমণ্ডলী আইনসভার সদস্যদেরকে নির্বাচিত করে। যারা আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তারা সরকার গঠন করে। অপরদিকে, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে রাষ্ট্রপ্রধানও জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত। এভাবে নির্বাচকমণ্ডলী সরকার পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করে।

২. প্রতিনিধি প্রত্যাহারঃ কোনো কোনো দেশে প্রতিনিধি প্রত্যাহারের ক্ষমতাও নির্বাচকমণ্ডলী ভোগ করে। তাদের নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে নির্বাচকমণ্ডলী তাকে পদ থেকে নামিয়ে দিতে পারে। এভাবে রাষ্ট্রে এ পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচকমণ্ডলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৩. জনমত গঠনঃ নির্বাচকমণ্ডলী জনমত গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্ত অথবা বিরোধীদলের বক্তব্য নির্বাচকমণ্ডলীর মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। নির্বাচকমণ্ডলী এসব সিদ্ধান্ত, মতামত ও বক্তব্য পর্যালোচনা করে সুষ্ঠু জমনত গড়ে তোলে। তাই নির্বাচকমণ্ডলীকে জনমতের ব্যারোমিটার বলা হয়।

৪. সরকারকে নিয়ন্ত্রণঃ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের জনপ্রতিনিধিকে বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আধুনিক প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার জনস্বার্থে কাজ করে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল যদি জনস্বার্থ বিরোধী কাজ করে তাহলে নির্বাচকমণ্ডলী গণভোট, গণউদ্যোগ ও গণনির্দেশের মাধ্যমে তা রোধ করে এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে।

৫. গণতন্ত্র বিকাশের সহায়কঃ নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী কার্যক্রমের সমালোচনা করে বলে সরকার স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না। এটি সরকারের ক্ষমতার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকারের ক্ষমতাকে সীমিত করে। এটি গণতন্ত্রের বিকাশের পক্ষে সহায়ক।

৬. সরকার পরিবর্তনঃ জনপ্রতিনিধিরা জনস্বার্থের পক্ষে কাজ করছে কিনা নির্বাচকমণ্ডলী তা দেখে থাকেন। জনস্বার্থের বিরোধী কাজ করলে নির্বাচকমণ্ডলী পরবর্তী নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের জন্য নতুন প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন। এ জন্য ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচকমণ্ডলীর মর্জিমাফিক নীতি কার্যকরী করে থাকে।

৭. সরকারকে সহায়তা দানঃ সরকার কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে নির্বাচকমণ্ডলীর সহায়তা কামনা করা হয়। সেই মুহূর্তে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারকে সহায়তা করে শাসন কার্য পরিচালনা করতে সহায়তা করে।

৮. আইন প্রণয়নে প্রভাব বিস্তারঃ নির্বাচকমণ্ডলী আইনসভার সদস্যদের নির্বাচন করে থাকে। আইনসভায় জনগণের জন্য কল্যাণকর আইন প্রণয়নের সময় নির্বাচকমণ্ডলী আইনসভার সদস্যদেরকে প্রভাবিত করতে পারে।

৯. শাসক কর্তৃপক্ষকে সংযত রাখেঃ পরবর্তী নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ভর করে নির্বাচকমণ্ডলীর মর্জির উপর। কাজেই শাসকবর্গ নির্বাচকমণ্ডলীর মতামতের বিরুদ্ধে বা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজ করতে পারে না। এই ভাবে নির্বাচকমণ্ডলী শাসক কর্তৃপক্ষকে সংযত রাখে।

১০. সরকারের অপরিহার্য অঙ্গঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের সহায়ক শক্তি হিসাবে। কাজ করে। এ জন্য অনেকে নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

১১. দলীয় নীতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করাঃ প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই কতিপয় আদর্শ নীতি ও কার্যক্রম থাকে। এই নীতি ও কার্যক্রমগুলো নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক সমর্থিত হলে সে দলের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব হয়। কাজেই দলীয় নীতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে নির্বাচকমণ্ডলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১২. সেতুবন্ধন সৃষ্টিঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর দৃষ্টিভঙ্গি সরকারের কার্যক্রম ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়। যার ফলে সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে নির্বাচকমণ্ডলীর সুষ্ঠু যোগাযোগের মাধ্যমে সেতুবন্ধনসৃষ্টি হয়।

১৩. সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধনে সহায়তা দানঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধনে নির্বাচকমণ্ডলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে নির্বাচকমণ্ডলীর মতামতের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধন করা হয়।

১৪. গণভোটে অংশগ্রহণঃ জাতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তের সময় বিতর্কের সৃষ্টি হলে সরকার গণভোটের আশ্রয় নেয়। এক্ষেত্রে নির্বাচকমণ্ডলী হ্যাঁ বা না ভোট দানের মাধ্যমে নিজেদের মতামত প্রকাশ করে থাকে সামরিক অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে একবার এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।

১৫. সরকার গঠনঃ সরকার কিভাবে গঠিত হবে এবং কাদের নিয়ে গঠিত হবে এ ব্যাপারে নির্বাচকমণ্ডলী ভূমিকা রাখে। নির্বাচকমণ্ডলী তাদের মূল্যবান ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি বাছাই করে। সরকার গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করে। কাজেই সরকার গঠনে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা অপরিসীম।

উপসংহারঃ উপরিউক্ত আলোচনায় এটা প্রতীয়মান হয় যে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলী নিষ্ক্রিয় নয়। বরং সক্রিয় শক্তি হিসেবে দলের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবকে প্রতিহত করে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রণয়ন করাই হচ্ছে নির্বাচক মণ্ডলীর প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অধ্যাপক গেটেল বলেন, আধুনিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলী প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ব্যাপক ক্ষমতা প্রয়োগ করে। তাই তিনি নির্বাচকমণ্ডলীকে রাষ্ট্রের চতুর্থ অঙ্গ বলে আখ্যায়িত করেছেন।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url