নদী ও প্রজাপতির গল্প। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মনি হায়দার
গল্পের নামঃ নদী ও প্রজাপতির গল্প
নদীটার মাঝখানে ছোট ডিঙি নৌকা।
মাথার উপর গনগনে সূর্য। নদীতে অল্প ঢেউ। মৃদু বাতাস। কয়েকটা গাঙচিল উড়ছে চারপাশে। আশপাশে কেথাও অন্য কোনো নৌকা দেখা যায় না। মানুষজনও চোখে পড়ে না। নীরব নিস্তব্ধ। সুন-সান। ভয় লাগে তাকাতে।
মাঝি ভাই নদীটার নাম? আমি জিজ্ঞেস করি।
কচা নদী- মাঝি ছোট কথায় জবাব দেয়। অল্প বয়সী মাঝি। গোলগাল চেহারা। মুখে ছোট ছোট দাড়ি। মাথায় গামছা বাঁধা। তাগড়া জোয়ান শরীর। নৌকা দ্রুত পানি কেটে ইলিশ মাছের মতো এগিয়ে যাচ্ছে। আমার খুব ভালো লাগে নদীর এই মনোরম দৃশ্য দেখতে। জীবনে এই দ্বিতীয়বার নদী দেখছি। এর আগে একবার গ্রামে গিয়েছিলাম লঞ্চে চড়ে। তখন পানি এতো কাছ থেকে দেখতে পারিনি। ইচ্ছে হচ্ছে হাত দিয়ে পানি স্পর্শ করি।
বেশি কথা বলো না মুন্না, বাবা আমাকে কথা বলতে বারণ করেন। আমি মাঝি ভাইয়ের সঙ্গে আর কথা বলি না। তাকাই বাবার মুখের দিকে। বাবার এই মুখটা আমার কাছে খুবই অপরিচিত। এ রকম কালো ম্লান মুখ আমি কখনো দেখিনি। বাবার চোখে চশমার ভেতর থেকে তার চোখের মণি দেখা যায়। চোখ দুটো কেমন যেন নিষ্প্রভ। বাবাকে দীর্ঘ বারোটি বছর দেখছি। কই এমন তো কখনো দেখিনি। বাবার মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের চোখ-মুখ ফোলা। কেবল কাঁদছেন। নীরবে কাঁদছেন। থেকে থেকে আঁচলে চোখ মুছছেন। মায়ের গায়ের রঙ সাদা দুধ-আলতা। সবুজ শাড়ি মায়ের পরনে। অনেক চুল মায়ের মাথায়। বেণী করা চুল সাপের মতো ঝুলে আছে। অবশ্য এখন মাথায় ঘোমটা। মাকে একটা বউয়ের মতো লাগছে। বাবা মায়ের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
![]() |
নদী ও প্রজাতির গল্প। মনি হায়দার |
মা পানি খাবো।
হঠাৎ মায়ের কোলে বসা তিন্নি কথা বলে ওঠে। তিন্নি আমার ছোট বোন। পাঁচ বছর বয়সের ছোট্ট। নিষ্পাপ একটি মুখ। গোলাপের পাপড়ির মতো ওর চোখের ভ্রু। ফোলা দুটো গাল। রাত্রির মতো কালো চুল মাথায়। ওর খুব অভিমান। আমার সঙ্গে সামান্য কারণে অভিমান করে বলে- যাও ভাইয়া তোমার সঙ্গে আড়ি। কোনো কথা বলবো না।
কেন? আমি হাসি। ওর চুলে আদর করি।
তুমি আমার ছবির বই এনেছো?
একদম ভুলে গেছি। কালকে এনে দেবো- একদম ঠিক।
ওর অভিমান ভাঙাতে চেষ্টা করি। তবুও কথা বলে না। দু'গালে হাতে রেখে গম্ভীর হয়ে বসে আছে।
কিরে আপামণি কথা বলবি না?
না।
বললাম তো, কালকে এনে দেবো।
তুমি অনেকদিন বলেছো। কিন্ত আনোনি। আমাকে তুমি একদম ভালোবাসো না।
ওর চোখে জল জমা হয়। এখুনি বৃষ্টি নামবে বোধ হয়। দুহাতে বুকের ভেতর তিন্নিকে তুলে নিই। ও আমার আদরের একমাত্র ছোট বোন। আমি ওর একমাত্র বড় ভাই। যেখানে যাই যতোদূরে যাই- তিন্নির ছবি আমার চোখের ভেতর হাঁটাচলা করে। ওর ছোট্ট মুখের আধো আধো কথা আমার ঘুম পাড়ানির গান।
কী হয়েছে তোদের? বাবা অফিস থেকে এসেছেন। তার হাতে অনেক বই। ছবি আর ছড়ার বই।
বাবা! তিন্নি আমার কোল থেকে নেমে যায় বাবার কোলে। আপাতত ওর দুঃখময় অভিমান থেকে বাঁচলাম। তিন্নি আমাদের সংসারে সোনার প্রতিমা। মায়ার পুতুল। মা, বাবা, তিন্নি আর আমি চারজনের ছোট সংসার। সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা বেশ ভালোই ছিলাম। আর একজন আছে কাজের বুয়া। তার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। আমাদের বাসায় দীর্ঘদিন আছে।
মা তিন্নিকে হাতের অঞ্জলি ভরে পানি খাওয়ান। মুখটা আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেন। তিন্নি খুব ক্লান্ত। মায়ের বুকে মাথা রাখে। চোখ দুটো
বোেজা। গতকাল থেকে আমরা কিছুই খাইনি- পানি ছাড়া। তিনি কয়েকবার খাওয়ার কথা বলেছে। মা অসহায়। আমরা অসহায়। তিন্নির মুখটা শুকিয়ে আমচুর। আমার কান্না পাচ্ছে।
ওকে বুকের ভেতর আরো জোরে চেপে ধরেন মা। ফুপিয়ে কাঁদছেন। নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে হঠাৎ একটা প্লেন উড়ে যায় বিকট শব্দে।
যুদ্ধবিমান। বাবা বলেন।
কোথায় যাচ্ছে? মা আস্তে করে জিজ্ঞেস করেন।
বাবা জবাব দেন- জানি না।
বাবা? আমি ডাকলাম।
কী?
কোথায় যাচ্ছি আমরা?
জানি না।
বাবার কথায় হঠাৎ আমার ভীষণ কান্না পায়। কেন যাচ্ছি? কোথায়। যাচ্ছি কিচ্ছু জানি না। আর কি কখনো ফিরে যেতে পারবো না বাসায়। যেখানে পড়ে আছে আমাদের সংসার। স্কুল। স্যার আর বন্ধুরা। পাশের বাড়ির শহিদ, নাছির, জাহাঙ্গির, ময়না, মিনু- এদের সঙ্গে কি আর দেখা হবে না? ক্লাসে গিয়ে আর কি দুষ্টুমি করতে পারবো না? বৈদ্য স্যার আর বুঝি অঙ্ক শেখাবেন না। শুনেছি বৈদ্য স্যারকে ওরা মেরে ফেলেছে। ইস- বৈদ্য স্যার কী সুন্দর করে অঙ্ক বোঝাতেন। বাড়িতে এসে আর করতে হতো না।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছোট গল্প "পিঁপড়ে যেদিকে যায়"। মনি হায়দার
আমাদের বাসাটা মগবাজারে। চারটে রুম। টিভি এবং ফ্রিজ আছে। ফোনও আছে। বাবা একটা কলেজে মাস্টারি করেন। তার কাছে দিন রাতে অনেক ছাত্রছাত্রী আসে। বাসাটার সামনে বড়ো লন। লনে সবুজ ঘাস। চারপাশে নানা ফুলগাছ। ছবির মতো সাজানো বাড়ি। বাবা প্রায় বিকেলে আমাদের নিয়ে হাঁটেন। বসেন। গল্প করেন। কখনো কখনো মা ট্রেতে গরম চা, চানাচুর, মুড়ি নিয়ে আসেন। আমাদের সঙ্গে বসেন। চা খাই। গল্প করি।
তিন্নিকে প্রায় সবুজ ঘাসের ভেতর থেকে ফড়িং ধরে দিতে হয়। নইলে
সেই গাল ফুলানো দারুণ অভিমান। আবার কখনো কখনো তিন্নি ফুল ছিঁড়তে যায়।
তিন্নি- আমি চিৎকার করে উঠি- ফুল ছিঁড়িস নে।
কেন? ফুল ছিড়লে কী হয়? ও দৌড়ে আসে আমার কাছে। মুখটা গোমড়া।
ফুল ছিড়লে ফুলেরা কাঁদে।
কেন কাঁদে?
কষ্ট পায় যে!
ঠিক আছে আর ফুল ছিঁড়বো না। মাথা দুলিয়ে দুলকি চালে বলে তাহলে আমাকে প্রজাপতি ধরে দাও।
তিন্নির জন্য ফুলের বনে আমি প্রজাপতি খুঁজি। প্রজাপতি পেলে আনন্দে হাতে তালি বাজায়। পরশু বিকেলে আমরা দুজনে প্রজাপতি খুঁজছিলাম। হঠাৎ গেট খুলে বাবা ঘরে এলেন। মাকে ডাকছেন, মুন্নার মা?
মুন্নার মা?
কী? মা কাছে এলেন। এমন করে ডাকছো কেন?
শিগগির পালাও।
কোথায়?
যেদিকে দুচোখ যায়।
মা অবাক। আমরা বিস্মিত। বাবা একটা ব্যাগে সবার জামা-কাপড় ভরছেন।
কেন পালাবো? জানতে চান।
পাক হানাদার বাহিনী ঘরে ঘরে তল্লাশি শুরু করে দিয়েছে। হাজার হাজার লোক মেরে ফেলেছে।
আর কথা নয়। যার যা পরনে ছিল তাই নিয়ে নামলাম পথে। আমরা একা নই। আশপাশের সবাই যাচ্ছে। ছেলে বুড়ো জোয়ান বাচ্চা সবাই সবকিছু ফেলে পালাচ্ছে। দরজা খোলা। জানালা খোলা। চুলোয় তরকারি। পোড়া তরকারির গন্ধ পাচ্ছি। সবুজ ঘাসের বন, প্রজাপতি, বাগান, সব পেছনে পড়ে রইলো। আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। জোরে কাঁদতেও ভয়। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। আমার চোখে পানি দেখে তিন্নিও কাঁদছে।
দূরে শোনা যায় ভারি মেশিনগানের শব্দ। টাটা টা একটানা
আওয়াজ। বুকের স্পন্দন থেমে যায়। মা-বাবা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। অনেক দূরের আকাশে ধোঁয়া দেখা যায়। কোনো বাড়িতে আগুন দেয়া হচ্ছে। ভয়ার্ত মানুষের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ভেসে আসছে। মনে পড়ে ঘরে কতো খাবার রেখে এসেছি। অথচ এখন একমুঠো ভাত পাইনে।
নৌকার পাশে দিয়ে অনেক লাশ ভেসে যায়। কী গন্ধ। মা গলগল করে বমি করে দেন। একটা লাশ একেবারে নৌকার গা ছুঁয়ে যায়। আমার মতো বারো বছরের বাচ্চার লাশ। আমি ভেবে পাই না ওই বাচ্চাটির কী অপরাধ ছিল? কেন ওকে মেরেছে পাকি হানাদার বাহিনী? ও কি মুক্তিযোদ্ধা ছিল? ওর কাঁধে কি কোনো স্টেনগান ছিল? এই লাশ কি কোনো মুক্তিযোদ্ধা সম্মুখযুদ্ধে মারা গেছে?
মা?
কী?
নদীর পানি খাই?
না। বাবা নিষেধ করলেন। বললেন- নদীর পানি দূষিত। দেখলে না- পাশ দিয়ে কতগুলো লাশ গেল। ওপারে যেয়ে পানি খাবে।
আচ্ছা।
মাঝি দ্রুত নৌকা চালায়। তার বলিষ্ঠ হাতের থাবায় নৌকা এগিয়ে চলে। আমরা ধীরে ধীরে খুশি। যাক বাবা- জল্লাদের হাত থেকে বাঁচা গেছে। ওরা আর আমাদের নাগাল পাবে না। নদীর ওপারে ঘন ঝোঁপ। সবুজ অভয়ারণ্য। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রাণভরে সবুজের গান
গাইতে ইচ্ছে করে।
খচ শব্দে মাঝি নৌকা তীরে লাগায়।
বাবা আগেই বলেছেন, এখানে নেমে সোজা উত্তরে চার মাইল হাঁটলে একটা গ্রাম আছে। নাম- মিঠেপুকুর। ওই মিঠেপুকুরে তাঁর এক বন্ধু আছেন। আমরা আপাতত সেখানে যাবো।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের গল্প "ভাস্কর্য"।
চার মাইল শুনে আঁতকে উঠি। খিদেয় চোখে অন্ধকার দেখছি- তার ওপর চার মাইল হাঁটা। মায়ের অবস্থা আরো করুণ, বিশেষ করে, নদীতে অতোগুলো লাশ দেখে মা খুব ভয় পেয়েছেন। জীবনে এতো মানুষের মৃতদেহ কখনো আমরা দেখি নি। পথে আসার সময় দেখেছি আর এক ভয়াবহ দৃশ্য।
আমরা ছুটছি। তিন্নি বাবার কোলে। মায়ের হাতে ছোট্ট একটা পুঁটলি। তাতে আমাদের সামান্য জামা-কাপড়। অগণিত মানুষ ছুটছে। কেউ কারো দিকে তাকাবার সময় পায় না। হঠাৎ পথের উপর ছোট একটা বাচ্চাকে দেখলাম। গায়ে সুন্দর জামা। হাতে ক'গাছি রুপোর চুড়ি। ভালো করে কথা বলতে পারে না। কেবল দু'হাত ঊর্ধ্বে তুলে অনবরত চিৎকার করছে। চারপাশে তাকাচ্ছে। মা-বাবা, ভাই-বোন কাউকে খুঁজছে ওর চোখ। চিৎকারের ভাষায় বাচ্চাটি ওর মাকে ডাকছে। শুধুই মাকে।
কোথায় মা?
মা আসছে না। হয়তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। অথবা মা আশপাশে কোথাও মরে পড়ে আছে। মেয়েটির চিৎকার তার কানে পৌঁছে না। পাশে একটা কুকুর। কুকুরটিও আকাশের দিকে মুখ করে ক্রমাগত ঘেউ ঘেউ করছে। মানুষ আর কুকুর কান্না মিলে কেবল একটি সুরই বোঝা যায়। বাতাসেও কান্না ভেসে বেড়ায়।
মাকে দেখে মেয়েটি কান্না থামিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। কণ্ঠে আহাদি অভিমান। মায়ের সঙ্গে যেন মেয়েটির কতো অধিকার। অনেক অভিমান। মা থমকে দাঁড়ান। মেয়েটির দিকে চেয়ে থাকেন। মায়ের চোখে পনি। মা ওকে কোলে তুলে নিয়ে যাবে ঠিক তখন বাবা ডাকলেন, মুন্নার মা?
মা মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ান। বাবার দিকে চেয়ে থাকেন। বাবা বলেন, ওসব দেখার সময় নেই। তাড়াতাড়ি চলো। আবার কোনদিক থেকে পাকি হানাদার বাহিনী এসে পড়বে।
বাবা মায়ের হাত ধরে টেনে আনেন। মা কেঁদে ওঠেন। মেয়েটি আশা ভঙ্গ হওয়ায় কাঁদে। আমরা হাঁটছি। অনেকদূর থেকে সেই মেয়েটির আকুল করা কান্না শুনতে পাচ্ছি। মা আঁচলে চোখ মোছেন?
বাবা?
কী? নৌকা থেকে নামতে নামতে বাবা বললেন, কিছু বলবি?
হ্যাঁ।
বল।
আমি হাঁটতে পারবো না। বাবা সামান্য হাসলেন। দু'দিন পর বাবার মুখে হাসি দেখলাম। বোধহয় হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়ে
আমরা কচা নদীর ওপারে চলে আসতে পেরেছি তাই বাবা হাসছেন। আমাকে বললেন, সামান্য পথ হাঁটতে হবে। নইলে যে বাঁচা যাবে না।
আমরা সবাই নেমে দাঁড়িয়েছি। বাবা মাঝিকে টাকা দিচ্ছেন। মা তিন্নিকে আদর করছেন। পাখি ডাকছে। মজা লাগছে। যাক এখন আর ভয় নেই। হঠাৎ পেছনে মানুষের সাড়া পেলাম। পেছনে ফিরে তাকালাম। বুকের রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস চলে না। আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই। সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাকি হানাদার বাহিনী। যাদের মরণ ছোবল থেকে দূরে থাকার জন্য এতো কষ্টে এতো আয়োজন, কতো পথ নদী পার হয়ে এখানে এলাম- যখন তীরে উঠলাম-
পাকি বাহিনীর একজন বললো- নামো।
বাবা ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন কোথায়?
নদীতে।
বাবা বুঝতে পারলেন আর বেঁচে থাকা যাবে না। ওরা বাঁচতে দেবে না। তাঁর মুখে কথা সরে না। বাতাস থমকে আছে। নৌকাটা ঢেউয়ের আঘাতে ভাসতে ভাসতে দূরে সরে যাচ্ছে। মাঝি ভাইও আমাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। আমি, বাবা, বাবার কোলে তিন্নি, মা, মাঝিভাই- মৃতুর মুখোমুখি। অনেকগুলো মেশিনগান লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ওরা রক্ত চায়। জীবন চায়।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প: ডানপিটে। মনি হায়দার
মা বারবার বাবার দিকে তাকাচ্ছেন। ভয়ে হতাশায় ঠোঁট চাটছেন। থর থর করে মা কাঁপছেন। মা কী করবেন- বুঝে উঠতে পারছেন না। সামনের সৈন্যটি বেয়োনেট দিয়ে বাবার কাঁধে আঘাত কারে। মুহূর্তে বাবার সাদা পাঞ্জাবিটা রক্তে লাল হয়ে গেছে।
বাবা ভীষণ ভয় পেয়ে নদীতে নেমে দাঁড়ালেন। আমরা সবাই নামি। মায়ের কাছে আমি। মায়ের মাথায় ঘোমটা। তার ঠোঁট নড়ছে। কলেমা পড়ছেন মা। অস্পষ্ট আওয়াজ শুনছি। মা-বাবা মাঝি ভাইয়ের কোমর পানি। আমার গলা সমান। কয়েক জোড়া অসহায় চোখ মেশিনগানের দিকে চেয়ে আছে। বিষণ্ণ মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে আমরা দাঁড়িয়ে আছি।
হঠাৎ তিন্নি চিৎকার করে ওঠে মা দুধ খাবো।
ফায়ার- ওদের একজন চিৎকার দিয়ে ওঠে।
বৃষ্টির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি নেমে আসে। অতো শব্দের মাঝেও বাবার একটি শব্দ শুনছিলাম- মুন্না...।
গুলির সঙ্গে সঙ্গে আমি ডুব দিয়েছিলাম। কেন দিয়েছিলাম জানি না। জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি। যখন জ্ঞান ফিরে পেয়েছি তখন বাবা-মা মাঝি ভাইয়ের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে একটা চরে উঠেছি। দেখছি বাব-মায়ের প্রাণহীন দেহ লাশ হয়ে ভেসে যাচ্ছে। চারপাশের রক্ত লাল। আমি তাদের একমাত্র ছেলে দাঁড়িয়ে দেখছি। তিন্নিকে কোথাও দেখছি না। তিন্নি যাকে আমি প্রজাপতি ধরে দিতাম, না দিলে রাগ করতো, কথা বলতো না আমার সঙ্গে, সে কচা নদীর অথৈ জলে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। বলবে না- ভাইয়া, আমাকে একটা প্রজাপতি ধরে দাও।
অথচ তিন্নি নিজেই ছিল একটা প্রজাপতি। কচা নদীর তীরে বারবার ফিরে আসি। কতো মানুষ যায়, নৌকা যায় আসে, আমার বাবা ফিরে আসেন না। স্রোত যায়। জোয়ার-ভাটা হয়- আমার বাবার কোনো চিঠি পাই না। আমার বড়ো জানতে ইচ্ছে করে দূষিত পানিতে বাবার কি খুব কষ্ট হয়!