রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতার কারণসমূহ কি কি?
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
মাস্টার্স শেষ পর্ব
রাষ্ট্রবিজ্ঞান
বিষয় কোড : ৩১১৯০৯
নিরাপত্তা অধ্যয়ন (Security Studies)
রচনামূলক প্রশ্নবলি
প্রশ্ন: রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতার কারণসমূহ সম্পর্কে আলোচনা কর?
ভূমিকাঃ একুশ শতকের বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় ছোট, বড় শক্তিশালী, দুর্বল প্রায় সব রাষ্ট্রই আজ - নিরাপত্তা হুমকিতে ভুগছে। পরিবেশ বিপর্যয়, খাদ্য ও জ্বালানি ঘাটতি, সন্ত্রাস, শরণার্থী সমস্যা প্রভৃতি কারণে বিশ্বের - অনেক দেশে নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের শিল্পায়নের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো যেভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, তাও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতার কারণ
নিম্নে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতার কারণসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. মারণাস্ত্রের প্রসারঃ
বিশ্বের প্রায় প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রই আজ কমবেশি মারণাস্ত্রের ভীতিতে ভীতসন্ত্রস্ত। বর্তমানে উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, ভারত, ইসরাইল, ইরান প্রভৃতি দেশও আজ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়েছে। এ দেশগুলো মারণাস্ত্রের অধিকারী হওয়ায় সত্যি সত্যিই বিশ্বকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী যদি কোনোভাবে এসব অস্ত্রের অধিকারী হয়, তাহলেই তা মানব সভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করবে।
২. অনুন্নয়নঃ
বিশ্বের মোট সম্পদের ৯০ শতাংশ রয়েছে উন্নত বিশ্বের জনগণের হাতে, যার ফলে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হচ্ছে না। তাই এসব অঞ্চলের অধিকাংশ দেশ দারিদ্রা, বেকারত্ব, খাদ্য ঘাটতি, স্বাস্থ্যহীনতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শিকার হচ্ছে, যা এসব অঞ্চলের দেশ ও জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে।
৩. পরিবেশ বিপর্যয়ঃ
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিবেশগত বিপর্যয় মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে উষ্ণতা বাড়ছে, যা পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। সুনামি, সিডর, আইলা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শিল্পোন্নত দেশগুলোর শিল্প-কারখানা থেকে যে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন হচ্ছে, তার ফলেও বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। তাই অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতিটি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
৪. জনসংখ্যার আধিপত্যঃ
বিশ্বের জনসংখ্যা আজ প্রায় ৮০০ কোটি হলেও সকল অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব এক নয়। ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার তুলনায় কম কিন্তু যেসব দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি, সেখানে আজ মানবিক নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। জনসংখ্যার আধিক্যের ফলে সেসব দেশে চরম খাদ্য ঘাটতি, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সন্ত্রাস, স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়।
৫. গণতন্ত্র বিকাশে ব্যর্থতাঃ
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আরাধ্য শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্র। কিন্তু উন্নত বিশ্বে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা হলেও অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতন্ত্র তার কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করতে পারে নি। ফলে সে সকল দেশসমূহে রাজনৈতিক সন্ত্রাস, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, বিপ্লব প্রভৃতি জনজীবনকে চরমভাবে নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে, যা বৈশ্বিক নিরাপত্তাহীনতারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৬. বিশ্বায়নঃ
বিশ্বায়নের এ যুগে একটি শিল্পোন্নত দেশের সাথে একটি দারিদ্র। দেশের প্রতিযোগিতা হচ্ছে, যার কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে দরিদ্র ও দুর্বল দেশগুলো দিন দিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। মূলত বিশ্বায়নের প্রভাব ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও কারিগরি সামর্থ্য না থাকায় তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ আজ চরম অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এসব দেশে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মেধাপাচার, সন্ত্রাস, মানব পাচার প্রভৃতি মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৭. সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদঃ
সন্ত্রাসবাদের ভয়াল থাবা দিন দিন সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদকে বর্তমান বিশ্ব নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ নামের যুদ্ধবিগ্রহ, হত্যা, হানাহানি বা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড কখনই মানবতার জন্য কাম্য নয়। কেননা সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে আক্রান্ত হচ্ছে বিশ্বের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল, যা নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম কারণ।
৮. অর্থনৈতিক আগ্রাসনঃ
আন্তর্জাতিক রাজনীতির অর্থ হচ্ছে Power Politics' বা ক্ষমতার রাজনীতি। উন্নত রাষ্ট্র এ ক্ষমতা প্রয়োগ করার ফলে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। বড় রাষ্ট্র সামরিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে ছোট রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। সাধারণত অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ বিশ্বায়নের নামে এবং অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে থাকে।
৯. বৈদেশিক সাহায্যঃ
উন্নত বিশ্বের দেশগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থা এবং বহুজাতিক সংস্থাসমূহের মাধ্যমে সাহায্যের নামে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে পুঁজি বিনিয়োগ করে। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা অর্থনৈতিক শোষণ অব্যাহত রাখে ও সুদৃঢ় করে। বিদেশি সাহায্যের মধ্য দিয়ে দাতাগোষ্ঠী উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভ্যন্ত রীণ রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও মতাদর্শ চাপিয়ে দেয়, যা তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম কারণ।
১০. দারিদ্র্যঃ
উন্নয়নশীল বিশ্বে দারিদ্র্য ও পরিবেশগত সমস্যা উভয়ই পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। দারিদ্র্যের কারণে পরিবেশগত সমস্যা বাড়ছে। আর পরিবেশগত সমস্যার কারণেই দারিদ্র্যের বিস্তার ঘটে, যা প্রকারান্তরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়। ফলে উন্নয়নশীল বিশ্বে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
১১. সামরিক আগ্রাসনঃ
বিশ্বের একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালের ওয়ান ইলেভেনের সন্ত্রাসবাদী ঘটনাকে পুঁজি করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলে ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে এবং ২০০৩ সালের মার্চে ইরাকে সামরিক আগ্রাসন চালায়। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে আজকের যে চিত্র, জনগণের যে দুর্দশা তা ঐ সামরিক আগ্রাসনেরই ফল। যে কারণে সমগ্র বিশ্বকেই আজ শরণার্থী সমস্যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সুতরাং সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন ও নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম এক কারণ।
১২. মরণব্যাধির বিস্তারঃ
বিশ্বব্যাপী এইডস (AIDS)-এর বিস্তার, আফ্রিকার ইবোলা ভাইরাস এবং সম্প্রতি আমেরিকা মহাদেশে 'জিকা ভাইরাসের' বিস্তার বিশ্ববাসীকে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। তাছাড়া হেপাটাইটিস ও জেপাটাইটিস-C ভাইরাসও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ সকল রোগসমূহ আজ মানব সভ্যতা ও বিশ্বের জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে।
পরিশেষেঃ
পরিশেষে বলা যায় যে, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি, খাদ্য, পানি, দারিদ্র্য, সম্পদের অসম বণ্টন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ, বেকারত্ব, সুশাসনের অভাব, লিঙ্গ বৈষম্য, সাহায্যনির্ভরতা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আজ বিশ্বের সকল দেশ ও জনগণকে নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ সমস্যার সমাধানই কেবল বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
