মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "রহস্যময় মানুষ"। Rohossomoy Manush
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
লেখক: মনি হায়দার
গল্পের নাম: রহস্যময় মানুষ
![]() |
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "রহস্যময় মানুষ"। Rohossomoy Manush |
লোকটাকে প্রথম দেখল মটকুই। আমাদের স্কুলের সামনে মাঝারি আকারের একটি সবুজ মাঠ। মাঠের পর পুরনো একটা লম্বা দেয়াল। দেয়াল ঘিরে নানা প্রকার গাছগাছালি। তারই মাঝখানে অনেক জায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট একটি শিরীষ গাছ। গাছটির প্রচুর ডালপালা ছড়ানো মাঠ জুড়ে। আমরা টিফিনের সময় মাঠে কিংবা শিরীষ গাছটার বড় ও মোটা শিকড়ের উপর বসে খেলি, গল্প করি। স্কুল শুরু হয়েছে অনেক আগে। জানালার কাছে বসেছে মটকু।
ওই আমাকে পেনসিলে খোঁচা মারে- দ্যাখ না ঐ লোকটাকে।
ওর খোঁচা ও দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালাম শিরীষ গাছটার গোড়ায়।
দেখি, একজন বৃদ্ধলোক মোটা শিকড়ের উপর পা তুলে আসন গেড়ে বসে আছে। মাথার চুলগুলো একদম সাদা। মুখের দাঁড়িগুলোও সাদা। পরনে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। কাঁধে একটা পুঁটলি, ঝোলার মতো ঝোলানো।
কী দ্যাখব? আমি প্রশ্ন করি মটকুকে- একটা লোক বসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, তাকে দেখার কী আছে?
মটকু গম্ভীরভাবে বলল- লোকে যে আমাকে বুদ্ধিমান বলে- তার কারণও আছে। আমি লোকটাকে অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ্য করছি। যখন এসে বসেছে, তখন থেকেই। ওর ঝোলা থেকে কাগজ বের করে রৌদ্রে শুকোতে দিয়েছে। শুকানোর পর সেগুলো ঝোলায় ভরে চুপচাপ বসে আছে। আছে তো আছেই- নট নড়ন চড়ন।
তাতে কী?
কীসলু, ঐ লোকটা খুব রহস্যময়। ঐ যে কাগজগুলো শুকালো-আমার ধারণা-
কী? থেমে যাওয়ায় আমি পাল্টা প্রশ্ন করি।
উত্তর দেয়ার জন্য যেই মটকু আমার দিকে ফিরেছে, স্যার গর্জে উঠলেন- মটকু। অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ্য করছি তুমি কীসব বলছ কিসলুর সঙ্গে?
কিছু না স্যার- মটকু দাঁড়িয়ে বলে।
ঠিক আছে। চুপচাপ থাকো।
স্যার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিফিনের ঘণ্টা পড়ল। মটকু আর আমি বারান্দায় দাঁড়ালাম। আমাদের সঙ্গে যোগ দিল কাবিল আর চৈতন্য।
চল লোকটাকে একটু ইয়ে করে আসি- মটকু বলেই হাঁটা আরম্ভকরল শিরীষ গাছের দিকে। ততক্ষণে কাবিল আর চৈতন্যও দেখল বৃদ্ধলোকটিকে। ওরাও পিছু নিল মটকুর। তখন আমিই বা কী করি? ওদের সঙ্গে সঙ্গী হবার জন্য হাঁটতে থাকলাম ওদের পিছু পিছু। মটকুর মাথায় রাজ্যের যত দুষ্টামি আছে সবই ডাংগুলির মতো সারাদিন খেলা করে।
আমাদের চারজনার দলটাকে দেখে বৃদ্ধ তাকিয়ে রইলেন অবাক চোখে।
খুব নিবিড়ভাবে আমাদের দেখছেন। মিটি মিটি হাসির একটি রেখা ফুটে উঠল তার মুখে। তারপর মাথাটা নিচু করে আবার মৌন হলেন।
আমরা ধারণা করেছিলাম আমাদের দেখে বুড়ো ভয় পাবেন। বা এই জাতীয় কিছু। যা থেকে আমরা মজা পাব। সেরকম কিছু ঘটল না দেখে আমরা একটু হতাশই হলাম আর কী!
কিসলু। আমাকে ডাকে মটকু।
কী?
আরও পড়ুনঃ অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নাবলি: জোটবদ্ধ রাজনীতি ও আন্তঃদলীয় সম্পর্ক
ক্লাসে স্যারের কারণে তোকে বলতে পারিনি, আমার মনে হয়-মটকু আমার সঙ্গে কথা বলছিল। ঘিরে ধরল কাবিল আর চৈতন্য।
কী মনে হয় তোর? প্রশ্ন করে কাবিল।
মনে হয় লোকটার কাগজপত্রের মধ্যে কোনো গুপ্তধনের খবরাখবর বা সন্ধান থাকতে পারে।
ধ্যাৎ, আমি বিষয়টাকে উড়িয়ে দিতে চাইলাম- ওই রকম একজন বুড়ো লোকের কাছে গুপ্তধনের সন্ধান থাকবে কী করে?
দু' হাত কোমড়ে দিয়ে দাঁড়ায় মটকু- তোর এই এক বদঅভ্যাস, কিসলু। সহজে তোকে কোনো কথা বিশ্বাস করানো যায় না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আয়, আমরা সবাই মিলে লোকটার কাছ থেকে কাগজপত্র কেড়ে আনি।
পারব আমরা? সংশয় চৈতন্যর।
পারব না মানে? আমি একাই পারি। কিন্তু তোদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজটা করতে চাই- ভারিক্কি চালে কথা বলে মটকু। আয় আমার সঙ্গে।
আমরা সবাই মিলে যখন লোকটার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধে ঝোলানো পুরনো নোংরা পুঁটলির দিকে তাকালাম, মুহূর্তের মধ্যে সে ভয়ংকর রূপ ধারণ করল। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে অদ্ভুত এক শব্দ উচ্চারণ করতে করতে আমাদের দিকে ধেয়ে আসে। আমরা পড়ি কী মরি দে ছুট। দূরে এসে দেখি লোকটা আবার আগের জায়গায় গিয়ে চুপচাপ বসে পড়েছে। আর দ্বিতীয়বার সাহস হল না তাকে ঘাটাবার। চৈতন্য চলে গেল। যাবার আগে বলল, পাগলের পিছনে ছোটার কোনো মানে হয় না।
কিছুক্ষণ পর ক্লাসের ঘণ্টা পড়ল। ক্লাসে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু বারবার মনে পড়ছে বুড়ো লোকটার ধেয়ে আসার ভয়ংকর ছবি। কেন সে এমন ভয়ংকরভাবে তেড়ে আসল? কী আছে ঝোলায়? সত্যি কি কোনো গুপ্তধনের নকশা আছে ওতে? হতেও পারে। কত গল্প উপন্যাসে এসব পড়েছি। লোকটা হয়তো কোনোক্রমে একটা গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। যার কাগজপত্র পোটলায়। এখন সেখানে পৌছানোর জন্য এমন ছদ্মবেশ ধারণ করেছে। ক্লাসে খুব বেশি মনোযোগ দিতে পারছি না। আমার ভিতরে একটি অদম্য কৌতূহল এবং সাহসের বিড়াল মিউ মিউ করতে আরম্ভ করল। মিউ মিউ উচ্চারণে বিড়ালটি বলছে, একটা বুদ্ধি বের করে কি পারো না বৃদ্ধ লোকটার কাছ থেকে গুপ্তধনের কাগজপত্রগুলো হাতিয়ে নিতে? নাও। তারপর বেরিয়ে পড়ো অজানার উদ্দেশ্যে। জগতে নিজের নাম এইভাবে প্রতিষ্ঠা করে যাও। লোকটা তো বুড়ো। হয়তো আর যেতে পারবে না সে গুপ্তধনের সন্ধানে। আমার মানসপটে ইতোমধ্যে আমি অভিযানের নানা প্রকার ছবি আঁকতে আরম্ভ করেছি।
স্কুল ছুটি হয়ে গেল। আসার সময়ে দেখলাম লোকটা একইভাবে ধ্যানী ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে আছে। সামনে উদাস দৃষ্টি প্রসারিত ঝোলাটা দু' হাত দিয়ে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে আছে। আগের চেয়ে অনেক সতর্ক সে। কীভাবে ঝোলাটা বাগানো যায় এই ভাবনায় ডুবে গেলাম। ঘরে গিয়ে গোসল করলাম। ভাত খেলাম। খেলার মাঠে গিয়ে চুপচাপ বসে বসে ভাবতে ভাবতে একটা আইডিয়া মাথায় আনার চেষ্টা করলাম। ভেবে দেখলাম, আইডিয়াটা মন্দ নয়। মুশকিল হল কাউকে জিজ্ঞেসও করা যাচ্ছেনা। জিজ্ঞেস করলেই নির্ঘাত আমার সঙ্গে যেতে চাইবে। সেটা তো আর হতে দিতে পারি না। কারণ, গুপ্তধন উদ্ধারের কাজটা আমি একাই করব। কাউকে ভাগ দেব না। তাতে আমার যত কষ্টই হোক। খেলার মাঠ থেকে ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। ফেরার সময় আবার গেলাম স্কুলের মাঠে, শিরীষ গাছের কাছে। আড়াল থেকে দেখতে পেলাম লোকটা সেই আগের মতোই আছে। অবাক লাগল, একটা মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনভাবে থাকে কী করে?
আমি ঘরে এলাম এবং পড়তে বসলাম। টেবিলে আমার মন বসে না। স্কুলের কাছেই আমাদের বাসা। মফস্বল শহর পিরোজপুর। সামান্য রাত হলেই চারদিক নীরব হয়ে যায়। মা খেতে ডাকলে খেয়ে আসলাম। ঘড়িতে আটটা বাজার সংকেত পেলাম। সাহসে বুক বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম। শিরীষ গাছটার নিচে গিয়ে দেখলাম লোকটা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে গাছের শিকড়ের উপর। ঝোলাটা সামান্য দূরে ছিটকে পড়ে আছে। আমি তো এটাই চাই। আস্তে আস্তে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে কাছে গিয়ে ঝোলাটা নিয়ে ভোঁ-দৌড়।
দৌড়ে ঘরে ফিরে নিজের রুমে ঢুকে দরজা-জানালা ভালোভাবে বন্ধ করলাম। বিছানায় উঠে বসে অপার কৌতূহল নিয়ে ঝোলাটা খুললাম। সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘদিনের একটি আঁশটে চটচটে গন্ধ পেলাম নাকে। বমি আসার যোগাড়। নাক চেপে ধরে অনেক কষ্টে বমি সামলালাম। গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া নিয়ে কথা।
প্রথমেই চোখে পড়ল আমার চেয়ে বড় একজনের একটি বহু পুরনো ঝিরঝিরে রং-ওঠা জামা। জামার নিচে একটি প্যান্ট। তার অবস্থাও কাহিল। কিছু খুচরো টাকা, কয়েকটা গোলাপের পুরনো গন্ধহীন পাঁপড়ি। মাথাটায় আগুন লাগল। এইসবের জন্য বুড়োটার এত তর্জন গর্জন। আর বলিহারি মটকু, তোরও যেমন বুদ্ধি। জামা কাপড়ের নিচে কয়েকটা সাদাকালো ছবি। অনেক অনেক পুরনো। চোখের সামনে মেলে ধরলাম। যদি এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে গুপ্তধনের অপার কোনো রহস্য!
আসলে ছবিগুলো পারিবারিক। বেশ কয়েক বার দেখার পর বুঝতে পারলাম বুড়োটার ছবিও আছে এখানে। অর্থাৎ ছবিগুলো বুড়ো লোকটার পারিবারিক কোনো স্মৃতি। মনটা খারাপ হতে লাগল। ছবিগুলোর পরে পেলাম পুরনো কয়েকটি ডায়েরির পাতা। গুপ্তধনের সন্ধান আমার হাতের মুঠোয়, এমন উত্তেজনা আমায় পেয়ে বসল। নিশ্চয়ই ডায়েরিতে গুপ্তধনের বর্ণনা আছে। আগ্রহ নিয়ে পড়তে আরম্ভ করলাম।
আরও পড়ুনঃ সাধারণ জ্ঞান: (দল, সরকার এবং বিরোধীদলের মধ্যে সম্পর্ক)
আমি আজ প্রায় বিশ বছর কথা বলি না। কেন বলব? যে দেশে আমার সন্তান বেঁচে নেই সে দেশে আমি কার সঙ্গে কথা বলব? আমার একমাত্র ছেলে সীমান্ত। জন্মেই যে মাকে হারিয়েছে। আমিই ওকে বড় করেছি। আমিই ওর মা-বাবা। খুবই বুদ্ধিদীপ্ত আর প্রাণবন্ত ছেলে সে। বাপ-বেটা মিলে একসঙ্গে তাস খেলতাম। আমি পার্বতীপুরের পোস্টমাস্টার। সামান্য জমিজমা আছে। বাপ-বেটার ভালোই চলে যাচ্ছে। সীমান্তর ভবিষ্যৎ চিন্তায় ব্যাংকেও কিছু টাকা জমা রাখছি। সীমান্ত বরাবরই মেধাবী ছাত্র। ক্লাসে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি। ও বাড়ছে খুব তাড়াতাড়ি। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে মনে হত ও কলেজে পড়ছে। ব্যাকব্রাশ চুল। বড় বড় বুদ্ধিদীপ্ত দু'টি চোখ। দেখে মন ভরে যায় আমার। সামনে এস এস সি পরীক্ষা। ওকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। আমরা গরিব মানুষ। লেখাপড়াই আমাদের সম্পদ। আমার সীমান্ত সেটা ভালো করেই বোঝে। আমি রাত জেগে ওকে দুধ গরম করে দেই। মাঝে মাঝে আমাকে বকে- তোমাকে এসব করতে বলেছে কে? যাও, ঘুমাও।
আমি ভয় পাওয়ার ভান করে ওর কাছ থেকে চলে আসি। বিছানায় বসে বসে ওর পড়া শুনি। খুব ভালো লাগে। পরীক্ষার মাস চারেক বাকি। আরম্ভ হল স্বাধীনতা-যুদ্ধ। থানা পর্যায়ে সে যুদ্ধের ঢেউ এসে লাগল।
ভাবলাম যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ হবে। কিন্তু না, যুদ্ধ চারিদিকে ক্রমশ বাড়ছে। আমি অস্থির সীমান্তের ভবিষ্যৎ চিন্তায়। ঢাকা শহর থেকে প্রতিদিন প্রচুর লোক সব হারিয়ে গ্রামে ছুটে আসছে। তাদের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার শুনি। আর ভয়ে কলজে শুকিয়ে যায়। স্কুল বন্ধ। পরীক্ষা হবে কি হবে না, বোঝা যাচ্ছে না। রাজাকারের উৎপাত বাড়ছে। থানা এলাকার মুসলিম লীগ নেতা দবিরউদ্দিন কয়েক দিন আগে এসে সীমান্তকে খুব বকাবকি করে গেল আমার সামনে। শহর থেকে প্রচুর লোক গ্রামে আসছে। অনেকে ক্লান্ত। এলাকার কিছু ছেলেমেয়ে মিলে সেই সব মানুষের সেবা করছে। তাদের দলে সীমান্তও আছে। আমার তো ভালোই লাগছে। বিপদে মানুষকে সাহায্য করবে না?
দবিরউদ্দিন বলল- সীমান্ত, তুমি ভাল ছেলে। ওই সব লোকদের সঙ্গে আর মিশো না। আমার রাজাকার বাহিনীতে এসো। তোমাকে টাকা দেব। রাইফেল-ট্রেনিং দেব, ভবিষ্যতে রাজাকারদের কমান্ডার বানাব তোমাকে।
আগামীকাল স্কুলের মাঠে এসো।
আচ্ছা- বলল সীমান্ত।
আমি কী করব ভেবে পেলাম না। পরিস্থিতি এমনই ঘোলাটে আর ভয়াবহ বুঝতে পারছি না কী আমার করা উচিত। সীমান্ত মানুষের সেবা করবে না এটাও যেমন মানতে পারছি না, তেমনি পারছি না ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিক। রাজাকার বাহিনীতে যোগ না দিলে দবিরউদ্দিনেরা ওকে মেরে ফেলবে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে মেরে ফেলেছে। মুক্তিবাহিনীতে গোপনে গোপনে কাজ আরম্ভ করেছে সীমান্ত। টের পাচ্ছি। কয়েকদিন আগে, রাতে দু'জন রাজাকার মারা পড়েছে ব্রিজের উপর। মুক্তিবাহিনীর ওপর চটে আছে দবিরউদ্দিন। কী করব আমি। সীমান্তও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছে না। বুঝতে পারছি ও একটা কিছু ভাবছে। ওর ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। আমি আর কত দিন বাঁচব? পুরো জীবনটাই তো ওর সামনে।
আমি যখন থাকব না তখন ওকে কত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজটা এখন থেকেই করুক।
আরও পড়ুনঃ বুক রিভিউ: "রাসুলের চোখে দুনিয়া"। Book Review Rasuler Chokhe Duniya
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, সীমান্ত নেই ঘরে। পড়ার টেবিলে একটি চিঠি।
'বাবা, তোমাকে বলে গেলে হয়তো যেতে দিতে চাইতে না। তাই না বলেই চলে গেলাম। দুঃখ করো না। এখানে থাকলে রাজাকার দবিরউদ্দিনের রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে হতো। এই দেশে জন্ম নিয়ে, আলো-বাতাসে বেড়ে উঠে এক হাজার মাইল দূরের পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হতে পারব না। তুমিই তো চাঁদভরা রাতে গাইতে শিখিয়েছ, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...।
যুদ্ধ শেষে বিজয়ের বেশে ফিরে আসব। আর হ্যাঁ, এসে যেন দেখি তুমি ঘরের দাওয়ায় আমার অপেক্ষায় আছ।
___সীমান্ত।'
সীমান্তের চিঠি পড়ে আমি খুব খুশি হয়েছি। বাছা আমার জাদু আমার সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করেছি। আজো করছি। যতদিন বাঁচব অপেক্ষা করব। চিঠি পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার সীমান্ত এসে আমাকে ডাকবে- বাবা?
সেদিন আমি সাড়া দেব। কথা বলব। এই তো আমি, সীমান্ত।
যুদ্ধে পাকবাহিনি পরাজিত হল। মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে ফিরে এল। আমি অপেক্ষায়ই আছি সীমান্তের। ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি গ্রাম গ্রামান্তরে, যেখানে যেখানে যুদ্ধ হয়েছিল সেইসব জায়গায়। তোমরা কি কেউ আমার সীমান্তকে দেখেছ? দেখলে বলো- আমি ওর হতভাগা বাবা এখনো ওর অপেক্ষায়। ওর জন্য পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে। সীমান্ত আসবে কখন? আমি অন্ধ হওয়ার পর?
লেখাটি শেষ।
আমার দু' চোখে জলের ধারা। কখন যে কাঁদতে আরম্ভ করেছি জানি না। মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করলাম। কাউকে না বলে দরজা খুলে বের হলাম এক দৌড়ে মটকুর বাড়ি। ও ঘুমুতে যাবার চেষ্টা করছিল। এত রাতে আমাকে দেখে অবাক। কোনো কথা না বলে ওকে চিঠিটা দিলাম। ও পড়ল এবং আমারই মতো ওর চোখে অশ্রুর ধারা।
চল লোকটাকে বাড়িতে নিয়ে আসি- আমি বলি মটকুকে।
চল।
আমরা দু'জন আবার ছুটলাম স্কুলে, শিরীষ গাছটার নিচে পৌছে দেখি তিনি নেই। কোথাও খুঁজে পেলাম না। সারারাত আমরা পাগলের মতো সীমান্তের বাবাকে খুঁজলাম। পেলাম না। আজো খুঁজি। তোমরা কেউ কি দেখেছ সাদা চুলে আচ্ছাদিত একজন বৃদ্ধ মানুষকে। যিনি তাঁর প্রিয়তম সন্তানকে খুঁজছেন একাত্তর সালের রণাঙ্গনে, আজও!
প্রিয় পাঠক, গল্পটি আপনাদের কাছে কেমন লেগেছে কমেন্ট বক্সে জানাবেন? এবং 'মনি হায়দার' এর লেখা মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প পড়তে আমাদের ওয়েবসাইট এবং ফেসবুক পেজ ভিজিট করতে পারেন।