মুক্তিযুদ্ধের গল্প: শরণার্থী। গোলাম সরোয়ার সলোক। Muktijuddher Golpo Soronarrthi
শরণার্থী
গোলাম সরোয়ার সলোক
সামনে পিছনে ডানে বায়ে শুধু মিলিটারি আর মিলিটারি। পশ্চিমা দখলদার বাহিনী। সাথে এদেশীয় সহযোগী দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-সামস। এখানে ওখানে ক্যাম্প করে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
চারিদিকে শুধু রাইফেল, মর্টার, মেশিনগান, এল এম জি'র ঠাস ঠাস, দুম দাম শব্দ। দ্রিম দ্রিম দ্রাম দ্রাম আওয়াজ।
সেই সাথে কান ঝালা পালা করে উড়াউড়ি করছে যুদ্ধের বোমারু বিমানগুলো। যেখানে খুশী সেখানে চিলের মত ছোঁ মেরে নিচেয় নেমে বোমা ফেলছে। আবার বাজপাখির মত ত্বরিত গতিতে উড়ে যাচ্ছে।
আগুনে পোড়া, আধ-পোড়া বাড়ী ঘর। বসতভিটা। ফসলের পোড়া মাঠ। আগুন ধোঁয়ার গন্ধে নিঃশ্বাস নেয়া কষ্টকর চারিদিকে লাশ আর লাশ। শকুনের উড়া উড়ি। শেয়াল কুকুরের ঘেউ ঘেউ। হই হুল্লোড়, কাড়াকাড়ি, মারামারি। দুর্গন্ধে পেটের নাড়ি ভুঁড়ি বের হয়ে আসার উপক্রম।
![]() |
মুক্তিযুদ্ধের গল্প: শরনার্থী। |
গাছের আড়ালে, পাটের ক্ষেতে, আনাচে কানাচে হিংস্র শ্বাপদের আক্রমণে মেয়েলী কণ্ঠের 'আহা উহু! ইস। ছাইরে দ্যান। নাইলে গুলি দিয়ে মাইরে ফ্যালান' শব্দ। চুড়ির ছন্দায়িত ঝন ঝন, টুং টাং আওয়াজ।
এসবের মধ্যেও-
'এই সরস্বতী, জোরে হাইটে আয়। পাছে পইরে থাহিস ক্যা'?
-'হেই ভগবান, রইক্ষে কক্সে।
-'মা দুর্গা, মা কালী, বাঁচাও মোগোর। জীবনডা নিয়ে যানি ইন্দিয়া যাতি পারি'।
-'দোরোতি পারিস নে ক্যা সুবল'?
-'বাবা, এটটু খাড়া, আমি মুতি নিই'।
-'আর পারিনে, বুগডা ফাটে যায়তো। জল খামু'।
-'ও কেষ্ট, কণ্ঠে গেলুরে'?
এরকম নানা জনের নানা কথা শোনা যায়।
গ্রামের ময়-মুরুব্বী, বিদগ্ধজন, মুক্তিবাহিনীরা অতিশয় সাহস ও সান্ত না দেয়া স্বত্বেও সবাই- যে যার মত পরিবার-পরিজন, টাকা পয়সা, সোনা-রূপা নিয়ে পালাচ্ছিল।
সবার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য একটাই। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সিমান্তের ওপাড়ে ভারত গমন।
যার গাড়ী ছিল, সে গাড়ীতে করে। ট্রাক-বাস ছিল যার- সে ট্রাক-বাসে। যার ঘোড়া গাড়ী ছিল-সে ঘোড়া গাড়ীতে। মহিষের গাড়ীতে চড়ে যাচ্ছিল মহিষের গাড়ীওয়ালা।
যার টাকা পয়সা খরচ করার মত ক্ষমতা আছে। সে রিকসা, ভ্যান বা ভাড়া করা গরুর গাড়ীতে করে যাচ্ছে। কেউ আবার মোটর ভাড়া করে।
আর যার টাকা পয়সা খরচ করার ক্ষমতা নাই। সে স্ত্রী, পুত্র-কন্যাদের হাত ধরে পাড়ি জমাচ্ছে পায়ে হেঁটে।
এ মন কি যার কোন লক্ষ্য এবং গন্তব্য স্থির ছিল না। সে-ও অবিরাম গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সিমান্তের দিকে। ভারতই তখন নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
স্রোতের পানার ন্যায় এ বাঁক হতে ও বাঁকে। এ গ্রাম পেরিয়ে ও গ্রামে। নদী ডিঙিয়ে শাখা নদী, শাখা নদী পিছনে ফেলে উপনদী। উপনদী ফেলে সাগর মোহনা।
পিচ ঢালা সড়ক, ইটের পাকা রাস্তা বা মাটির ভাল পথ এড়িয়ে। লোকজন ও যানবাহন চলাচলহীন কাঁচা কর্দমাক্ত দুর্গম পথ ধরে ছুটছে।
কেউ মাথায় বাক্স পেটরা নিয়ে। কেউবা আবার সন্তানের হাত ধরে।
নিজের মাথার ঝুরির মধ্যে বৃদ্ধ মাকে বসিয়ে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। কেউ স্ত্রীর কোলে ছোট বাচ্চা দিয়ে পঙ্গু ছেলেটাকে কাঁধে করে দৌড়াচ্ছে।
মেয়ের কাঁখে ব্যবহার্য জিনিসের বোঝা চাপিয়ে আজন্মের বসতভিটা ছেড়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কেউ কেউ।
আরও পড়ুনঃ গল্পের নাম: পাশের বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মনি হায়দার
এই বুঝি মিলিটারী এলো। এই বুঝি রাজাকার এসে মেরে দিল গুলি করে। সবাই শরণার্থী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভারতের দিকে। পিপীলিকার সারির মত। ছুটছে তো ছুটছেই।
ভদ্র-অভদ্র, ধনী-নির্ধন, চাকুরে-শ্রমিক, কেরানী-চাপরাশী, কাজী-কুলীতে কোন পার্থক্য নেই।
পাশাপাশি সুখ-দুঃখের গল্প করতে করতে পাড়ি জমাচ্ছে সবাই। অভুক্ত অবস্থায়। তবু এ চলার বিরাম নাই। বিরতি নাই।
বিপরীত দিক হতে আগত ক্লান্ত, ধুলি-ধূসরিত দূর-দুরান্তের উদ্দেশে যাত্রাকারী মানুষের সাথে পথিমধ্যে দেখা হচ্ছে বার বার। কথাও হচ্ছে দু'একটি।
কারো বাড়ী যশোর, খুলনা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা। কারো আবার রাজবাড়ী, ঢাকা মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর,। আবার কারবা পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী।
উভয়মুখী যাত্রীই ভীত সন্ত্রস্ত। উভয়ের মনের ভিতরেই মৃত্যু-ভয়ের আশংকা প্রকট। এর মধ্যেও প্রয়োজনীয় দু'একটি কথার আদান প্রদান হচ্ছে। ব্যাথাতুর মনে খবরাখবর নিচ্ছে।
-"বাড়ী কই "? রাজবাড়ী গামী ফালুর প্রশ্ন।
-"আরিচাঘাট"। কাঞ্চিরামের উত্তর।
-"ইদিকে কোনঠে যাওয়া হয়"? খোকসা মুখী নুরাই জানতে চায়।
-"বাঁচার জন্যি ইন্দিয়া যাই"। ককিল মুচির হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব।
-"আপনেরা কইথে আলেন"? নিরাঞ্জন দাসের জিজ্ঞাসা।
-"পথে মেলেটারী, রেজেকার নাইতো"? ভারতগামী সুশান্তের ভয়ার্ত প্রশ্ন
-"বডার পাতি আর কত দূর যাতি হবি "? কৃষ্ণলাল হাঁটতে হাঁটতে কয়। ইত্যাদি টুকরো টুকরো কথাবার্তা।
কোন সতর্কবাণী থাকলে অবলীলায় বলে দিচ্ছে। সে মতে গতির পরিবর্তন হচ্ছে সারাটা দলের মধ্যে।
পিচকমিটির লোক, রাজাকার, মিলিটারীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পৌঁছুতে হবে নিরাপদ গন্তব্যে। সিমান্তের ওপার। নিরাপদ আশ্রয় ভারতে।
এই হাজার হাজার, লাখ লাখ শরণার্থীর কাফেলায় যোগ দেয়ার জন্যে জাগলবার গ্রামের সুবোধ চাকীদের তিনটি হিন্দু পরিবার রাতের অন্ধকারে যাত্রা শুরু করে।
এদের সাথে আরও কয়েকটি পরিবার যোগ দিয়েছিল। এরা হোল সন্তু নাপিত, জিতেন দাস, অশ্বিনী জেলে ও গজেন বৈরাগীর পরিবার।
এরা সবাই পারস্পারিক যোগাযোগ, পথঘাটের খোঁজখবর নিয়ে পরিকল্পনামত মধ্যরাতে বাড়ী ছাড়ে। বাড়ীঘর ত্যাগ করার মুহূর্তে সে কি কান্না!
প্রাণের ভয়ে তবু ছেড়ে যেতে হয়।
তবু চলে যায়।
যাবার আগে সবাই বারান্দায় জ্বেলে রেখে যায় কুপিবাতি। যাতে বিরোধী পক্ষ ও আশেপাশের রাজাকাররা বোঝে এখনও ওরা বাড়ীতেই আছে। চূড়ান্ত আক্রমন লুটতরাজ দু'এক দিন পরে করলেও চলবে।
যাকে যাকে শেষ করে দেবার লিস্ট করেছে। তাঁদের শেষ করা যাবে এক'আধ বেলা আগে পরে।
সুবোধ চাকী, সুনীল চাকী আর বোন সুধা রানী। সহোদর তিন ভাই বোন। ছোট দুই ভাই বোন সুনীল ও সুধার এক ছেলে এক মেয়ে। আর দুই ছেলে দুই মেয়ে বড় ভাই সুবোধ চাকীর।
চাকী পরিবারে মোট তের জন লোক। কারন সুধারানীর স্বামী মরে গেছে।
চাকীরা বর্ডার পর্যন্ত এগিয়ে দেবার জন্য মাহাতাব মণ্ডলকে সাথে নিয়ে যায়। মণ্ডলের সাথে তাঁদের ভারি সখ্য। মণ্ডলকে টাকা দিয়ে গুড় পাট মাধ্যমেই গরু-ছাগল, জমি-জমা বর্গা দেয়। হাট-বাজার করায়। পুজো-পার্বণ বা সামাজিক যে কোন অনুষ্ঠানে তাঁকেই কেনায়। মণ্ডলের আগে রাখে।
আগে ডাকে।
মণ্ডল অতন্দ্র প্রহরীর মত তাঁদের আগলে রাখে।
মসিকালো অন্ধকারে গড়াই নদী নৌকায় পাড় হয়। অতঃপর পায়ে হেঁটে শত বিপদসংকুল পথ অতিক্রম করে। রাত বারোটায় সবাই মিলে শৈলকূপার অদুরে বাখরবার গ্রামে উপস্থিত হয়।
বাঁকি রাতটুকু কাটানোর জন্য আশ্রয় নেয় লুৎফর বিশ্বাসের বাড়ীতে।
সবেমাত্র পোটলা পুটলি খুলে চিড়ে, মুড়ি, ছাতু, গুড় বের করেছে। একটু করে খাবে। আর তখনই কয়েকটা বাড়ী পর শুরু হোল গোলাগুলি।
প্রচণ্ড গোলাগুলি। খোলার উপর খই ফুটছে যেন।
সেই সাথে মানুষের হই চই। শোরগোল। কান্নাকাটি।'এই তোমরা কে কোথায় আছো। ডাকাত পরেছে। ডাকাত, ডাকাত- ধর ধর'।
শুধু ফটাস, ফটাস। দ্রাম, দ্রাম। দ্রিম, দ্রিম
শিশু ও মেয়েছেলের কান্নাকাটি- কলকোলাহল। পুরুষের চিৎকার।
কান ঝালাপালা হবার উপক্রম।
সুবোধ চাকীর দুইটা বয়স্কা মেয়ে ছিল। ছবি ও ছায়া। বোন সুধারানীর মেয়ে খুকী। তিন বোনই পূর্ণ যুবতী। বয়স পঁচিশ হতে ত্রিশের মধ্যে। তাঁরা সবাই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ফেলেছে।
বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছিলো। ব্যাটে-বলে ঠিকমত লাগেনি। তাই বিয়ে এতদিনেও হয়নি।
এরই মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেছে।
চাকী পরিবারের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার অন্ত নাই। এখন কি উপায়। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে মেয়ে গুলোকে হারাতে হবে। ওরা ধরে নিয়ে যাবে।
দিনের পর দিন আটকে রেখে অকথ্য অত্যাচার চালাবে। হয়তো মিলিটারীর মেজরের মনোরঞ্জনের জন্য ক্যাম্পেও পাঠিয়ে দিতে পারে।
কথা গুলো চিন্তা করতেই এক অন্য রকম ভয়ে গা শিউরে ওঠে।
ভয়ে কাঁপছে থর থর করে। ওরা যদি এখানে এসে সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করে ব্রাশফায়ারে মারে। কি করা যায়? এখন উপায় কি?
ছোট ভাই সুনীলের গলা ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে সুবোধ।
মাহাতাব মণ্ডল সৎ ও বিশ্বস্ত লোক। আজীবন অনেক উপকার করেছে চাকীদের। তাঁর বিনিময়ে চাকীরাও অতিশয় তাঁকে ভালবাসে ও বিশ্বাস করে। একারণেই সাথে করে এনেছে। ভারতের বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য।
অবস্থা বেগতিক দেখে সে অভয় দেয়। সেই সাথে অন্য সব পরিবারদেরও শান্ত হতে বলে।
-"আমার জান থাকতি আপনাদের ক্ষেতি হতি দেবনা। জানডা গেলিও
আপনেদের মান-সুরমান রক্ষে করব। মাইয়া গুলানরে আমার লগে দেন। আর আপনেরা এহানেই পলাপুলো থাহেন। আজান হোলিই হবাই এহানে
চলে আমু"।
বাখরবারের পাশ দিয়ে বয়ে যায় গড়াই নদী। বলতে গেলে অর্ধেক গ্রামই গ্রাস করেছে নদী। প্রতিনিয়তই নদী ভাঙছে। গ্রাম ঘেঁষেই ইয়া বড় বড় ভাঙ্গন। যা পাড় হতে বিশ বাইশ হাত নিচুতে ভেঙ্গে বসে গেছে।
পাড়ির উপর থেকে নিচের দিকে তাকালে ভাঙ্গন কুলের কাছের কিছুই দেখা যায় না।
তিনটি মেয়ে সাথে নিয়ে গেল মণ্ডল। বাঁকি রাত লুকিয়ে কাটালো নদীর ভাঙ্গনে। উপর হতে একটা বড় মাটির চাব ভাঙ্গলো। কান ঝালাপালা করার মত ঝুবঝাব শব্দ তুলে পাশে পড়লো। ঠিক তাঁদের অবস্থানের দুই তিন হাত দূরে।
গায়ের উপর পড়লেই শেষ। নিকষ কালো অন্ধকারে মাটির নিচেয়ই আজীবনের জন্য নিঃশেষ হয়ে যেত।
এক সময় গোলাগুলি থেমে গেল। সেই সাথে মানুষের হই চই।
জানা গেল ডাকাত পরেছিল। সোনা-রূপা, টাকা-পয়সা লুটে নিয়ে গুলি ফোটাতে ফোটাতে সটকে পরেছে।
গুলির আঘাতে আহত হয়েছে কয়েকজন।
আর খাওয়া হোল না। ফর্সা হোল পুবের আকাশ। শান্তির অমিয় আহ্বান ঘোষণা করে মসজিদে মসজিদে শুরু হোল আজান।
ইতিমধ্যেই মেয়ে তিনটিকে সাথে নিয়ে চাকীদের অবস্থানে এসে গেছে মণ্ডল। সবার গা কর্দমাক্ত। প্রাণ ভয়ে দৌড়ে যেতে কয়েকবার পরে গেছে। এতে ছিড়ে গেছে পরিধেয় কাপড়।
গোলাগুলির শব্দ শুনে ছুটতে থাকে শরণার্থীদলের সবাই। যে যার মত রাতের অন্ধকারে এদিক সেদিক পালায়।
সুবোধ চাকীর স্ত্রী যুথিকা চাকী গর্তের মধ্যে পরে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। পা ভেঙ্গে হাড় বেড়িয়ে গেছে। কখনও উচ্চস্বরে কাঁদছে। আবার কখনো চাপাস্বরে।
উনার হাটাতো দূরে থাক। নড়া সড়ার উপায় নাই। পা ফুলে ঢোল।
কিন্তু চারিদিকে ফর্সা হয়ে আসছে।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্থান ত্যাগ করতেই হবে। যদি আশেপাশের রাজাকাররা তাদের অবস্থান টের পায়। আক্রমণ করে বসে! তাহলে সামান্য যা কিছু সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে, তাও কেড়ে নেবে।
মেরেও ফেলতে পারে।
সঙ্গের দাস, নাপিত, মুচি, জেলে পরিবার গুলো হাঁটা শুরু করেছে।
চাকী পরিবার যাবে কিভাবে? তাঁদের বউয়ের পা ভাঙ্গা। ব্যাথায় পা টন টন করছে।
পাশেই ছিল উকিল গাড়োয়ানের বাড়ী। সে মহিষের গাড়ী ভাড়ায় বয়। এই কাজ করেই সংসার চালায়।
মণ্ডল উকিলের বাড়ী গিয়ে তিনটি গাড়ী ভাড়া করে আনে। বলা হয় টাকার সমস্যা নাই। যত দ্রুত পারো বর্ডারে পৌঁছে দিতে হবে।
মালপত্র, ছেলেমেয়ে নিয়ে ছইয়ের ভিতর বসে মহিলারা। কিছু জিনিসপত্র গাড়ীর নিচেয় দড়ি দিয়ে বাখারীর সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়। মণ্ডলসহ পুরুষরা ছইয়ের বাহিরে বসে।
জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি।
পর পর কুদিন একটানা বৃষ্টি হয়েছে। আকাশে এখনো মেঘের আনাগোনা। বৃষ্টি নামতে পারে যে কোন সময়। বৃষ্টি শুরু হলেই বাইরের লোকগুলোকে ভিজতে হবে।
ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম হলেও আশার কথা এই যে, অজানা বিপদসংকুল পথে তাঁদের আর হাঁটতে হবে না। অচেনা লোকজন আর জানতে চাইবে না, 'কোথা হতে আসা হোল্?' কোথায় যাওয়া হবে কোন পথে'?
কোনমতে এদিনটা চলতে পারলেই শেষ রাতের দিকে বর্ডারে গিয়ে পৌঁছুবে তাঁরা। ওখান থেকে লুকিয়ে বর্ডার পাড় হয়ে যেতে পারলেই মুক্তাঞ্চল- নিরাপদ ইনডিয়া।
সামনে পিছে তিনটি গাড়ী সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করানো। গাড়ীর পাশেই দাঁড়ানো তিনজন গাড়োয়ান। যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি চলছে।
এখনই যাত্রা শুরু হবে।
ঠিক তখনই সবার মনে ভয়ের ছায়া মেলে ধরলো বয়স্ক গাড়োয়ান উকিল।
বলতে গেলে মুখে বেশীর ভাগই সাদা দাড়ি। নতুন করে রাখা দাড়ি তা দেখেই বোঝা যায়।
মাথায় সাদা টুপি। আগে ছিলনা। মিলিটারির ভয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য চেহারা-সুরতে মুসলমান সাজা।
যুদ্ধ দিনে এরকম অনেকেই করেছে।
এলাকায় সবাই তাঁকে উকিল পাগল বলে ডাকে। কারনে অকারণে একটু বেশী কথা বলে।
আবার কেউ কেউ উকিল প্রধানও বলে থাকে।
গ্রামের সালিশ দরবারেও যায় সে। উল্টা পাল্টা কথা বলে। গ্রামে নেচে নেচে হেঁটে বেড়ায়।'
বুলি তয় আর কই কিগো, এ্যাগো ওগো বলাটাই তাঁর অভ্যাস।
-"বুলি তয় আর কই কিগো, বাবুগো- হামার ভাড়ার সব গুলান ট্যাঁহাই আগাম দেওন লাগবো"।
-"তুমার অর্ধেক টাকাতো অ্যাডভান্স হিসাবে আগেই দিয়ে দিয়েছি। বাঁকি অর্ধেক বর্ডারে পৌঁছে দেয়ার পর দিব"।
-"বুলি তয় আর কই কিগো, পথ্যি মধ্যে যুদি কুন বিপুদ আপুদ ঘটে? মেলেতারিরা যুদি হামার মারেই ফেলে? তহন আপনেগের ট্যাঁহা হামার কুনুই কামে লাগবিনানে। ছুদু পরানডাই হারামু। না বাবু, তা হবিনানে। গাড়ী ছাড়ার আগেই পাওনা পাতি ছব মিটায়া দেওন লাগবো"।
উকিল গাড়োয়ানের কথা শুনে সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মাহাতাব মণ্ডলের দিকে তাকায়। সে মুসলমান। বলিষ্ঠ পুরুষ। মুখে অমিত তেজ। বুকে দুর্দমনীয় সাহস। তদুপরি তাঁদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
-"পতে কি ধরা পরা বা চোর ডাহাতির ভয় ডর আচে নাহি "? মণ্ডল জানতে চায়।
-"তয় আর কই কিগো বাবু, বিপততো অ্যাহন সারা দ্যাশ জুড়ে। দিনি মেলেতারি রেজেকার। নাতি মুক্তির ঠ্যালা, ঠাস ঠাস, ফাটুস ফুটুস। ভয় না থাহলি আপনেরা বাড়িঘর ছাইরে পলান ক্যা? পতে ঘাটে হগল খানে বিপুদ"।
সুবোধ চাকী ছোট ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে বলে,-
"লোকটাকে সুবিধার মনে হচ্ছে না। এখন এক রকম, তখন এক রকম কথা বলে। কথায় কোন আগা মাথা নাই। ভয় দেখাচ্ছে। শুনছি, গাড়োয়ানরাও নাকি সুযোগ বুঝে লুটতরাজ করে"।
-"তয় আর কই কিগো বাবু, ও বাবুরাগো, বয় পাইয়েন না। মোগোর তিন বাপবেতার গাড়ীতি প্রেত্যেক দিন বারো-পুনারো ক্ষ্যাপ শরণার্থী এন্ডিয়া চালান করি দিই। বাঁচন-মরনের মালেক আল্লাহ। আপনেরা কন ভগবান। উনি নিলি হামি ঠ্যাকাতি পারুম না। আর উনি বাঁচালি পাক-বাহিনীর চৌদ্দ গুষ্ঠিও কিছু করতি পারবিনা গো"। উকিল কথাগুলো বলে নিজে নিজেই একটু হাসে।
উকিলের সঙ্গী গাড়োয়ান নিজের দুই পোলা। বারিক আর খালেক। তারা নিশ্চুপ। নির্বিকার।
যেন বিপদ আপদ তাঁদের কাছে কিছু না। এ সবের বিরুদ্ধে জীবন যুদ্ধ করে বেঁচে থাকাটাই তাঁদের স্বভাব।
চুক্তি অনুযায়ী পুরো টাকাটাই শোধ করে দেয়। টাকা হাতে পেয়ে উকিল এক দৌড়ে কোথা যেন চলে যায়। অনেকক্ষণ দেড়ি করতে থাকে।
মণ্ডল এদিক ওদিক কয়েকবার ইতি উতি তাকিয়ে সহযাত্রীদের বলে,-"লোকটার মতি গতি ভাল ঠেকতেছে না। আপনেরা যে যার মত এডডু সাবধানে থাহেন। চোক কান খুলে রাহেন। হুশিয়ার থাহেন সগলে"।
তখনও রাত পুরোপুরি ফর্সা হয়ে যায়নি। উকিল হাসতে হাসতে আসে।
গাড়োয়ানের জন্য নির্ধারিত স্থানে উঠে বসে বলে,-"। হুড় হুড়। হেট হেট। চল চল। ডানে বায়ে। বারিক খালেক, হামার লগে লগে তরাশ তরাশ চলে আয় বাজিরা। আল্লা, রক্ষে করো মাবুদ"।
গাড়ীর চাকার ক্যাচর ক্যাচর শব্দ। ছন্দের মত সুর তুলে সামনের দিকে এগুতে থাকে।
এবার উকিল তাঁর স্বভাব-সুলভ ঢঙে গল্প জুড়ে দেয়।
-"তয় আর কই কিগো বাবু, কেউ দ্যাশ ছাড়তেছে পরান বাঁচাতি।
কেউ আবার দ্যাশের মদ্দি নাগছে ধনী হতি। গত কালকে যে ব্যাটা পাস্তা ভাতে পায়নি নুন। আইজে হে নাজাকার হয়া নাইফেল হাতে নিয়ে হিন্দুগের করে খুন। দিনি দিনি আর কত কি দ্যাখপো। ছবই উপরয়ালার লিলে খেলা"।
ইয়াসিন মাস্টারের বড় ছেলে ইউনুস। খোকসা কলেজে পড়ে। সে এই দলে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা হতে। ট্রেনিং নিয়ে এসে দখলদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করবে। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করবে। বরাবরই সে চুপচাপ।
সে মণ্ডলকে কানে কানে জিজ্ঞাসা করে,-"লোকটা রাজাকার নাকি? আমার সন্দেহ হচ্ছে"।
সুনীল মনে মনে ভাবে লোকটা রাজাকার না হলেও মুসলিম লীগের গোঁড়া সমর্থক। পাকিস্তানপন্থী।
তাই তাঁকে পাল্টা ভয় দেখানোর উদেশ্যে বলে,-"কোচওয়ান বাহে, কমলাপুরের আকামদ্দিন চেয়ারম্যানের চেনেন "?
-"তয় আর কই কিগো বাবু, উনারে চিনুম না? বালা করেই চিনি জানি। বোটের আগে মুসলিম লিগির পাথির বোট চাতি আইছিল মোগোর গাঁয়ে"।
-"সেই চেয়ারম্যানের ভাগ্নেও আমাদের সঙ্গে আছে। এই যে ইউনুস"?
এতে কোচওয়ানের কোনই ভাবান্তর হয় না। নিজের স্বভাব-সুলভভঙ্গীতেই সে বলে,-"এই যুজ্জের মদ্দি কত ন্যাতা, পাতিন্যাতা আর হিদু সরনাতি পার করে দিলাম। সধ্যে রাতির ক্ষ্যাপে জানিপুরের এক ব্যাবসা করা পরিবার দিলাম চালান করে। সাতে চিল বিস্তর ত্যাহা পয়সা। সুনা-রূপো। ক্যামনে যে বসিগাঁর খিলাপত রেজেকারের বাইনী টের পালো। তয় আর কই কিগো বাবু, ছব কাড়ে কুড়ে নিইলো"।
ক্যাচর ক্যাচর শব্দ করে গাড়ীর চাকা ঘুরছেই। গাড়ী সামনের দিকে এগিয়ে চলছে সমান তালে।
পিতার এতো সব কথা শুনে পিছনের গাড়ী হতে পুত্র বারিক রেগে যায়। "ও বাজী, তোমার ফ্যাদা প্যাচাল থামাওতো। বগর বগর রাহো? এডডা বেড়ি ধরাও। বেড়ি খাই"।
কোন গাড়ীতে যাত্রী উঠার পর সবাই ড্রাইভার বা গাড়োয়ানের কাছে নিরাপত্তা ও সাহস আশা করে। সে মনোযোগ সহকারে গাড়ী চালিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিক। কিন্তু একি। এতো তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত।
তাঁর রহস্যময় পিলে চমকানো গল্প শুনে ভয়ে গা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ঘোরতর বিপদের মধ্যে পতিত বলে প্রতিয়মান হয়। তখন নিজের সাহসের উপর নির্ভর ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
-"আমাগোর এতো চোর ডাহাটির ভয় নাই কোচোয়ান"। বয়স্ক যাত্রী যুগোল নাপিত বলে ওঠে।
-"আমাগোর লগে কি আছে যে চুরি ডাহাটির ভয় থাকপি? হামরা কি উনার আগের ক্ষেপের মওজন নাহি? অত ভয় টয় নাই আমাগোর"। বলে কেত্ত জেলে উদাস নয়নে আকাশের দিকে তাকায়।
-"হু, আরে কলিই হোল? ডাহাতি করা এত সওজ কথা? হামরা এত গুলান মানুচ আচি না "? বলে গৌরদাস ঘাড় উঁচু করে তাকায় সবার মুখের দিকে।
একে অন্যে এ ধরণের কথা বলে যতই সাহসী বা বীর পুরুষের পরিচয় দেয়া হোক। মনে-প্রাণে সবাই ভয় পেয়েছে।
সবার কথা না জানলেও সুনীল চাকীর কথা জানে সে। কয়েক লাখ ক্যাশ টাকা ছাড়াও স্ত্রীর বিশ বাইশ ভরি সোনা সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে। যা ঐ পুটলিটার মধ্যে লুকানো আছে। দেশ স্বাধীন না হলে সে ভারতেই থেকে যাবে।
এ রকম মানসিক প্রস্তুতিও সে নিয়েই পথে বেড়িয়েছে। সেই সুনীল চাকী বলছে,-"ইউনুস, তোর কাকীকে ওপারে এক আত্মীয়ের বাসায় পৌঁছে দেব। তারপর তোর সঙ্গে ট্রেনিং-এ যাব। মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাবো"।
-"কাকু, আগে ইনডিয়াতো পৌঁছাই"।
সবার মনেই একটা অজানা আশঙ্কা। ততোধিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। সবারই একমাত্র ইচ্ছা, কখন, কিভাব, কি করে, ওপারে পৌঁছানো যায়।
অযথা গল্প- গুজব আর ভাল লাগছে না কারো। সহি-সালামতে ইনডিয়া পৌঁছানোর আশায় বসে আছে সবাই। যেন প্রার্থনারত অবস্থায় সকল যাত্রী।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "ভেলায় ভেসে যায়"
ক্রমেই অখণ্ড নিটোল নীরবতা নামে তিনটি গাড়ীতে।
রাস্তা ধরে গাড়ী চলছেই। দুই পাশে গ্রাম, ফসলের মাঠ। বিভিন্ন ফল ও বাঁশবন। পেড়িয়ে চলছে।
এরই মধ্যে বাতাস শুরু হোল। সাথে ঝম ঝম বৃষ্টি। তিনটি গাড়ীতেই প্রাণ-চাঞ্চল্য শুরু হয়ে গেল। সবাই ঠেলাঠেলি করে ছইয়ের ভিতর ঢোকে।
কিন্তু জায়গা কম। তাই মেয়েরা ও বউ-পোলাপানের ছইয়ের মধ্যে।
পুরুষদের বাহিরে বসে ভিজতে হয়।
তিনজন গাড়োয়ানের মাথায় মাথাল আছে। তবু এপাশ-ওপাশ দিয়ে ভিজতে থাকে তাঁরা।
মেঘ-বৃষ্টির ঝাপটায় অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শুরু হয় মেয়েলী কণ্ঠের কল-গুঞ্জন। শিশুর কান্না ও দম্পতির ফিসফাস কথাবার্তা।
-"ও দুগা, জর্দার কোটো কোটে থুচিস "?
-"ছবইতো গুছায়া রাখনু। না, তাড়াহুড়োয় আনা হওনিগো "?
-"চুন গুয়া কই "?
-"উডা আবার রাখনু কোষ্ঠেযে"?
পান খেতে চুন সুপারি জর্দার খুবই প্রয়োজন। এগুলোর অভাবে দুর্গার মা চেঁচিয়ে ওঠে।
-"হায় ভগমান, করছস ডা কি? আহন এডি কোটে পানু? ক্যামনে মুই পান খামু? তুই তুর আয়না কাকুই ছুনু পাকদার নিতি পারলু। আর কি না হামার জিনিসডা"।
-"চুপ রওতো মা"।
-"আলো, আলো। এডি কি? এডি? কার ছাইলে মুতি দিলু। কাপুড়ডা ভিজি গেলু "?
"ভিজুগ না। মানুসডি ভিজতি নাগছে। টেপির বোন ফুঁসে ওঠে।
-"এ আবার কিরে? নরম নরম কাঁদার মত। আঠা আঠাও লাগে। আরে গুন্দুও তো আচে।
হাগলু কিডারে? কুতা কয়না ক্যা"? কাশিদাসের বউ খেই মেই করে ওঠে।
-"আরে হাগুক না। হাগতি দ্যাওতো। জান বাঁচেনা। হাগা নিয়ে কাইজে-ফ্যাসাদ"। বলে ষষ্ঠীর পিসী।
এসব অপ্রয়োজনীয় আজেবাজে কথায় বিরক্ত হয় উকিল। সে তাঁর স্বভাব-সুলভ ভঙ্গীতে বলে, তয় আর কই কিগো বাবু, ছামনে শিকারপুর,-রেজেকারের ক্যাম্প বইছেগো বাবু? হগলেই চুপডা মাইরে বসে থাহেন। সরনাতি টের পালিই ফুটুস"।
সুনসান নীরবতা নেমে আসে তিনটি গাড়ীতে। একে অপরের নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও শুনতে পাচ্ছে। সবাই গুটি সুটি মেরে বসে আছে।
যশোর রোডের কাছাকাছি এসে গেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড় হয়ে যাবে। হটাৎ গুলির শব্দ। উতকর্ন হয় সবাই।
'কুথায়-কুথাস্থ? ভয়ার্ত কণ্ঠে সবাই জানতে চায়। একে অপরকে মাথা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে।
'গুলির ছন্দ না? কুথায়? কুন দিচ্ছি?
-"তয় আর কই কিগো বাবু বাবুরা, হগলেই চুব যান তো। ছানতো হন। নড়াচড়া কইরেন না। মুহি তালা আঁটি বহেন। মনে মনে আল্লারে ডাহেন"।
কোচোয়ানের ধমকে আরেকবার চুপ হয় সবাই।
রাইফেল, মেশিনগানের কান ঝাঁঝালো আওয়াজ। গাড়ী যতই সামনে এগুচ্ছে শব্দ ততই স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হচ্ছে। খোলার উপর যেন খই ফুটছে।
-"হায় আল্লাহ্, যেহানে বাগের ভয়-সেহানেই রাইত অয়। মনে মনে ঠাহর করে নাখছিলাম, ছামনের বিপুদের জাগাডা চুপচাপ পাড় হয়া যামু। অইলো না। অহন কি করি"। বলে খালেক গাড়োয়ান ভেবড়ি ছেড়ে কেঁদে ওঠে।
-"অই খালেক, চুপ যা। যশোর নোডের পরেই শিকারপুর রেজেকার ক্যাম্প বসায়ছে। শুনছি মুক্তিরা আরেক্রম কইরেছে"। বারিক ছোট ভাইকে অভয় দেয়।
গাড়োয়ানদের কথাবার্তার মাঝে ভগবান, মা দুর্গা, মা কালী, রক্ষা করো মা, এ জাতীয় প্রার্থনায় গাড়ীতে গাড়ীতে অন্যরকম উপাসনালয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
এরই মধ্যে যশোর রোডের সামনে গাড়ী এসে গেছে। বিশ/ ত্রিশ গজ বাঁকি।
এমন সময় দুই/তিনজন রাইফেলধারী দৌড়াতে দৌড়াতে সামনে এলো। ওরা পিছনে তাকাচ্ছে- আর দৌড়াছে। কোন দিকে যাবে। কি করবে। সে হুস জ্ঞান নাই।
চোখের পলকে গাড়ী পাড় হয়ে ছুটতে লাগলো পিছনে। রাস্তা ছেড়ে পাট ক্ষেতের মধ্য দিয়ে। মাথা নিচু করে লুকিয়ে লুকিয়ে।
লোকগুলোর পড়নে লুঙ্গি। গায়ে খাকি জামা। জামার দুই ঘাড়ের উপর রাজাকার লেখা।
ওদের পিছনে পিছনে দৌড়ায়ে গেল আরও পাঁচ/সাতজন। হাপ প্যান্ট পরা। গায়ে স্যান্দো গেঞ্জি। হাতে রাইফেল। মাথায় গামছা বাঁধা।
"ধর শালারে, ধর- জয় বাংলা" বুলি মুখে।
এতে পরিস্কার হোল, এরা মুক্তি। রাজাকার ধরতে ছুটছে।
দেখতে দেখতে জলপাই রঙের এলো কয়েকখানা। দাঁড়ালো রোড পাড় হয়ে ওপারে যাওয়ার পথের মধ্যখানে। বৃষ্টির মত গুলি ছুড়তে লাগলো।'মুক্তি কিয়া হুয়া', 'মুক্তি কোষ্ঠে হ্যায়'।
'থাম' বলে উকিল দুই ছেলের গাড়ী থামাতে বললো। এরপর যাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বললো,-"আপনেরা নামে এক দোড়ে পলান। ঐ দেহা যায় বাঁশের ঝাড়, আমবাগান। যান। যানতো। জানডা বাঁচান। হামরা এহানে থাহর। আপনাগোর জিনিচ পত্তর দেহি"।
উকিলের শেষ কথাগুলো শোনার কারো সময় নাই। সবাই গাড়ী হতে লাফ দিচ্ছে। মাটিতে পড়ছে আর দৌড়াচ্ছে।
রাস্তার নিচেয় নামলেই পাটক্ষেত, আখক্ষেত ও ধঞ্চেবন। এর ভিতর দিয়ে যে যেদিক পারছে। দৌড়াছে। যেতে হবে উকিলের দেখানো বাঁশবন, বেতবনের মধ্যে। আমবাগানের ভিতর।
বৃষ্টি হচ্ছেই। সেই সাথে দমকা হাওয়া।
শ্যামল লাফ দিয়ে পা পিছলে গেল পড়ে। চিৎপটাং হয়ে গড়াতে গড়াতে রাস্তার নিচেয় আখক্ষেতের ভিতর গেল চলে।
ওর আর এই পথ টুকু হাঁটা লাগলো না।
সুবোধ চাকী একটু মোটা ও ভারী মানুষ। নামতে গিয়ে এক পাটি জুতা আটকে গেল গাড়ীর বাঁশের মাচানের ভিতর। যতই টানে, পা কিছুতেই ছাড়াতে পারে না।
পা টানার ব্যাথা ও মিলিটারির গুলি খেয়ে মৃত্যু-ভয়ে গগনবিদারী চিৎকার করতে থাকে। সে ছুটতেও পারছে না। দৌড়াতেও পারছে না।
যেন খুঁটায় বাঁধা গরু। লাফালাফি দৌড়াদৌড়ি করছে। কিন্তু কিছুতেই করতে পারছে না এক ইঞ্চি পথ অতিক্রম।
শেষ পর্যন্ত উকিলের সহায়তায় এক পাটি জুতা ফেলে রেখেই ভোঁদৌড়। ধুতি পরে উদোম গায়ে দৌড়াছে। আগে আগে যাচ্ছে ভুঁড়িটা। ভুঁড়িটা না থাকলে সে অতিদ্রুত অতিক্রম করতে পারতো।
মৃত্যু-ভয়ে আতঙ্কিত যাত্রীরা। কার আগে কে নামে। এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
নিমাই জেলে লাফ দিয়ে পরতে না পরতেই ঘাড়ের উপর পড়লো ওর
বউ টেবী।
নিমাই চিৎকার দিয়ে'মা দুগ্ধ বলেই চুপ। কিছুক্ষণ পর দু'জনে পিছল পথে জড়াজড়ি করতে করতে চলে গেল পাটক্ষেতের ভিতর।
সুধারানী মেয়ে খুকীর হাত ধরে দৌড়াতে থাকে। রাস্তার পাশের বেতবনের চোরাকাঁটায় আঁচল আটকায়। কাপড় ছাড়ানোর সময় কোথায়? ছিঁড়ে রেখে দিয়েই দৌড়। প্রাণটা বাঁচাতে পারলেই বাঁচে।
নিজে বাঁচলে বাপের নাম। এই যেন সবার চিন্তা-চেতনা। সবাই সটকে পরেছে। গাড়ীতে কোকাচ্ছে শুধু সুবোধ চাকীর বউ যুথিকা চাকী। তাঁর পা ভাঙ্গা। কেউ তাঁকে সাথে বা কোলে করে নেয়নি।
হায়রে নিয়তি। হায়রে সময়। সুখের সময় সবাই সবার বন্ধু হয়।
দুঃখের সময় বন্ধু-স্বজন কেউ কারো নয়।
যায়। মণ্ডল তাঁকে কোলে তুলে নিয়ে এক দৌড়ে ধনচে ক্ষেতের মধ্যে মিশে
অঝর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছেই।
চারিদিকে মশীকালো অন্ধকার। তাঁর উপর মাথার থেকেও উঁচু আখ পাট ক্ষেত। চোখ তাকানোর উপায় নাই। চোখের মণিতে, পাতায় এসব গাছের খোঁচা লাগে। তাই চোখ বন্ধ করেই দৌড়াচ্ছে।
কোন দিকে গেল। আর কতদূর ঐ বন? তা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
সবার কণ্ঠে দিশেহারা মানুষের চাপা আর্তনাদ।'হায় হায়, খুব কাম অইছেগো! গাড়ীর মদ্যি হামার টাহার ফোতো পরে নইছেগো। গাড়িয়াল লিয়ে পলায় যদি'
'ছয়তানডা হামার কুন বিপদের মদ্যি ফেলে দিলুগো ভগবান'।
'বুলি নাই তহন,-- উডা রেজেকার'।
'ও বাহে, কোষ্ঠে গেইলেন গো তুমরা? কিচুইতো চহি দেহি নে'।
'ও সরস্বতী, তুই কোঠে গেলুরে'?
'এই পটকা, হামার হাত ধরে দোড়ো'।
'আরে কার মাইয়া কান্দেগো, সবনাশ করে দিলোরে। মুগডা চাপি ধরোগো' এইসব টুকরো টুকরো আর্তনাদ পিছনে ফেলে আপনজনদের হাত ধরে দিক-চিহ্নহীন অন্ধকারে ছুটতে থাকে।
এক সময় সবাই হাঁপিয়ে ওঠে। যে যেখানে পারে, ক্লান্ত হয়ে বসে থাকে। শুয়ে পরে।
তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঠাস ঠাস, দ্রিম দ্রিম গুলির শব্দ কানে শুনছে। ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এই বুঝি একটা এসে গায়ে লাগে।
এভাবেই কাটে অনেকক্ষন। অনেক ঘণ্টা।
বৃষ্টি থামে এক সময়। আকাশ পরিস্কার হয়। বন্ধ হয় গোলাগুলির শব্দও। তবে ঝির ঝিরে বাতাস আছে। বাতাসে বৃষ্টির পানি পাতায় পাতায় পরছে টুপটাপ টুপটাপ করে।
দেখতে দেখতে রোদ ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। দেখা গেল সূর্যের মুখ। অস্তগামী সূর্যের লাল আভায় চারিদিক রঞ্জিত।
প্রাণের সাড়া পরে গেল। ধান পাট আখ ধনচেক্ষেতে ও বাঁশবনে, আমবাগানে যারা লুকিয়ে ছিল। তাঁরা একে একে বেড়িয়ে আসতে থাকে।
পিছনে জনবসতি। এদিকে এগুতে সাহস করে না কেউ। যদি রাজাকার ওৎ পেতে বসে থাকে। সুযোগ বুঝে গুলি ছোড়ে। তাই গাড়ীর দিকেই এগুতে থাকে।
-"বাগের ছামনে ফেলি দিয়ে গাড়োয়ান মগল্প মালছায়াল লিয়ে পলায়া গেলু"। সত্য জেলে প্রথম ক্ষুব্ধ মন্তব্য করে।
-"তহনই কইচিলাম। উড্ডা রেজেকার। ক্যামুন হলু? চালাকি করে সপ লিয়ে ফুটলোতো "? ইউনুস বলতে থাকে বিড় বিড় করে।
সবাই পায়ে পায়ে গাড়ীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ওদের ধারনা গাড়োয়ান তিন বাপ-বেটা মালামাল নিয়ে পালিয়ে গেছে। বিশ্বাস ভঙ্গের হতাশায় মুষড়ে পরেছিল।
কিন্তু তাড়া একটু দূরে থাকতেই তিনটি গাড়ী দেখতে পায়। উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। মুহূর্তেই ভাঙ্গা মন চাঙ্গা হয়। নববলে বলীয়ান হয়ে উৎসাহ আর উদ্দীপনায় সামনে এগুতে থাকে।
গাড়ীতে এসে দেখে। সব মালামাল গাড়ীতে ঠিক আছে। এক কানাকড়িও এদিক ওদিক হয়নি।
শুধু গাড়োয়ান তিনজন মুখ গুঁজে পরে আছে। নিরব নিথর। কোন সাড়া শব্দ নাই। পেট দিয়ে ভুঁড়ি বের হয়ে গেছে।
বের হওয়া নাড়ি ভুঁড়ির উপর মশা মাছি ভন ভন করে বসছে। অবলা পশু মহিষ তা লেজ দিয়ে নেড়ে নেড়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ঠিক এভাবেই তাড়াচ্ছে শিয়াল, কুকুর, শকুনকে। লাশের মুখের সঙ্গে মুখ লাগিয়েও নাড়া চাড়া করছে।
যেন পরম মমতায় পালনকারীকে আদর করছে। চুমু খাচ্ছে। দু'চোখ বেয়ে ঝর ঝর করে পানি ঝরছে। যার দ্বারা সমস্ত মুখমণ্ডল ভিজে গেছে।
অবলা পশু কি বুঝতে পারছে তাঁর পালন কর্তার মৃত্যুবাণী? ওরাও কি বুঝতে পেরেছে একাত্তরের ভয়াবহ স্মৃতি?
আরও পড়ুনঃ ভোটকেন্দ্রে অবস্থানকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং ভোটারের দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা
শরণার্থী দল নিরব নিথর। অবাক হতবাক। মানুষ হয়ে তাঁরা যাদের চিনতে ভুল করেছে।
বনের পশুরা তাঁদের ঠিকই চিনেছে। পরম মমতায় মুখে মুখ লাগিয়ে আদর করছে আর কাঁদছে।
কিছুক্ষণের জন্যে হলেও শরণার্থী দল বাহ্যিক পৃথিবীর সব কিছু ভুলে যায়। নিস্পলক চোখে এ দৃশ্য দেখতে থাকে। হৃদয়-পটে মনের রঙে একাত্তরের স্মৃতি আঁকে।