একুশ দফা কি? ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভের কারণগুলো বিশ্লেষণ

অথবা

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণগুলো আলোচনা কর।

অথবা

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণসমূহ বর্ণনা কর।


১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন ও এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মহাবিজয় লাভ ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক একাধিপত্যের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনসাধারণের অধিকার আদায়ের এক বলিষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিবাদ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে স্ফুরণ ঘটে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রচলিত সংবিধান অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও তা যথাসময়ে না হয়ে ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন ছিল পূর্ববাংলার প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন।


১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণগুলো আলোচনা
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণগুলো আলোচনা

একুশ দফা কি?

১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং যুক্তফ্রন্ট গঠন ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে ২১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ২১ দফা ইশতেহার প্রনয়ন করা হয়। মূলত ২১ দফার ভিত্তি ছিল কুরআন ও সুন্নাহ। অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ২১ দফার কর্মসূচি প্রণয়ন করা হবে বলে সবাই ঐক্যমত্য পোষণ করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে আবুল মনসুর আহমদ ২১ দফা ভিত্তিক নির্বাচনী ইশতেহারের মুসাবিদা রচনা করেন।

১৯৫৪-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণ

নিম্নে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ আলোচনা করা হলো।

১. স্বায়ত্তশাসনকে উপেক্ষা করা

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভবিষ্যৎ মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের যে প্রতিশ্রুতি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসসের দাবিকে উপেক্ষা করে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে সচেষ্ট হয়। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনকে উপেক্ষা করায় জনগণের মধ্যে ক্রমান্বয়ে ক্ষোপ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠে। এ পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কারণে পূর্ববাংলার জনগণ যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিয়ে জয় করে।

২. ভাষা আন্দোলনের প্রভাব

সমগ্র পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ জনের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে পূর্ববাংলার ছাত্রজনতা এর বিরুদ্ধে যে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে তা ক্রমান্বয়ে সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একাত্মতাবোধের জন্ম দেয়। তারা এ একাত্মতাবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিয়ে।

৩. বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের মুসলিম লীগ ত্যাগ

মুসলিম লীগের আদর্শগত কোন্দলে ও অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে এ পাকিস্তান মুসলিম লীগে ভাঙন দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থকে উপেক্ষা করে মুসলিম লীগ পাকিস্তানের স্বার্থকে রক্ষা আতে সচেষ্ট হলে আবুল হাসিম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী প্রমুখ নেতা মুসলিম লীগ ত্যাগ করে। মুসলিম ১৫ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দল ত্যাগ যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে অনেকটা সহজ করে দেয়

৪. পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবহেলা

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শাসকগোষ্ঠী - পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে। যার কারণে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি পশ্চিম পাকিস্ত বল তুলনায় অনেকাংশে হ্রাস পায়। এতে জনগণ ক্রমান্বয়ে পশ্চিমা শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। সকগোষ্ঠির পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এ বৈষম্যমূলক আচরণ যুক্তফ্রন্টের বিয়কে সহজ করে দেয়।

৫. দমনমূলক নীতি 

মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন গণআন্দোলনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে অভিহিত করে এবং এসব আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নেতা ও কর্মীদের উপর দমনমূলক নীতি প্রয়োগ করায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে মুসলিম লীগ বিরোধী মনোভাব জাগ্রত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে মুসলিম লীগ বিরোধী মনোভাব বৃত্তফ্রন্টের বিজয় লাভকে সহজ করে দেয়।

৬. মুসলিম লীগের জনবিচ্ছিন্নতা

পূর্ববাংলার মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এ অঞ্চলের জনগণের সাথে নিবিড় স্বাস্পত গড়ে না তুলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাথে সখ্য গড়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ প্রয়াস ছিল সম্পূর্ণরূপে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ পরিপন্থী। আর এ কারণে মুসলিম লীগ ক্রমে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের এ জন বিচ্ছিন্নতাকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে।

৭. নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ব্যর্থতা

১৯৫১ সালে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানে টালবাহানা শুরু করে এবং তিন বছর পিছিয়ে ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। এ সময়ের মধ্যে ভাষা আন্দোলনসহ মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ব্যাপক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে, যা জেফ্রন্টের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।

৮. সংবিধান প্রণয়নে সরকারি ব্যর্থতা

পাকিস্তান সৃষ্টির দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও শাসকগোষ্ঠী জনগণের মালা-আকাঙ্ক্ষা সংবলিত পাকিস্তানের সংবিধান রচনায় ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এর ফলে জনঅসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। এ জনঅসন্তোষ যুক্তফ্রন্টের বিজয় লাভে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৯. মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল

কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায় গভর্নর জেনারেলের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে কোন্দলের সৃষ্টি করে। ১৯৫৩ সালে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীনকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করায় এ কোন্দল ব্যাপক আকার ধারণ করে, যার প্রভাব পড়ে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে। মুসলিম দীগের এ অভ্যন্তরীণ কোন্দল যুক্তফ্রন্টের বিজয় অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

১০. জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা সংবলিত ২১ দফাভিত্তিক নির্বাচনী ইশতেহার

সর্বোপরি রীগার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রত্যয়সহ সামগ্রিকভাবে পর্ববাংলার পূর্ববাংলার সর্বস্থরের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা সংবলিত যুক্তফ্রন্ট প্রণীত বিখ্যাত ২১ দফাভিত্তিক নির্বাচনী ইশতেহার মসলিম স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারে থাকায় জনগণ যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করতে সচেষ্ট হয়।

পরিশেষে 

পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে পূর্ববাংলার জনসাধারণের স্বাধিকার বরিয়ার মূর্ত প্রতীক হিসেবে যুক্তফ্রন্টের আবির্ভাব ঘটেছিল। বিপুল জনসমর্থনে এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কশ বিজয় লাভকরে মুসলিম লীগের একাধিপত্যকে খর্ব করে। যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের ফলে বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা এবং সেই লক্ষ্যে তাদের ঐকাবোধ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় পরবর্তীতে মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্র সুপ্রশস্ত হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url