গল্পের নাম: পাশের বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মনি হায়দার

মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
লেখকঃ মনি হায়দার 

গল্পের নামঃ পাশের বাড়ি


বিয়েটা শেষ পর্যন্ত কি ভেঙ্গেই যাবে? খুব দুঃচিন্তায় মন খারাপ করে পিউলী বসে আছে বারান্দায়। দশটা নয়, পাঁচটা নয়, তিনটে নয়- একটি মাত্র মেয়ে। সেই সুশ্রী মেয়ে ঝমক-এর বিয়েতে একটু ধুমধাম করবে না? পিউলী, পিউলীর বন্ধুরা- মেঘলা, চায়না, রয়না, আনিস আর বানিস। ছেলে পক্ষের কাছে তেমন কিছুতো চায়নি! কেবল দাবী করেছে ঝমকের গলায় একখানা সোনার অলঙ্কার দিতে হবে। ছেলের মা লায়লা এক কথায় রাজি। সেই থেকে দু বাড়িতে বিয়ের আয়োজন চলছে মহাসমারোহে।

অথচ গণ্ডগোলটা বাজল বিয়ের মাত্র তিন দিন আগে!

ছেলে মানে হবু জামাই আপেলের মা লায়লা খবর পাঠিয়েছে ঘটককে দিয়ে-কোন গয়না দিতে পারবে না তারা।

আকাশ থেকে পড়ে পিউলী, মেঘলা, চায়না, রয়না, অ্যানিস আর বানিস। সবাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করে- কেনো দিতে পারবে না?

ঘটক সুমন আবার লায়লার বন্ধু। একই ক্লাসে পড়ে সুমন। মুখ কাচুমাচু করে জবাব দেয় সুমন- অতো কথা আমি বলতে পারবো না বাপু! আমাকে লায়লা যা বলতে বলেছে, তোমাদের কাছে তাই বললাম।

মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প। পাশের বাড়ি
পাশের বাড়ির গল্প। মনি হায়দার 

কারো সাথে ঝগড়া বাঁধলে মীমাংসা করে দেয়ার খ্যাতি আছে রয়নার। সে হঠাৎ সুমনকে জিজ্ঞেস করে- এটা তোর কোন ষড়যন্ত্র-টড়যন্ত্র নয়তো?

মানে? সুমন হা।

মানে আর কি! একদম বুড়োদের মতো জবাব দেয় রয়না- অনেক মানুষ আছে যারা অপরের ভালো চায় না। আচ্ছা পিউ-

পিউলী ফিরে তাকায়- কি?

আমি গিয়ে লায়লার সঙ্গে একবার কথা বলে আসবো-

সবাই মিলে সায় দেয়- ঠিক আছে, যা। হ্যাঁ, ভালো করে দেখে আয়

আমি কি ষড়যন্ত্র করেছি- গম্ভীর কণ্ঠে বলে সুমন।

রয়না হাসতে হাসতে বলে- আচ্ছা, যাচ্ছি।

তখনই রয়না চলে যায়। সুমন গম্ভীর মুখে, মন খারাপ করে বসে থাকে। কি অবাক কাণ্ড! দুটি পরিবারের মধ্যে বিনে পয়সায়, বন্ধুত্বের কারণে একটা সম্পর্ক তৈরী করে দিচ্ছে ঘটক হিসেবে, আর উল্টো ওকেই সন্দেহ!

মৃধা বাড়ি। হাওলাদার বাড়ি।

রাস্তার এপার-ওপার, মুখোমুখি দুটো বাড়ি। এই এলাকার সবচেয়ে পুরোনো বাড়ি হাওলাদার বাড়ি। বাড়ির মালিক মাধব হাওলাদার। বয়স প্রায় সত্ত্বর বছরে কাছাকাছি। মাথার চুল সাদা এলোমেলো কাশবন। হালকা-পাতলা গড়ন। নাকের নিচে এক টুকরো সাদা গোঁফ। নাকের উপরে, চোখে স্টীল রীমের গোলাকার চশমা। হাতে সবসময় একখানা তেল চকচকে কালো লাঠি। স্বাধীনতার পরের বছরই গুলশানে এসে জায়গা কিনে বাড়ি বানিয়েছেন মাধব হাওলাদার। সে বাড়ি বানানোর আশ্চর্য গল্প আছে। চারপাশে জঙ্গল আর ডোবা বিল। বন থেকে রাত দুপুরে নয়, দিন দুপুরেও ভেসে আসে এক্কেবারে আস্ত খেক শিয়ালের কলজে হিম করা ডাকাডাকি। ভয়ে বুক কাঁপতো। সেই সময় জঙ্গল আর বিলের মধ্যে বাড়ি বানানো দেখে লোকজন হাসাহাসি করেছে অনেক। দূর থেকে তাকে বলত- পাগল। এমনকি পিউলীর বাবা বাবুল হাওলাদার পর্যন্ত ঝিলের মধ্যে বাড়ি বানানোর বিরোধিতা করেছে। কিন্তু কারো কথায় কান না দিয়ে মাধব বাড়িটা বানালেন। সাদা, দুধসাদা বাড়িটা দূর থেকে দেখলে মনে হতো- বিলে সাঁতার কাটছে রাজহাঁস। অথবা পাল তোলা বিরাট পানসী নৌকার মতো লাগতো অনেকের কাছে। বাড়িটার নাম দিলেন 'হাওলাদার বাড়ি'।

ওমা! মাধব হাওলাদার বাড়ি বানানোর কয়েক বছরের মধ্যে পুরো গুলশান এলাকাই পাল্টে যায়। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে বাড়ি তুলতে আরম্ভ করে। জলার মধ্যে সাত হাত পানির নিচের জমি কেনে তারা। কিনেই শেস নয়, পানি সরিয়ে তড়তড়িয়ে বাড়ি উঠাতে থাকে। একটা বড় রাস্তাও হল। 'হাওলাদার বাড়ি'র ছাদে বসে মাধব চারদিকে বাড়ি বানানো দেখেন আর হাসেন। অনেকে তার কাছে আসেন বাড়ি তৈরীর পরামর্শ নিতে। পান খাইয়ে-দাইয়ে মাধব দাদু সবাইকে টাটকা

পরামর্শ দেন। অবশ্য কোন ফি-টি নেন না। এলাকার সবচেয়ে পুরনো, বনেদী বাড়িওয়ালা হিসেবে তার একটা দায়িত্ব আছে না! এইসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মঙ্গল আলি মৃধার সঙ্গে পরিচয় দাদু মাধব হওলাদারের।

এক সকালে হওলাদার বাড়িতে এসে আসন গেড়ে বসলেন মঙ্গল আলী মৃধা। বললেন, শুনেছি আপনি এই এলাকার সবচেয়ে পুরনো লোক।

তিন গাল হেসে দাদু বলেন, ঠিকই শুনেছেন। তা আপনার জন্য কি করতে পারি?

হাসলেন মঙ্গল আলি মৃধা- এখন আমি তো আপনার প্রতিবেশী। ।

মানে? দাদু চোখ থেকে চশমা নামালেন

ঐ যে বাড়িটা তৈরী হচ্ছে- হাত দিয়ে 'হাওলাদার বাড়ি'র উল্টোদিকে নির্মীয়মাণ একটি বাড়ি দেখিয়ে বললেন, ওটা আমার বাড়ি।

আরও পড়ুনঃ নদী ও প্রজাপতির গল্প

খুব খুশি হলাম আপনার মতো একজন প্রতিবেশী পেয়ে। জানেন, এখানে এখন যারা বাড়ি তৈরী করছে তারা সবাই তরুণ। আমি এদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারি না। আপনাকে পেয়ে ভালোই হল-

সেই থেকে মঙ্গল আলি মৃধা আর মাধব হাওলাদার একে অপরে বন্ধু।

দুই পরিবারের মধ্যে খুব আসা-যাওয়া ঘনিষ্ঠতা। লায়লা হচ্ছে মঙ্গল আলি মৃধার বড়ো মেয়ের মেয়ে। নানার বাসায় থেকে পড়াশুনা করছে পিউলীদের স্কুলে।

বিকেলে পিউলী এবং ওর বন্ধুদের মুখ মলিন করে বসে থাকতে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন দাদু মাধব- তোমরা মুখ ঘোমরা করে বসে কেনো?

দাদু, আমাদের মন খুব খারাপ-জবাব দেয় চায়না।

কেনো? কোনো? দাদু অবাক হয়ে জানতে চান।

হবে না কেনো? দাদু আপনিই বলুন, বিয়ের মাত্র তিনদিন আগে যদি বরপক্ষ জানায় নতুন বৌকে ওরা গয়না দিতে পারবে না। এটা কোন কথা হলো? এতে মেয়ের মা, আমাদের মন কি ভালো থাকতে পারে? কথা বলে হাঁপাতে থাকে মেঘলা।

মাধব পাশে বসেন নাতনীর। আলতো আদর করতে করতে পিউকে কাছে টানেন- তাতো বটেই। তাতো বটেই। কিন্তু ছেলে পক্ষ কে?

ঐ যে লায়লা- গাল ফুলিয়ে জবাব দেয় পিউ, লায়লার ছেলে আপেলের সঙ্গে আমার মেয়ে ঝমক- এর বিয়ে হওয়ার কথা-

তাই?

হ্যাঁ, দাদু।

কিন্তু ছেলেপক্ষ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগে জানা দরকার।

জানার জন্য রয়নাকে পাঠিয়েছি লায়লাদের বাসায়- আনিস জানায়।

ওদের কথার মধ্যে চলে আসে রয়না। সবাই তাকায়। রয়না বসতে বসতে কথা বলে- সুমনের কথাই ঠিক।

পিউলী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে- আমার মেয়ে ঝমকের এখন কি হবে?

সবাই নিন্দা করবে। মাধব সত্যি সত্যি কান্না দেখে হাসতে থাকেন-

শিশুরা মিছেমিছে খেলাটাকেও কতোটা গভীরভাবে নেয়। নাতনী পিউলীকে আদর করতে করতে বলে দাদু- পিউ, শোনো-

না, আমি কোন কথাই শুনবো না।

কেনো?

ক্লাসের সবাইকে আমি ঝমকের বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছি। বলেছি ছেলেপক্ষ 'ঝমক'কে এত্তো এত্তো গয়না দেবে-

দাদু, রয়না, মেঘলা, চায়না, আনিস, বানিস মিলে সান্ত্বনা দেয় পিউলীকে। পিউলীর শোক একটু কমলে দাদু বলে- তোমাদের ব্যাপারটার মধ্যে মনে হচ্ছে আমাদের মতো বুড়োদেরও লাগবে। আমি এখন 'বুড়োদের' ক্লাবে যাচ্ছি। সেখানে মৃদা সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হবে। তার সঙ্গে কথা বলে আমি ঝমকের বিয়ের ঝামেলা ঠিক করে দেবো-কেমন?

দাদুর প্রস্তাবে সবাই খুশি। তিনি লাঠি হাতে উঠে দাঁড়ান।

তুমি কখন বাসায় আসবে দাদু? জিজ্ঞেস করে পিউলী।

আমার ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হবে- বুড়োদের ক্লাবে বুড়োদের গল্প করবো, টিভি দেখবো, পত্রিকা পড়বো- আড্ডা দেবো- সকালে আমার ঘরে এসো- তখন সব জানতে পারবে।

আচ্ছা।

যে যার মতো চলে যায়।

সকালে দাদু বিছানায় বসে চা পান করছেন গম্ভীর মুখে। পিউলী আর ওর সব বন্ধুরা এসেছে। সবাই দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সোনাই দাদু চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ওদেরকে কাছে ডাকছেন। ওরা দাদুকে ঘিরে বিছানায় বসে।

দাদু- খবর কি? জিজ্ঞেস করে মেঘলা।

একটি বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দাদু বললেন- তোমাদের সঙ্গে কথা বলে বুড়োদের ক্লাবে গেলাম। গিয়ে দেখি- ক্লাবের সবাই মিলে পত্রিকার একটি খবর মনযোগ দিয়ে পড়ছে। দাদু- পিউলীর কণ্ঠে অভিমান- আমার ঝমকের বিয়ের সঙ্গে পত্রিকার খবর টেনে আনছো কেনো?

আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছোট গল্প "পিঁপড়ে যেদিকে যায়"। মনি হায়দার 

কেনো আনছি। তাহলে খবরটা পড়ে শোনাই- মাধব হওলাদার বিছানার নিচ থেকে পত্রিকাটি বের করে পড়তে আরম্ভ করলেন-"পাড়েরহাট এলাকার একাত্তরের ঘাতক সাঈদ আলী এখন ঢাকার গুলশানে বিশাল বাড়িতে বসবাস করছে। নাম পাল্টিয়ে রেখেছে- মঙ্গল আলী মৃধা। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাড়েরহাটে একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে দিনদুপুরে বাইরে থেকে দরজা জানালা বন্ধ করে, ঘরে আগুন লাগিয়ে হত্যা করেছে। সেই হত্যাকান্ডে তিন তিনটি অবুঝ শিশুও ছিল-যারা জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। অমৃত সমান তিনটি শিশুর নাম-মেঘলা, আনিস, পিউলী।"

পত্রিকার খবর পাঠ করতে করতে মাধব হাওলাদার কেঁদে ফেলেন। তাঁর কান্না ওদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। সবাই কাঁদছে। পিউলীর মা কি একটা কাজে এসে সেও কাঁদতে আরম্ভ করে। রাজহাঁসের মতো সাদা বাড়িটা কান্নায় ভাসছে। এ যেন কান্নার শোকসভা।

অনেকক্ষণ কান্নার পর শোক একটু কমলে দাদু বলেন-ভালোই হলো।

যদিও পুতুল বিয়ে, কিন্তু পাশের বাড়ির সঙ্গে কোন সম্পর্ক না থাকাই ভালো। তোমরা কি বল? দাদু ক্লান্ত চোখে ওদের দিকে তাকান।

পিউলী, আনিস, মেঘলা, রয়না, চায়না, বানিস ঘাড় কাৎ করে দাদুর কথা মেনে নেয়।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url