নিরাপত্তা গবেষণা কি? সুরক্ষাকরণ কি? বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উন্নত বিশ্বের নিরাপত্তার হুমকিসমূহ কি কি?
১. প্রশ্নঃ নিরাপত্তা গবেষণা কি?
অথবা, নিরাপত্তা গবেষণা বলতে কি বুঝ?
ভূমিকাঃ আসন্ন কোনো আক্রমণ থেকে সুরক্ষা যা নিরাপদ থাকাই নিরাপত্তা। আর নানা ধরনের নিরাপত্তা - ঝুঁকি এবং ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং ভবিষ্যতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার হুমকিসমূহ নিয়ে যা কাজ করে তাকে বলা হয় নিরাপত্তা গবেষণা। সামাজিক তথা মানব ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়টি সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় বলে নিরাপত্তা গবেষণা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
![]() |
| নিরাপত্তা গবেষণা কি? সুরক্ষাকরণ কি? বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উন্নত বিশ্বের নিরাপত্তার হুমকিসমূহ কি কি? |
নিরাপত্তা গবেষণা কি?
আধুনিক বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে নিরাপত্তা গবেষণা। নিরাপত্তা হচ্ছে কোনো বৈদেশিক বা হিংস্র ও ভয়ানক আক্রমণ থেকে ব্যক্তি, জাতি, গোষ্ঠী, দেশ বা সর্বোপরি মানব জাতিকে সুরক্ষাকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। কিন্তু পূর্বে এ নিরাপত্তা চিন্তা শুধু রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট সরকারের মাথাতেই ঘুরপাক খেত। কিভাবে সামরিক মজুদ বৃদ্ধি করে রাষ্ট্রকে বহিঃশত্রুর হুমকিমুক্ত করা যায়, তা নিশ্চিত করাই ছিল এ নিরাপত্তা ধারণার প্রধান কাজ। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তা ধারণার আলোচনায় গবেষণার প্রয়োজন হয়। পরিবেশের অবনমন, ওজোনস্তরের ধ্বংসাবশেষ, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কষাঘাত, নিত্যনতুন রোগবালাই-এর আক্রমণ এবং বহু হুমকি মানব জাতির অস্তিত্বকে সঙ্কটে ফেলেছে, যার কারণে নিরাপত্তা গবেষণা একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এক সময় নিরাপত্তা বলতে কেবল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে বুঝানো হতো। কিন্তু আধুনিক যুগে নিরাপত্তা কেবল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, নিরাপত্তা গবেষণায় সর্বপ্রথম নিরাপত্তা ঝুঁকিসমূহকে চিহ্নিত করা হয়। বর্তমান বিশ্ব নানা ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা করছে। যেমন- পরিবেশের নিরাপত্তা, সাইবারের নিরাপত্তা, প্রযুক্তির নিরাপত্তা, ভৌগোলিক নিরাপত্তা প্রভৃতি। নিরাপত্তা গবেষণার কাজ হলো এ সকল নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ ও প্রতিকার অনুসন্ধান করা।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, নিরাপত্তা গবেষণা হলো আধুনিক বিশ্বের নানা নিরাপত্তাহীনতা বা নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করা এবং নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যেসব হুমকি আসছে, তা নিয়ে অধ্যয়ন করা। এ গবেষণার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা নিরাপত্তা প্রভৃতি মৌলিক অধিকারের নিরাপত্তা থেকে শুরু হয়েছে।
২. প্রশ্নঃ সুরক্ষাকরণ বলতে কি বুঝ?
অথবা, সুরক্ষাকরণ কি?
ভূমিকাঃ নিরাপত্তা গবেষণার ক্রমবিকাশে সুরক্ষাকরণ ধারণাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটি একটি নব্যতম শব্দ, যার উৎপত্তি মাত্র বিশ শতকের শেষদিকে। পূর্বে বিশ্বে মানব সম্পর্ক তত জটিল ছিল না বলে সুরক্ষাকরণ ধারণার প্রয়োজন হয় নি। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বের নানা ধরনের নিরাপত্তাহীনতার দরুন সুরক্ষাকরণ ধারণার বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।
সুরক্ষাকরণ কি?
আসন্ন হুমকি থেকে কিভাবে নিরাপদে থাকা যায়, তার পথ-নির্দেশনাকেই সুরক্ষাকরণ বলে। সাধারণত নিরাপত্তা ধারণার মাধ্যমেই বিকশিত হয়েছে সুরক্ষাকরণ ধারণাটি। নিরাপত্তা হলো কোনো আক্রমণ থেকে সুরক্ষা। আর সুরক্ষিত হওয়ার উপায়ই হলো সুরক্ষাকরণ। সুরক্ষাকরণ শব্দটির উদ্রেক হয় স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী নিরাপত্তা ধারণার ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে নিরাপত্তা গবেষণার একটি আলোচ্য বিষয় হিসেবে। কারণ স্নায়ুযুদ্ধের পূর্বে নিরাপত্তা বলতে বুঝানো হতো শুধু সামরিক নিরাপত্তার বিষয়। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধোত্তর সময়ে বিশ্বে বিভিন্ন রকম নিরাপত্তা ঝুঁকি পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরিবেশের নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, প্রযুক্তির নিরাপত্তা, ভৌগোলিক নিরাপত্তা প্রভৃতি। নিরাপত্তার এসব ঝুঁকি বিস্তৃতির ফলে সুরক্ষাকরণ পদ্ধতি অনুসরণ করে নিরাপত্তা অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। Barry Buzan ১৯৯৫ সালে সর্বপ্রথম কোপেন হেগেন স্কুলের আলোচনায় Securitization বা সুরক্ষাকরণ বিষয়টির আলোচনার মূল বিষয় হলো প্রচলিত নিরাপত্তার ধারণা বর্তমান যুগে পর্যাপ্ত নয়। তাই কিভাবে বা কোন উপায়ে বর্তমান বিশ্বে নিরাপত্তা বজায় রাখা যায় বা অর্জন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করাই হচ্ছে সুরক্ষাকরণ।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সুরক্ষাকরণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি নতুন আলোচ্য বিষয়। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তাহীনতার কারণে সুরক্ষাকরণের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। নিরাপত্তা অধ্যয়নে নিরাপত্তা অর্জনের পদ্ধতি এবং নানা ধরনের সুরক্ষাকরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। নানাবিধ গুরুত্বের কারণে সুরক্ষাকরণ সামাজিক বিজ্ঞান সম্বন্ধে আলোচনার জন্য বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে।
৩. প্রশ্নঃ বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উন্নত বিশ্বের নিরাপত্তার হুমকিসমূহ কি কি?
অথবা,
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উন্নত বিশ্বের নিরাপত্তার হুমকিসমূহ সম্পর্কে লিখ।
ভূমিকাঃ যে রাষ্ট্র যত উন্নত, সে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ঝুঁকি তত বেশি। তাই নিরাপত্তা হুমকির সূচক নির্ণয় করার সময় উন্নত বিশ্বের নিরাপত্তা হুমকি চিহ্নিত করতে হবে। সুতরাং উন্নত বিশ্বের সামরিক নিরাপত্তার পাশাপাশি অন্যান্য নিরাপত্তার বিষয়ও আলোচনায় আসতে পারে।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উন্নত বিশ্বের নিরাপত্তা হুমকিসমূহঃ
নিম্নে বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উন্নত বিশ্বের নিরাপত্তা হুমকিসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. অভিবাসনঃ
উন্নত বিশ্বের নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় হুমকি অভিবাসন। অনুন্নত দেশের অনিরাপদ জীবনব্যবস্থা থেকে উন্নত জীবনযাপনের আশায় মানুষ উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমায়। এ মানসিকতার কারণে উন্নত বিশ্বে অভিবাসন সংকট দেখা যায়, যা উন্নত বিশ্বের নিরাপত্তা হুমকিস্বরূপ।
২. বাণিজ্য সংকটঃ
উন্নত বিশ্বের বাণিজ্য সংকটের পেছনে নানাবিধ কারণ ও উপাদানের সম্পর্ক আছে। অধিক জনবহুলতার কারণে আইনিভাবে বাণিজ্য পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার অবৈধ অভিবাসী কর্তৃক অবৈধ বাণিজ্য উন্নত বিশ্বে বাণিজ্য সংকট তৈরি করছে।
৩. পরিচয় সংকটঃ
অভিবাসন ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার কারণে নিজস্ব পরিচয় নির্মাণের সংকট উন্নত বিশ্বকে বড় ধরনের হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে তাদের নাগরিকত্বের উপর।
৪. যৌন সহিংসতাঃ
যৌন দাসী, যৌন কর্মী ও যৌন সহিংসতা উন্নত বিশ্বের সৃষ্টি। উন্নত বিশ্ব অনুন্নত বিশ্ব থেকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে কর্মের সুযোগের নামে নারীদেরকে যৌন কাজে লিপ্ত হতে বাধ্য করছে। ফলে উন্নত বিশ্বে যৌন সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৫. সাংস্কৃতিক দ্বিধাঃ
উন্নত বিশ্ব অনুন্নত বিশ্বের সাথে মেলামেশার কারণে উন্নত বিশ্বের কৃষ্টি, কালচার, বিশ্বাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিবর্তন আসছে। আর এর ফলে কোনটি তাদের নিজস্ব আর কোনটি অন্য দেশের-তা নির্ণয়ে দ্বিধা তৈরি হচ্ছে, যা উন্নত বিশ্বের সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করছে।
৬. পরিবেশ দূষণঃ
অধিক জনসংখ্যার ফলে উন্নত বিশ্বের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। তাছাড়া অভিবাসন ও মানব পাচারের ফলে উন্নত বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই উন্নত বিশ্বের পরিবেশ দিন দিন দূষিত হয়ে পড়ছে।
উপসংহারঃ
পরিশেষে বলা যায় যে, অনুন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের নিরাপত্তা সমস্যার সমাধানের জন্য উন্নত বিশ্বের উপর নির্ভরশীল। তাই সুদূর আফ্রিকার মতো তৃতীয় বিশ্বের নিরাপত্তা যখন বিঘ্নিত হয়, তার প্রভাব আমেরিকা ও ইউরোপের উন্নত বিশ্বেও পড়ে। তাই উন্নত বিশ্বে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অনুন্নত বিশ্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
