মুক্তিযুদ্ধের গল্প: একাত্তরের চিঠি। গোলাম সরোয়ার সলোক। Ekattorer chithi
একাত্তরের চিঠি
-গোলাম সরোয়ার সলোক
ইদানিং নিতুর অস্থিরতার অন্ত নেই। সব সময় ছটফট করে। প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। চাপা দীর্ঘশ্বাস জগদ্দল পাথরের মত বুকে চেপে থাকে। দম বন্ধ হয়ে আসে। একেবারে মারা গেলেও বেঁচে যেত। কিন্তু মরেও না।
নিতুর একমাত্র কন্যা সন্তান ইরা। মুক্তি নামেও মাঝে মাঝে ডাকে।
বড় হয়ে উঠেছে। অনাস সেকেন্ড ইয়ারে পরে। ভারী চঞ্চল। এক সেকেন্ড চুপচাপ থাকে না।
সারাক্ষণ প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতেই থাকে।
" আম্মু, আব্বু কবে আসবেন? উনি কোথায় আছেন? তুমি সব সময় চুপিসারে কাঁদো কেন? আব্বু কি রাগ করে গেছেন"?
মা কোন কথার জবাব দেয় না। দিতে পারেও না। সে আরও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বাকরুধ হয়ে ওঠে। দু-গণ্ড বেয়ে অশ্রু ঝরে। কত আর মেয়েকে আব্বু আসবে বলে প্রবোধ দিবে। এ কথাতো আজ এত বছর ইরাকে বলেই আসছে।
![]() |
মুক্তিযুদ্ধের গল্প: একাত্তরের চিঠি |
ইরা এদিক ওদিক হলে। কিম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে। নিতু আস্তে করে ছোট্ট মরচে ধরা টিনের সুটকেস বাক্সটি খোলে। সম্পদ দুটি হাতে নেড়ে তার অস্তিত্ব অনুভব করে। বুকে চেপে ধরে। শতবার চুমু খায়। মাথায় রাখে। সুন্দর করে মুছে ময়লা-ধূলা পরিষ্কার করে।
অনুভবে অনেক কিছু অনুভব করে।
দু'টি চোখ হয়ে যায় শ্রাবণের কূলহারা পদ্মা- মেঘনা। এতে উত্তাল ঢেউ জাগে। তীর ভাঙ্গে। চুরমার করে দু-কুলের পরিবেশ। ভাঙ্গে আসার বসতি। ভাসিয়ে দেয় ক্ষেতের ফসল। ডুবিয়ে দেয় জেগে উঠা সকল সম্ভাবনার-চর।
চোখ ফুলে যায়। অঝর ধারায় অশ্রু ঝরে। বুকের কাপড় ভিজে। অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ধরে শরীর। এটা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার।
কত আর অবুঝ মনকে বুঝ দেয়া যায়? নিজেকে সামলে নেয়া যায় কত আর? নিতুর জীবন-খাতা কি শুধু দুঃখ দিয়েই লেখা? কখনোই কি পাবেনা স্বপ্ন সুখের স্বর্ণ-রেনুর ছোঁয়া?
বেশ কিছুদিন হয়। এই বাক্সের প্রতিও ইরার নজর পরেছে। উঠতে বসতে "মা" ঐ বাক্সটার ভিতর কি? তুমি নিজে বাক্স খুলে কি পড়ো?
আমাকে দেখাও। আমি দেখবো।
-"না, তোমাকে দেখতে হবেনা"। অশ্রু-ভেজা চোখে শীতল কণ্ঠে নিতু জবাব দেয়।
-"কেন? এতে কি লুকানো আছে"?
-"আমার জীবনের সেরা দুটি সম্পদ"।
-"চাবি দাও । দেখি--দেখি"।
-"বললামতো, তোমাকে দেখতে হবেনা"।
-"আমি কিন্তু বাক্স ভেঙ্গে ফেলবো "। ইরার বলিষ্ঠ ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ।
-"না, মা, এই কাজটি তুমি কখনো করো না। আমার শেষ এবং সেরা দুটি সম্পদ নষ্ট করে দিও না মা। তোমার অভাগী মায়ের প্রতি তুমি সদয় হও"।
অশ্রু-ভেজা আকুতি মায়ের। মেয়ের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে কত কাকুতি মিনতি। অনুনয়-অনুরোধ।
-"তাহলে বল তুমি আর ঐ ভাঙ্গা টিনের বাক্সও খুলবে না। কাঁদবেও না। তুমি কাঁদলে আমি স্থির থাকতে পারি না"। মায়ের প্রতি মেয়ের দরদু মাখা অনুরোধ।
-"আমি কি তা পারবো মা? আমার দেহ-অঙ্গ সৌষ্ঠব বাইরে। প্রাণটা ঐ বাক্সের ভিতর। এই অনুরোধ তুমি করোনা। আমি এই অনুরোধ রাখতে পারবোনা। আমার এই মধুর সুখটুকু থেকে তুমি বঞ্চিত করোনা, মা"।
মায়ের অনুনয়-আকুতি।
তবু নিতুর চিন্তার শেষ নেই। যদি এক সময় বাক্স খুলেই ফেলে। কিম্বা ভাঙ্গে? তখন কি ইরা আমার বিশ্বাস করবে? কোন পরকীয়া প্রেমের স্মৃতি-চিহ্ন ভাববে নাতো?
তখন চরম সত্যটাকে কিভাবে তুলে ধরবো? যা শতভাগ সত্য এবং পবিত্র। অথচ যার কোন দালিলিক প্রমান নেই। নেই কোন চাক্ষুস প্রমাণও। তখন কি ইরা আমাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেবে? নাকি...
না! সে চিন্তাও করতে পারছে না। বুঝি ভূমিকম্প হয়ে যাবে। বুঝি উলট পালট হয়ে যাবে পৃথিবী।
না। মাথা ঝিম ঝিম করছে। চোখে অন্ধকার লাগছে। সারা শরীর কাঁপছে থর থর করে।
সে আর চিন্তা করতে পারে না।
তবু স্মৃতির সোনালী নদী সাতরে। এক সময় চলে যায় সেই একাত্তরে। ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে।
পঁচিশে মার্চ।
কালরাত্রি।
নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালী জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পরে সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনী। চালায় নির্মম অত্যাচার।
চারিদিকে খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নি সংযোগ। শহর, বন্দর, গ্রাম এক নিমিষে পুড়ে ছারখার। যেন শ্বশানপুরী।
চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ।
রক্তে রঞ্জিত রাজপথ। রক্তের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে দেশ। এই রক্ত-স্রোত বেয়ে চলেছে পদ্মা- মেঘনা- যমুনায়।
মমতাময়ী মায়ের স্তনে শিশুর মুখ লেগে আছে। দখলদার বাহিনীর বুলেটের আঘাতে নিরব হয়ে গেছে। তাজা রক্ত বেরুচ্ছে মুখ ও বুক দিয়ে।
ওপাশে আদরের স্ত্রীর আক্র-সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে স্বামী খেয়েছে গুলি। পেট ফুড়ে নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে গেছে।
এদিকটায় বিবস্ত্র অবস্থায় যুবতী কন্যা পরে আছে। নিাঙ্গের কাপড় ও উরুদেশ রক্তে ভেজা। রক্তে রঞ্জিত। মুখে বুকে হায়েনার ছোবল। ঠোঁট কামড়ে কেটে নিছে। পাশে কুগাছি ভাঙ্গা কাচের চুড়ি পরে আছে। হায়রে মানুষ! হায়রে মানবতা!
পাকিস্তানি বাহিনী যাকে যেখানে পাচ্ছে। সেখানেই গুলি করে মারছে। মারছে পাখির মত। শেয়াল কুকুরের মত।
জ্বলছে বাঙ্গালীর আশা-আকাঙ্খা-প্রত্যাশা।
জ্বলছে স্বাধীনতার স্বপ্ন।
প্রাণ ভয়ে মানুষ ছুটছে। গন্তব্য সীমান্তের ওপার। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। সব সহায় সম্বল বাড়ী ঘর ছেড়ে তারা পালিয়ে যাচ্ছে প্রাণ ভয়ে। জমি-জমা, হাল- গেরস্তি সবই রেখে চলে যাচ্ছে।
শুধু জীবনটা আর স্ত্রী কন্যার ইজ্জত সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য।
অন্ত। শুধু ছুটছে আর ছুটছে। মানুষের এ ছুটে চলার শেষ নেই। নেই কোন জায়গা তার আশি বছরের বৃদ্ধা মাকে ঝুড়ির মধ্যে বসিয়ে মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে। মা প্রখর রোদে ঘেমে উঠেছে। বুক ফেটে যাচ্ছে পিপাসায়। ক্ষীণস্বরে জল জল করে কাঁদছে।
সত্য জেলে তার বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে যাচ্ছে তক্তার উপর শুয়ে দিয়ে। তক্তার দু দিক দড়ি দিয়ে দোলনা বানানো। এই দড়ির মধ্যে ছ'হাত লম্বা বাঁশ পুরে দেয়া। এই বাঁশ দু'জন কাঁধে তুলে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ও পাশটায় পথের পাশে শ্যামলের বোন টুটুল পরে আছে। পাতলা পায়খানা আর বমি করতে করতে মরণাপন্ন। ডাক্তার নেই। পথ্য নেই। নেই ওষুধের বালাই।
নিমাই মাঝির দেড় বছরের ছেলেটি ক্ষুধায় ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদছে। কিন্তু দুধ নেই মায়ের বুকে। সাথে খাবারও নেই। বুঝি এখনই মারা যাবে।
নিমাই ভাবছে, মরে গেলেই বাঁচি। আর কাঁদাকাটি- কলরব করবেনা।
পিছন থেকে ধাওয়া করে আসা মিলিটারি রাজাকাররাও টের পাবেনা তাদের পালিয়ে যাওয়া। রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে ভারমুক্ত হবে।
তাহলেই অতি দ্রুত অতি অল্প সময়ে সীমান্ত পার হয়ে যাবে। ভারতে গিয়ে বাঁচবে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। দয়া মায়া যেন সবই শেষ হয়ে গেছে। আগে নিজে বাঁচি। তারপর অন্য কিছু।
এদিকে ছাব্বিশে মার্চের প্রথম প্রহরেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।
"আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্ এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম"।
পাকিস্তানি বাহিনী ত্যাগ করে আসা এদেশীয় সেনাসদস্য, ই,পি, আর, আনসার ও পুলিশ গ্রামের জোয়ানদের সংগঠিত করতে শুরু করে। কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র যুবকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে স্ব-স্ব উদ্যোগে। উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
শত শত, হাজার হাজার জোয়ান মুক্তি বাহিনীতে নাম লেখাচ্ছে। ভারত সরকারও জোয়ানদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে পাঠাচ্ছে বাংলাকে শত্রু মুক্ত করার জন্য।
গড়াই নদীর তীরে জাগলবার ছোট্ট গ্রাম। কামার-কুমার, জেলে-তাঁতি, কৃষক-মুচি, নাপিত-মাঝি সব সম্প্রদায়ের বাস এখানে। সবাই সৌহাদ্ধের প্রীতি-ডোরে বাঁধা। বলতে গেলে সবাই সবার আপন। মিলে মিশে বাস করে আত্মীয়ের মতন।
কিনু মণ্ডল এই গ্রামেরই এক ছোট্ট চাষি। সামান্য জমি জমা চাষ করে। এতেই বাপ বেটি দু'জনের সংসার চলে যায়।
কিনুর বউ সাজু নিতার ছোট্ট রেখেই মারা গেছে। সেই থেকে কিনুই নিতার বাপ-মা। ভাই-বন্ধু।
নিতা আঠারো পার করতে যাচ্ছে। সারা অঙ্গ জুড়ে যেন সরষে ফুলের ছড়াছড়ি। হলুদের ডুগ ডুগ রং। চোখে চঞ্চলতা। মুখে পাগল করা হাসি। যেন রূপের ছলাৎ ছলাৎ নদী। একটু ঢেউ-দোলা লাগলেই দেহে বাকে বাঁকে উপচে পরবে। শতধা বিভক্ত কাঁচের টুকরার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে।
কিনু মমতার দৃষ্টি দিয়ে বিভোর হয়ে দেখে।
আর কত কি ভাবে।
এইতো সেদিনও নিতা ছোট্ট ছিল। কাঠ বিড়ালীর মত বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কোলে কাঁধে উঠতো।
এখন মেয়েটির সারা অঙ্গ জুড়ে কাঁচা হলুদ বাঁটা। রূপ আর লজ্জার ছড়াছড়ি। ডাগর ডাগর দু'চোখ জুড়ে সাগর খেলা করে। একটা রাজপুত্তের মত ছেলের সঙ্গে নিতার বিয়ে দিতে হবে।
কিন্তু দেশ জুড়ে যুদ্ধ। কিভাবে যে কি করা যায়? কবে যে যুদব থামে? কবে যে দেশ স্বাধীন হয়? কবে যে দেশে শান্তি আসে?
কিনু খুব ভোরে পান্তা-মরিচ খেয়ে লাঙ্গল-গরু নিয়ে মাঠে যায়। যাবার আগে কত কথা নিতাকে বলে...
-"মা রে, সমায় খারাপ। গরের বাইর হস না। সদর দুয়ার আটকে দিয়ে থাহিস। মেলেটারই রেজেকার আইলি দড় খুলবি না"।
-"ঠিক আছে, বাজি। খুলুম না। তয় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আইও। মোরে ডর করে। এহেলা এহেলা বাল লাগে না"।
-"হ রে মা। একটা চাষ দিয়েই চলে আমু"।
বাপ মাঠে যায়।
মেয়ে একা বাড়ীতে থাকে। একাকীত্ব আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাকে গ্রাস করে।
সে ঘরে ঢোকে। পঞ্চম শ্রেণীর পড়া গুলো মুখস্থ করে। অংক কষে। যুদ্ধের জন্য স্কুল বন্ধ। তাই লেখাপড়ায় আণেক ব্যাঘাত ঘটেছে।
রাতদিন শুধু গুলির শব্দ। বোমারু বিমানগুলো কান ঝালা পালা করে দেয়। ঝড়ের গতিতে এদিক ওদিক ছুটে যায়। বোমা বর্ষণ করে। কামান মর্টার গগন বিদারী শব্দে বুক কেঁপে ওঠে।
রাতে ছোট্ট ঘরের ভিতর নিতা ঘুমায়। আরক্ষার জন্য শিয়রে বটি রাখে।
কিনু লাঠি হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে থাকে। চোর রাজাকার আর মিলিটারির ভয়ে জেগে জেগে রাত কাটায়।
ঘুম পেলে গামছা বিছিয়ে সামান্য একটু ঘুমিয়ে নেয়।
দু'তিন সপ্তাহ হয়।
পীচ কমিটির চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম কিনুর খোঁজ খবর নেয়া শুরু করেছে। দেখা হলেই সালাম দেয়। বৃকে জড়িয়ে ধরে মোলাকাত করে।
অজানা আশংকায় কিনুর হৃদ-স্পন্দন থেমে আসে। সে জমাট বাঁধা বরফের মত শীতল হয়ে যায়।
চেয়ারম্যানের চেলারা সব রাজাকার হইছে। কাঁধে অস্ত্র নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। কিনুর বাড়ীর সামনে এসে শিষ দেয়। ঘরের চালায় ইট খোয়া মারে।
ইরা ভয়ে শিউরে ওঠে। তার গলা শুকিয়ে আসে। ঢক ঢক করে সে গ্লাস ভরে পানি পান করে। আল্লাহ্ মাবুদ বলে বুকে ফুঁক নেয়।
কয়েকদিন আগে ও পাড়ার জরিনার ধরে নিয়ে গেছে। চেয়ারম্যান নাকি জরিনারে পাঞ্জাবী মেজরকে দিছে উপহার স্বরূপ। জরিনার বাবা-মা,
ছোট ভাই বোন গুলোর কি কান্না!
সেই কান্নায় পাহাড় গলে যায়। গাছের পাতা ঝরে পরে। আর ওদের কি এতটুকু মায়া হয় না?
দিলে রহম নেই? মা-বোন কি নেই ওদের?
ওরা শকুনের দল।
কিনু কতবার ভেবেছে। খোকসায় ওর মামা-মামীর কাছে রেখে আসবে। কিন্তু পরক্ষনেই বাস্তব অবস্থার কাছে করেছে নতি স্বীকার। কারণ সেখানেও তো এই একই অবস্থা। ক্ষুধার্ত হায়েনার দল উদগ্রীব হয়ে আছে।
রাত দ্বি-প্রহর। চারিদিক অন্ধকারের বন্যায় ডুবে গেছে। কোথাও সাড়া শব্দ নেই। সুনসান নিরবতা। নিঃশ্বাস নেয়ার শব্দ শোনা যায়।
হঠাৎ মনে হোলো কে যেন বাড়ীর সদর দরজায় ধাক্কা দিলো। খিল ভেঙ্গে ধপাস করে দরজা খুলে গেল। সেই সাথে দাপদুপ করে কে যেন ঢুকে এলো বাড়ীর ভিতর। একেবারে উঠানের উপর।
কাল বিলম্ব না করে কিনু লাঠি ছুঁড়ে মারে।
সঙ্গে সঙ্গে নিতা দরজা খুলে বটি ছোঁড়ে। চোখের পলকে লাঠি ও বটি লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত হানে।
-"বাবা গো---মরে গেলাম গো" বলে কে যেন উঠানের মাটিতে লুটিয়ে পরে। "পানি পানি" বলে অস্ফুটে আওয়াজ করতে থাকে। এই অস্ফুট আওয়াজ কিনু ও নিরা শুনতে পায়।
-"কীডা,--কীডাগো তুমি"? কিনুর শ'শ ব্যস্ত প্রশ্ন।
-"হ্যাঁ, আ- আ-মি-। আ- আ-মি-জা-মা-ল-। আ-মিম-রে গে-লা-ম। পা-নি--পা-নি-।
এরই মধ্যে নিতা কুপি বাতি জ্বালে।
কিনু বাতি হাতে করে উঠানে আসে। ভীরু পায়ে পাশে নিতাও।
আবছা আলো-আধারিতে দেখে দু'জন। এক যুবক উঠানে পরে কাতরাচ্ছে। পীঠে ঝুলানো কি জানি অস্ত্র। অস্ত্রের গায়ে অনেকগুলো ছিদ্র। অন্য কাঁধে একটি ঝুলি। ঝুলি ভর্তি তামাটে রঙয়ের আঙ্গুলের মত লম্বা ধাতব পদার্থ। বেশ কয়েক কুড়ি উঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরেছে।
-"আহা রে! এ কি? এ কি করলাম? ছাওয়ালডারে মারে ফেললাম।
পানি আনতো মা। অকে বাচাতি হবি। আমি মানুচ হয়ে মানুচ খুন করলাম। আহা রে! না জানি ও কার পুত"।
নিতা এক গ্লাস পানি এনে মুখে ধরল।
ছেলেটি ঢক ঢক করে গ্লাসের সব পানি পান করলো। তারপর অতি মিহি সুরে আস্তে করে বলল," চাচা আমি মুক্তিযোদ্ধা। পাত্রদহ গ্রামে মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমন করতে গিয়েছিলাম। আক্রমণও করি। ওদের অনেক মিলিটারি হতাহত হয়েছে"।
-"তাই নাহি বাপ? তুমি মুক্তি? হায় এডা আমি কি করলাম গো! আমার মনডাতেও কত আশা চিল যুজ্জে যাবার। বয়স্ক মাইয়াডার জন্নিই যাতি পারি নাইরে বাপজি। আর সেই আমিই কিনা তুমারে রাজাকার ভাবি আগাত করলাম। উহু! এ আমি কি করলাম? আমি কি মানুচ, না
পাচান? উহু! এ কি অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস "!
নিতা দেখে তার ছোড়া বটি এখনও পায়ের সঙ্গে আটকে আছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। ভিজে গেছে গায়ের কাপড়। রক্তে রঞ্জিত হয়েছে উঠান। নিতার মনের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। সে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
বাপ বেটিতে দু'জনে ধরাধরি করে জামালের ঘরের মধ্যে আনে।
মেঝেয় খেজুরপাতার পাটির উপর কাঁথা পেতে শুতে দেয়। অতি আস্তে চাপা স্বরে কথা বলে। ছেলেটির সেবা শুশ্রুষা করতে থাকে।
-"তা এদিক আইলে ক্যানে বাজি"? কিনু অতি নিচু স্বরে প্রশ্ন করে।
দরদ ভরা মনের অনাবিল আদর যেন উছলে ওঠে। সে আদর শ্রাবণের অঝর ধারার মত ঢেলে দেয় জামালের সমস্ত শরীরে।
সারা অবয়ব জুড়ে।
-"যুদ্ধ করতে করতে আমাদের গোলা বারুদ ফুরিয়ে যায়। তাই আমরা প্রান বাঁচানোর জন্য যে যার মত পেরেছি। এদিক সেদিক নিরাপদ দূরত্বে ছুটতে থাকি। ওরা সবাই যে কে কোথায় গেল। রিয়াদেরতো হাতে আঘাত লেগেছিল। ও দৌড়ে আসতে পারলো কি না"।
-"নামডা কি যিনি বুললে বাজি "? কিনু অতি আস্তে শীতল কণ্ঠে জানতে চায়।
-"জামাল। ভবানীপুরের আফছার সেখের ছেলে আমি"।
-"ভবানীপুর! সেতো এহান থাহি অনেক দুরি বাজি"!
-"হ্যাঁ, তবে পা চালিয়ে হেটে গেলে আর কতক্ষণ"।
-"হয়রে বাজি, হয়। তয় আমরাতো এহন বয়স্ক মানুচ। আমারে সুমায় এটটু বেশীই লাগবি। কি, ঠিক বুলিনি বাজি "?
-"চাচা, আপনি আমার বটি ছুঁড়ে কেটে দিলেন"? বলেই জামাল ডুকরে কেঁদে উঠলো। চোখে তার সাত সাগরের পানি। টপ টপ করে ঝরে পরছে। ঝরছেতো ঝরছেই। বিরামহীন ভাবে ঝরছে।
সে সঙ্গে নিতার চোখেও হাজার মেঘের বৃষ্টি ধারা। মুখমণ্ডল, বুক ও শাড়ীর আঁচল ভিজে জব জবে।
মানুষের চোখে এতো পানি থাকে? আজ অশ্রু-জলে পৃথিবী ভেসে যাবে নাতো?
নিতার চোখে মুখে একরাশ অনুশোচনা। অকৃত্রিম অপরাধবোধ।
সে ক্ষমা নিতে চায়। কিন্তু এই ছোট্ট কথাটি মুখে প্রকাশ করতেও পারছে না। এ যে কত বড় যন্ত্রনা। কত অসহনীয় অস্থিরতা। তা একমাত্র নিতাই জানে।
এই যন্ত্রনা ও অস্থিরতা শুধু নিতাকেই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
একদিকে মৃত্যু-যম। অন্যদিকে কিনু আর নিতা। মরনের হিম- শীতল দেশে মৃত্যু-যম টানে। আর কিনু নিতা টানে চির সুন্দর পৃথিবীর জীবন-জাগার দেশে।
শেষ পর্যন্ত্য মৃত্যু-যম হার মানে।
জয় হয় বাপ-বেটির।
ওদের মুখে পরম তৃপ্তির অনাবিল হাসির রেখা ফুটে ওঠে। যেন হারিয়ে যাওয়া অনেক সাধের পোষা পাখিটিরে বহুদিন পর এইমাত্র হাতের মুঠোয় ফিরে পেল।
এ সুখের শেষ নেই। নেই কোন অন্ত।
আহত মুক্তি জামালকে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। আর বাপ বেটি বারান্দার বাহির দিকে কাপড় টানিয়ে রাতে ঘুমিয়ে থাকে।
ঘুমতো আর একটুও হয় না।
জামালের সেবা শুশ্রুষায় ব্যতিব্যাস্ত থাকে সারারাত। দুধ গরম করে খাওয়ায়। ক্ষতস্থান পরিস্কার করে দেয়। সময় মত ওষুধ নিয়ে সামনে ধরে।
জামাল প্রীত হয়। মুখে ফোটে একফালি চাঁদের মত নির্মল স্মিত হাসির রেখা।
এই মধুময় হাসি নিতা প্রান ভরে দেখে।
অন্তর দিয়ে অনুভব করে।
বাড়ীর গাছের অনেক মৌসুমি ফল ঘরে ছিল। ওগুলো থেকে ভালো পাকা ও মিষ্টি ফল বেছে বেছে নিতা জামালকে খেতে দেয়। জামাল তা আগ্রহ ভরে হাতে তুলে নেয়। আস্তে আস্তে চিবিয়ে খায়।
এ দেখে নিতার আনন্দ হয়। ভাললাগে।
বিকেলে দুধের গ্লাস হাতে দিতে অসাবধানতায় জামালের হাতের ছোঁয়া লেগেছে। মুহূর্তের মধ্যেই নিতার সারা শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। সে আলোড়িত হয়। শিহরিত হয়। হয় পুলকিত।
শীতের জীর্ন মরা নদীতে বান ডাকে। মনের নদীতে উথাল পাথাল
ঢেউ জাগে। কুলু কুলু ছন্দ তুলে অনুরাগের বানী ফোটে। সে আবেশে বিভোর হয়।
-"আপনার নাম কি"? ছোট্ট করে বলে জামাল জানতে চায়।
-"নিতা"। ঠিক জামালের সুরে সুর মিলিয়ে ছোট্ট করে উত্তর দেয়।
- "বাহ! খুব সুন্দর নামতো। ভারী মিষ্টি"।
-"সুন্দর না ছাই। পচা নাম"। বলে লাজে মাথা নিচু করে থাকে।
-"যাবেন আমার সঙ্গে "?
-"কোথায়"?
-"যুদ্ধে। কত মেয়েইতো ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। সেবা শুশ্রুষা
করছে আহত যোদ্ধাদের। ক্যাম্পে রান্না করে দিচ্ছে কেউ। কেউ রেকি করে। শত্রুদের অবস্থানের
সঠিক তথ্য দিয়ে কেউ করছে সহায়তা"।
-"আমার যে ভয় করে"।
-"ভয় কিসের? আমি আছি নছ"?
-"সত্যি"?
খুশী আর লজ্জা মাখা হাসি হেসে দৌড়ে পালায়।
তার চোখে মুখে, সারা অঙ্গে আজ এত লজ্জা কেন? শরীরে জড়ানো শাড়িখানাও কি আজ ছোট হয়ে গেল? এত লজ্জা আজ ঢাকে সে কি দিয়ে? রাখেইবা সে কথায়?
জামাল একটু সুস্থ বোধ করছে।
তবে পুরোপুরি না।
তবুও সন্ধ্যা রাতে মিলিটারি ও রাজাকারদের অবস্থান রেকি করতে জানিপুর বাজারে যায়।
অলংকারের দোকানের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়।
একছড়া হারের উপর আটকে যায় তার চোখ। বিদ্যুতের আলোয় হার ছড়া ঝিকমিক করছে।
আহ! কত সুন্দর। পাথর কুচির হার। প্রতিটি পাথর থেকে লাল, নীল, হলুদ, কমলা, সবুজ, বেগুনী, আসমানি ও ফিরোজা রং বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তাজমহলের পাথর কি এর থেকেও সুন্দর? প্রানবন্ত? হৃদয়গ্রাহী?
হারটি কিনে সে পকেটে রাখে। কেমন যেন অন্য রকম ভালোলাগা ভালবাসায় বুক ভরে যায়।
দ্রুতপদে বাড়ী ফিরে আসে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে। কিনু চাচা বারান্দায় নেই। হয়তো গরু দু'টির খাবার দিতে গেছে। কিম্বা প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে
জামাল অতি সন্তর্পণে নিতুর কাছে চলে যায়। পিছন হতে চুপিসারে নিতার গলায় পরিয়ে দেয় পাথর কুচির হার।
নিতা চমকে ওঠে। ছোট্ট পাখির ছানার মত তার বুক ধর ফড় করতে থাকে। ঘটনার আকরসিকতায় সে হতবিহবল
বিহ্বলতায় কেটে যায় কিছু সময়।
তারপর খুশি আর লজ্জার মাঝখানে দাঁড়িয়ে উপর পাটির দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ায় কিছুক্ষণ। অস্ফুটে বলে ওঠে,--"কে"?
-"চোর"।
-"চোর না, চোর না, ডাকাত। চোরেতো সামান্য কিছু চুরি করে। আর ডাকাত সব কিছু লুটে নেয়"। বলে ছোট্ট করে জবাব দিয়ে এক দৌড়ে পালিয়ে যায়।
সুস্থ হয়ে উঠেছে জামাল। এবার যুদ্ধ ফ্রন্টে ফিরে যেতে হবে। তার আগে নিতাকে সে বিয়ে করে যেতে চায়।
একথা কিনু শোনে।
দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি এবং তার শরীরের দুর্বল অবস্থার কথা চিন্ত । করে সে রাজি হয়ে যায়। সে ভাবে। তার মরার আগে অন্তত মা মরা মেয়েটার একটা গতি হোক। ঘর বর হোক।
পরের রাতেই অতি অনাড়ম্বরভাবে দু'জনের বিয়ে হয়ে যায়। মৌলবি হিসেবে বিয়ে পড়ায় তোফাজ্জেল মোল্লা। উকিল সাক্ষী হয় পাশের বাড়ীর জলিল ও সিদ্দিক।
মেয়েকে পাত্রস্থ করে কিনু খুশী হয়। সে মহান আল্লাহ্র দরবারে শত কোটি শুকরিয়া বলে। দু'রাকাত শুকরিয়া নামাজ পড়ে।
কয়েকদিন শ্বশুর বাড়ীতেই লুকিয়ে থাকে জামাল। বেশ আমোদ আহ্লাদেই কাটতে থাকে দিন শ্বশুর ও নব পরিণীতা বধূর আদর সোহাগে মন ভরে যায়।
এদিকে মেয়ের মুখে একরাশ অনাবিল হাসি খুশী দেখে কিনুর মন ভরে যায়। তার মনে হয়, হারিয়ে যাওয়া অনেক সাধের পোষা পাখীটিরে অনেকদিন পর হাতের মুঠোয় ফিরে পেয়েছে আজ।
এক সপ্তাহ পর।
রাতের আঁধারে নিজেকে লুকিয়ে মা, মাটি, মাতৃভূমি ও স্বাধীনতার ডাকে জামাল যুদ্ধ-ফ্রন্টে চলে যায়। এটা তার গুরু দায়িত্ব। সবার আগে করণীয় কর্তব্য।
পিছনে রেখে যায় বাপ- মা, ভাই-বোন, স্ত্রীয়-স্বজন, শ্বশুর ও নব পরিণীতা বধূ নিতাকে।
কথায় বলে দেয়ালেরও কান আছে। সূর্য উঠলে পৃথিবী আলোয় ভরে।
চাঁদে জোছনা ঝরে। বিনা মেঘেও বজ্রপাত হয়।
সারা গ্রাম রটে গেল। কিনুর ঘরে জোয়ান পোলা থাকে। সে মুক্তি। এ কান ও কান হতেহতে কথাটা চ্যালা রাজাকারদের কানেও যায়। নিতা ও কিনুর প্রতি আগে থেকেই রাগান্বিত ছিল। নিতা তাদের কু-প্রস্তাবে সারা দেয়নি। পুরন করেনি তাদের মনস্কাম। এটা কি কম অপমানের, কম লজ্জার কথা!
আগুনে ঘি ঢালা হল।
বিষয়টি চেয়ারম্যানকে জানালো ওরা।
-"কি-----? কি কইলি তরা? আমার তল্লাটে মুক্তি? আর কিনু
বুড়ো আমার ইচ্চের কোন মূলই দিলো না? আমি বুড়োর কদমবুছি করলাম। দেখে নিবানে"। চেয়ারম্যানের সে কি
গুরু-গম্ভীর হুংকার।
পরদিন চেয়ারম্যান শহর থেকে মিলিটারি ডেকে আনল। তাদের মুখে একটাই বুলি,-"মুক্তি কাঁহা হ্যায়। মালাউন কাঁহা হ্যায়"?
সারা গ্রাম পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দিলো। ঘর বাড়ী, খড়ের গাদা পুড়ে শেষ। যাকে যেখানে যে অবস্থায় পেল। তাকেই গুলি করে মারল।
কিনুর কাছ থেকে মুক্তি সম্পর্কে কোন তথ্য না পেয়ে ক্ষেপে যায়। তাকে হাত পা বেঁধে আগুনে ফেলে দেয়। পুরে ছাই হয়ে যায় কিনু।
সবুজ গ্রাম খানি বিলীন হয়ে গেছে। শুধু ছাই আর ছাই। লাশ আর লাশ। রক্তে মাটি লাল।
কত মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম লুট করেছে পৈশাচিক কামনায়। ধরে নিয়ে গেছে কত যুবতী মেয়ের। কত কূল বধূর। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কত ছাত্রীর।
নিতার ভাগ্য ভাল। মিলিটারি আসার আভাস পেয়েই পাশের ঘন জঙ্গলে চলে যায়। ভাঙ্গা কবরের গর্তের মধ্যে ঢুকে পরে। উপরে লতা-গুল্ম দিয়ে ঢেকে ফেলে। সারাদিন ভাঙ্গা কবরের ভিতর এভাবেই থাকে নিজেকে লুকিয়ে।
রাত বাড়লে উঠে এসে দেখে সব শেষ। আদরের পিতা লাশ হয়ে পরে আছে। মগজ বেড়িয়ে গেছে। তার বিয়ের মৌলবি সাক্ষী উকিল বেঁচে কেউ নেই।
সবাই নিরব, নিথর। চলে গেছে না ফেরার দেশে।
ক্ষুধায় ক্লান্ত- অবসন্ন নিতা একা হয়ে যায়। সে কিছুক্ষণ প্রান ভরে কাঁদে। তারপর কোদাল আনে। অনেক কষ্টে কবর খোঁড়ে। গর্তের মধ্যে বাবার লাশ গড়িয়ে দিয়ে কোনোমত মাটি চাপা দেয়।
তারপর রাতের আঁধারেই অজানার উদ্দেশে পা বাড়ায়।
অনেক দূরে চলে যায়।
তাকে বাঁচতে হবে। জামাল যুদ্ধ থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে তাকে পাগলের মত খুঁজবে।
সন্ধ্যায় আশ্রয় জোটে এক বৃদ্ধা মহিলার বাড়ী। উনার কেউ নেই। মিলিটারিরা স্বামী ও পুত্রদের গুলি করে মেরেছে। ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে অষ্টাদশী মেয়েটাকে। এই মেয়ের জন্যই আশায় বুক বেঁধে আছে। যদি সে ফিরে আসে।
বৃদ্ধা মহিলা বলতে গেলে স্বচ্ছল। সবই আছে তার। ক্ষেতের ধানের ভাত, পুকুরের মাছ আর নিজের পালন করা গাভীর দুধ খায়।
নিতাকে পেয়ে এবং তার সব কথা শুনে উনার মাতৃত্ব জেগে ওঠে। পরম আদরে বুকে টেনে নেয়। মেয়ে বলে সম্বোধন করে। ওর মধ্যে নিজের মেয়ের অনুপস্থিতি ভুলতে চায়।
নিতা বৃদ্ধা খালা বলে ডাকে।
সময় পেলেই নিতা তার জীবনের নির্মম, নিদারুণ সত্য ঘটনা খুলে বলে। খালা তাকে বলে ধৈর্য ধরতে। সান্ত্বনা দেয়। নিতার সব জ্বালা যন্ত্রনা, দুঃখ কষ্ট আদর সোহাগে মুছে দিতে চায়।
তার সব মায়া মমতা ঢেলে দিয়ে বুকের মধ্যে চেপে ধরে।
একদিন নিতা দেহের ভিতর নতুন প্রানের অস্তিত্ব অনুভব করে। অন্য রকম অনুভূতি স্পন্দিত হয়। কচি কণ্ঠের মা ডাক শুনতে পায়। নব অতিথি চীৎকার করে বলছে- 'মা আমি আসছি'।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-লজ্জা-ভয়ে নিতা মূর্ছা যায়।
নিতা বৃক্ষটি অঙ্কুরেই উপড়ে দিতে চায়।
সাহস হয়না।
এ যে তার স্বামী জামালের দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। স্বামীর আমানত। স্বামীর আমানত রক্ষা করার পবিত্র দায়িত্ব স্ত্রীর। তাই সে অপারগতা প্রকাশ করে। হেরে যায়।
খালার মাধ্যমে নিতা সন্ধান পায় পাশের বাড়ীর এক মুক্তিযোদ্ধার।
এই মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে জামালকে চিঠি লিখে সব জানায় নিতা।
জামাল খুশী হয়।
পরদিনই ছেলেটির দিয়ে উত্তর লিখে পাঠায়।
প্রিয়তমা নিতা,
সব জেনে খুশী হয়েছি। আমাদের ভালবাসার স্মৃতি চিহ্ন হয়ে যে আসছে, সে সত্য, পূত-পবিত্র। সে বাঞ্ছিত। তুমি ওকে যত্ন করো। লালন পালন করো। ছেলে হলে নাম রাখবে বিজয়। মেয়ে হলে মুক্তি। যুদ্ধ শেষ হলেই আমি চলে আসবো। স্বাধীন দেশের মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেব। পত পত করে লাল সবুজ পতাকা উড়া দেখব। আর সেই আনন্দের সঙ্গে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরবো। অনেক আদর করবো। অনেক অনেক। ভালো থেকো।
ইতি জামাল।
চিঠিখানা নিতা শতবার পড়ে। চুমু খায়। বুকে জড়িয়ে ধরে। খালাকে পড়ে শোনায়। দু'জনার চোখেই বাঁধ ভাঙ্গা বন্যা। দু'জনেই আবেগে উদ্বেল।
এক ভোরে ইরার জন্ম হয়।
নিতা শত দুঃখ কষ্টের মাঝেও লালন পালন করতে থাকে।
৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হয়। বাতাসে লাল সবুজ পতাকা উড়ে। জাতি পায় সার্বভৌম স্বাধীন একখণ্ড ভূখণ্ড। একটি স্বতন্ত্র জাতীয় সঙ্গীত।
কত মুক্তিযোদ্ধা ফিরে আসে। তাঁরা আবার নতুন করে নতুন স্বপ্ন বুকে নিয়ে পথ চলা শুরু করে।
জামাল আসবে বলেও আসছে না।
কিন্তু নিতা তার আশা পথ চেয়ে আছে। কখন আসবে। কখন তার আমানত তার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে নির্ভার হবে। কখন স্বামীর বুকে মাথা রেখে মোমের মত গলে যাবে?
ইরার ধারনা মায়ের এত কান্না, এত দুঃখ কষ্টের কারন ঐ বাক্স। তাই একদিন সত্যি সত্যিই বাক্স ভাঙ্গে। বাক্সের ভিতরে একটি পাথর কুচির হার আর একখানা জীর্ণ মলিন চিঠি পায়।
চিঠিখানা অনেক দিনের পুরনো। ভাজ পরে চার খণ্ড হয়ে ছিঁড়ে যাবার উপক্রম। অনেক যত্নে সেটিকে সুস্থ শরীরে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা।
চিঠিখানা এক নিমিষে পড়ে ফেলে। মূল সত্য উদঘাটন করে চীৎকার দিয়ে ওঠে। কান্নায় ভেঙ্গে পরে। দু'চোখে অশ্রুর বন্যা বয়ে যায়।
-"মা----মা। তুমি খুনি। তুমি নিষ্ঠুর। কেন এমনটি করলে তুমি---তুমি "?
মেয়ের চীৎকারে মা সম্বিত ফিরে পায়।
৭১ থেকে বর্তমানে এসে হুঁচোট খায়। দেখে মেয়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। কি হোল তার আজ?
-"কি মা? কি হয়েছে"? বলে নিতা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
-"মা আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান? এই সত্য সুন্দর কঠিন সত্যটিকে তুমি এতদিন বাক্সে লুকিয়ে রেখেছ? তুমি আমার গর্বকে হত্যা করেছো। তুমি আমার অহংকারকে হত্যা করেছো"।
-"থামো মা, থামো। তুমি শান্ত হও"। মায়ের অশ্রু ভেজা আকুতি।
-"জানো মা, আমার সহপাঠিদের মধ্যে অনেকেই বলে আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। মুক্তিযোদ্ধার নাতি- নাতনী। আমি চুপ থাকি। আমিও কত ইচ্ছা করি, আমার যদি কেউ মুক্তিযোদ্ধা থাকতো তাহলে গর্বের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে বলতামআমিও মুক্তি পরিবারের সন্তান।
-"থামো মা, থামো। চুপ করো একটু শান্ত হও।- "
-"কেন তুমি এমনটি করলে মা? আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা? বাবার বুকের রক্তে রজ্জিত হয়ে ঐ পতাকা লাল! ঐ জাতীয় সঙ্গীতে আমার বাবার আত্যাগ, নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টা জড়িত। এই দেশ, এই মাটি আমার বাবার রক্তে কেনা? তুমি আমার এই সুমধুর সুখ থেকে বঞ্চিত করেছো মা। গলা টিপে হত্যা করেছো আমার স্বপ্ন ও আবেগকে। কেন---কেন এমন করলে----?
- "ভয়ে। যদি তুমি ভুল বুঝতে? যদি---আমাকে দ্বিচারিণী ভাবতে "?
-"না মা, না। এটা তোমার ভুল ধারনা। আমার মাকে আমি চিনি"।
এ দেশের আকাশ-বাতাস, ফুল-পাখি, সবুজ প্রকৃতি, ফসলের মাঠ, সুন্দর পরিবেশ... সবই আমার বাবার দান। সব কিছুতেই আমার বাবার ছোঁয়া। সব কিছুতেই আমার বাবা মিশে আছে। তোমরা সবাই শুনে রাখো, আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আজ থেকে আমি ইরা নই। আমি মুক্তি। আমার নাম মুক্তি।
দু'জন দু'জনের জাপটে ধরে আছে।
দু'জনই অশান্ত, অস্থির, বেসামাল, উন্মাতাল।
বুকে কাল বৈশাখীর ঝড়ের তাণ্ডব। চোখে মুখে মেঘ-বাদলের মৌসুমি। আষাঢ় শ্রাবণের অঝর ধারাপাত।