রাজনৈতিক জোট কি? বাংলাদেশের জোটবদ্ধতার রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা
ভূমিকা: কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচিতে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সুসমন্বিত কার্যক্রমকে রাজনৈতিক জোট বলে। যখন কোনো রাজনৈতিক দল এককভাবে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয় অথবা লক্ষ্য অর্জনে বিরাট প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়, তখন রাজনৈতিক জোটের জন্ম হয়। নিজস্ব দলীয় অস্তিত্ব ও নীতি বিসর্জন দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ অর্জনের জন্য কয়েকটি রাজনৈতিক দল যখন কর্মসূচি গ্রহণ করে তখন তাকে রাজনৈতিক জোট বলে।
![]() |
রাজনৈতিক জোট কি? বাংলাদেশের জোটবদ্ধতার রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা |
রাজনৈতিক জোট কি?
রাজনৈতিক জোট স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নয়। এটি একটি সাময়িক পদক্ষেপ যা রাজনৈতিক দলগুলোকে সংকট থেকে উত্তরণের পথ নির্দেশ করে। সাধারণত ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটাতে কিংবা আসন্ন নির্বাচনে সরকারি দলের পতনকে নিশ্চিত করার জন্য জোট গঠিত হয়। এক বা একাধিক কর্মসূচির ভিত্তিতে রাজনৈতিক জোটের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদগণ বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক জোটের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো:
- আমজাদ হোসেন বলেছেন, "সমমনা দল ও ব্যক্তিদের নিয়েই সাধারণত জোট গঠিত হয় এবং উদ্দেশ্য হাসিল হওয়া পর্যন্তই সাধারণত এর অস্তিত্ব বজায় থাকে।"
- হারুনুর রশীদের মতে, "কোনো সাধারণ উদ্দেশ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলের ঐক্যই হলো জোট। নির্বাচন বা আন্দোলনের প্রশ্নে একাধিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে জোট গড়ে উঠতে পারে "মৌলিক জাতীয় স্বার্থবাহী সুনির্দিষ্ট কতগুলো দাবি আদায় বা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অথবা স্বৈরশাস্ত্রের অবসানকল্পে এবং গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অথবা ইস্যুভিত্তিক অতি জরুরি কতগুলো উপস্থিত জনস্বার্থ বিষয়ক লক্ষ্যার্জনের জন্য কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার কৌশল হিসেবে যখন ছোট বড় একাধিক রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করে, তখন এটিকে রাজনৈতিক জোট বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।"
শেখ মুজিব শাসনামলে গঠিত জোটসমূহের বিবরণ:
নিম্নে শেখ মুজিব শাসনামলে গঠিত জোটসমূহের বিবরণ দেওয়া হলো:
১. ৭-দলীয় জোট:
১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে ১৫ দফার ভিত্তিতে একটি '৭ দলীয় জোট' গঠন করা হয়। এ জোটের শরিক দলগুলো ছিল ন্যাপ (ডা.) জনাব আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, জনাব অলি আহাদের নেতৃত্বাধীন বাংলা জাতীয় লীগ, শ্রমিক-কৃষক সাম্রাজ্যবাদী দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী), বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ স্যোশালিস্ট পার্টি।
২. ত্রি-দলীয় গণ-ঐক্যজোট:
চীনাপন্থি কমিউনিস্ট 'দল উপদলগুলোর সমালোচনা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের উদ্ভব ও দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন, রুশ-ভারত বিরোধী প্রচারণা প্রভৃতি মোকাবেলা, অরাজকতা সৃষ্টিকারী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং দেশ থেকে মুনাফাখোর, মজুদদার, কালোবাজারি, দুর্নীতি ও সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ রোধ করার জন্য ১৯৭৩ সালের ১৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোঃ) ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মনি সিং) 'ত্রিদলীয় গণ ঐক্যজোট' গঠন করে।
৩. বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এক আদেশ বলে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল গঠনের কথা ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপতি নিজে বাকশালের চেয়ারম্যান হিসেবে এ সংগঠনের যাবতীয় ব্যবস্থা করবেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ জুন তারিখে এক আদেশ বলে বাকশালের গঠনতন্ত্র ঘোষণা করেন।
জিয়ার শাসনামলে গঠিত জোটসমূহের বর্ণনা:
নিম্নে জিয়ার শাসনামলে গঠিত জোটসমূহের বিবরণ দেওয়া হলো।
১. ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ:
জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, খেলাফতে রব্বানী পার্টি একত্রিত হয়ে ১৯৭৬ সালে 'ইসলামি ডেমোক্রেটিক লীগ' গঠন করে। এই জোট ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক নীতি মোতাবেক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করে। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ ও মুসলিম লীগ মিলে ২০টি আসন পায়।
২. জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট:
১৯৭৮ সালের ৩ জুনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জিয়াউর রহমানের সমর্থক ৬টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠিত হয়। এ ফ্রন্টের শরিক দলগুলো ছিল (ক) জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল), (খ) ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (গ) লেবার পার্টি, (ঘ) মুসলিম লীগ (শাহ্ আজিজ), (ঙ) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) (চ) বাংলাদেশ তফসিল ফেডারেশন।
৩. ন্যাশনাল ফ্রন্ট:
১৯৭৮ সালের ৩ জুনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনাব আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে কতিপয় ডানপন্থি দল 'ন্যাশনাল ফ্রন্ট' নামে একটি জোট গঠন করে জিয়াউর রহমানের বিরোধিতা করে নির্বাচনে একটি তৃতীয় ধারা সৃষ্টির প্রয়াস চালায়।
এরশাদের শাসনামলে গঠিত রাজনৈতিক জোটসমূহ:
১. ৮ দলীয় ও ৫ দলীয় জোট:
১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ দেশে সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৫ দলীয় জোট ভেঙে যায় এবং ফলে ৮ দলীয় জোট ও ৫ দলীয় জোটের উৎপত্তি হয়। দেশে সামরিক শাসন বিদ্যমান থাকা অবস্থায় সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে এই বিভক্তি দেখা দেয়। নির্বাচনে যে সকল দল অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাদের সমষ্টি '৮ দলীয় জোট'। অন্যদিকে ওয়ার্কার্স (বাশার-মেনন), জাসদ (ইনু), বাসদ (মাহবুব), বাসদ (খালেকুজ্জামান) ও কৃষকশ্রমিক সমাজবাদী দল নির্বাচনের অসম্মতি জ্ঞাপন করে জোট থেকে বেরিয়ে আসে, এবং '৫ দলীয় জোট' গঠন করে। ১৯৮৬ সালের পর থেকে এই '৫ দলীয় জোট' এভাবেই রয়েছে।
২. ৭ দলীয় জোট:
গণতান্ত্রিক পার্টি এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (নুরুর রহমান), ১৯৮৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ৭ দলীয় জোটের ভিত্তি রচনা করে। ১৫ দলীয় জোটে যেমন সবসময় ১৫টি দল ছিলোনা, ৭ দলীয় জোটেও তেমনি সবসময় ৭টি দল ছিলোন। জাতীয় লীগ, ইউপিপি, গণতান্ত্রিক পার্টি এবং কেএসপি সরাসরি সরকারের সাথে যোগদান করে। তবে এই জোটে বিএনপি'র প্রাধান্য সবসময় প্রতিষ্ঠিত। অভিন্ন ৫ দফা দাবি আদায়ের প্রশ্নে ৭ দলীয় জোট ১২ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে।
খালেদা জিয়ার শাসনামলে গঠিত জোটসমূহ:
১. প্রগতিশীল গণঐক্যজোট:
জাতীয় ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং সমাজবাদী ও সমাজ প্রগতির ধারা সংহত করার দৃঢ় অঙ্গীকার ঘোষণার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ ও সমমনাদের নিয়ে 'প্রগতিশীল গণঐক্যজোট' (Progressive Democratic Unity Front) আত্মপ্রকাশ করে।
২. ১৫ দলীয় জোট:
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (ম-ই), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, জাতীয় ছাত্রদল, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বা-কা), ছাত্র ঐক্য ফোরাম, গণতান্ত্রিক ছাত্রকেন্দ্র, ছাত্র সমিতি, গণতান্ত্রিক ছাত্রলীগ ও জাতীয় ছাত্রঐক্যের সমন্বয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর (১৯৯৩) ছাত্র সমাজের একটি '১৫ দলীয় জোট' গঠিত হয়।
৩. ত্রি-দলীয় জোট:
গোলাম আযম ইস্যুকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সর্বদলীয় একটি ঐক্যজোটের নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা চালায় বিএনপির বিরুদ্ধে। ঐ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগ সকল বামপন্থি দল বাদ দিয়ে জামায়াত ও জাতীয় পার্টিকে নিয়ে 'ত্রিদলীয় জোট' (Three Party Alliance) গঠন করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জোরদার আন্দোলন শুরু করে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে গঠিত রাজনৈতিক জোটসমূহ:
১. চার দলীয় জোট:
শেখ হাসিনার শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে সংবিধান অনুযায়ী নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা করার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী ঐক্যজোট মিলে চার দলীয় জোট গঠন করে। মূলত খালেদা জিয়া তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, জোটবদ্ধ নির্বাচন করলে বিজয় অবশ্যম্ভাবী। ফলে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চার দলীয় জোট নির্বাচনী জোট হিসেবে আরো প্রাণ পায়। চার দলীয় জোটের ঘোষণায় চার দফা দাবি পেশ করা হয়। যথা।
২. ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট:
চার দলীয় জোট থেকে জাতীয় পার্টি বের হয়ে গেলে এরশাদ নতুন জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। এ প্রক্রিয়ায় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২১ জুন ২০০১ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের ৮ দফার প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেন। এভাবে জাতীয় পার্টি চরমোনাই পীর সৈয়দ ফজলুল করিমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এবং আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তিনটি দলকে সাথে নিয়ে ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি নির্বাচনী জোট গঠন করে এবং ক্ষমতায় গেলে ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার ঘোষণা প্রদান করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, রাজনৈতিক জোট বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার শাসনামলে বিভিন্ন রাজনৈতিক জোট গড়ে উঠেছে। স্বৈরশাসন থেকে বাংলাদেশকে সংসদীয় ব্যবস্থায় উন্নীত করাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক জোটের সবচেয়ে বড় সাফল্য। আজোও বাংলাদেশে জোট রাজনীতির অস্তিত্ব বিদ্যমান।