বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছোট গল্প "পিঁপড়ে যেদিকে যায়"। মনি হায়দার

 
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
লেখকঃ মনি হায়দার 

গল্পের নামঃ পিঁপড়ে যেদিকে যায়



অবনী?

শাওন ডাকছে। পরনে লাল রঙের লুঙ্গি। গায়ে ডোরাকাটা গেঞ্জি। মাথায় গামছা বাঁধা। মুখে নীল আতঙ্ক। চোখে ভয় নিয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। ও খুঁজছে অবনী, অবনীর মা-মাসিমা আর দীপা দিদিকে। যার পদ্মপাতার ওপর শিশির বিন্দুর মতো কোমল টলমল চোখ, ঘন কালো লতানো চুল। মুখে নদীর ঢেউ উপচানো হাসি। শাওনকে গান শেখায় 'জ্যোস্না রাতে সবাই গেছে বনে...।' সঙ্গে যোগ দেয় অবনী। হারমোনিয়ামের রিডে হাত বোলায় দীপা দিদি। কী চমৎকার সুডোল হাত! যেন কাঁচা হলুদ রঙ। শরীরে মিষ্টি গন্ধ। চোখ দুটি বুজে ঢলে ঢলে গান গায়- এসো নীপ বনে...। অবনী, শাওন, দীপাদিদির সঙ্গে দোলে-এসো নীপ বনে...। দীপাদিদির ছোট ভাই অবনী। পড়ে ক্লাস সিক্সে। শাওন পড়ে একই ক্লাসে। একই স্কুলে।

গ্রামটার নাম বোথলা। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দুরুন্ত নদী কচা।

গ্রামটার বুক চিরে হেসেখেলে এগিয়ে গেছে ছোট্ট একটা খাল। খালটা উত্তর দিকে দক্ষিণে সাপের মতো বয়ে গেছে। পুব পাশে অবনীদের বাড়ি। পশ্চিম পাড়ে একটা মাঠ। মাঠের পর এটা বড় পুকুর। পুকুরটায় সাড়া বছর পানি থাকে। তারপরই শাওনদের বাড়ি।

মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প। মনি হায়দারের লেখা।
মুক্তিযুদ্ধের ছোট গল্প "পিপড়ে যেদিকে যায়"

অবনী আর শাওনের মধ্যে খু-উ-ব ভাব।

বাড়ির সামনের মাঠে দুজনে ঘুড়ি ওড়ায়। কানামাছি খেলে। এক মাস্টারের কাছে পড়ে। প্রতিদিন বিকেলে শাওন দীপাদিদির কাছে গান শিখতে যায়। গত বছরের স্কুলের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় শাওন কোনো পুরস্কার পায়নি। এবার তাই খুব রাগ। দীপাদিদিরও প্রতিজ্ঞা- যেভাবেই হোক, এবার গানের প্রথম পুরষ্কার শাওনের জন্য চাই-ই-চাই।

দীপাদিদি যখন শাওনকে গান শেখায় সা-রে-গা-মা ...। অবনী গলা মেলাতে মেলাতে শাওনকে খোঁচা মারে এ্যাই, বেলা তো পড়ে এলো।

খেলতে যাবি না?

ছন্দ, তাল কেটে যায়।

'দীপাদি'- চেঁচায় শাওন।

কী হলো?

অবনী খোঁচা দিচ্ছে।

ওটা তো ভোম্বল পেটভরা অম্বল গায়ে দেয় কম্বল।

দিদি অবনীকে নিয়ে ছড়া কাটে। তাতে অবনী সাহেব অপমানিত হয়। উঠে চলে যায়। শাওনও ওর পিছু ধরে। দিদি যেতে দিতে চায় না।

ওটা তো ভোম্বল, ওর দ্বারা কিছু হবে না। তুই থাক- গলা সাধ।

না দিদি আমি যাই, না গেলে অবনী রাগ করবে।

করুক। তুই আগে গানটা শিখে নে। আয় ধর- তোর ডাক শুনে যদি কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। কী আর করা! শাওন কণ্ঠ মেলায়। অবনী রাগ করলেও চলে যায় না। অল্প দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ সে শাওনকে ছাড়া যাবে না। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর বেড়ালের মতো গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে। বসে পড়ে শাওনের পাশে, পরিত্যক্ত স্থানে। দিদি শাওনের সঙ্গে সেও গান ধরে।

আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের গল্প "ভাস্কর্য"।

গান শেখা সেদিনের মতো শেষ। সন্ধ্যার আকাশে গাঢ় লালিমা। দিদি আঁচল ভরে মুড়ি আনে। সঙ্গে ঝুনা নারকেল, আখের গুড়। ওরা মুঠো মুঠো হাতে নিয়ে খায়। ঘরের ভেতর সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বলে ওঠে। কাছে, দূরে শোনা যায় উলুধ্বনি। আজানের মধুর সুর।

অবনীর বাবা দূরের পাড়ের হাটে দোকান দিয়েছে। শাওনের বাবা স্কুলের মাস্টার। অঙ্ক শেখান। তাদের মধ্যেও অনেক ভাব। অবনীর বাবা অনিল রায় বাড়ি আসলেই শাওনের বাবা মুজিবুর রহমানকে ডেকে নিয়ে যান। পুজোর সময় সন্দেস, নাড়, রহমান সাহেবকে খেতে দেন। রহমান সাহেব মাঝে মধ্যে অনিল রায়কে বাড়িতে ডেকে আনেন। অনেক গল্প করেন দু'জনে। সেদিন আর শাওনের পরদিন ক্লাসের পড়া হয় না। হারিকেনের মৃদু আলোয় দুজন বাবার ছেলেবেলাকার নানা রঙের গল্প শোনে। আর শুনতে শুনতে ওইসব ঘটনার নায়ক হয়ে যায় শাওন। সবকিছুর আগে বিষয়গুলো অবনীকে না বলা পর্যন্ত ক্ষান্ত থাকে না ও।

অবনী কোথাও বেড়াতে গেলে তিনদিনের বেশি থাকে না। থাকতে পারে না। তিনদিনের বেশি হলেই কান্না পায়। কেবল মনে পড়ে শাওনকে।

ইস! এখন কী করছে শাওন? খেলছে? কার সঙ্গে? আমাকে ছাড়াই খেলছে? খুব খারাপ লাগে। নিমিষে পাখির ডানায় ভর করে উড়ে আসতে চায় শাওনের কাছে। পারে না। ওর নানাবাড়ি কচা নদীর অপর পারে। প্রথম দুটো দিন মোটামুটি কাটে। তৃতীয় দিনে মুখ ভার। মা বুঝতে পারেন অবনীর মন খারাপ কেন?

চারদিনের মাথায় অবনী কাঁদবেই। কোনোভাবেই আর নিজেকে মানিয়ে রাখতে পারে না। শেষে মামারা ওকে পৌঁছে দিয়ে যায়। আবার দুটি দুরন্ত কিশোর মুখোমুখি ফড়িং ধরার নেশায় মেতে ওঠে। কচা নদীর স্বপ্নে কাতর দুটি কিশোর দাঁড়ায় নদীর তীরে, ডাকে বন্ধু আমরা ফিরে এসেছি।

নদীর ঢেউ কূলে আছড়ে পড়ে, যেন নদী জবাব দেয়, সু-স্বাগতম বন্ধুরা, আমিও তোমাদের না দেখে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।

নদী ও মানুষের মিলন সেতু এভাবেই নির্মাণ হয়। কেউ যার খবর রাখে না। কেউ যা জানে না। দুটি কিশোর হৃদয়ে আলুথালু ঝড় ওঠে। ঢেউয়েরা সাড়া দেয়। গাঙচিল ডানা ঝাপটায়। মাঝি বৈঠা ঠেলে। জাহাজ যায় দূরে, অনেক দূরে।

সেই অবনীকে আজ সাত সাতটি দিন দেখতে পায় না শাওন! শাওনকে দেখতে পায় না অবনী। দীপাদিদির কাছে গান শিখতে পারে না। অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করছে ও। এক এক সময় ইচ্ছে হয়েছে পাকিস্তানি হারামজাদা বাহিনীদের সমস্ত অস্ত্র কেড়ে নিয়ে কচা নদীর বিশাল বক্ষে ফেলে দিয়ে দুরন্ত গাঙচিলের মতো ডানা মেলে উড়ে যাই দিদির কাছে। অবনীর কাছে।

কয়েকদিন আগে দেখেছে মাসিমার জ্বর। বিছানায় শোয়া। দিদি গান শেখাতে পারেনি। আঁচলভরে মুড়ি এনে খেতে দিয়ে বলেছে, দাদাভাই, আজকে গান শেখাতে পারব না।

কেন?

দেখছিস না- মা অসুস্থ। আমাকে আজকে সব কাজ করতে হবে। খোপে হাঁস-মুরগি নিতে হবে। রাতের রান্না চড়াবো। আজকে আবার শুক্রবার- বাবা আসবে। মাকে ওষুধ খাওয়াতে হবে। অনেক কাজ-

দিদি?

কী আবার?

তোমার বিয়ে?

আমার বিয়ে! অবাক দীপাদি।

হ্যাঁ।

ওমা, তাই নাকি?

হ্যাঁ।

তোকে কে বলেছে?

তুমি জান না?

নাহ্- দীপাদিদির নিরীহ দৃষ্টি।

তাহলে কাকিমাকে জিজ্ঞেস করি?

ওরে আমার আম কুটকুট্ বাঁদর। এতো বাঁদরামি কোথায় শেখা হচ্ছে? কান ধরছে শাওনের।

আহ্ মারছ কেন? আমি কী মিথ্যা বলেছি? শাওন জোর প্রতিবাদ করে তার কান ধরার জন্য- অবনী আমাকে সব বলেছে। তাছাড়া-

তাছাড়া কী?

বাবা আর কাকামশাই আমার পড়ার টেবিলে বসে আলাপ করেছিল, আমি শুনেছি।

সত্যি? তুই সত্যি শুনেছিস হুতুম পেঁচা? শাওন বুঝতে পারে দীপাদিদি এখন খুব মুডে আছে। ভালো মুডে খাকলেই ওকে হুতুমপেঁচা বলে ডাকে।

হ্যাঁ, শুনেছি।

বল না, কী কী শুনেছিস?

বলবো কেন? তুমি আমাকে মারলে যে? চলো অবনী, বাইরে যাই-।

ঠিক আছে, যাও।

শাওন বুঝতে পারে দীপাদিদি রাগ করেছে। ও মৃদু হাসে। পাশ ঘেঁষে বসে- বলি?

না দরকার নেই- অভিমানী কণ্ঠ দিদির।

শোনো, কাকা বলেছে, আমাদের হবু জামাই বাবু দেখতে নাকি রাজপুত্তুরের মতো। বড় চাকরি করে। চট্টগ্রাম সমুদ্র সৈকতের কাছে থাকে। বিয়ে হলে কাকাবাবু, বাবা, আমি, অবনী, আমরা সবাই চট্টগ্রাম বেড়াতে যাব। তখন কিন্তু আমাকে অনেক আদর করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: ডানপিটে। মনি হায়দার 

তোকে আদর করতে আমার বয়ে গেছে।

শাওন আর অবনী অবাক চোখে ওদের দিদিকে দেখে- এ এক নতুন দিদি। চোখে মুখে লজ্জার লাল রঙ ঢেউ খেলছে। এতো সুন্দর আর দেখিনি। দিদি ওদের দিকে তাকায় না।

হঠাৎ কাকিবা ডাকে, দীপা? ও দীপান্বিতা?

যাই মা! দিদি যেন পালাবার পথ পায়। দ্রুত উঠে চলে যায়। যাবার সময় আঁচলের মুড়িগুলো দিয়ে যেতে ভোলে না। অবনী আর শাওন বাইরে বেরিয়ে পড়ে। দুজনে হাঁটে। মুড়ি চিবোয়। কচা নদীতে অল্প অল্প ঢেউ। একটা জাহাজ চলে যায়। বটগাছের নিচে দাঁড়ায় ওরা।

হঠাৎ অবনী জিজ্ঞেস করে- শাওন মিলিটারি কী?

মিলিটারি? অবাক চোখে তাকায় শাওন। এই শব্দটা এ পর্যন্ত আর কখনো শোনেনি।

হ্যাঁ, মিলিটারিরা নাকি ঢাকায় হামলা চালিয়েছে। ওদের কাছে নাকি অনেক অস্ত্র। বাঙালি পেলেই মেরে ফ্যালে।

তোকে এসব কথা কে বললো শুনি?

গত রাতে নদীর ওপার থেকে মামা এসেছিল।

তারপর?

মামা এসব কথা মাকে, দিদিকে বলছিল। ওরা মনে করেছিল আমি ঘুমিয়ে পড়েছি কিন্তু ঘুমায়নি। জেগে ছিলাম। মামা মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে। মা, দিদি, বাবাকে সাবধানে থাকতে বলেছে।

কেন?

পাকিস্তানের বিপক্ষে যারা আছে, তাদের নাকি মেরে ফেলবে।

কেন মারবে?

জানি না।

ধ্যাৎ, শুধু শুধু আমাদের মারবে কেন? অসহিঞ্চু শাওনের কণ্ঠ।

ওই তো বললাম, কেবল মানুষ মারে না। ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়,

সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে।

এই সব কথা বিশ্বাস হয় না শাওনের। মানুষ কেমন করে মানুষকে মেরে ফেলবে? মায়া লাগে না? এই চোখ দিয়ে কী মানুষের রক্ত দেখা যায়? স্কুলের অমল স্যার পড়া না পারলে দুই চারটে পিটুনি দেয়। আবার লাইব্রেরিতে ডেকে নিয়ে আদর করেন।

কীরে খুব লেগেছে?

কথা বলে না ওরা। অমল স্যার মায়াভরা কণ্ঠে বলেন- হ্যাঁরে আমি কি তোদের মারতে চাই? তোদের মারতে আমার খুব খারাপ লাগে। কিন্তু তোরা যখন পড়া পারিস না, তখন মেজাজটা গরম হয়ে যায়। তাইতো বলি- বাড়িতে ঠিকমতো লেখাপড়াটা কর, আমাকেও আর বেত উঁচিয়ে মারতে হবে না।

আচ্ছা স্যার, আমরা বাড়িতে মনোযোগ দিয়ে পড়বো।

হ্যাঁ, তাই পড়িস। অমল স্যারও মানুষ। ওরাও তো মানুষ। তবু কেন এতো অচেনা মনে হয়!

দূর বোকা ওসব কিচ্ছু না। অবনীকে সান্ত্বনা দেয় শাওন- যদি তেমন কিছু হয়, তুই আমাদের বাড়ি আসবি।

আমি একা? মা, দিদি, বাবা?

সাবাই আসবি। একসঙ্গে মিলেমিশে থাকব।

তাই? খুশি হয় অবনী। যাক বাবা শেষ পর্যন্ত একটা ঠিকানা পাওয়া গেল! যেখানে মিলিটারির ভয়ঙ্কর হামলা থেকে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। আরো মজাই হবে- যখন শাওন আর অবনী একসঙ্গে পাশাপাশি থাকবে সারাটা সময়। ভাবতে ভাবতে ওদের মুড়ি খাওয়া শেষ। কালো ঘোমটা মাথায় পরে সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। সূর্যটা লাল আগুনের পিও হয়ে টুপ করে ডুবে যায় কচা নদীর অথৈ জলের মধ্যে। বহু দূরের ওপার থেকে ভেসে আসে মানুষের কোলাহল। শেষ হলো একটি দিনের। রাতের পর আগামীকাল সকালে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি নতুন দিনের সূচনা হবে।

ওরা দুজন শাওন এবং অবনী যে যার বাড়ি ফিরে যায়। কালকে ক্লাসের পড়া তৈরি করার কথা ভাবতে ভাবতে জীবন এবং স্বপ্ন কখনো কখনো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় সেটা টের পায় ওরা মাঝরাতে। যখন পুরো গ্রামটা ঘুমিয়ে পড়েছিল পরম মমতায়।

মাঝরাতে ওদের ঘুম ভেঙে যায়। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। চারদিকে টা-টা-টা-টা গুলির একটানা বিশ্রী ভৌতিক আওয়াজ। যেন আকাশ ফেটে বৃষ্টি নয়, বজ্র নেমে আসছে। শত শত বজ্রের অগ্ন্যুৎপাতে কানের তালা ফেটে যাচ্ছে। গ্রামের কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। রাস্তার ওপাশে

মানুষের করুণ চিৎকার ভেসে আসছে। শাওন বাবার সঙ্গে জেগে বসে আছে। চারপাশে ঘনকালো নিবিড় অন্ধকার। ভয়ে কলজে কাঁপছে। শাওন ভাবছে অবনীদের কথা।

আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: কোয়াক পাখির ডাক। লেখক মনি হায়দার

তাহলে সত্যিই কী গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারি এসে গেল? সন্ধ্যায় বলা অবনীর কথাগুলো রাত শেষ হবার আগেই ঘটে গেল? এখন কি হবে? বাবা ওকে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরেছেন। মা, বাবা, শাওন, ছোট বোন রুমকী সবাই ঘরের মেঝেতে একসঙ্গে পাশাপাশি বসেছে জড়াজড়ি করে। কারো বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুনের লাল শিখা। চারদিক দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। ওই পরিষ্কার আলোতে কেউ দৌঁড়ে পালাবার চেষ্টা করলেই রাজাকার-মিলিটারিরা গুলি করে মারবে। মানুষ মারার জন্য মানুষের কী চমৎকার ফাঁদ!

বাবা? ফিসফিস করে ডাকে শাওন।

কী?

এরা কারা?

পাকিস্তানি মিলিটারি বাবা।

কেন এসেছে ওরা?

ওরা আমাদের দাবিয়ে রাখতে চায়। আমাদের ক্ষমতা আমাদের হাতে দিতে চায় না। শোষন করতে চায়। তারই প্রতিবাদ করছি আমরা বাঙালিরা। বঙ্গবন্ধু সাত মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু পশ্চিমা সামরিক জান্তারা মানতে চায় না। তাই তো অসহায় মানুষের ওপর ঝুঁপিয়ে পড়ছে। লির্জজ্জভাবে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেলেছে ওরা। এখন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে আসছে অজগরের মতো লকলকে জিহ্বা নিয়ে। ওদের সঙ্গে কিছু এ দেশের মানুষও যোগ দিয়েছে।

কেন?

ওরা রাজাকার। বিশ্বাসঘাতক।

বাবা?

বলো।

অবনীদের কী হবে?

কী করে বলবো আমি?

ও।

রাত বাড়ে। বাড়ে মানুষের চিৎকার। গুলির শব্দ। বাঁশপোড়ার শব্দ। পাখিরা অন্ধকারে দূরে চলে যায়। মহা আতঙ্ক নিয়ে কালো রাত পার হয়। সূর্যটা আজ ফ্যাকাশে, তামাটে, বিবর্ণ। শোকে সূর্যটা কাঁদছে গুমড়ে গুমরে। গাছের পাতারা নড়ে না। ঘরের বার হয় না কেউ। পাকিস্তানি হারামজাদা বাহিনী সাবধান করে দিয়েছে- ঘরের বাইরে কাউকে দেখলেই গুলি।

মিলিটারিরা খালপাড়ের উঁচু জায়গায় ক্যাম্প করেছে। এই এলাকায় নাকি মুক্তিবাহিনী আছে। তাদের ধরে ধরে মারবে। শান্তি কমিটি করা হয়েছে। কাদের মোল্লা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। সে সকালে এসে বলে গেছে- মুসলমান কারো কোন ভয় নেই। অমুসলমান মালাউলদের অবস্থাটা টাইট করে দেবো। এই দেশে কোনো অমুসলিম থাকতে পারবে না।

কী নির্মম, সাংঘাতিক অবস্থা! সাত সাতটি দিন।

কোনো খবর নেই। কেউ বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। গ্রামের নিরপরাধ লোককে মেরেছে ওরা। কাদের মোল্লা এই সুযোগ তার ব্যক্তিগত নিধনে ব্যবহার করছে। কচা নদীর পাড়ে জোয়ান পুরুষদের নিয়ে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে মেরেছে। নদীর পানিতে, খাল, বিলের স্রোতে মানুষের তাজা টাটকা লাল রক্ত। হাঁস-মুগরি, নারকেল, কলা, চাল, যেখানে যা পেয়েছে কেড়ে নিয়েছে। সাতদিন পর ওরা ক্যাম্প উঠিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেছে।

শাওন এক দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে সাঁকো ডিঙিয়ে অবনীদের বাড়ি হাজির। মনে মনে ভাবছে- অনেক কথা জমা আছে। বলবে অবনীকে। পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী আসার পর থেকে অবনী, তোর কথা একবারও ভুলতে পারিনি। তোর কথা এমনভাবে রাত শেষ হওয়ার আগেই সত্যি হবে ভাবিনি। কাকিমা, দিদি কেমন আছে? চল আমাদের বাড়ি চল। কোনো ভয় নেই এখন। মিলিটারি চলে গেছে। আমি থাকতে তোকে কেউ কিছু বলতে পারবে না।

কিন্তু কই- কউকে তো দেখা যাচ্ছে না। নীরব, নিঝুম। কোথায় গেল সবাই? শাওন কী উচ্ছ্বাস আর উৎকণ্ঠা নিয়ে এসছে- তার কী কোনো দাম নেই? দিদি, কাকিমা, অবনী বুঝি রাগ করেছে? এই সাতদিনে একবারও খোঁজ-খবর নিতে পারিনি, তাই।

আচ্ছা! কেমন করে ও খবর নেবে? মিলিটারির জন্য কী ঘরের বাইরে বের হতে পেরেছি? একটুও কি বুঝবে না?

রাগ না করলে এতোক্ষণে দীপাদিদি এসে দরজায় দাঁড়াতো- কাকে চাই?

দিদি ওকে কতো না চেনে। তারপরও না চেনার ভান করে ওই কথাটা জিজ্ঞেস করবেই। যেন কোনোকালে কখনো দেখেনি।

আমি আপনাকে চাই- মুচকি হাসে শাওন।

দিদিও হাসে- আমি তো বাড়িতে নেই।

তাহলে অবনীকে ডেকে দিন।

অবনীও বাড়ি নেই।

এই কথাটার মানে উল্টো- অর্থাৎ অবনী বাড়ি আছে। ওদের তামাসা দেখে কাকিমা মুখে আঁচলচাপা দিয়ে হাসেন। কী জাদুময় লুকোচুরি খেলা অথচ আজ এখনো কেন দরজা খুলে দাঁড়াচ্ছে না দীপাদিদি?

হঠাৎ শাওন দেখে- উঠোনে বেলগাছের নোয়ানো ডালে লম্বা রেশম কালো একগোছা চুল উড়ছে। বুঝতে পারছে দীপাদিদির চুল। কিন্তু এখানে কেন? দিদি চুলের ভীষন যত্ন নেন। গাছের নিচে একটা মানুষের আঙ্গুল, এক খাবলা মাংস। পাশে ছোট্ট একটা গর্তে রক্তের জমাটবাঁধা কালো দাগ। কোথাও কেউ নেই। কেবল একটা বিড়াল করুণ সুরে মিউমিউ করছে।

আরও পড়ুনঃ General Knowledge about Oxford University

ও একা দাঁড়িয়ে। ভয়াবহ পরিবেশ। গা ছমছম করছে। আবার দেখে শাওন দীপাদির পরনের লাল শাড়িটার কিছু ছেঁড়া অংশ ডালিম গাছের ডালে বাতাসে উড়ছে। দিদির লিপস্টিক, উল, বোনা কাঁটা, ক্রিমের কৌটা,

প্রিয় টিয়ে পাখির শূন্য খাঁচা মাটিতে গড়াগড়ি করছে।

ব্যাপারটা কী? ভাবছে শাওন।

অবনী যা বলেছিল-

শাওনের চোখে পড়ে কয়েক সারি পিঁপড়া দল বেঁধে অবনীদের রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছে। ও পিঁপড়ার সারি অনুকরণ করে রান্নাঘরের দিকে যায়। হঠাৎ শাওনের খুব হাসি পায়। অবনী পিঁপড়া দুচোখ দেখতে পারে না। ভীষণ ভয় পায়। যে পথে পিঁপড়ে থাকে- সে পথে হাঁটেই না। ছোট সময়ে একবার ওর পা কেটে গিয়েছিল। কাকিমা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়েছে। অবনী সে বাঁধন ছিঁড়ে খালি পায়ে বসে বসে লুডু খেলছিল। রক্তের স্বাদ পেয়ে অনেক পিঁপড়ে এসে জড় হয়। ক্ষতস্থানের ব্যথায় চেঁচিয়ে ওঠে। সেদিন থেকেই পিঁপড়ের ওপর দারুণ ক্ষ্যাপা অবনী।

নারকেলের শাঁস যদি পিঁপড়ায় খায়- ও আর সে নারকেল খাবে না।

এতো ছোট্ট প্রাণীকে ভয় পাবার কী আছে? যা হাতের আঙুলের চাপে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যায়। তাকে এতো ভয়!

অবনীরা ওর মুক্তিযোদ্ধা মামার সঙ্গে চলে গেলো না তো? কূল-কিনারা পায় না শাওন। গেলে অবশ্য ভালোই হতো। এই অসহ্য পরিবেশের মধ্যে থাকার কোনো মানে হয় না। আবার মান খারাপ হয় শাওনের- মামার বাড়ি চলে গেলে দেখা হবে কবে? ফিরে আসতে অনেক দিন যদি লাগে? মেজাজ খারাপ। কেন যে পাকিস্তানি হারামজাদা বাহিনী এলো? সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেল।

না- অবনী ওর মামার সঙ্গে চলে যায়নি।

শাওন দ্যাখে- অবনী রান্নাঘরের চুলোর পাশে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বিবর্ণ। সাদা শুকনো। এলোমেলো চুলে রক্তের দাগ লেগেছে। ওকে ঘিরে লক্ষ লক্ষ পিঁপড়ে। লাল পিঁপড়ে। কালো পিঁপড়ে। ছোট পিঁপড়ে। বড় পিঁপড়ে। আশ্চর্য- পিঁপড়েরা অবনীর দূর্বা-শ্যামল শরীরটাকে ঢেকে রেখেছে। শরীরের কয়েক জায়গায় গর্ত বানিয়ে ফেলেছে। অবনী কী ব্যথা পাচ্ছে না? কেন ও চিৎকার করে উঠছে না? একটু নড়ছেও না তো!

কচা নদীর পাড়ের একটি সবুজ গ্রাম। সেই গ্রামের হরিণ কিশোর, যে স্বপ্ন দেখতো অনেক বড় হবার। কচা নদী ছিল যার বন্ধু। পিঁপড়ে ছিল ভয়ঙ্কর শত্রু, যে পিঁপড়ে দেখলেই চিৎকার করে উঠতো সেই অবনী এখন নীরব নিথর। সে এখনে অকাতরে ঘুমিয়ে গেছে পিঁপড়ের বিছানায় সৌম্য শান্ত পরিপাটিভাবে। যে অবনী পাকিস্তানি হারামজাদা বাহিনীর কারণে ভয় পেয়েছিল সেই অবনীকে অবাক চোখে দেখে, তার বন্ধু শাওন।

অবনী কি পিঁপড়ার কামড়ে ভয়ে ব্যথায় চিৎকার করে উঠবে!

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url