মনি হায়দারের লেখা মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "আজও কড়া নাড়ে"। Ajo kora nare
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
লেখক: মনি হায়দার
গল্পের নাম: আজো কড়া নাড়ে
রাতের আঁধার কেটে যাচ্ছে। পাতলা অন্ধকার। পূর্বাকাশ অনেকটা লাল। মনে হয় সিঁদুর আঁকা বাংলাদেশের ম্যাপ। ঝাউগাছে কয়েকটি পাখি নীরবতা ভেঙে আচমকা ডেকে ওঠে। চারদিক শান্ত নিঝুম। মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস। হৃদয় জুড়িয়ে যায়। প্রাণে জাগে গান।
মা খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। হাত-মুখ ধোবেন, তারপর রান্না ঘরে। সবার জন্য নাস্তা বানাবেন। বেলুন হাতে নিয়ে পানিতে গোলা আটা নিয়ে ঝুলে ঝুলে পিঠে বানান। মায়ের এই ঝুলোনি অভি'র খুব ভালো লাগে। চোখে রাশি রাশি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে অভি।
![]() |
মনি হায়দারের লেখা মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "আজও কড়া নাড়ে" |
মা হাসেন- কিরে খোকা, অমন করে কী দেখছিস?
অভি কথা বলে না। তাকিয়ে থাকে। বুকের ভেতর কলমিলতার মৃদু কাঁপন জাগে। ভালোলাগার অনুভবে ভরে যায় হৃদয়মাঠ।
অভি আজ মায়ের আগেই বিছানা থেকে উঠেছে। এঁটো মুখে দাঁড়ায় ব্যালকনিতে। সূর্য ওঠা দেখবে। বাবা প্রায়ই ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে এখানে দাঁড়াতেন। তাঁর মুখে থাকতো ব্রাশ। কাঁধে তোয়ালে। চোখে স্বপ্নের পবিত্র এক ভোর খেলতো চিতল মাছের মতো। সূর্য ওঠার দৃশ্য দেখতে দেখতে বাবা ঝলমলিয়ে হেসে উঠতেন। সেই অনন্য সুন্দর হাসিটা অভি'র মনে গেঁথে আছে। ও হাসি মোছা যায় না কখনো।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "ভেলায় ভেসে যায়"
খোকা? অভি দ্যাখে মা এসেছেন।
কী?
তুই এতো সকালে উঠেছিস?
হ্যাঁ মা। অনেক দিন তো সূর্যোদয় দেখা হয় না। বাবা আমাকে দেখাতেন। আজ আমি দেখবো।
মায়ের মুখে ম্লান বেদনার ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ে। চোখে অবারিত শূন্যতা। দৃষ্টিতে বিরান এবং ঝলসানো হিরোশিমা।
খোকা, তোর বাবাকে মনে পড়ে?
খুব মনে পড়ে মা। যেমন তুমি এই এখন আমার সামনে মা হয়ে দাঁড়িয়ে আছো। বাবা- আমার আদরের বাবা তোমার মতো আমাকে সারাক্ষণ জড়িয়ে আছে। আমার রক্তে মাংসে বাবা নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতার গান হয়ে।
বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সবার প্রিয় স্যার। দেশের জন্য ভাবনা সারাক্ষন মাথার মধ্যে নাড়াচাড়া করতো। লিখতেন। ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন। কারাগারে ছিলেন। সেখানে বসে নাটক লিখতেন।
কারগারের বন্ধুদের নিয়ে রাতের আঁধারে হেরিকেনের মৃদু আলোয় অভিনয় করাতেন। প্রমাণ করলেন স্বাধীনতাকে শিকলে বন্দি করে রাখা যায় না।
স্বাধীনতা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। সে বেরিয়ে আসবেই জ্বালামুখে ধ্বংসের লাভা নিয়ে আকাশছোঁয়া গতিতে। পাথর ঘষলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছাড়া আর কিছুই বেরোয় না। সেই বাবা আমার ক্লাস থেকে এসেই ডাকতেন- খোকা-
খোকা-খোকা-!
অভি কাছে এসে দাঁড়ায়- বাবা, আমায় ডাকছো?
হ্যাঁ। বাবা হাসেন- তোমার জন্য কী এনেছি বলতো দেখি।
চকলেট।
উহু। হলো না।
ভাবে অভি। তারপর বলে... তাহলে কী এনেছো ঘোড়ার ডিম?
বই এনেছি।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "আনিস সাহেবের হাসি"
লাফিয়ে ওঠে অভি। বই। কই দেখি?
এইতো।
বাবা রঙ বেরংয়ের ঝকমারি ছবি ও ছড়ার বই বের করে দেন। উজ্জ্বল হাসির ঝলকে ভরে যায় ফ্লাট। বাবা ওর বন্ধু। বাবা ওর আকাশ নদী। সবুজ গাঁ। বাবাকে ছাড়া রাতে ঘুমুতে পারে না। গলা ধরে ঘুমিয়ে আছে অভি।
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। গভীর রাত। আকশে পোড়া চাঁদ। মাটির পৃথিবীতে পাতা হায়েনার ফাঁদ। দূরে করুণ সুরে কাঁদছে কুকুর। ছুটছে গোলা, মরছে মানুষ। জ্বলছে ঘরবাড়ি। পালাচ্ছে মানুষ দলে দলে। হায়েনারা ছুটছে পিছু পিছু। হাসছে বিকট রাক্ষসে মুখে কুৎসিত অবয়বে। রাস্তায় রাস্তায় ভারী ট্যাংক। শোনা যায় শহর কাঁপানো কামানের গর্জন। বিশ্ববিদ্যালয় ষ্টাফ কোয়ার্টারে মানুষের লাশ। রক্তের লাল মিছিল এখানে সেখানে। প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া অবোধ শিশু চিৎকার করে বলছে-আমার স্বাধীনতা কোথায়?
আমার মা কোথায়? আমার দুধ কোথায়?
জবাব দেয় বুলেট- এইতো এখানে।
পাখিরা জানতে চায়- কী চাও তোমরা?
লাশেরা জবাব দেয়- স্বাধীনতা।
বাবা, বাবা- তুমি কোথায়? জড়িয়ে ধরে অভি বাবাকে।
বাবা বলেন- এইতো আমি।
এতো গোলমাল কিসের?
স্বাধীনতার।
রাত শেষে সকাল নামে। থেমে গেছে মানুষের কথা। কুকুর বিড়াল সেই পথে। এ যেন এক মহাশ্মশান। কোনো কালে এই শহরে মানুষ ছিলো বলে মনে হয় না। ওপরে শ্যেন চক্ষু নিয়ে উড়ে বেড়ায় শকুন। রিকশার খোলে নিহত রিকশাওয়ালা। বাদামওয়ালা ডাকে না আজকাল বাদাম-বাদাম বলে। জীবন এখন ফেরি করে ফিরছে পালানোর পথে। অগণিত মানুষ পালাচ্ছে। চোখে মুখে মৃত্যুর ভয়ংকর প্রতিচ্ছবি। নিজভূমে শরণার্থী তারা।
বাবা চলো- আমরাও পালাই।
কোথায়?
যেখানে দানব, গুলি আর রক্ত নেই।
না-খোকা তা হয় না।
কেন হয় না?
স্বাধীনতার জন্য। আমাদের এখানে থাকা প্রয়োজন। এখানে বসে গান লিখবো, কবিতা লিখবো, ভাষন লিখবো, নাটক লিখবো। লেখায় গনগনে আগুন ছড়িয়ে দেবো গণমানুষের মাঝে। দেয়ালে পোষ্টার পড়বে মানুষ। উল্লসিত হবে। পোষ্টারে লেখা থাকবে- দাঁড়াও জল্লাদ।
আরও পড়ুনঃ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (RPO) এবং বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন
কড়া নাড়ে জল্লাদ।
দুপুর। বাবা ক্লাস থেকে এসেছেন। চুলগুলো এলোমোলো। যেন বাবুই পাখির বাসা।
কই ভাত দাও। বাবা মাকে তাড়া দেন। খুব খিদে পেয়েছে। মা তাড়াতাড়ি ভাত বাড়েন। গরম ভাত। ধোঁয়া উঠছে। পালংশাকের তরকারি। বাবা সকালে নিজের হাতে বাজার করেছেন। বাবা ঝোল পছন্দ করেন। মা ঝোলসহ তরকারি দেন পাতে।
অভিকে ডাকেন বাবা-আয় খোকা-
কড়া নাড়ে জল্লাদ।
দরজা খোলে কাকু। বাবার পাতে আরো তরকারি আর ঝোল দেন মা।
জানো খোকার মা-দেশের অবস্থা খুব খারাপ। যেখানে সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা এখন শানানো আক্রমণ চালাচ্ছে। স্বাধীনতা বেশি দূরে নয়। মা হাসেন। বাবা হাসেন। হাসে অভিও।
ভাইয়া। ডাকে কাকু।
কী?
কারা যেনো এসেছে, তোমাকে ডাকছে।
মুখে খাবার দেয়নি বাবা। হাতে লোকমা। পেটে ক্ষুধা। উঠে আসেন।
সামনে দাঁড়ানো তারই ছাত্র। ছাত্রের কাঁধে স্টেগান। মুখ ভাবলেশহীন।
জানালা গলে দৃষ্টি বাইরে যায় বাবার। উঠোনে দাঁড়ানো জলপাই রংয়ের গাড়ি। গাড়িতে বিদেশী সৈন্য। চোখে খুনের নেশা। গাড়িতে রক্তের ছাপ। লাল।
স্যার চলেন।
কোথায়?
থানায়। আবার এক্ষুণি ফিরে আসবেন।
কি যেন ভাবলেন অধ্যাপক গাড়ির দিকে চেয়ে চেয়ে।
চলো। কণ্ঠস্বর তার এতটুকুও কাঁপেনি।
মা জামাটা এগিয়ে দেন। সবাই ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ়।
'চলে যাচ্ছেন বাবা।
কোথায় যাচ্ছে বাবা?
ফিরে দাঁড়ালেন বাবা- হাসলেন সূর্যোদয়ের মতো। কাছে ডাকলেন অভিকে। আদর করলেন এবং গভীর বিশ্বাসে বললেন যাচ্ছি খোকা, তোদের জন্য স্বাধীনতা আনতে।
আরও পড়ুনঃ একজন মুক্তিযোদ্ধা দাদুর গল্প
বাবা জলপাই রংয়ের রক্তমাখা গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি ছাড়লো, গেট পার হলো, রাস্তায় নামছে গাড়ি। ছুটছে অভি- ডাকলো বাবা-বাবা-বাবা
গাড়ি তখন অনেক দূরে। চোখের আড়ালে। বাবা খোকার ডাক শুনতে পেলেন না। সবাই কাঁদছেন। মা দাদী কাকু এবং অভি। বাবা গেছেন স্বাধীনতা আনতে।
অভি আজো অপেক্ষা করছে- বাবা আসবেন। যে কোন সময় আসতে পারেন। দরজা খুলেই খুঁজবে অভিবে। ডাকবেন- খোকা। কই গেলি খোকা?
[শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী স্মরণে]