সরকার কি? সরকারের আধুনিক শ্রেণীবিভাগটি উল্লেখ কর?
প্রশ্নঃ-১। সরকার কি?
অথবা,
সরকারের সংজ্ঞা দাও।
ভূমিকাঃ রাষ্ট্র গঠনের উপাদানসমূহের মধ্যে সরকার অন্যতম। সরকার হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি। সরকারকে কেন্দ্র করে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্র তার ইচ্ছাকে প্রকাশ ও বাস্তবায়ন করে। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সরকারের সংজ্ঞাঃ রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম মৌলিক উপাদান সরকার। সরকার হলো রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। সংকীর্ণ অর্থে সরকার হলো রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমষ্টিগত রূপ। ব্যাপক অর্থে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সমষ্টিগত রূপই হলো সরকার।
![]() |
| সরকার কি? সরকারের আধুনিক শ্রেণীবিভাগটি উল্লেখ কর? |
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন লেখক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাদের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরকারের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের দেওয়া কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হলো:
১. প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবি (Willoughby)'-এর মতে, "সরকার হলো একটি প্রতিষ্ঠান বা যন্ত্র যার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার ইচ্ছাকে গঠন ও কার্যকর করে।" (The organisation or machinery through which the state formulates and executs its will is termed as government.)
২. অধ্যাপক গাণার (Garner) বলেছেন, "সরকার হলো একটি কার্যনির্বাহী মাধ্যম বা যন্ত্র যার মাধ্যমে সরকারের সাধারণনীতি নির্ধারিত হয় এবং যার দ্বারা সাধারণ কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় ও সাধারণ স্বার্থ সাধিত হয়।"
৩. রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল (Aristotle)-এর মতে, "The government is everywhere the sovereign in the state and the constitution is infact the government."
৪. অধ্যাপক গেটেল (Gettel)-এর মতে, "সরকার হলো রাষ্ট্রের একটি সংস্থা বা যন্ত্র।" (Government is the organisation or machinery of the state. ")
উপসংহারঃ সুতরাং সরকার হলো রাষ্ট্র গঠনের সেই মৌলিক উপাদান যার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সরকারই রাষ্ট্রের প্রধান মুখপাত্র। সরকারবিহীন রাষ্ট্র তাই মহাসমুদ্রে নাবিকহীন জাহাজতুল্য।
__________________________________________
প্রশ্নঃ-২। সরকারের আধুনিক শ্রেণীবিভাগটি উল্লেখ কর?
ভূমিকাঃ সরকারের শ্রেণীবিভাজনের প্রবণতা সুপ্রাচীনকালের। সরকারের সংস্থাগুলোর কাঠামো, প্রকৃতি, কর্মপ্রক্রিয়া ও পারস্পরিক সম্পর্ক সকল রাষ্ট্রে এক রকম নয়। বিভিন্ন চিন্তাবিদ রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে সরকারের শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। সরকারের আধুনিক শ্রেণীবিভাগ তাদের মধ্যে অন্যতম।
সরকারের আধুনিক শ্রেণীবিভাগঃ যে সকল চিন্তাবিদ সরকারের আধুনিক শ্রেণীবিভাগ করেছেন তাদের মধ্যে ম্যারিয়ট ও লিকক প্রদত্ত শ্রেণীবিন্যাসটিই অধিক গ্রহণযোগ্য। নিম্নে ম্যারিয়ট ও লিকক প্রদত্ত সরকারের আধুনিক শ্রেণীবিন্যাসটি উল্লেখ করা হলো:
ম্যারিয়ট (Marriot)-এর শ্রেণীবিভাগ: সরকারের আধুনিক শ্রেণীবিভাগ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এ. আর. ম্যারিয়ট (A.R Marriot)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মূলত নিম্নোক্ত তিনটি নীতির ভিত্তিতে তিনি সরকারের শ্রেণীবিভাগ করেছেন:
১. ক্ষমতার আঞ্চলিক বণ্টনের বিচারে ম্যারিয়ট সরকারকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা- এককেন্দ্রিক সরকার (Unitary government) এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার (Federal government)।
২. সংবিধান সংশোধন পদ্ধতির বিচারে ম্যারিয়ট সরকারকে দুইভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা- সুপরিবর্তনীয় (Flexible) এবং দুষ্পরিবর্তনীয় (Rigid)।
৩. আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তিতে তিন ধরনের সরকারের কথা বলেছেন। যথা-স্বৈরতন্ত্র, সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ পরিচালিত এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত।
লিকক প্রদত্ত (Leacock) সরকারের শ্রেণীবিভাগ: ম্যারিয়টকে অনুসরণ করে স্টিফেন লিকক্ (Stephen Leacock) সরকারের যে শ্রেণীবিভাগ করেছেন তা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সবিশেষ গুরুত্ব বহন করে। লিকক্ সরকারকে প্রধানত দুভাগে বিভক্ত করেছেন। গণতন্ত্র এবং একনায়কতন্ত্র। গণতন্ত্রকে তিনি আবার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ এ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। পরোক্ষ গণতন্ত্রকে আবার তিনি দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা- সসীম বা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র এবং সাধারণতন্ত্র।
ক্ষমতা বণ্টনের বিচারে এদের উভয়কে তিনি আবার দু'ভাগে বিভক্ত করেছেন যথা- এককেন্দ্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়। তাছাড়াও লিকক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ভিত্তিতে এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার উভয়ের দুটি রূপের কথা বলেছেন-পার্লামেন্ট বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, রাষ্ট্র গঠনের একটি মৌলিক উপাদান হওয়া সত্ত্বেও সরকার একটি পরিবর্তনশীল শক্তি বা যন্ত্রবিশেষ। স্থান-কাল ও পাত্রভেদে সরকারের রূপ তাই প্রতিনিয়তই পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। তাই বিভিন্ন সময় ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সরকারের শ্রেণীবিভাজন ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
__________________________________________
প্রশ্নঃ-৩। সরকারের অত্যাধুনিক শ্রেণীবিভাগটি উল্লেখ কর?
ভূমিকাঃ সরকারের শ্রেণীবিভাজনের প্রবণতা সুপ্রাচীনকালের। সরকারের সংস্থাগুলোর কাঠামো, প্রকৃতি, কর্মপ্রক্রিয়া ও পারস্পরিক সম্পর্ক সকল রাষ্ট্রে এক রকম নয়। বিভিন্ন চিন্তাবিদ রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে সরকারের শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। সরকারের অত্যাধুনিক শ্রেণীবিভাগটি তাদের মধ্যে উল্লেযোগ্য।
সরকারের অত্যাধুনিক শ্রেণীবিভাগঃ অত্যাধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিযোগ হলো সরকারের সনাতন ও আধুনিক শ্রেণীবিভাগ বাস্তবধর্মী নয়। রাষ্ট্রচরিত্রের কোনো ইঙ্গিত এ শ্রেণীবিভাগের মাধ্যমে পাওয়া যায় না। তাই তারা সরকার ও তার শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কিত আলোচনার পরিবর্তে রাজনৈতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাগের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করেন। এ পর্যায়ভুক্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে অ্যালান বল (Alan R.Ball) উল্লেখযোগ্য। তিনি সরকার তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন-
১. উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা (Leberal Democratic System),
২. সর্বাত্মক ব্যবস্থা (Totalitarian System),
৩. স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা (Autocratic System).
অ্যালান বলের মতানুসারে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এককেন্দ্রিক বা যুক্তরাষ্ট্রীয় হতে পারে এবং মন্ত্রিপরিষদ বা রাষ্ট্রপতি শাসিত হতে পারে। তার মতে, সর্বাত্মক ব্যবস্থা সাম্যবাদী বা ফ্যাসিবাদি হতে পারে। তাছাড়া স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও বল দুভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা- সনাতনপন্থী ও আধুনিক। আধুনিক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা আবার সামরিক বা অসামরিক হতে পারে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, রাষ্ট্র গঠনের একটি মৌলিক উপাদান হওয়া সত্ত্বেও সরকার একটি পরিবর্তনশীল শক্তি বা যন্ত্রবিশেষ। স্থান-কাল ও পাত্রভেদে সরকারের রূপ তাই প্রতিনিয়তই পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। তাই বিভিন্ন সময় ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সরকারের শ্রেণীবিভাজন ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
__________________________________________
প্রশ্নঃ-৪। একনায়কতন্ত্রের সংজ্ঞা দাও?
ভূমিকাঃ একনায়কতন্ত্র হলো একটি অতি প্রাচীন রাজনৈতিক মতবাদ। তত্ত্বগতভাবে একনায়কতন্ত্র হলো গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা। এরূপ শাসনব্যবস্থায় সরকার অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী থাকে এবং জনগণের ইচ্ছা- অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে সে ক্ষমতা অপ্রতিহতভাবে প্রয়োগ করে। প্রাচীনকালে গ্রিস ও রোমের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি ও স্পেনে একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয়। বর্তমানকালেও অনেক দেশে একনায়কতন্ত্র বিদ্যমান রয়েছে।
একনায়কতন্ত্রের সংজ্ঞাঃ
রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা যখন এক ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে এবং সেই ব্যক্তি যখন তার খেয়াল-খুশিমতো শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে তখন তাকে একনায়কতন্ত্র বলে। একনায়কতন্ত্র হলো গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী শাসনব্যবস্থা।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ একনায়কতন্ত্র সম্বন্ধে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের দেওয়া কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো।
১. অধ্যাপক নিউম্যান (Newman)-এর মতে, "রাষ্ট্রের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা কতিপয় ব্যক্তি ক্ষমতা দখল করে অবাধে ক্ষমতা প্রয়োগ করলে তাকে একনায়কতন্ত্র বলা হয়।"
২. প্লেটো ও এরিস্টটল (Plato & Aristotle)-এর মতে, "যখন রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা একজনের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং সে নিজের স্বার্থের জন্য শাসন করে তখন তাকে স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র বলা হয়।"
৩. ইসক্রুটন (Escruton)-এর মতে, "একনায়কতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা দল সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা ও সকল জনগণের নিকট হতে আনুগত্য আদায় করে।"
৪. অস্টিন রেনির (Austin Raney)-এর মতে, "যে শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতা কোনো একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তাকে একনায়কতন্ত্র বলে।"
৫. ইতালির ফ্যাসিস্ট একনায়ক মুসোলিনি (Mossolini) বলেন, "সবকিছুই রাষ্ট্রের স্বার্থে, কোনো কিছুই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, কোনো কিছুই রাষ্ট্রের বাহিরে নয়।" (Everything for the state, nothing against the state, nothing outside the state)
৬. আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেন, "যে শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতা কোনো একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমটির হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তাকে একনায়কতন্ত্র বলা হয়।"
উপসংহারঃ সুতরাং উপর্যুক্ত সংজ্ঞাসমূহের আলোকে বলা যায় যে, একনায়কতন্ত্র হলো এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা একজন বা কয়েকজন ব্যক্তির হাতে থাকে এবং ঐ ব্যক্তি তাদের ইচ্ছানুযায়ী এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে। আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন, হিটলার, মুসোলিনি প্রমুখ একনায়ক ব্যক্তিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
__________________________________________
প্রশ্নঃ-৫। একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর?
ভূমিকাঃ একনায়কতন্ত্র হলো একটি অতি প্রাচীন রাজনৈতিক মতবাদ। তত্ত্বগতভাবে একনায়কতন্ত্র হলো গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা। এরূপ শাসনব্যবস্থায় সরকার অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী থাকে এবং জনগণের ইচ্ছা- অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে সে ক্ষমতা অপ্রতিহতভাবে প্রয়োগ করে। প্রাচীনকালে গ্রিস ও রোমের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি ও স্পেনে একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয়। বর্তমানকালেও অনেক দেশে একনায়কতন্ত্র বিদ্যমান রয়েছে।
একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যাবলিঃ একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কতগুলো বৈশিষ্ট্য বর্তমান। সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্রের কথা বাদ দিলে 'অন্যান্য সকল অগণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রে নিম্নোক্ত সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান।
১. এক ব্যক্তির শাসনঃ একনায়কতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি এক ব্যক্তির শাসন। এ শাসনব্যবস্থার মূল ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে এবং তিনি অপরিসীম ক্ষমতার মালিক হন। তার ইচ্ছানুযায়ী শাসনকার্য পরিচালিত হয়।
২. দায়িত্বহীনতাঃ দায়িত্বহীনতা একনায়কতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ শাসনব্যবস্থায় দায়িত্বহীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। একনায়কতন্ত্রে সরকার জনগণের উপর কর্তৃত্ব খাটায়।
৩. বিরোধীদের কণ্ঠরোধঃ একনায়কতন্ত্রে সকল রকম বিরোধিতার অবসানকল্পে ন্যায়-অন্যায় সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড ও গুপ্ত হত্যা প্রভৃতি পথে বিরোধী সমালোচনার কণ্ঠরোধ করার ব্যবস্থা করা হয়।
৪. ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধীঃ একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়। ব্যক্তির সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কোনো রকম স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয় না। জনগণকে এখানে ঘৃণার চোখে দেখা হয়।
৫. আইন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্বঃ একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্রনায়কই হলো সর্বেসর্বা। তার আদেশই হলো আইন। এই আইন অমান্য করার অধিকার কারো নেই। এখানে নামে মাত্র আইন ও বিচার বিভাগ থাকে।
৬. মিথ্যা প্রচারঃ মিথ্যা প্রচার এ ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বৈরাচারী শাসককে আড়ালে রেখে একনায়কের জনকল্যাণকর ও গৌরবময় নেতৃত্বের কথা সর্বদা প্রচার করা হয়।
৭. গোপনীয়তা রক্ষা করাঃ একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সর্বক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। যেহেতু এই ব্যবস্থা এক ব্যক্তির একক কর্তৃত্বই বিদ্যমান সেহেতু শাসনব্যবস্থার গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থ হলে একনায়কতন্ত্রের অবসানের সম্ভাবনা থাকে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, অনেক প্রতিকূল দিক থাকা সত্ত্বেও অনেকে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে অন্তর্বর্তীকালীন শাসনব্যবস্থা হিসেবে সমর্থন করেন। তাদের মতামত হলো যখন কোনো সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তখন নতুন সমাজব্যবস্থার অনুকূল পরিবেশ রচনার জন্য এটি আবশ্যক।
__________________________________________
প্রশ্নঃ-৬। সংসদীয় সরকার কাকে বলে?
অথবা,
মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের সংজ্ঞা দাও?
ভূমিকাঃ শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যকার ক্ষমতাগত সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে আধুনিক গণতান্ত্রিক সরকারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হলো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার আর অন্যটি হলো সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা আজ বিশ্বে বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় ব্যবস্থা।
সংসদীয়/মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের সংজ্ঞাঃ যে শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভা শাসন ক্ষমতার অধিকারী এবং তাদের কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়ী থাকে তাকে সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ সরকার ব্যবস্থা বলে। এ পদ্ধতিতে শাসন বিভাগ তার কার্যাবলির জন্য আইন বিভাগের কাছে দায়ী থাকে এবং শাসন বিভাগের সমুদয় ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের হাতে ন্যস্ত থাকে। নামেমাত্র একজন রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন যিনি মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংসদীয় সরকারের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের দেওয়া কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো-
১. অধ্যাপক গার্নার (Garner)-এর মতে, "এটি এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা যেখানে প্রকৃত শাসক বা মন্ত্রিপরিষদ তার রাজনৈতিক কার্যাবলির জন্য প্রত্যক্ষ ও আইনসঙ্গতভাবে আইন সভা বা এর একটি কক্ষের নিকট দায়ী থাকে।" অধ্যাপক ডাইসি (Dicey)-এর মতে, "সংসদীয় শাসনব্যবস্থা, শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগীয় ক্ষমতা একত্রীকরণের ভিত্তিতে গড়ে উঠে এবং উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে থাকে।"
২. হারম্যান ফাইনার (Harman Finer) বলেছেন, "মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার হচ্ছে স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত এমন এক সংস্থা, যার সদস্যবৃন্দ আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা দলসমূহের মধ্য থেকে নিয়োগ লাভ করেন এবং সচরাচর ঐ সংস্থার সদস্য এবং আইনসংস্থার আস্থা লাভ সাপেক্ষে ক্ষমতাসীন থাকেন ও ক্ষমতা কার্যকর করেন।"
উপসংহারঃ সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা হচ্ছে এমন এক সরকার ব্যবস্থা যেখানে শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে মন্ত্রিপরিষদের উপর। এখানে শাসন বিভাগ এবং মন্ত্রিসভার সদস্যগণ সমস্ত কার্যাবলির জন্য আইনসভার নিকট দায়ী থাকেন।
__________________________________________
প্রশ্নঃ ৭। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর?
ভূমিকাঃ শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যকার ক্ষমতাগত সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে আধুনিক গণতান্ত্রিক সরকারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হলো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার আর অন্যটি হলো সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা আজ বিশ্বে বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় ব্যবস্থা।
সংসদীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যঃ সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের কতকগুলো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো:
১. প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্যঃ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে শাসনব্যবস্থার মধ্যমণি। তাকে কেন্দ্র করেই সকল শাসনব্যবস্থা আবর্তিত হয়ে থাকে। তার পরামর্শেই অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করা হয়। মূলত প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রকৃত নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী।
২. নামমাত্র রাষ্ট্রপ্রধানঃ সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারে একজন নামমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শ ছাড়া তিনি কিছুই করতে পারেন না। তিনি নির্বাচিত বা বংশপরম্পরায় নিযুক্ত হয়ে থাকেন।
৩. যৌথ দায়িত্বশীলতাঃ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রীগণ ব্যক্তিগতভাবে এবং মন্ত্রিসভা যৌথভাবে আইনসভার নিকট দায়ী থাকেন।
৪. বিরোধী দলের অস্তিত্বঃ এই ব্যবস্থায় আইনসভায় বিরোধী দলের অস্তিত্ব থাকে। বিরোধী দল সরকারের নীতি ও কার্যাবলির গঠনমূলক সমালোচনা করে সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।
৫. আইন প্রণয়নে মন্ত্রিসভার নেতৃত্বঃ এই সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রিসভার সদস্যরাই আইনসভায় অধিকাংশ আইনের বিল ও বাজেট প্রস্তাব করেন।
৬. নমনীয় প্রকৃতিরঃ সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার সাধারণত নমনীয় প্রকৃতির। সংসদে সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠতায় যেকোনো নীতি ও সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও পরিবর্তন করা যায়।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা সরকার পরিচালনার অন্যান্য ব্যবস্থা হতে উত্তম ব্যবস্থা। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাকে অন্যান্য ব্যবস্থা থেকে আলাদা করেছে।
