মুক্তিযুদ্ধের ছোট গল্প: রক্তসূর্য। গোলাম সরোয়ার সলোক। muktijuddher golpo Rokto-Surjo

রক্তসূর্য

গোলাম সরোয়ার সলোক 




কার্তিকের মাঝামাঝি।

রাত দ্বি-প্রহর।

ভরা পূর্ণিমা।

চাঁদের কলস ভেঙ্গে জোছনার জল গড়িয়ে পরেছে। সেই জোছনায় মাঠ, ঘাট, প্রান্তর ডুবে গেছে। সমস্ত প্রকৃতি জোছনায় ঢাকা পরেছে।

মতিজানের ছোট্ট উঠোনটিও বাদ পড়েনি। সারা উঠোন জুড়ে বিপুল বিশাল জোছনা জলরাশির বান ডেকেছে। হাসনাহেনার গন্ধে ভেজা রাতের নির্জনতা। মহুয়ার নেশায় মাতাল পক্ষীকুল আর বৃক্ষলতা। চাঁদের আলোয় ভেজা ঘুমন্ত প্রকৃতি। বড়ই সুন্দর। অন্যরকম আবেশ জাগানো।

মতিজান এক চিলতে সুখ বুকের ভিতর আঁকড়ে ধরে। চাঁদের আলোয় টইটুম্বুর উঠোনের দিকে চেয়ে থাকে। বারান্দা ছেড়ে, উঠোন ছেড়ে, তার আরও দূরে চোখ যায়। বটগাছ, বাবলাগাছ ছেড়ে খোলা মাঠের পানে।

মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প রক্তসূর্য
মুক্তিযুদ্ধের গল্প: রক্তসূর্য। গোলাম সরোয়ার সলোক 


চাঁদনী রাতে গাঁও গেরামের গাছ-গাছালিকে তাঁর কাছে বিশাল বিশাল বৃক্ষের মত মনে হয়।

মতিজানের বাড়ীর চারপাশে বেশ বড় বড় কটি আম গাছ, জাম গাছ, নিম গাছ। এই গাঁয়ে প্রতি বাড়ীতেই এমন বড় বড় গাছ আছে।

আজকের চাঁদের আলো যেন সেই সব গাছের পাতা আর ফল ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঝরছে বৃষ্টির মত অঝর ধারায়।

আজ কেমন যেন হু হু করে ওঠে মতিজানের বুকের মধ্যে।

আর তখনই ঘরের মধ্যে মেঝেয় শোয়া সমর- মতিজানের নাড়িছেঁড়া ধন, নয়নের মনি কেঁদে ওঠে।

-"এযে বাজান আমি। কাঁদেনা, কাঁদেনয়া,"-- বলতে বলতে মতিজান ঘরের ভিতর ঢোকে। তাড়াহুড়ো করে সমরকে কোলে নেয়। মাতৃেেহর ফলগুধারায় ভিজিয়ে আদর করতে থাকে।

-"বাপ চায়ি দ্যাক, চৌদিকে কেমন ধবধবে জুচনা। এই জুচনায় গতর ভিজায়ি আইজ তুর বাপ আসপিনি"। মতিজান আবেগে আপ্লুত হয়।

স্নেহাবেশে আত্মজকে বুকে চেপে ধরে।

গাঁও-গেরামে রাত একটু বাড়তে না বাড়তেই চারিদিকে নীরব হয়ে যায়। যেন সমস্ত প্রকৃতি ঘুমে অচেতন।

দূরে' বহুদূরে' হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া' করে শিয়াল ডেকে ওঠে। অমনি সঙ্গে সঙ্গে এক পাল কুকুরের'ঘেউ ঘেউ চিৎকার শোনা যায়।

মতিজানের বুক ধক করে ওঠে।

সারা শরীরে শিহরণ জাগে-'ঐ বুঝি এলো'!

আজ সন্ধ্যা থেকেই যার জন্যে মন উচাটনসেই প্রান প্রিয় স্বামী বুঝি এলো। এলো তাঁর বংশের প্রদীপ, কলিজার টুকরা সমরকে দেখতে।

জাগলবার গাঁও তো আর গাঁও নেই। যেন শ্মশানপুরীতে পরিণত হয়েছে। পীচ কমিটি আর রাজাকার, আল-বদরের অত্যাচারে মানুষ একে একে গাঁও ছাড়া হয়েছে।

কিন্তু মতিজান কোথায়ও যায়নি।

আর সে স্বামীর ভিটে-মাটি ছেড়ে যাবেই বা কি করে! তাইজুদ্দিন যে তাঁকে রেখে গেছে। স্বামী তাইজুদ্দিন যুদ্ধে যাবার সময় বলে গেছে,-"মতি তুই কুতাও যাইস নে। বুল যাবিনানে? আমি শিগগির ফিরে আসপোনে"।

-"মোরে যে ডর করবেনে"। মতিজান বলেছিল।

-"ডর কিয়ের? মুই তো শগুণ গুলানরে তাড়াতিই যাচ্ছি। তুই রাইতে গরে খিল আঁটি দিয়ে শুয়ি থাহিস। মুই তুর আশেপাশেই থাকবোনে"।

বোশেখ মাসে গাঁয়ে মিলিটারী আসে।

ওদের মুখে শুধু বুলি,-"মুক্তি কিধায় হ্যাঁয়? মুক্তি কাঁহা হ্যাঁয়? লাড়কি কাঁহা হ্যাঁয়? আনকোরা চিজ আওরত কাঁহা "?

মুক্তি সন্দেহ করে গ্রামের জোয়ান জোয়ান সব ছেলেকে এক লাইনে দাঁড় করে গুলি ছুঁড়ে মারে। গ্রামের শুকনো মাটি রক্তে ভিজে।

সকল বাড়ী ঘরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। ধুঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে আগুনের লেলিহান শিখা সব গ্রাস করে। সমস্ত কিছু পোড়া শেষ হলে এক সময় নিভেও যায়।

পড়ে থাকে পোড়ামাটি।

লাশের গন্ধে বাতাস ভারী হয়। শিয়াল কুকুরে তা খুটে খুটে খায়।

এতো কিছুর পরও মিলিটারিরা জাগলবার ছাড়ে না। গ্রামেই ক্যাম্প করে থাকতে শুরু করে। তাঁরাই পীচ কমিটি, শান্তি কমিটি বানায়। রাজাকার, আলবদর, আলসামস গঠন করে।

ওরা নিজেদের স্বার্থে কাউকে শান্তি বাহিনীতে, আবার কাউকে রাজাকার, কাউকে আলবদর, কাউকে আলসামস বাহিনীতে ভর্তি করে নেয়।

মুকশিদপুরের নুরুল ইসলাম হয় সেই পীচ কমিটির চেয়ারম্যান।

পাকিস্তানি আর্মির মেজরের সাথে তাঁর ভারী সখ্যতা। এক সঙ্গে সব সময় উঠ-বস। মূলত এজন্যই নুরুল চেয়ারম্যানের প্রচণ্ড দাপট। তাঁর ইঙ্গিতেই খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, লুটতরাজ, অপহরণ হয়।

সে তার গুন্ডা বাহিনী দিয়ে এই সব নানা অপকর্মের মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়ে।

অন্যদিকে মিলিটারীদের নেক-নজরে কত কিছুই করে সে। লুট করা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী ক্যাম্পে পাঠায়। গ্রামের লোকের পুকুর সাবাড় করে। বিক্রি দিয়ে নিজের পকেট ভরে। চেলাপুলাদের দেয়। ক্যাপ্টেন মেজরের নজরানা পাঠায়। বড় বড় রুই, কাতল, চিতল, বোয়াল।

মনোরঞ্জনের জন্যে সুন্দরী যুবতী ধরে নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পে সাপ্লাই দেয়। প্রতিদিন মেজরের নতুন নতুন আনকোরা চিজ চাই। জোগানদার নুরুল চেয়ারম্যান।

এই শকুন চেয়ারম্যানই তো মতিজানের চাঁদের মত জীবনে কলংক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে।

ফটিক নামের এক সহযোদ্ধার দিয়ে ক'দিন আগে তাইজুদ্দিন খবর পাঠিয়েছে। বলেছে ছেলেকে এক নজর দেখতে আসছে সে।

বৈশাখে তাইজুদ্দিন যখন যুদ্ধে যায়, সমর তখন আট মাসের পেটে।

সমরের জন্মের পর থেকেই তাইজুদ্দিন শতবার চেষ্টা করেছে ছেলেকে দেখে যাওয়ার জন্য।

কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে বাড়ী আসতে পারেনি। সব সময় নতুন নতুন যুদ্ধ ফ্রন্টে যুদ্ধে ব্যাস্ত থাকতে হয়েছে।

পশ্চিমা মিলিটারীর ভয় তো আছেই।

তাঁর উপর রাজাকার, আলবদরের বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রানে মেরে ফেলানোর মত নিষ্ঠুরতার ভয়ে সে বাড়ী মুখো হতে পারেনি।

বুকের মধ্যে ধরা সমর আবার কেঁদে ওঠে।

মতিজান আদর করতে থাকে।

ঘুম পাড়ানোর জন্য সে উঠোনের উপর হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। এক সময় ঘুমিয়ে পরে ছেলে।

তাঁকে ঘরে শোয়ায়ে রেখে মতিজান উঠোনে এসে দাঁড়ায়।

তাঁর চোখে আজ ঘুম নেই। প্রতীক্ষার প্রহর বুঝি শেষ হতে যাচ্ছে। হয়তো এখনই তাঁর স্বামী তাইজুদ্দিন এসে যাবে!

'প্রতীজ্ঞা করেছে তাইজুদ্দিন। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মাটিতে দাঁড়িয়েই সে তাঁর শিশু পুত্রকে কোলে তুলে নেবে। নিভৃত নির্জনে অবসর মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী মতিজানের খোঁপায় আদর করে গুঁজে দেবে লাল টকটকে কৃষ্ণচূড়ার গুচ্ছ। এ দৃশ্যটি মতিজান চোখ বন্ধ করে মানস নয়নে দেখতে পায়।

মতিজানের ভাল লাগে। মা-মাটি-দেশ ও দেশের-স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধে যাওয়াটা যে এতো আনন্দের। তা আগে জানতো না সে।

হটাৎ করে শেয়াল ডেকে ওঠে। সাথে সাথে কুকুরগুলোও ঘেউ ঘেউ শুরু করে।

মতিজানের দেহের বাঁকে বাঁকে ঢেউ জাগে। অন্যরকম অনুরাগে। সে কান খাড়া করে।

এদিক ওদিক সন্ধানী চোখে তাকায়।

-"বাড়ীতে কেউ আছস "?

অন্যরকম কণ্ঠস্বরে মতিজান বুঝল কেউ কিছু খুঁজতে এসেছে! পীচ কমিটির চেয়ারম্যান আর তাঁর রাজাকার, আল-বদররা নয়তো! মতিজানের গলাটা কেমন জানি শুকিয়ে আসতে লাগলো! যদি সত্যি সত্যিই শকুনগুলা আসে? এতো রাতে একা মেয়ে মানুষ। কি করবে সে?

-"কে আছস বাড়িতি? কতা কস্থ না কেনে"? আবার সেই ডাক। সেই কণ্ঠস্বর।

মতিজান দেখে উঠোনের ওদিকে দশ/ বারো জন লোক এসে গেছে। মাঝে নুরুল চেয়ারম্যান। এতক্ষণে শোরগোল শুরু করে গেছে। ও-দের

ডাকাডাকিতে রাতের ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

-"কই তাজু? বেড়ি আয়। তুই বাড়ী আইছ'স আমরা শুনিছি "।

মতিজান ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়।

চোখের সামনে সে রোজকেয়ামত দেখতে পায়। এখুনি হয়তো সাংঘাতিক একটা মহাপ্রলয় ঘটে যাবে।

সে এখন কি করবে! কেমন করে এই শকুনদের হাত থেকে বাঁচবে? ভিতরে ভিতরে খুব অসহায় বোধ করতে থাকে।

ও-দিকে মতিকে দেখে শকুনের দল এক সঙ্গে চিৎকার করে উঠলো। চেয়ারম্যান সাঙ্গ পাঙ্গদের থামতে বলে। মতিজানের দিকে বন্য চোখে চেয়ে কয়,-"হুনলাম তাইজুদ্দি আইছে"?

মতিজান কোন কথা না বলে ঘুরে দাঁড়ায়।

-"কিরে "?

চেয়ারম্যান পুনরায় বলে,-"ভারী দেমাক হইছে, না"?

মতিজানের চুপচাপ থাকতে দেখে চেয়ারম্যান চিৎকার করে বলে,-"এই শয়তানী, বড় বাড় বেড়েচিস, না? ভালা চাইস তো তাজুরে বাইর করে দে"।

-"সে আহে নি "।

-"আহেনি মাইনে? অবশ্যিই আইছে। আমরা জানিছি"।

-"বুল জানিছো তুম-আপনিরা। হে আহেনি"।

-"বজ্জাত মাইয়া। শুদু মিছি কতা কয়"।

-"হারামজাদির চুল ধরি ঘরে নিয়ি চল? চেয়ারম্যান চেলাপেলাদের নির্দেশ দিয়ে বলে।

-"তুম- আপনিরা গরে যায়া দেহোনা"।

মতিজান ভয়ে দু'পা সরে গিয়ে বলে। বুকখানা তাঁর জলি কলার পাতার ন্যায় কাঁপতে থাকে। জোছনালোকিত রাতেও চোখে অমাবস্যার অন্ধকার দেখে সে।

মতির মনে পড়ে যায় ঐ রাতের কথা। তাঁর দুধের মত ধবধবে জীবনে কালিমা লেপনের রাতের কথা।

ঐ রাতেও তো'ওক্স এমন করেই ডেকেছিল।

রাতের আহার শেষে ঘুমিয়ে পড়েছিল তাজু আর মতি।

হঠাৎ মাঝরাতে'ওক্স উঠোনের উপর দাঁড়িয়ে হাঁকাহাঁকি-ডাকাডাকি করতে থাকে। ও-দের ডাকে তাজু-মতি দম্পতির কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভয়ে পাথরের মত শক্ত হয়ে তাজুকে বুকের মাঝে জাপটে ধরে। কাছে টেনে ধরে মতি বলেছিল,

-"উরা তুমায় ডাহে কেনে গো"?

-"কি জানি! ছাড়তো। দেহি কিডায় ডাহে"।

-"না, যেইও না। যুদি কিচু এডডা কইরে বইসে----তাইলে কি হবিনি"?

তাজু জোড় করে মতিজানের বাহুর বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। তারপর বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। তাঁর সাথে সাথে মতিজানও আসে।

দেখে উঠোনের উপর আলো-আঁধারিতে কুজন মানুষ। মতিজান চিনতে পারে ওদেরকে। ওরা পীচ কমিটির চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম। সঙ্গে রাজাকার গোলাম আলী, আলফাজ, হামিদ, রতন ও কালু।

"তাইজু চলো, আমাগো লগে ক্যাম্পে যেতি হবি "। দীর্ঘ টেনে টেনে চেয়ারম্যান বলে।

-"কেনে যেতি হবি "? ভয়ার্ত কণ্ঠে তাজু বলে ওঠে।

-"মেজর সাইবে যেতি কইছে"।

-"না আমি যেতি পারুমনানে। কি জন্যি যেতি হবি"।

-"না, তোর যেতিই হবি। মেজর সাবের ডাক। স্বয়ং যমেও ফিরাতি পারে নারে তাজু। আর তুইতো কোন ছাড়"।

-"আমি কোন সাতে/পাঁচে নিই। তাই ক্যাম্পে যাওনের দরকার নিই "। ভীত সন্ত্রস্ত কাঁপা কণ্ঠে বলে তাজু।

-"বুললিই হোল? যেতিই হবি তোর। তুই যাবিনা? তোর বাপে যাবে"।

ধমকের স্বরে চেয়ারম্যান বলে। সেই সাথে সে তাঁর চামচাদের ইশারা করে। চোখের পলকে তাঁরা দু'দিক থেকে তাজুকে পাঁজাকোলা করে চেপে ধরে।

এদের মধ্যে একজন চড়া সুরে বলে ওঠে,-"চোল শালা, চোল। তাড়াতাড়ি ক্যাম্পে চোল"। গোয়িন্দাগিরি করোস? টিকটিকিগিরি ছুটায়ে দিবানে। শালা, মুক্তিরে ইনফরমার হইচু "?

তারা একরকম জোর-জবরদস্তি করেই তাজুকে টেনে হিঁচড়ে ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

তিন দিন পর তাঁকে বাড়ীর সামনে ফেলে রেখে যায়। সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত। আধমরা অচেতন অবস্থায়।

সমস্ত গায়ে অমানুসিক নির্যাতনের চিহ্ন। ফোলা সারা শরীর। গায়ে অসহ্য যন্ত্রনা। দুই/তিন দিন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কাটে।

এই অবস্থায় তাজুকে নিয়ে মতিজান আর যমের টানাটানি শুরু হয়।

এক পর্যায়ে মতিজানই জিতে যায়। হার মানে যমরাজ। তাজু মুদিত আঁখি সামান্য একটু মেলে চায়।

মতিজানের নিদ্রাহীন ক্লান্ত, অবসন্ন চোখে-মুখে অনাবিল হাসি ফুটে ওঠে।

কিন্তু সে হাসি মুহূর্তের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর ভয়ের মাঝে হারিয়ে যায়। তাজুর মুখে অস্ফুট স্বরে'যুদ্ধে যাৱ কথা শুনে।

মাত্র তিন দিন মিলিটারী ক্যাম্পে ছিল তাজু। তাঁর সমস্ত শরীরের উপর দিয়ে যে অমানুষিক মারপিট, অত্যাচার, নির্যাতন চালানো হয়েছে। তা বলে শেষ করা যাবেনা।

পায়ে দড়ি বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে জিকের নলা বা ডাল দিয়ে পিটানো। বস্তার ভিতরে ভরে বস্তার মুখ বেঁধে বারংবার পুকুরে ডুবানো চুবানো। ইলেকট্রিক শক দেয়া। বাথটাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ফুটন্ত গরম পানিতে জোড় করে বসিয়ে রাখা। সারা শরীরের উপর আট/ দশ জন চড়ে বুট দ্বারা পেষা। শোয়ায়ে নিয়ে শরীরের উপর নিচে বাঁশ দিয়ে তাঁর দুই প্রান্তে লোক উঠে চাপ দেয়া। শোয়ায়ে চোখে মুখে কাপড় বেঁধে গরম পানি ঢালা। চামড়া ছিলে লবন দেয়া। প্লাস দিয়ে চেপে চেপে হাত-পায়ের নখ তুলে ফেলা। সমস্ত গিঠে গিঠে বেতের লাঠি দিয়ে সপাং সপাং অকথ্য বাড়েনো। উল্টাভাবে চেপে ধরে হাত-পায়ের আঙ্গুল ভেঙ্গে দেয়া। সারাক্ষন নিদ্রাহীন অবস্থায় রাখা। জ্বলন্ত সিগারেটের সেঁকা দেয়া গায়ে। পিপাসার পানি চাইলে পেসাব দেয়া। আরও কত রকমের অত্যাচার! উঁহু ! কি মর্মান্তিক! মনে হলেই গা শিউরে ওঠে।

তাজু মাত্র তিন দিন ছিল। এই তিন দিন গেছে তাঁর তিনটি যুগের মত। তাতেই জেনেছে অনেক কিছু সে।

রাতে পাশের কক্ষে শুনেছে যুবতী মেয়ের গগনবিদারী চিৎকার-গোঙ্গানী। দলিত মথিত ও বিধ্বস্ত হওয়ার বিকট আর্তনাদ। সেই সাথে শকুনদের পৈশাচিক অট্টহাসি।

আর দু'একটি টুকরো কথাবার্তা। "চিজ বহুত খাসা হ্যাঁয়। একদুম আনকোরা হ্যাঁয়। বহুত মজা হ্যাঁয়"।

-"দোহাই আপনেগো, মুইরে বেআব্রু কইরেন না। আপনে আমার ধম্মের বাপ। তারছে মাইরে ফ্যালান। মরিতি চাই----তবু---"।

কে শোনে কার কথা।'

ওরে বাব। ওরে মা। আর পারিনে। মরে গেলাম"। এই সব চিৎকারের মাঝে মিশে যায় ধস্তাধস্তি আর কাঁচের চুরি ভাঙ্গার শব্দ।

মৃতপ্রায় তাজুর রক্তে প্রতিশোধের আগুন শত শিখা মেলি জ্বলে ওঠে। সে জেনে গেছে শত্রু, যুদ্ধ, স্বদেশ, স্বাধীনতা।

এসব মতিজানের জীবনে জ্বলন্ত স্মৃতি। যা মুহূর্তে মতিজানের মনের আয়নায় ভেসে ওঠে।

বসন্ত এলে কু------উ, কুউ বধির জনেও শোনে। ডাকলে সাগর ঝর্ণা কি আর নুড়ির বাধা মানে। সময় হলেই গোলাপ ফুটে সুবাস ছড়ায় বনে।

তাজুর বেলায়ও ঠিক তাই হোল।

মতিজানের শত বাধা, অনুরোধ, অনুনয় পায়ে ঠেলে সে যুদ্ধে চলে যায়। সে এইতো পাঁচ মাস আগের কথা। এপ্রিলের মাঝামাঝির ঘটনা।

সিনেমার সেলুলয়েডের ফিতার ন্যায় সবই জীবন্ত।

ছবির মত সব মনে পড়ে মতিজানের।

এরই মধ্যে সবাই একসঙ্গে হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে।

ও-দের হই চই আর শোরগোলে সমর ঘুম থেকে জেগে ওঠে। ভয়ে কাঁপতে থেকে।

তাঁরা চোখের পলকে সারা ঘর তছনছ করে ফেলে। চৌকির নিচেয়, মাচার তল, দরজার আড়ালে, ডোলের মধ্যে কোথায়ও তাইজুদ্দিনকে না পেয়ে হিংস্র জানোয়ারের মত ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। এক ঝটকায় মতিজানের চুলের মুঠি ধরে চিৎকার দিয়ে বলে,-"বুল, কুতায় লুকাইয়ে আইছে "?

-"হে তো আহেনি"।

-"আহেনি না "?

বলে চেয়ারম্যানের ইশারায় রাজাকারা একসঙ্গে হুঙ্কার ছেড়ে মতিজানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই কি যেন হয়ে গেল।

এ কি জাহেলিয়ান যুগ?

এই কি রোজ কিয়ামত?

নাহ! আমি লিখতে পারছি না! সুধী পাঠক, আমি অপারগ। লিখতে পারছি না। আমি ক্ষমা চাই।

আমার কলম ক্লিব! তাঁর মুখে ভাষা নাই! কিভাবে সে বলে বুঝাবে। প্রকাশ করে জানাবে!

আপনাদের অমূল্য সময় নষ্ট করার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী। নিজ গুণে ক্ষমা করে দিবেন।

চেষ্টা করে দেখি নৃশংস নির্লজ্য কার্যকলাপের লক্ষ ভাগের এক ভাগ। বিন্দু-বিসর্গ, ছিটে ফোটা জানাতে পারি কি না।

প্রথমে চেয়ারম্যান, পরে অন্যান্যরা-নাহ! তাও তো পারি না!

প্রথমে চেয়ারম্যান, পরে অন্যান্যরা-----

মতিজানকে খুবলে খুবলে খায়। যতক্ষণ জ্ঞান ছিল। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রতিরোধ করার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছে। নিঃসাড় হয়ে পরেছে এক সময়।

মুখ ও ঠোঁটের মাংস কামড়ে কামড়ে উঠে গেছে। এতে বোঝা যায় সে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দানবের শক্তির সঙ্গে পেড়ে উঠেনি।

উরু, জংঘা ও শরীরের গোপন অঙ্গের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় ক্ষতের। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। পশু গুলো পৈশাচিক পাশব ইচ্ছা মিটিয়েছে উন্মাদের মত। নিষ্ঠুর ভাবে।

মতিজান অচেতন অবস্থায় মেঝেয় পরে আছে। ঝর্না ধারার ন্যায় রক্ত ঝরছে সারা শরীর হতে।

পাশেই পরে আছে সমর। সে নিরব, নিথর।

অবক্ত চিৎকারে কি যেন ফরিয়াদ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

এদিকে তাইজুদ্দিন দৃপ্ত পদে ছুটে আসছে হন হন করে।

সে এখন চিরচেনা জাগলবার গ্রামে ঢুকে পরেছে। সাথে দু'জন সহযোদ্ধা। সবার কাঁধেই চাইনিজ স্টেনগান।

বাড়ীর অদূরে তেঁতুল গাছটার নিচেয় আসতেই বিপরীত দিক হতে আসা মানুষের পায়ের শব্দ পায়। অমনি তাড়াহুড়ো করে রাস্তার পাশে বাঁশ বাগানের ভিতর ঢুকে।

নিঃশব্দে দাঁড়ায় ভাট-কাউফলা গাছের আড়ালে।

সঙ্গী দু'জনকে তাজু চুপচাপ থাকতে বলে। অপলক দৃষ্টিতে রাস্তার উপর চেয়ে থাকে।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আলোছায়ায় দেখে নুরুল চেয়ারম্যান ও তাঁর চেলারা। এরাই তো তাজুর চোখ বেঁধে ক্যাম্পে নিয়ে গেছিলো।

তার পরের ঘটনায় আজও গা শিউরে ওঠে। উহু! কি শারীরিক নির্যাতন! কি মানসিক নির্যাতন।

মুহূর্তেই তাঁর শরীরের সমস্ত রক্ত প্রতিশোধের নেশায় টগবগিয়ে ওঠে।

চোখের পলকে কাঁধের স্টেনগানটা বাম হাতের উপর আনে। চোখে নিশানা ঠিক করে ডান হাতের তর্জনী টিগারে স্পর্শ রাখে।

-"কি করিস "?

চাপা অথচ ধমকের স্বরে বাম পাশে দাঁড়ানো সহযোদ্ধা মকছেদ ছোঁ মেরে স্টেনগানটা কেড়ে নেয়। রাগে-দুঃখে তাইজুদ্দিন ফুলতে থাকে।

মকছেদের উপর রাগান্বিত হয়।

-"এখন গোলাগুলি করলি সকলে জাগি যাবি। ক্যাম্পে থনে মেলেটারী আসপি। তাইলে আর আইজ বউ-ছাওয়ালের মুখ দেখতি পারবিনানে "।

মকছেদের কথায় যুক্তি আছে দেখে তাজু কড়ি থেকে কোমল হয়।

রাজাকারের দল হনহন করে চলে যায় ক্যাম্পের দিকে।

ওরাও বাড়ীর দিকে পা বাড়ায়।

চুপিসারে হাঁটতে হাঁটতে চাপা স্বরেমোসলেম বলে,-"আগে বউ-পুলার মুখ দেখ। তারপর সব গুনলানরে কচু কাটা করবোবরে"।

-"কবে করবো? আইজই এখনই করি "?

"না, এখন না। পাগল হলি নাকি? তুই কেনে করবি? ভূড়ির যমের বাড়ী পাটাবো আমি। ওরা আমার খালাতো বোন কুলুকজান্তরে আর্মির হাতে তুলে দিছে। আমাগোর বিয়ের কথা ছিল"। শেষের কথা কটি

বলতে মোসলেমের গলা ভারী হয়ে ওঠে।

শুনে মকছেদ ও তাজুর মন মোমের মত হয়ে যায়। চোখের কোনা

ভিজে ওঠে। গণ্ড বেয়ে পড়তে থাকে।

তাজু ঝাপসা চোখে আকাশের দিকে তাকায়। চাঁদের আলো দেখতে দেখতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়।

বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, "হ্যাঁ, মোসলেমের বুকে বড় কষ্ট "!

এক সময় তাজু জন্মের পর থেকে চেনা উঠোনে পা রাখলো। তাঁর গা-টা ছম ছম করছে। প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হতে চাচ্ছে না। আর তর সইছে তাজুর।

সে শ' শ' ব্যাস্তভাবে বারান্দায় উঠে যায়। দরজা খোলা দেখে ভাবে,----হয়তো তাঁর জন্যই মতি দরজা খুলে অপেক্ষা করছে।

এতো রাতে জাগিয়ে রেখেছে সমকেও বুঝি!

"মতি, এই মতি। আমি আইচি। কুপি বাতিডা জ্বালা। সাতে আরও দু'জন আনচি। বয় নাই। জ্বালা পিদিম "। এক নিঃশ্বাসে চাপা কণ্ঠে কথা কুটি বলে তাজু ঘরের ভিতর ঢোকে।

কোন সাড়া শব্দ নেই।

শুধু তাঁর কথা কটিই প্রতিধ্বনি হয়ে তাঁর কানে ফিরে এলো। আঁধারে তাজু হাতড়াতে

থাকে। এক সময় কিসে যেন হাত লেগে শিউরে ওঠে! চিৎকার দিয়ে বলে,-"এদিকে আইও বাইরা! তচ লাইট জ্বালাও দেহি "!

ঘরের ঘুটঘুটে অন্ধকারে টর্চ লাইটের আলোয় যা দেখলো তা জাহেলিয়ান যুগে ঘটতো কিনা সন্দেহ! এই লোমহর্ষক হৃদয় বিদারক দৃশ্য কেউ দেখতে পারেনা! দেখাও যায় না!

নাহ! যায় না লেখাও! কারণ, ক্লীব কলমেরও মমত্ববোধ আছে! কলমও থমকে যায়!

দেখে মেঝেয় রক্তাক্ত অবস্থায় পরে আছে দু'টি দেহ। তাঁদের প্রাণ-

পাখী উড়ে গেছে।

কথায় আছে, অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর।

আগত তিন মুক্তিযোদ্ধার অবস্থাও ঠিক তাই। তিন জনই যেন কিছুক্ষণের জন্য পাথর হয়ে গেছে। মুখে কোন কথা নেই। শুধু বোবা চোখের দৃষ্টি আছড়ে পড়ছে সদ্য-মৃত দু'টি লাশের উপর।

তাহলে ওরা এই কাজ করে কাপুরুষের মত পালিয়ে গেল! আর তাজু বাঁশ বনের আড়াল থেকে তা দেখলো।

তখন তাঁর হাতেও তো অস্ত্র ছিল। কেন ট্রিগার টিপে ধরলো না। কেন সব গুলোকে পরপারে পাঠালো না।

মনে মনে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিল।

বড়ই অপরাধী মনে হচ্ছিলো তাজুর।

তাঁর বুকে অশান্ত সাগরের দুরন্ত গর্জন। উদ্দাম উত্তাল তীর ভাঙ্গা অশান্ত ঢেউ।

ওদের চোখে আজ পানি নেই। আছে আগুন। অনির্বাণ প্রজ্বলিত প্রতিশোধের আগুন।

ওরা তিন জন তাড়াহুড়ো করে উঠোনের এক পাশে লাশ দু'টোকে সমাহিত করে।

পিতার কাঁধে পুত্রের মরদেহ এতো ভারী লাগে! বইতে এতো কষ্ট! আজই প্রথম বুঝলো তাইজুদ্দিন।

চাঁদটি আলো ঢেলে ঢেলে ক্লান্ত হয়ে পশ্চিমাকাশে ঢলে পরেছে।

তাজু ঘরের ভিতর আসে। চাঁদের আলো বেড়ার ফাঁক দিয়ে এসে মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। ছোপ ছোপ রক্তের উপর আলো কেমন যেন ঝিকমিক করে উঠেছে

তাজু পরান ভরে দেখছে। এক সময় উঠানে দণ্ডায়মান মকছেদ মসলেমের ডাকে সম্বিত ফিরে পায়। নিজের মাঝে ফিরে আসে।

-"তাড়াতাড়ি আহো। সূর্যি উঠার আগেই যুজ্জ-ফ্রন্তে যেতি হবি। রক্তের বদলা নিতি হবি "।

-"হ্যাঁ, আহি "।

বলেই মাজায় বাঁধা সবুজ গামছা খানা খুলে নিয়ে রক্তের কাছে বসে পরে। স্ত্রী-পুত্রের রক্ত গামছার মাঝ খানে মুছে নেয়।

সব টুকু মোছা শেষ হলে গামছাটা মাথায় বেঁধে উঠোনে নেমে আসে।

যুদ্ধের সময় জন্ম হয়েছিল বলে মতিজান ছেলের নাম রেখেছিল 'সমর'। মানে যুদ্ধ।

সেই ছেলেকে বুকে নেয়া হলো না। হলো না কলিজার টুকরারে প্রান ভরে আদর করা। অভাগিনী বউরে দু'টো ভাল কথা বলা।

বউকে বাড়ী থাকতে বলে যুদ্ধে গিয়েছিলো। যুদ্ধ শেষ হলেই ফিরে আসার কথা দিয়েছিলো। স্ত্রী-কে বুক ভরা প্রেম দিতে চেয়েছিল।

দেয়া হলো না। তাঁর কোন ইচ্ছেই পুরন হলো না।

তাঁর আর কিছুই রইলো না।

তাই শেষ সম্বল বউ-ছেলের রক্ত সবুজ গামছায় মেখে মকছেদের হাত ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে।

শেষ রাতের নীরবতা ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে যায়।

এতক্ষণে পুব আকাশটা রক্ত জবার রঙে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে। এই বুঝি ভোর হয়ে এলো। ঝোপ-ঝাড়, বাঁশবন ও বড় বড় গাছের নিচেয়ও ফর্সা ফর্সা হয়ে আসছে।

ওরা তিনজন স্বাধীনতা আনার জন্যে আলো-আঁধারিতে নিজেদের ডুবিয়ে ফেলে। অদম্য সাহস বুকে বেঁধে দূর্বার বেগে যুদ্ধফ্রন্টের দিকে হাঁটতে থাকে।

নভেম্বরের শুরুতেই দখলদার বাহিনী কোণঠাসা হতে থাকে। ইতিমধ্যেই সমস্ত অঞ্চল যেতে থাকে মুক্তিবাহিনীর দখলে।

ডিসেম্বরের শুরুতেই যুদ্ধের পট পাল্টে যায়। চারিদিক হতে মিলিটারী পিছু হটতে থাকে।

এরই মধ্যে ৩ ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে। হাজার হাজার, লাখ লাখ সৈন্য পাঠাতে থাকে বাংলাদেশে। শত শত যুদ্ধ-বিমান ও হেলিকপ্টার যোগে সৈন্য ও যুদ্ধ সরমজ্জাম আসতে থাকে।

শুরু হয়ে যায় স্থল, নৌ ও আকাশ পথের হামলা।

সব এলাকা ছেড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকার দিকে প্রান ভয়ে পালাতে থাকে।

১০ ডিসেম্বর।

শেষ রাত।

জাগলবার মিলিটারী ক্যাম্পে আক্রমণ করেছে তাইজুদ্দিন্থরা। শুধু গুলি আর গুলি। কামান, মর্টারের বিকট শব্দ। শুধু দ্রাম দ্রাম, দ্রিম দ্রিম শব্দ। ঠাস ঠাস, দুম দুম শব্দে কান ঝালাপালা হবার উপক্রম। চারিদিক হতে ক্যাম্পে আক্রমণ।

আর যায় কোথায়।

মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় মিলিটারীরা পিছু হটতে থাকে।

তাজুর কোন দিকে খেয়াল নাই। সে শুধু স্টেনগান চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁর রক্তে যুদ্ধ জয়ের নেশা। আজ নেবে সে প্রতিশোধ। মারবে মরণ ছোবল।

এমন সময় শত্রুপক্ষের একটা গুলি এসে লাগে তাজুর বুকে।

সে মাটিতে লুটিয়ে পরে।

এক মুহূর্তের মধ্যে কি হতে কি হয়ে গেল। শত্রুসেনারা আত্মসমর্পণের জন্য অস্ত্র ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।

সঙ্গে সঙ্গে মকছেদ আর মসলেম তাজুর মাথায় বাঁধা রক্তে রঞ্জিত সবুজ গামছাখানি খুলে নিল। তারপর তা স্টেনগানের সাথে বেঁধে উড়িয়ে দিল।

ভোরের মিষ্টি হাওয়ায় তা উড়তে লাগলো পত পত করে।

মকছেদ আর মসলেম চোখ ফেরালো পুব আকাশে।

দেখতে পেল সবুজ বন-বনানীর বুক চিরে লাল সূর্যটিও উদিত হয়েছে। রক্তিম সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় রাতের আঁধার কেটে গেছে। রক্ত-সূর্যের সোনার কিরনে উদ্ভাসিত চারিদিক।

তাজুর সবুজ গামছার মাঝে তাঁর স্ত্রী- পুত্রের রক্ত আর সবুজ মাঠ-বনের মাঝে উদিত রক্ত-সূর্যের রঙের কোন পার্থক্য নেই।

থাকে। মকছেদ আর মসলেম তা বিস্ময় ভরা অবাক দৃষ্টিতে দেখতে এ দেখার শেষ নেই।

নেই কোন অন্ত।

নেই কোন ক্লান্তি।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url