১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লিখ
অথবা,
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ফলাফল ও প্রভাব উল্লেখ কর
ভূমিকা: ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন ও এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মহাবিজয় লাভ ছিল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক একাধিপত্যের বিরুদ্ধে পূর্ব-বাংলার জনসাধারণের অধিকার আদায়ের এক বলিষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিবাদ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে স্ফুরণ ঘটে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রচলিত সংবিধান অনুযায়ী পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও তা যথাসময়ে না হয়ে ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন ছিল পূর্ব বাংলার প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন।
![]() |
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের গঠন বিজয়ের কারণ এবং ফলাফল ও প্রভাব আলোচনা। |
যুক্তফ্রন্ট গঠন:
পাকিস্তানে মুসলিম লীগের অপশাসন থেকে রক্ষা পেতে ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সমমনা কিন্তু দল নিয়ে একটি নির্বাচনী জোট (Electoral Alliance) গঠিত হয়। যা যুক্তফ্রন্ট (United Front) নামে পরিচিত। জেফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দল সমুহের নাম নিম্নে উল্লেখ করা হলো
১. আওয়ামী মুসলিম লীগ- মওলানা আবদুল হামিদ খান হসানীর নেতৃত্বাধীন।
২. কৃষক শ্রমিক পার্টি- শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন।
৩. নেজামে ইসলাম-মাওলানা আতহার আলীর নেতৃত্বাধীন।
৪. গণতন্ত্রী দল- হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বাধীন।
২১ দফা ভিত্তিক নির্বাচনী ইস্যু:
১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট পূর্ববাংলার শিক্ষক, হাহ, কৃষক, শ্রমিক তথা আপামর জনসাধারণের ভাবাবেগের প্রতি লক্ষ রেখে ২১ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। নির্বাচনি ইস্যুতে যুক্তফ্রন্ট বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবি ও পূর্ববাংলার আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনাধিকারকে প্রাধান্য দেয়। তাছাড়া যুক্তফ্রন্ট হাজসিক বৈষম্য ও শোষণের নীতি, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, পাট শিল্প জাতীয়করণ, সমবায় ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য সাহায্য ইতাদি অন্তর্ভুক্ত করে বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসে।
অন্যদিকে মুসলিম লীগ কোনো গণমুখী ইস্যুকে সামনে আনতে পারে নি। ভোটারদের কাছে মুসলিম লীগের একমাত্র শ্লোগান ছিল ইসলামিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের নির্বাচনি স্লোগান ছিল দুটি। এক-ইসলাম বিপন্ন, দুই-পাকিস্তান বিপন্ন। মুসলিম লীগের নির্বাচনি প্রচারণায় পূর্ববাংলার মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের কথাটি অস্বীকৃত থেকে যায়। এর ফলে দলটি জনগণের কাছাকাছি আসতে ব্যর্থ হয়। উপরন্ত যুক্তফ্রন্ট সমসাময়িক লবণ সংকটের বিষয়টি সামনে। নিয়ে আসে এবং এটিকে সরকারের পতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগ সরকারকে গণবিরোধী ও দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে আখ্যায়িত করে মুসলিম লীগকে নাজুক অবস্থায় ফেলে দেয়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে যেসব তরুণরা মুসলিম লীগের পক্ষে কাজ করে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিল তারাই এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কাজ করে দলটিকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
১৯৫৪-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণ
যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ নিম্নরূপ।
১. স্বায়ত্তশাসনকে উপেক্ষা করা:
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভবিষ্যৎ মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের যে প্রতিশ্রুতি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পর থেকে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বিশেষ করে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে উপেক্ষা করে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে সচেষ্ট হয়। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনকে উপেক্ষা করায় জনগণের মধ্যে ক্রমান্বয়ে ক্ষোপ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠে।
২. ভাষা আন্দোলনের প্রভাব:
শুধু পূর্ব বাংলারই নয় সমগ্র পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ জনের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে পশ্চিম- পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে পূর্ববাংলার ছাত্রজনতা এর বিরুদ্ধে যে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে তা ক্রমান্বয়ে সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একাত্মতাবোধের জন্ম দেয়। আর এই একাত্মতাবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে।
৩. বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের মুসলিম লীগ ত্যাগ:
মুসলিম লীগের আদর্শগত কোন্দলে ও অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগে ভাঙন দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থকে উপেক্ষা করে মুসলিম লীগ পাকিস্তানের স্বার্থকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হলে আবুল হাসিম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসীন প্রমুখ নেতা মুসলিম লীগ ত্যাগ করে।
৪. পূর্ব-বাংলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবহেলা:
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠী বৈষম্যমূলফ নীতি অনুসরণ করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি করে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শাসক গোষ্ঠী পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করলে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি পশ্চিম পাকিস্ত ানের তুলনায় অনেকাংশে হ্রাস পায়। ফলে জনগণ ক্রমান্বয়ে পশ্চিমা শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে।
৫. দমনমূলক নীতি:
মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন গণআন্দোলনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে অভিহিত করে এবং এই সকল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নেতা ও কর্মীদের উপর দমনমূলক নীতি প্রয়োগ করায় পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে মুসলিম লীগ বিরোধী মনোভাব জাগ্রত হয়।
৬. মুসলিম লীগের জনবিচ্ছিন্নতা:
পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এ অঞ্চলের জনগণের সাথে নিষিড় সম্পর্ক গড়ে না তুলে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর সাথে সখ্যতা গড়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে সময় অতিবাহিত করতে থাকে। এই প্রয়াস ছিল সম্পূর্ণরূপে পূর্ব বাংলার জনগথের স্বার্থ পরিপন্থী। আর এ কারণে মুসলিম লীগ ক্রমে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
৭. নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ব্যর্থতা:
১৯৫১ সালে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানে টালবাহানা শুরু করে এবং তিন বছর পিছিয়ে ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। এই সময়ের মধ্যে ভাষা আন্দোলনসহ মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ব্যাপক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে যা যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
৮. সংবিধান প্রণয়নে সরকারি ব্যর্থতা:
পাকিস্তান সৃষ্টির দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও শাসক গোষ্ঠী জনগনের আশা-আকাঙ্ক্ষা সংবলিত পাকিস্তানের সংবিধান রচনায় ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এর ফলে জনঅসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।
৯. মুললিম লীগের অভ্যন্তরীণ ফোম্পল:
কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায় গভর্নর জেনারেলের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে কোন্দলের সৃষ্টি করে। ১৯৫৩ সালে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীনকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করায় এই কোন্দল ব্যাপক আকার ধারণ করে, যার প্রভাব ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পর্যবসিত হয়।
১০. জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা সংবলিত ২১ দফা ভিত্তিক নির্বাচনী হলতেহার:
সর্বোপরি পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা সংবলিত যুক্তফ্রন্ট প্রণীত বিখ্যাত ২১ দফাভিত্তিক নির্বাচনী ইশতেহার মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রত্যয়সহ সামগ্রিকভাবে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারে থাকায় জনগণ যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করতে সচেষ্ট হয়।
যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ফলাফল
১৯৫৪ সালের ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে। নির্বাচনী ফলাফল অনুযায়ী প্রাদেশিক পরিষদের ৩০৯টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট এককভাবে ২২৩টি আসন লাভ করে। অন্যদিকে মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করে জনধিকৃত হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৪টি ও খেলাফত রব্বানী ১টি আসন লাভ করে। এছাড়া এ নির্বাচনে ৭২টি আসন অমুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এ দিক দিয়ে দেখা যায় সংরক্ষিত আসন ব্যতীত ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট এককভাবে ২২৩টি আসন জয়ের ফলে ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য হলেও যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জনসাধারনের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সমূহ সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। যদিও যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কার্যকাল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি তথাপি নির্বাচনের বিজয় পূর্ব বাংলার জনজীবনে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে পূর্ব-বাংলার জনসাধারণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার মূর্ত প্রতীক হিসেবে যুক্তফ্রন্টের আবির্ভাব ঘটেছিল। বিপুল জনসমর্থনে এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভকরে মুসলিম লীগের একাধিপত্যকে খর্ব করে। যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের ফলে বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা এবং সেই লক্ষ্যে তাদের ঐক্যবোধ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় পরবর্তীতে মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্র সুপ্রশস্ত হয়।