মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "পরীরানী"। লেখক মনি হায়দার। "Pori Rani" - a story of the Liberation War
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
লেখক: মনি হায়দার
গল্পের নাম: পরীরানী
ট্রাঙ্কের ঢাকনা খোলার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো ভ্যাপসা একটা গন্ধ নাকে লাগল। লাগারই কথা। ট্রাঙ্কটা মায়ের চৌকির নিচে প্রায় বারো বছর ধরে আছে। কখনও কোনো কাজে প্রয়োজন হয়নি, তাই খুলিনি। বাবার যাবতীয় কাগজপত্রে ট্রাঙ্কটা ঠাসা। প্রতিবেশীর সঙ্গে জমিজমা নিয়ে বেঁধেছে একটা ঝামেলা। সে কারণে কাগজপত্র দরকার। দীর্ঘ বছর পর ট্রাঙ্কটা খোলার প্রয়োজন হলো-তাই।
![]() |
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "পরীরানী"। লেখক মনি হায়দার। |
প্রয়োজনীয় কাগজটাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পুরো ট্রাঙ্কটা বার কয়েক খুঁজলাম। সব কাগজপত্র বের করে পাটিতে বিছিয়ে খুঁজছি। হঠাৎ হাতে পেলাম একটা সাদা বড় খাম। দামি কাগজে খামটা যত্নের সঙ্গে মোড়ানো। কৌতূহল হলো খামটা পেয়ে। কী আছে ভিতরে? হাতের চাপে ভিতরে পাথরের ছোট ছোট টুকরোর মতো ঠেকছে। খাম খুললাম। প্রথমেই বের হলো একজোড়া ছোট্ট কানের দুল। পুরনো কিন্তু রঙ এখনো উজ্জ্বল। পরখ করে দেখলাম- সোনার দুল। কৌতূহল আরো বাড়ল। পুরো খামটা খুলে পেলাম রুপোয় তৈরি চেইন, পুঁতির দানা, হাতির দাঁতের চিরুনি; ছোট্ট গোল চমৎকার আয়নাও একখানা।
কিছুই বুঝতে পারলাম না।
বাবার ট্রাঙ্কে বিশেষ যত্নে রাখা এই প্যাকেটে এসব কেন? কোথেকে এলো? খামটা ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখি ভিতরে কাগজের মতো যেন কী। ছিঁড়ে ফেললাম প্যাকেটটা। কাগজে বাবার হাতের লেখা। তীব্র কৌতূহলে পড়তে আরম্ভ করলাম।
'আমাদের ছোট বোন মীরা।
ভীষণ আদুরে ও ডানপিটে স্বভাব ওর। হওয়ারই কথা। পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে ও কনিষ্ঠ। সবার ছোট যে হয়- তার অনেক সুবিধা। ডালা উপচানো আদরে ভাসতে পারে। দু'হাতে বড়দের আদর লুটতে পারে। মীরার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল অন্যরকম। আমি ছিলাম ওর আশ্রয়। কোনো কারণে বাড়ির কেউ যদি বকত, মীরা ছুটে আসত আমার কাছে।
বানিয়ে বানিয়ে অনেক গল্প করত ও। গল্পগুলো শোনার আমি ছাড়া কেউ ছিল না। পড়ালেখা করা, গানের মাস্টার জোগাড় করা, দোকান থেকে পুতুলের কাপড় আনা সবই করতে হতো এই আমাকে।
বুড়ো দাদা? (মীরা আমাকে বুড়ো দাদা ডাকত।)
কী? চোখের সামনে থেকে বই নামাই।
বাজারে কখন যাবে?
কেন?
তর্ক করো না। বলো কখন যাবে?
এই তো আধা ঘণ্টা পর। কেন পরীরানী?- আমি ওকে আদর করে পরীরানী ডাকি। ও পরীর মতো সুন্দর। হাসলে গালে টোল পড়ে।
দাঁতগুলো মুক্তোর মতো ঝকমকে দেখায়।
আসার সময় বাজার থেকে আমার জন্য একটা বড়, অনেক বড় ঘুড়ি এনো।
ঘুড়ি।
হ্যাঁ, ঘুড়ি! ঘুড়ি চিনো না, বুড়ো দাদা?
চিনব না কেন? ভালোই চিনি। কিন্তু ঘুড়ি দিয়ে তুই কি করবি?
কেন? উড়াব।
তুই ঘুড়ি উড়াবি! আমি হেসে গড়াগড়ি খাই। মেয়েরা কখনো ঘুড়ি উড়ায় নাকি।
মেয়ে বলে ঘুড়ি ওড়ানো যাবে না, কোথাও নিষেধ আছে নাকি?
তা নেই। আসল কথাটা বল-তুই ঘুড়ি দিয়ে কী করবি?
পরীরানী রেগে যায় বলছি তো উড়াব।
আচ্ছা, এনে দেব।
দেবে তো?
দেবো।
বাজার থেকে ফেরার সময় পরীরানীর জন্য ঘুড়ি এনেছি। না নিয়ে এলে খুব রাগ করত। ঘুড়িটা পেয়ে কী খুশি হয়েছিল পরীরানী, বলে বোঝানো যাবে না।
পরে জেনেছি পাশের বাড়ির আনিসের সঙ্গে পরীর ঝগড়া হয়েছে ঘুড়ি নিয়ে। আনিসের ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে উড়ে আমাদের বাড়ি এসেছিল।
পরীরানী সেই ঘুড়ি ধরতে গেলে ঘুড়ির পিছনে পিছনে ছুটতে আসা আনিস বলে-এ্যাই মীরা, আমার ঘুড়ি ধরিস না।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "রহস্যময় মানুষ"
তৎক্ষণাৎ ঘুড়ি উঠোনোর চাল কুমড়ার জাংলায় পড়েছে।
এ ঘুড়ি তোর?
হ্যাঁ।
নাম লেখা আছে নাকি?
আছে-বলে আনিস ছোঁ মেরে ঘুড়িটা নিয়ে যায়। যাবার সময় বলে-পরের ঘুড়ি ধরিস, জীবনে ঘুড়ি হাতে নিয়েছিস?
আমাদের পরীকে অপমান!
পরের দিন পরীরানী বাড়ির মেয়েদের ছাদে নিয়ে ঘুড়ি উড়ানোর উৎসবে নামে।
পরীরানী বাড়ির আনন্দ। পরীরানী নাচলে বাড়িটা নাচে। পরীরানী মুখ গোমড়া করলে বাড়িটার মুখও মলিন হয়ে যায়। ও কাঁদলে আমদের পুরো বাড়িটা কান্নায় ভেঙে পড়ে। কারণও আছে। বাবা মীরাকে, মানে-পরীরানীকে দারুণ আদর করেন। পরীরানীর মুখের গড়ন নাকি আমাদের দাদির মতো। বাবাকে খুব ছোট রেখে আমাদের দাদি মারা গিয়েছিলেন। তাই দাদিকে আমরা দেখিনি। পরীরানীকে আমরা দেখি, আর না দেখা দাদির ছবি আঁকি।
আমাদের পরীরানী কেবল আদরই পায় না। তার যোগ্যতাও আছে। সে সেভেনে পরীক্ষা দিয়ে অষ্টম শ্রেণীতে উঠল এ বছর। সে ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রী। কারণ, তার রোল নম্বর এক।
পারিবারিকভাবে আমরা আমাদের ছোট্ট বোনের সাফল্য উদযাপন করি। মেজ ভাই অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক। খাওয়ার ঘরে ছোট্ট একটা মঞ্চ বানানো হলো। মঞ্চের পিছনে কার্টুন এঁকে নিচে 'পরীরানী' লিখে দিয়েছে সে। বাবা সভাপতি। মা প্রধান অতিথি। সবচেয়ে ছোট ভাই হারুন ফুলের মালা দিয়ে অভিনন্দন জানায় পরীরানীকে। মীরার বান্ধবী রেণু 'বাড়ির পাশের আরশিনগর...' গান গেয়ে শোনায়।
হঠাৎ সব পাল্টে গেল।
যুদ্ধ। সারাদেশে কালো বর্বর সামরিক শাসন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ভীমরুলের মতো কালো কুৎসিত সৈন্য আসতে থাকে গোপনে। কালো সৈন্য। নিষ্ঠুর সৈন্য। দাঁতাল সৈন্য। ছুঁচো সৈন্য। কানকাটা সৈন্য। খাটাশ সৈন্য। যাদের কোনো দয়ামায়া নেই। আমাদের গ্রাম প্রধান সড়কের কাছে। প্রায়ই পাকিস্তানি সৈন্য বোঝাই গাড়ি আসা-যাওয়া করে। মাঝেমাঝে গাড়ি থামিয়ে গ্রামের মধ্যে নেমে পড়ে। বাড়ি বাড়ি যায়, আম, কাঁঠাল, ছাগল, গরু, মুরগি, ডিম, কলা যা পায় নিয়ে যায়। ভাবখানা এমন, এসব ওদের বাপদাদার সম্পত্তি। আর মুক্তিযোদ্ধা খোঁজে।
আমাদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিন জনই মুক্তিযোদ্ধা। পাশের বাড়িতে একজন আস্ত এবং সাচ্চা রাজাকার আমাদের হামিদ চাচা। হামিদ চাচা প্রায়ই আমাদের ভয় দেখান-পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কেউ থাকতে পারবে না।
চাচা, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের রক্ষা করবেন-আমি বলি। কেমন করে রক্ষা করবেন? তোমাদের তিন ভাই কোথায়?
ওরা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গেছে।
পালিয়ে গেছে, না মুক্তিযুদ্ধে গেছে। কী মনে করো? কোনো খবর রাখি না বুঝি? সব খবরই রাখি।
হামিদ চাচা প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে চলে যাবার পর দিনই আমাদের গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারি ঢোকে। মুক্তির খোঁজে বাড়ির পর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। আগুনে, মানুষের চিৎকারে পুরোটা গ্রামে নেমে আসে কেয়ামত। প্রাণের ভয়ে মানুষ যে যেদিকে পারছে ছুটছে। আমরাও ছুটছি। আমি, মা-বাবা আর আমাদের পরীরানী। ছোটার সময়ে আমরা খালি হাতেই যাই। ব্যতিক্রম পরীরানী। কখনও পালাবার সময়ে ছোট্ট পুঁটলিটা নিতে ভুল করে না।
আরও পড়ুনঃ বুক রিভিউ: "রাসুলের চোখে দুনিয়া"
পুটলিটার মধ্যে ছোট-বড় অনেক পুতুল। কানের দুল। সোনার বালা। রুপোর চেইন। পুঁতির দানা। হাতির দাঁতের চিরুনি আর ছোট্ট একখানা আয়না। আরও আছে হরেক কিসিমের জিনিসপত্রাদি। ওর নিজের সাম্রাজ্য। সময় পেলে আপনমনে খেলে মায়ের ঘরের এক কোণে। রেণুর মেয়ের সঙ্গে ওর ছেলের বিয়ে দিতে গিয়ে যে কতবার ঝগড়া হয়েছে, কতবার কথা বন্ধ থেকেছে, তার শেষ নেই। অসংখ্যবার আড়ি হয়েছে। আবার সব ভুলে মিলেমিশে খেলায় নেমেছে।
এইভাবে আমরা ছুটে পালাই, যখন পাকিস্তানি আর্মিরা আমাদের গ্রামে হামলে পড়ে-বর্গীর মতো, কুকুরের মতো, হায়েনার মতো অসহায়-নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর। দিনে-রাতে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। এমনকি ঘুমের মধ্যেও কান সজাগ রাখি। কতবার এমন হয়েছে, দুপুরে খেতে বসেছি সারাদিন পর, এক লোকমা ভাত মুখে দিয়েছি সবেমাত্র, ছুটে এসে কেউ একজন খবর দিল, ওরা আসছে, ওরা আসছে, পালাও, তোমরা পালাও-
মুখের ভাত মুখে নিয়েই আমাদের গ্রামবাসীর পালাতে হত বাড়ির পিছনে, গভীর বনের দিকে। কতবার পড়ে পড়ে পা কেটেছে। রক্ত ঝরেছে- খেয়ালই করার সুযোগ পাইনি। জীবন আগে, বাঁচি আগে-পরে কাটাছেঁড়া দেখা যাবে। পালাতে পালাতে একটা অভ্যাসই হয়ে গেছে। এমনকি রাতের ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারেও পালাতে তেমন একটা অসুবিধা হত না। পালাতে পালাতে অভ্যাস হয়ে গেছে। গভীর জঙ্গলে একটা শিরীষ গাছের নিচে বড় শিকড়ের আড়ালে আমরা গুটিসুটি বসে থাকতাম। মশায় কামড়ালে শব্দ করতে পারতাম না। মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট। মানুষের কষ্ট কিন্তু মানুষই দিচ্ছে। দুঃখ লাগে, যখন তারা বলে-পশ্চিম পাকিস্তানিরা নাকি আমাদের ভাই! অমন ভাইদের মুখে ঝাঁটা।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি।
শহরে বন্দরে নগরে গ্রামগঞ্জে বৃক্ষের পাতায় পাতায় নদীর স্রোতে ফুলের পাপড়িতে কোমলে শ্যামলে মুক্তিদের আগমন বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। যখন-তখন তারা পাক আর্মিদের ওপর বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমাদের দু'ভাই ইতোমধ্যে বাড়ি এসে জানিয়ে গেছে, তারা বড় একটা মুক্তি দল নিয়ে আশেপাশেই আছে। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। দেশ স্বাধীন হবেই একদিন।
আশায় বুক বাঁধি আমরা।
আমাদের পরীরানী তার বন্দি অবস্থাকে মানতে পারছে না এক্কেবারেই। সে রাস্তায় যেতে পারছে না। স্কুল বন্ধ অনেক দিন। তার সহপাঠীদের সঙ্গে নেই যোগাযোগ। পুকুরে সাঁতার কাটা, গোসল করা নিষিদ্ধ। ছটফট করছে সে। প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে-বুড়ো দাদা?
কী?
ওরা এদেশ থেকে কবে যাবে?
কারা?
ওই যে পাকিস্তানি না টাকিস্তানি, ওরা। ব্যাটাদের জ্বালায় আর পারি না বাপু। দুর্গন্ধ ব্যাটাদের গায়ে। ওয়াক থু।
যাবে। ওরা এ দেশে থাকতে পারবে না।
কবে? আমি যে দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি।
মুক্তিরা চারিদিক থেকে দারুণ আক্রমণ শানাচ্ছে ব্যাটাদের ওপর। ওরা দিশেহারা। যে কোনো দিন আত্মসমর্পণ করতে পারে।
যেদিন দেশ স্বাধীন হবে, সেদিন আমি বারোটা ঘুড়ির মতো বারোটা পাতাকা উড়াব।
বারোটা কেন?
আমার যে বারো বছর বয়স হলো বুড়ো দাদা।
আমি হাসি।
মা-বাবা হাসেন ওর চপলতার প্রকাশ দেখে। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠৎ গোলাগুলির ভীষণ শব্দ। অভ্যাস মতো আমরা বেরিয়ে পড়লাম গভীর বনের দিকে। প্রথমে মা, তারপর বাবা, বাবার পরে আমি। আমার সঙ্গে পরীরানী। আমরা পাশাপাশি দৌড়াচ্ছি দু'জনে হাত ধরাধরি করে। চারপাশে ঘোর জমাট অন্ধকার। রাস্তার উপর পাকিস্তানি আর্মির মরণ আক্রমণ। ঠা-ঠা-ঠা গুলির, চিৎকারের, আর্তনাদের শব্দ বাতাস ছিঁড়ে ছিড়ে কানে আসছে। মানুষের সে কি মরণ আর্তনাদ।
আরও পড়ুনঃ রাজনৈতিক জোট কি? বাংলাদেশের জোটবদ্ধতার রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা
বুড়ো দাদা?
কী?
আমার গয়না? আমার গয়না নেই। ওরা নিয়ে যাবে।
বলেই পরীরানী উল্টো আবার বাড়ির দিকে ছুটে যায় মুক্ত তীরের তীব্র গতিতে। ভয়ে আমার শরীরে ঘাম ঝড়ে। চোখের নিমিষে পরীরানী চোখের আড়ালে হারিয়ে যায়। মা-বাবাকে ঘটনাটা বলে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরে আসি আমাদের ঘরের কাছাকাছি। ইতোমধ্যে আমাদের ঘরে পাকিস্তানিরা ঢুকে পড়েছে। সঙ্গে রাজাকার, আমাদের প্রতিবেশী হামিদ চাচা। ওরা খবর পেয়েছে-আমার দুই ভাই ঘরে আছে। যারা মুক্তি তাদের ধরার জন্য এসেছে। কাউকে কোথাও পায় না ওরা। ঠিক এমন সময়ে ওদের সামনে পড়ে আমাদের পরীরানী।
পরীরানী সবেমাত্র গোপন জায়গা থেকে তার গয়নার পুটলি নিয়ে ঘরের বাইরে পা রেখেছে। পাকি মিলিটারির এক ক্যাপ্টেনের টর্চের উজ্জল আলোর মুখোমুখি পরীরানী। আমি গাছের আড়াল থেকে দেখছি। অসহায়, অবর্ণনীয় কষ্টকর মুহূর্ত।
কি করবো, হাসবো, কাঁদবো না পাকিস্তানিদের খালি হাতে যুদ্ধ লড়বো- বুঝতে পারছিলাম না। ওকে মুহূর্তের মধ্যে পাঁজাকোলা করে সৈন্যরা নিয়ে যায়। নিয়ে যাচ্ছে বাড়ি আলো করা আমাদের আদরের পরীকে, পরীরানীকে। পরীরানী সমস্ত শক্তি, আবেগ, উৎকণ্ঠা, আদরে ডাকছে আমাকে, আমি শুনছি। -পরীরানী চিৎকার করে আমাকে ডাকে- বুড়ো দাদা? আমাকে বাঁচাও, বাঁ-চা-ও
আমি জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরে আসল, তখন সকাল। গভীর জঙ্গল থেকে মা-বাবা ফিরে এসেছেন। ফিরে এসেছেন পাড়া প্রতিবেশীরাও। সবাই জানতে চায় আমার কাছে, পরীরানী কোথায়?
উঠোনে পড়ে আছে পরীরানীর গয়নার পুঁটলি।
হারিয়ে যাওয়া পরীরানীকে আমরা আর কোনোদিন খুঁজে পাইনি।
পরীরানীর জন্য কাঁদতে কাঁদতে মা মারা গেলেন। মা যেদিন মারা গেলেন দেশ স্বাধীন হলো সেদিন। আমার জীবনে পরীরানীর স্মৃতি কোনো দিন মুছবার নয়। যতদিন বেঁচে থাকব, পরীরানীকে খুঁজব এই বাংলায়।
বাবার লেখা শেষ।
না দেখা পরীরানী, আমার ফুপুর জন্য কখন যে চোখে জল এসেছে টের পাইনি। এখন থেকে বাবার মতো আমিও তাঁকে খুঁজব।'