বাংলাদেশে নিরাপত্তা অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা
প্রশ্নঃ বাংলাদেশে নিরাপত্তা অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য লিখ।
অথবা,
বাংলাদেশে নিরাপত্তা অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে যা জান লিখ।
ভূমিকাঃ উন্নয়নশীল দেশের সার্বিক কূটনৈতিক, খাদ্য, জ্বালানি, সামরিক, প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করার জন্য নিরাপত্তা অধ্যয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য নিরাপত্তা অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই।
![]() |
| বাংলাদেশে নিরাপত্তা অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা |
বাংলাদেশে নিরাপত্তা অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
নিম্নে বাংলাদেশের নিরাপত্তা অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা করা হলো:
১. ভৌগোলিক নিরাপত্তা
নিশ্চিতকরণ। আধুনিক সময়ে ভৌগোলিক নিরাপত্তা বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের মুখ্য বিষয়, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সুতরাং বাংলাদেশের ভৌগোলিক নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে নিরাপত্তা অধ্যয়নের বহুমাত্রিক জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে।
২. প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ
বাংলাদেশে প্রায়ই নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে থাকে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো নিরাপত্তা। ফলে নিরাপত্তা অধ্যয়নের নানাবিধ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ ও মোকাবিলা করা যায়।
৩. সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন
নিরাপত্তা অধ্যয়ন বাংলাদেশের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিরাপত্তা অধ্যয়নের বৈষয়িক জ্ঞানের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনের কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান লাভকরা যায়।
৪. জ্বালানি নিরাপত্তা
বাংলাদেশে সামগ্রিক জ্বালানি সংকট নিরসন ও সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে নিরাপত্তা অধ্যয়নের গবেষণালব্ধ ও বাস্তবিক জ্ঞানের প্রয়োগ খুবই জরুরি। বাংলাদেশের জ্বালানির বিভিন্ন উপকরণ বিদেশে পাচার করা হয় এবং বিদেশি জ্বালানির নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিরাপত্তা অধ্যয়ন প্রয়োজন।
৫. দরিদ্র ও বেকার সমস্যার সমাধান
দরিদ্র ও বেকার সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করে। আর নিরাপত্তাহীনতা দারিদ্রদ্র্য ও বেকারত্বের কারণে নাজুক হওয়ার সম্ভাবনা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সুতরাং বেকার সমস্যা সমাধান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশে নিরাপত্তা অধ্যয়ন প্রয়োজন।
৬. মানব পাচার রোধ
মানব পাচার বৈশ্বিক, রাজনৈতিক, অর্থনীতির অগ্রগতির পথে বড় অন্তরায়। মূলত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক প্রভৃতি নিরাপত্তার অভাবে মানব পাচার অতি সহজে ও দ্রুত করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশও বিভিন্নভাবে মানব পাচারের শিকার হচ্ছে। সুতরাং মানব পাচার রোধে বাংলাদেশে নিরাপত্তা অধ্যয়নের গুরুত্ব অপরিসীম।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, নিরাপত্তা বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন যেমন-ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য নিরাপত্তা অধ্যয়ন খুবই প্রয়োজন। কেননা নিরাপত্তা অধ্যয়ন ব্যতীত রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব নয়।
প্রশ্নঃ রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতার কারণ কি?
অথবা,
রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতার কারণ সম্পর্কে লিখ।
ভূমিকাঃ একুশ শতকের বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় ছোট-বড়, শক্তিশালী, দুর্বল প্রায় সকল রাষ্ট্রই আজ নিরাপত্তার হুমকিতে ভুগছে। পরিবেশ বিপর্যয়, খাদ্য ও জ্বালানি ঘাটতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মারণাস্ত্রের ব্যবহার, অর্থনৈতিক আগ্রাসন, সুপেয় পানির অভাব, মরণ ব্যাধির বিস্তার প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ।
রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতার কারণ
নিম্নে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতার কারণসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. মারণাস্ত্রের প্রসার
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জাতিই আজ কমবেশি মারণাস্ত্রের জীতিতে জীতসন্ত্রত। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি বর্তমানে পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, ভারত, ইসরাইল, ইরান প্রভৃতিও আজ পারমাণবিক শক্তির দেশ। এ দেশগুলোর পারমাণবিক অস্ত্র তথা মারণাস্ত্রের অধিকারী হওয়া সত্যি সত্যিই বিশ্বকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
২. পরিবেশগত বিপর্যয়
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিবেশগত বিপর্যয় মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে উষ্ণতা বাড়ছে এবং পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ- সুনামি, সিডর, আইলা প্রভৃতি। তাছাড়া শিল্পোন্নত দেশগুলোর শিল্প-কারখানা থেকে যে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন হচ্ছে, তার ফলে পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠছে, যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩. গণতন্ত্র বিকাশে ব্যর্থতা। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্র। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো গণতন্ত্রের কাঙ্ক্ষিত মান ধরে রাখতে পারছে না। শাসক শ্রেণীর ক্ষমতালিলা, জনগণের অসচেতনতা এবং দাতা দেশ ও গোষ্ঠীয় অপরিণামদর্শিতার কারণেই গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারছে না। ফলে বাড়ছে। রাজনৈতিক হত্যা, গুম, সন্ত্রাস এবং শরণার্থী সমস্যা, যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম কারণ।
৪. সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ
সন্ত্রাসবাদের ভয়াল থাবায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আক্রান্ত হচ্ছে বিশ্বের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭০ তম অধিবেশনে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদকে বর্তমান বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মূলত সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ নামে যুদ্ধবিগ্রহ, হত্যা, হানাহানি বা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড কখনোই বিশ্ব মানবতার জন্য কাম্য নয়।
৫. অর্থনৈতিক আগ্রাসন
বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অর্থই হচ্ছে 'Power Politics' বা ক্ষমতার রাজনীতি। এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে বড় রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে ছোট রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ বিশ্বায়নের নামে এবং অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে থাকে, যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম কারণ।
৬. মরণব্যাধির বিস্তার
বিশ্বব্যাপী এইডস (AIDS)-এর বিস্তার, আফ্রিকার ইবোলা ভাইরাস এবং আমেরিকা মহাদেশে 'জিকা ভাইরাসের' বিস্তার বিশ্ববাসীকে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। তাছাড়া হেপাটাইটিস ও জেপাটাইটিস- ভাইরাসও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ সফল রোগ আজ মানব সভ্যতা ও বিশ্বের জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি, খাদ্য, পানি, দারিদ্র্য, সম্পদের, অসম বণ্টন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ, বেকারত্ব, সুশাসনের অভাব, লিঙ্গ বৈষম্য, সাহায্যনির্ভরতা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আজ পৃথিবীর সকল দেশ ও জনগণকে নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
প্রশ্নঃ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ কি?
অথবা,
নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বলতে কি বুঝ?
ভূমিকাঃ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকেই এ বিষয়টি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ১৯৯৫ সালে Barry Buzan সর্বপ্রথম নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বা Securitization-এর বিষয়টি উল্লেখ করেন।
নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
প্রাচীনকাল থেকেই নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকেই নিরাপত্তার ধারণাটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ১৯৯৫ সালে Barry Buzan সর্বপ্রথম নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বা Securitization-এর বিষয়টি উল্লেখ করেন। কোপেন হেগেন স্কুলে অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় তিনি বলেন, বর্তমান যুগে প্রচলিত নিরাপত্তা পর্যাপ্ত নয় কারণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে হুমকি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যার কারণে জনজীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা গবেষণায় নতুন উপাদান যোগ করতে হবে, যাতে করে সামষ্টিক একটি নিরাপত্তা ধারণা তৈরি হয়। কোপেন হেগেনের আলোচনায় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়ে বলা হয়-"প্রথাগত নিরাপত্তা বিষয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান করছে বর্তমান প্রক্রিয়াসম্পন্ন বা আধুনিক নিরাপত্তা ধারণা, যা নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের আলোচ্য বিষয়। প্রথাগত নিরাপত্তা আলোচনায় শুধু বৈষয়িক অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়ে বলা হয়, যেমন-ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সামরিক সক্ষমতা এবং মেরুকরণ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ একজন পরিচালকের কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের পরিবর্তনকে বুঝায়।"
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক বিশ্বের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হচ্ছে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। আসন্ন বিপদ থেকে সুরক্ষিত থাকার নিশ্চিত উপায়ই নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। নানা ধরনের বিবেচ্য বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভকরার মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের উপায় খুঁজে বের করা হয়।
